হাসান নাঈম
সাহিত্যের জগতে যারা রাজা মহারাজা হয়ে থাকবেন, দেবেশ রায় তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর রচনা বর্ণনাত্মক। ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’, ‘মফস্বলী বৃত্তান্ত’, ‘সময় অসময়ের বৃত্তান্ত’ যেন সত্যিকার অর্থেই বৃত্তান্ত।
প্রতিবেদনগুলো কলেবরে ছোট হলেও শৈলী একই। তিনি ছিলেন রুশ সাহিত্যের একনিষ্ঠ পাঠক
এবং সংস্কৃত সাহিত্যের সমঝদার ও একনিষ্ঠ ভক্ত। তাঁর উপন্যাসের বর্ণনা প্রবাহ
অনেকটা তলস্তয়, দস্তয়ভস্কির মতো মনে
হলেও প্রকৃত অর্থে তিনি তা নন, বরং
অনেকটা যেন ‘মঙ্গলকাব্য’ বরং তাও নয়। আমরা মুকুন্দরামের সেই
নগর পত্তন অংশের কথা জানি, কবি সেখানে তিন পৃষ্ঠা
ব্যাপী শুধু ঘাসের নাম বলেছেন। ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্তে’র কথাই ধরুন না কেন—শ্রমিকদের পোষাকের বর্ণনা দিতে গিয়ে
তাদের টি-শার্টের বর্ণনা কতোক্ষণ দিয়েছেন তা মনে থাকার কথা, আর শ্রী দেবীর নাচ নিয়ে তো অধ্যায়ের পর অধ্যায় রচনা
করেছেন—"ম্যাঁ তেরি দুশমন দুশমন তু ম্যারা, ম্যাঁ নাগিন তু সাপেরা!"
কিন্তু ‘মঙ্গলকাব্যে’র অন্তর্গত বৈশিষ্ট্যকে সতীনাথ ভাদুড়ী যে
অর্থে ধারণ করেছিলেন তাঁর ‘ঢোঁড়াই
চরিতমানসে’, দেবেশ রায়কে সেরকম দেখা
যায় না। তবে বোধ করি ‘মঙ্গলকাব্যে’র সাথে তুলনার আরেকটা জায়গা আছে, বিশেষ
করে ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’ যে ছ’টি পর্বে বিভক্ত তার ‘অন্ত্যপর্বকে’ পূর্ববর্তী পর্বগুলোর সাথে তুলনা করলে
প্রায় প্রক্ষিপ্ত মনে হয়, মনে হয় কালকেতু-ফুল্লরার সাথে ধনপতি-খুল্লনার আখ্যান
জুড়ে দেয়া হয়েছে কোনো পারম্পর্য ছাড়াই, মুখ্য উদ্দেশ্য যেন মহিমাটা বর্ণনা
করা।
এখানেও মুখ্য হয়ে ওঠে—তিস্তার পারের জীবনটাকে বর্ণনা করা, বাঘারুর ব্যক্তিগত জীবন নয়। এই চেতনা তাঁর অন্যান্য উপন্যাসেও দেখতে পাই, ব্যক্তিকে সমষ্টির মধ্য দিয়ে দেখা, জীবনের ক্ষুদ্র ঘটনা, তুচ্ছ মুহূর্তগুলোকে সমষ্টির মধ্য দিয়ে মহৎ করে তোলা যেন তাঁর একপ্রকার খেলার বস্তু, কেবল মহৎ শিল্পীদেরই এ খেলায় অধিকার আছে।
এ প্রসঙ্গে ‘বরিশালের
যোগেন মণ্ডল’ তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনা।
এবং এর মহাকব্যিক পরিমণ্ডল, নিম্নবর্গের মানুষের পরিমণ্ডল, এর রাজনীতি নিম্নবর্গের
রাজনীতি, যদিও বাংলা সাহিত্যে এ কারবার পূর্বে অনেকেই করে গিয়েছেন, কিন্তু দেবেশ
রায় স্বতন্ত্র। এই
প্রশ্নও ওঠে, ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্তে’র আদিপর্ব থেকে অন্ত্যপর্ব সমস্তটা মিলে
কি এক মহাকাব্যিক আখ্যান হয়ে ওঠেনি? তবে বলব, উপন্যাসকে মহাকাব্য বলা অবান্তর। আর
যদি তা হয়ও তবে বিংশশতাব্দীর সেই মহাকাব্যের নায়কের নেই ধীরোদাত্ত, ধীরোদ্ধত...
ইত্যাদি গুণ! আর গুণ কী? বাঘারুর কী মন আছে না মগজ আছে? তার শরীরখানাই সার, যে
বোঝেও শরীর দিয়ে, বলেও শরীর দিয়ে। বাঘারু কি সত্যিই নায়ক? উপন্যাসের এমনই বিচিত্র
নিরীক্ষা করেছেন দেবেশ রায়।
মহাকবি কালিদাসের উপর ছিলো দেবেশ রায়ের অগাধ ভক্তি, যা নানা
প্রসঙ্গে তাঁর কাছ থেকে আমরা জানতে পারি। ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম্’ পাঠে তাঁর অভিনবত্ব আমাকে মুগ্ধ করে। এইখানে এসেই তিনি
প্রাচ্যমুখী, প্রাচ্যের পাঠ তাঁর নিবিষ্ট পাঠ। বাংলা উপন্যাসকে তিনি পাশ্চাত্যের
ছাঁচে ফেলতে চাননি কখনো, এবং তাঁর বিশ্বাস তা হয় না, একটা জাতির মনন এবং চিন্তাকে
আরেকটা ভাষায় হয়তো বর্ণনা করা যায়, কিন্তু তার অন্তর্গত বস্তুকে ধারণ করা যায় না।
তাই তিনি তলস্তয় পড়েও মুখ ফিরিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের দিকে; শেক্সপিয়র পড়েও মুখ
ফিরিয়েছেন কালিদাসের দিকে।
শিল্প-জগতের সমস্ত তত্ত্ব ও ধারণাকে হয়তো তিনি আত্মস্থ করতে পারেননি, হয়তো এক জীবনে তা কেউই পারেন না, কিন্তু যতোটুকু আত্মস্থ করেছিলেন তা বিশাল, আর সে বিশালকে নিয়ে তিনি হাজির হয়েছেন এই ভারতের পুরাণ ও ইতিহাসের আঙিনায়; মার-বেতালের পুরাণ আর তিস্তাপুরাণই শুধু নয়, তাঁর সমস্ত রচনাকে বেষ্টন করে আছে সেই চেতনা।
তত্ত্বের কথায় মনে হলো, তিনি কি ন্যাচারালিজমকে স্থান
দিয়েছিলেন তাঁর রচনায়? নাকি তাঁর রচনার বিষয়বস্তু দাবি করে এমন ভাষা-ভঙ্গি!
উপন্যাসের ভাষা-শৈলীতে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বরাবরই আলোচ্য। বিভূতিভূষণ
বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘আরণ্যক’ কিংবা ‘ইছামতী’ উপন্যাসে যে ভাষা ব্যবহার করেছেন তাতে
অরণ্য এবং নদীর কথা আছে, কাব্যিক ভঙ্গিতে যা সমাদৃত, এবং বলাই বাহুল্য ‘আরণ্যক’ বর্ণনাত্মক, ‘ইছামতী’ সংলাপ নির্ভর; দেবেশ রায় তাঁর উপন্যাসে
উভয়-পদ্ধতিকে একসাথে স্থান দিয়েছেন। বিভূতিভূষণ দ্বারা তিনি অনুপ্রাণিত ছিলেন কিনা
আমার জানা নেই, কিন্তু কোথাও একটা ঐক্য দেখা যায় এই দুই লেখকের মধ্যে। রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর ‘চোখের বালি’র ভূমিকা লিখতে গিয়ে নবযুগের সাহিত্যের
বৈশিষ্ট্য বলেছিলেন। বলেছিলেন ঘটনা পরম্পরা বর্ণনা নয়, আঁতের কথা টেনে বের করাই
নবযুগের সাহিত্যের কাজ; সেই নবযুগ এসেছিলো সত্য, দেবেশ রায় সেই যুগেরও আরও
উত্তরকালের মানুষ এও সত্য। হয়তো তাই—
রবীন্দ্রনাথকে অবশ্যপাঠ্য এবং গুরু মেনেও সেই নবযুগের পথের মোড় ঘুরিয়ে তিনি হাঁটতে চেয়েছেন তাঁর নিজের পথে। সে পথে হেঁটেছেন অনেকদূর। কতোটুকু সফল হয়েছেন জানি না, সেই বিচার করার ক্ষমতা আমার নাই, কিংবা অন্য কারও নাই, সে কেবল মহাকাল তার নিঃশব্দ এবং নির্মোহ ভঙ্গিতে জানিয়ে দেবে বাংলা উপন্যাসের উত্তরকালের পথিকদের।
“ক্রান্তি হাটের হাটখোলায় সন্ধ্যা নেমে
গেলো” —এই ছিলো তাঁর অমর কীর্তি তিস্তাপারের বৃত্তান্তের
প্রথম বাক্য, তাঁর মৃত্যুর খবর শুনেও তাই মনে হয়েছিলো, যেন বাংলা উপন্যাসের জগতের
একটা আস্ত অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটলো। তিনি তাঁর কীর্তির মধ্যে বেঁচে থাকবেন।
কিন্তু তবু রবীন্দ্রনাথের ভাষায়ই বলি, “তোমার কীর্তির চেয়ে তুমি যে
মহৎ!”
লেখক : শিক্ষার্থী, বাংলা
বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন