সুব্রত কুমার দাস
১৯১৪ সালে প্রকাশিত ‘আনোয়ারা’ দিয়ে বর্তমান বাংলাদেশ অঞ্চলে উপন্যাসের যে যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯২০-এর দশক থেকে সেটি বিস্তৃত হতে শুরু করে। ১৯৪৭-এর দেশভাগের পর সে-বিস্তার অধিক শক্তিতে প্রকাশিত হওয়া শুরু হয়। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের পর আমাদের উপন্যাসে অনেক শক্তিশালী ও সফল উদ্যোগ লক্ষিত হয়েছে সন্দেহ নেই। নতুন শতাব্দীতে সে যাত্রায় যুক্ত হয়েছে অনেক অভিনব ও নিরীক্ষামূলক উপন্যাস। তবে বাংলাদেশের সাহিত্যে সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত অনেকক’টি উপন্যাসই ভবিষ্যতে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো টিকে থাকবে, এমনটিই মনে করেন সাহিত্য সমালোচকেরা।
আলোচনার গভীরে যাওয়ার আগে নিকট অতীতে যে ক’জন ঔপন্যাসিক আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন তাঁদের কথা স্মরণ করা প্রয়োজন। একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে আমাদের উপন্যাস জগতে প্রথম যে নক্ষত্রের পতন হয় তিনি আহমদ ছফা (১৯৩৪-২০০১)। এরপর কথাসাহিত্য জগতের মহিরুহ আবু ইসহাক (১৯২৬-২০০৩), মাহমুদুল হক (১৯৪০-২০০৮), আলাউদ্দিন আল আজাদ (১৯৩২-২০০৯), আবু রুশদ্ (১৯১৯-২০১০), রাজিয়া খান (১৯৩৬-২০১১) ও রশীদ করিম (১৯২৫-২০১১) প্রমুখ আমাদের ছেড়ে চিরবিদায় নেন। এদের সকলেই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভালো উপন্যাস লিখে বাংলা সাহিত্যে তাঁদের আসন স্থায়ী করে গেছেন।
আহমদ ছফার অকাল মৃত্যু যেমন বাংলাভাষী পাঠককে শোকাহত করেছিল তেমনি হুমায়ুন আজাদের (১৯৪৭-২০০৪) উপর উগ্রবাদীদের নৃশংস্য আক্রমণ পাঠককে নির্বাক করে ফেলে। হুমায়ুন আজাদ রচিত বিপুল আলোড়ন সৃষ্টিকারী পাক সার জমিন সাদ বাদ প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। ২০০১ সালে নির্বাচনে চারদলীয় জোটের বিজয়ের পর বাংলাদেশে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর উপর যে বর্বরোচিত অত্যাচার নেমে আসে তার চিত্রণ উগ্রবাদী মৌলবাদী গোষ্ঠীকে স্থির থাকতে দেয় নি। উপন্যাসটিতে হুমায়ুন যে সাহস ও শক্তির পরিচয় দেখিয়েছিলেন সেটি বাংলাভাষী পাঠকের দীর্ঘকাল স্মরণে থাকবে।
সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের উপন্যাস জগতে কয়েক জন লেখকের আবির্ভাব ঘটেছে যাঁরা পূর্বে উপন্যাসে কখনো হাত দেননি অথবা দিলেও সেটি বিশেষ মনোযোগ কাড়েনি। এদের মধ্যে সর্বাগ্রে উল্লেখ করা যায় হাসান আজিজুল হকের (জ. ১৯৩৯) কথা। বাংলা ছোটগল্প জগতের এই যুবরাজের প্রথম উপন্যাস প্রয়াস ছিল ১৯৯১ সালের ‘বৃত্তায়ণ’। সে উপন্যাস খুব বেশি আলোড়ন না তুললেও ২০০৬ সালে প্রকাশিত ‘আগুনপাখি’ লেখককে এনে দিয়েছে বিপুল সম্মান। দেশভাগের যন্ত্রণাক্লিষ্ট বাঙালির চোখের জলের সে রূপায়ন নতুন শতাব্দীর বিপুল সংখ্যক পাঠককে আলোড়িত করেছে। কবি ও প্রাবন্ধিক সাযযাদ কাদির (জ. ১৯৪৭) দীর্ঘদিন ধরে নিরলসভাবে সাহিত্যচর্চা করলেও ২০০৮ সালে প্রথম আসে তাঁর উপন্যাস ‘অন্তর্জাল’। ২০১১ সালে প্রকাশিত খেই পূর্ববর্তী উপন্যাসের মতোই ক্ষুদ্র কলেবরে বিপুল তথ্যভাণ্ডারকে আত্মীকৃত করেছে। আর এভাবেই সাযযাদ কাদির বাংলা উপন্যাসে নতুন একটি ধারার সূচনা করেছেন বলা যেতে পারে। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম (জ. ১৯৫১) যে দুটি উপন্যাস এখন পর্যন্ত প্রকাশ করেছেন সেগুলো হলো ‘আধখানা মানুষ’ (২০০৬) এবং ‘তিন পর্বের জীবন’ (২০০৮)। তবে উপন্যাস রচনা করে রীতিমতো হৈ চৈ ফেলে দিয়েছেন
যিনি তাঁর নাম হরিশংকর জলদাস (জ. ১৯৫৫)। অদ্বৈত মল্লবর্মণের (১৯১৪-১৯৫১) উত্তরসূরি হিসেবে চিহ্নিত হরিশংকরের প্রথম উপন্যাস ‘জলপুত্র’ প্রকাশিত হয় ২০০৮ সালে। নিুবর্গীয় জেলে সমাজের মানুষকে নায়ক করে রচিত তাঁর উপন্যাসের দ্বিতীয় প্রয়াস দহনকাল-এ (২০১০)। নিষিদ্ধ পল্লীর জীবন নিয়ে রচিত ‘কসবি’ (২০১১) হরিশংকরের একটি অন্যতম শিল্পোত্তীর্ণ উপন্যাস। বর্তমান বছরের বইমেলায় প্রকাশিত তাঁর রামগোলাম বাংলা ভাষার অন্যতম এক সৃজন বলে স্বীকৃত হতে বাধ্য। হরিজন সম্প্রদায়ের মানুষের জীবন নিয়ে রচিত তাঁর এ উপন্যাসে যেমন রয়েছে তাদের বঞ্চনার ইতিহাস, তেমনি আছে প্রত্যাশা ও দ্রোহের আলোক শিখা।
প্রবাসী লেখিকা সালেহা চৌধুরী (জ. ১৯৪৩) দীর্ঘদিন ধরে উপন্যাস, ছোটগল্প এবং প্রবন্ধে সমান তালে অবদান রেখে চলেছেন। ‘বিন্নি ধানের খই’, ‘ময়ূরীর মুখ’, ‘অনিকেত মানব’, ‘রুপন্তীর সুখ-দুঃখ’, ‘অমৃতাকে ঘিরে’, ‘মুহূর্ত’ প্রভৃতি উপন্যাসের লেখিকা সালেহা চৌধুরী রচিত ‘ব্রিটেন একটি দ্বীপ’ লন্ডনের বাংলাদেশি মানুষদের জীবনচিত্র। ২০০৯ সালে প্রকাশিত সে উপন্যাসটিতে প্রবাসী-বাঙালি জীবনের সুখপাঠ্য এবং অনুপুঙ্খ চিত্রণ পাওয়া সম্ভব। লন্ডন প্রবাসী আরেক বাংলাদেশি কথাকার কামাল রাহমান (জ. ১৯৫৫) রচিত প্রথম উপন্যাস ‘তাজতন্দুরী’ বাঙালিদের বৃটেন অভিবাসনের এক মনোরম ডকুফিকশান। এ বছরে প্রকাশিত তাঁর উপন্যাস ‘ঝুমপাহার’ গবেষণাভিক্তিক একটি রচনা। পাবর্ত্য অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রাকে গভীর মনোযোগ ও নিপুণনতায় কামাল উপস্থাপন করেছেন তাঁর এ উপন্যাসে। আরেক প্রবাসী লেখক সেজান মাহমুদ (জ. ১৯৬৭) ২০০৯ সালে ‘অগ্নিবালক’ রচনা করে রীতিমতো আলোড়ন সৃষ্টি করে ফেলেছেন। এ বছরের বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে তাঁর ‘লীথি’।
আমাদের সাহিত্য জগতকে বটবৃক্ষের ছায়া দিয়ে সজীব রেখে চলেছেন সৈয়দ শামসুল হক (জ. ১৯৩৫)। যে-প্রবীণেরা দীর্ঘদিন ধরে ব্যাপক আয়োজনে সমৃদ্ধির যোগান দিয়েছেন তাঁদের মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে বিশেষভাবে সক্রিয় দেখা গেছে হাসনাত আবদুল হাইকে (জ. ১৯৩৯)। নন্দিত এ কথাশিল্পী বিশেষভাবে আদৃত হয়েছেন তাঁর জীবনীমূলক উপন্যাসগুলির কারণে। ১৯৮২ সালে ‘মহাপুরুষ’ নামে উপন্যাসটি এ ধারায় ছিল তাঁর প্রথম প্রয়াস। কাল্পনিক একটি চরিত্রকে ভিত্তি করে রচিত সে উপন্যাসটির ধারা পরবর্তীকালে বাস্তব চরিত্রকে আশ্রয় করে রচিত হতে শুরু করে। আর তারই ধারাবাহিকতায় তাঁর ‘সুলতান’ (১৯৯১), ‘একজন আরজ আল ‘(১৯৯৫)এবং ‘নভেরা’র (১৯৯৫)প্রকাশ। এ বছরের বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশের খ্যাতিমান শিল্পী কামরুল হাসানের জীবনভিত্তিক তাঁর উপন্যাস ‘লড়াকু পটুয়া’। সক্রিয় অন্য যে কথাশিল্পীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখের দাবীদার তিনি বিপ্রদাস বড়ুয়া (জ. ১৯৪০)। ছোটগল্প ও ভ্রমণকাহিনির সাথে সাথে উপন্যাসেও তাঁর কৃতি বিশেষভাবে মূল্যায়নের যোগ্য। ১৯১১ সালে বাংলাদেশ ও জাপানের প্রেক্ষাপটে রচিত তাঁর উপন্যাস ‘কালোনদী’ প্রকাশিত হয়। এছাড়া তাঁর ‘অশ্রু ও আগুনের নদী’ বিশেষভাবে উল্লেখের দাবীদার। ২০০১ সালের নির্বাচনোত্তর অমানবিক জীবনচিত্র নিয়ে তিনি এ উপন্যাসটি রচনা করেন। অনুরূপ বিষয়কে আশ্রয় করে অন্য আরো যে উপন্যাস রচিত হয়েছে তাদের মধ্যে মহসীন হাবিব (জ. ১৯৬৫)-এর ‘কুকুরের কান্না শোনা যায়’(২০০২) এবং সালাম আজাদ (জ. ১৯৬৪)-এর ‘ভাঙা মঠ’ (২০০৪) বিশেষ মনোযোগ দাবী করে।
উর্দু কবি মির্জা গালিব (জ.১৭৯৭-১৮৬৯)-এর জীবনভিত্তিক উপন্যাস সেলিনা হোসেন (জ. ১৯৪৫) রচিত ‘যমুনা নদীর মুশায়েরা’ প্রকাশিত হয় ২০১১ সালে। জনপ্রিয় উপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদ (জ. ১৯৪৮) এর বেশ কয়েকটি বিপুল কলেবরের উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে সাম্প্রতিক দশকে। ২০০৪ সালে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক তাঁর উপন্যাস ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ প্রকাশিত হয়। ২০০৫-এ ‘লীলাবতী’ প্রকাশের পর ২০০৮-এ প্রকাশিত ‘মধ্যাহ্ন’-কে লেখকের একটি গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যকর্ম হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। ২০১১ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর বাদশা নামদার। অন্য আরেক যে জনপ্রিয় কথাশিল্পী মর্যাদাবান এক উপন্যাস রচনা করেছেন সেটি হলো ‘নুরজাহান’। ইমদাদুল হক মিলন (জ. ১৯৫৫) রচিত সে উপন্যাসটির প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয় ১৯৯৫ সালে। মৌলবাদী চিন্তার বিরুদ্ধে স্থিত এ উপন্যাসের দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশিত হয়েছিল ২০০২ সালে। আর গত বছর সে উপন্যাসের সর্বশেষ খণ্ডের প্রকাশ বাংলাভাষী পাঠকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এক প্রাপ্তি। ইতোমধ্যে ২০০৯ সালে প্রকাশিত ‘জীবনপুর’ মিলনের আরেকটি অভিনব প্রয়াস। যেখানে লেখক দুর্দশাগ্রস্ত এক বাঙালি মুক্তিযোদ্ধার পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে পালিয়ে যাওয়ার কাহিনি বিবৃত করেছেন। ‘সে’ (২০০২), ‘মা’ (২০০৩) প্রভৃতি উপন্যাসের রচয়িতা আনিসুল হক (জ. ১৯৬৫)২০১১ সালের বাংলা একাডেমী পুরস্কার পেয়েছেন তাঁর উপন্যাসের জন্য। এ বছরের বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে তাঁর ‘যারা ভোর এনেছিল’। জনপ্রিয় ধারার আরেক পরিচিত মুখ চঞ্চল শাহরিয়ার (জ. ১৯৬৬)। এ পর্যন্ত প্রকাশিত তাঁর উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে ‘দিন যায় টানাপোড়েনের দিন’ (১৯৯৮), ‘এইসব ভালোবাসা মিছে নয়’ (২০০০), ‘মেয়ে তুমি কি দুঃখ বোঝো’ (২০১২)।
১৯৯৭ সালে আকিমুন রহমান (জ. ১৯৫৯) তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘পুরুষের পৃথিবীতে এক মেয়ে’ প্রকাশ করেন। বাঙালি নারীর একান্ত ব্যক্তিগত জীবনভিত্তিক সে উপন্যাসের ভাবনা নিয়ে আকিমুনের পরবর্তী গ্রন্থ ‘রক্তপুঁজে গেঁথে যাওয়া মাছি’ প্রকাশিত হয় ১৯৯৯ সালে। আর ২০০৪ সালে প্রকাশিত হয়েছিল ‘জীবনের রৌদ্রে উড়েছিল কয়েকটি ধূলিকণা’। জাদুবাস্তবতার অন্যতম প্রধান বাঙালি কারিগর নাসরীন জাহান (জ. ১৯৬৪) ১৯৯০ এর দশক থেকেই ব্যাপকভাবে আলোচিত। নতুন শতাব্দীতে তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে ‘শঙ্খনর্তকী’ (২০০৩), ‘মৃত্যুসখীগণ’ (২০০৯) এবং ‘কবচকুণ্ডলা’ (২০১২)। ২০০৫ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘সামান্তা’ বর্তমান নাগরিক সমাজে অবক্ষয়িত তরুণদের চিত্র।
গত ১২ বছরে বাংলাদেশের উপন্যাসে অনেক মেধাবী ও পরিশ্রমী উপন্যাসিকের আগমণ ঘটেছে। নতুন সে আগতদের মধ্যে সর্বাগ্রে যার নাম উল্লেখ করতে হয় তিনি আহমাদ মোস্তফা কামাল (জ. ১৯৬৯)। ২০০২ সালে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর আত্মজৈবনিক ‘আগন্তুক’। ২০০৯ সালে প্রকাশিত ‘অন্ধ জাদুকর’-এর জন্য তিনি বিশেষভাবে পুরস্কৃত হন। আর এ বছরের বইমেলায় প্রকাশিত তাঁর ‘কান্নাপর্ব’ বাংলা উপন্যাসের জগতে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রয়াস। এ বছর প্রকাশিত তাঁর অন্য আরও যে একটি উপন্যাস সেটি হলো ‘পরম্পরা’। অন্য যে কথাকার তরুণদের কাছে রীতিমতো ঝড় তুলেছেন তিনি হলেন জাকির তালুকদার (জ. ১৯৬৫)। ২০০২ সালে প্রকাশিত ‘কুরসিনামা’ থেকেই জাকিরের মেধাবী অগ্রসরণ। এরপর ২০০৮ সালে তাঁর বহিরাগত এবং ২০০৯ সালে ‘মুসলমান মঙ্গল’ প্রকাশিত হয়। কৈবর্ত বিদ্রোহের ঐশ্বর্য নিয়ে রচিত তাঁর উপন্যাস ‘পিতৃগণ’ (২০১১) বিপুল পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। আর এ বছরে প্রকাশিত ‘কবি ও কামিনী’ একটি নন্দিত সৃজন। প্রাক-ইসলামী যুগের আরবীয় কবি ইমরুল কায়েসের জীবন ও পরিপার্শ্ব নিয়ে রচিত কবি ও কামিনী লেখকের কল্পনা শক্তি এবং পাঠ-গভীরতাকে নির্ণিত করে। তরুণ ঔপন্যাসিকদের মধ্যে পাপড়ি রহমান (জ. ১৯৬৪) তাঁর ‘পোড়া নদীর স্বপ্নপুরাণ’ (২০০৪), ‘বয়ন’ (২০০৮), ‘পালাটিয়া’ (২০১১) সবক’টিতেই বিশেষ প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। প্রথম উপন্যাস জীবনের ভগ্নাংশ থেকেই মাসুদা ভাট্টি (জ. ১৯৭৩) নন্দিত। ‘পরিযায়ী মন’ (২০০৩), ‘নদী এখনো নীল’ (২০০৫), ‘বট পাকুড়ের উপাখ্যান’ (২০১১) তাঁর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রচনা। ২০০৭ সালে প্রকাশিত ‘তরবারির ছায়াতলে’ উপন্যাসটিতে তিনি বাংলাদেশের ইসলামপন্থী মৌলবাদীদের উত্থানের চিত্র উপস্থাপন করে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন।
মাহমুদ নাসির জাহাঙ্গীরি (জ. ১৯৫৯), সাদ কামালী (জ. ১৯৬২), ইমতিয়ার শামীম (জ. ১৯৬৫), হামিদ কায়সার (জ. ১৯৬৬), শাহনাজ মুন্নী (জ. ১৯৬৯), হামীম কামরুল হক (জ. ১৯৭৩) আমাদের উপন্যাস ক্ষেত্রে আরো কয়েকটি উজ্জ্বল মুখ। ২০০২ সালে জাহাঙ্গীরির ‘কাহাত কহর সাল’ নামের শক্তিশালী উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়। সাদ কামালীর উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলোর মধ্যে ‘রাষ্ট্রের সংক্রাম’, ‘লীলাবতী’, ‘কমরেড বকুলের মৃত্যুসাধনা’র কথা বিশেষভাবে বলা যায়। ১৯৯৬ সালে ইমতিয়ার তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘ডানা কাটা হিমের ভিতর’ প্রকাশ করেন। ২০০২ সালে তাঁর আত্মজৈবনিক উপাদানে ভরপুর উপন্যাস ‘আমরা হেঁটেছি যাঁরা’ কিশোরের দৃষ্টিতে মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের হতাশাব্যঞ্জক চিত্র। শুধুমাত্র গল্পকে আশ্রয় না করে অভিনব এক বর্ণনাকে সঙ্গী করে এগিয়ে চলে ইমতিয়ারের উপন্যাস। তাঁর ‘অন্ধমেয়েটি জ্যোৎস্না দেখার পর’, ‘চরসংবেদ’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। এ বছরের বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে ইমতিয়ারের ‘মৃত্যুগন্ধি বিকেলে সুশীল সঙ্গীতানুষ্ঠান’ যেটিতে ইমতিয়ারের অভিনব বিবরণ ক্ষমতার পরিচয় পাওয়া সম্ভব। বিপুল সম্ভাবনাময় হামিদ কায়সার ভ্রমণোপন্যাস রচনায় বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। ২০০৮ সালে প্রকাশিত ‘মহানন্দার তীরে’ এবং বর্তমান বছরে ‘বুকের ভিতরে এক বন আছে’ হামিদের গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ। ভ্রমণ সাহিত্যকে উপন্যাস কাঠামোয় ফেলে সত্যিকারের উপন্যাসের উত্তীর্ণ করার শক্তি ও সাহস যেমনটি হামিদ দেখিয়েছেন তা বোধ করি বাংলা ভাষায় খানিকটা দুর্লভ। হামিম কামরুল হকের যে দুটি উপন্যাস এখন পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে সেগুলো হলো ‘রাত্রি এখনো যৌবনে’ (২০০৮) এবং ‘গোপনীয়তার মালিকানা’ (২০১০)। শাহনাজ মুন্নীর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস ‘২২ আঙুলের জীবন’ । বর্ণনা ভঙ্গির অভিনবত্বের জন্য মামুন হুসাইন (জ. ১৯৬২) বিশেষভাবে দৃষ্টি কেড়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে ছোটগল্প রচনায় নিবিষ্ট মামুনের প্রথম উপন্যাস ‘নিক্রপলিস’ প্রকাশিত হয় ২০১১ সালে। তরুণ সাহিত্যিক পরিমণ্ডলে ব্যাপকভাবে আদৃত মামুনের ‘হাসপাতাল বঙ্গানুবাদ’ (২০১২) অভিনব রচনা। প্লটের অস্পষ্টতা, কাহিনির হ্রস্বতা এবং বর্ণনার অভিনবত্ব মামুনের সাহিত্যকে নতুন ধারার পাঠকের কাছে বিশেষ জনপ্রিয় করে তুলেছে। প্রথম উপন্যাস ‘পালাবার পথ নেই’ বিশেষ মনোযোগ দাবী না করলেও শাহীন আখতারের (জ. ১৯৬২) মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘তালাশ’ বিশেষ পরিচিতি পেয়েছে। ২০১০ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘সখি রঙ্গমালা’ আরেকটি উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি। ১৯৯৯ সালে মশিউল আলম (জ. ১৯৬৬) ‘আমি শুধু মেয়েটিকে বাঁচাতে চেয়েছি’ লিখে পাঠকের দৃষ্টিতে চলে আসেন। পরবর্তীতে প্রকাশিত তাঁর অন্য উপন্যাসগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘তনুশ্রীর সঙ্গে দ্বিতীয় রাত’ (২০০০), ‘ঘোড়া মাসুদ’ (২০০৪), ‘দুই নম্বর হাসপাতাল’ (২০১১) প্রভৃতি। বরেণ্য দার্শনিক সরদার ফজলুল করিমের জীবনভিত্তিক উপন্যাস ‘বাবা’ তাঁর একটি মূল্যবান প্রয়াস। একমাত্র উপন্যাস ‘মায়াপীর’ (২০০৯) লিখে মুজিব ইরম বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে উল্লেখযোগ্য হয়ে উঠেছেন। অদ্ভুত ভাষাশৈলীর সে-উপন্যাসে মুজিব নতুন এক ধারা নির্মাণেরই প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। ক্ষুদ্রাকায় ‘মৃত্যুর আগে মাটি’ (২০০২) প্রশান্ত মৃধাকে (জ. ১৯৭১) অনেক প্রশস্তি দিয়েছে সন্দেহ নেই। বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দুদের ভারত চলে যাওয়াকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট বেদনাবিধুর এক কাহিনি তিনি এ উপন্যাসে উপস্থাপন করেছেন। এ বছরে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর ‘রূপকুমার ও হরবলা সুন্দরীর অসমাপ্ত উপাখ্যান’। ২০০৮ সালে প্রকাশিত হয়েছিল শেখ আলমামুন (জ. ১৯৭৩) রচিত উপন্যাস ‘নুহুলের মনচিত্র’। দার্শনিক এমন রচনা বাংলাদেশের উপন্যাসে হাতে গোনা। ২০০২ সালে ‘মরা কটালের জোছস্না’-র পর সমীর আহমেদ (জ. ১৯৭৩) আর কোন উপন্যাস লেখেন নি। বর্তমান বছরে প্রকাশিত হয়েছে কবি রেজা ঘটক (জ. ১৯৭০)-এর উপন্যাস ‘মা’। স্বকৃত নোমান (জ. ১৯৮০) বর্তমান বাংলাদেশের এক গুরুত্বপূর্ণ ঔপন্যাসিক। তাঁর প্রধান গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘নাভি’ (২০০৮), ‘ধুপকুশী’ (২০০৯), ‘জলেশ্বর’ (২০১০), ‘রাজনটী’ (২০১১) এবং ‘বেগানা’ (২০১২)।
সন্দেহ নেই বাংলাদেশের উপন্যাসে আরও অনেক মেধাবী ও সৃষ্টিক্ষম লেখক রয়েছেন। তাঁদের কারো কারো রচনার শিল্প মান সুউচ্চ। যদিও পরিচিতি প্রাপ্তিতে হয়তো তাঁরা অনেকটাই পিছিয়ে। উদাহরণ হিসেবে ওয়াসি আহমেদের নাম করা যেতে পারে। ‘মেঘপাহাড়’ বা ‘রৌদ্র ও ছায়ার নকশা’ বা ‘শীতপাখিরা’ সে লেখকের ঔপন্যাসিক সৃজন। ২০০০ সালে প্রকাশিত সেলিম মোজাহারের ‘জোছনার আঙ্গুলে ত্রিতাল’ নামের একমাত্র উপন্যাস প্রয়াশটির কথাও এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে। এখানে উল্লেখ পায়নি এমন মেধাবী কথাকারও থেকে যাওয়া অসম্ভব নয়।
দশকজুড়ে বাংলাদেশে মিডিয়ার দাপট। সে-দাপটের বহুমুখী ব্যবহারে অনেক সাহিত্যিকও পারঙ্গম হয়ে উঠেছেন। কিন্তু আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয়, মিডিযার যুগেও সত্যিকার উপন্যাস চিনতে হয়তো পাঠকের সামান্য দেরি হতে পারে কখনো কখনো, কিন্তু যথার্থটি চিনতে পাঠক কখনোই ভুল করেন না। আর সে কারণেই সময়ের অগ্রসরণের সাথে সাথে পাঠক নির্ধারণ করে ফেলেন কোনটি আস্তাকুঁড়ে যাবে, আর কোনটির স্থান হবে পাঠকের টেবিলে। আর তাই আমরা আশাবাদী সত্যিকারের মেধাবী কথাশিল্পীরা তাঁদের কলমকে সুউন্নত রাখবেন শিল্পের দাবীতেই, মিডিয়ার প্রয়োজনের কাছে হার মানবেন না।
ঔপন্যাসিকদের বিশাল একটি দল ক্রমাগত ঋদ্ধ করে চলেছেন আমাদের কথাসাহিত্যকে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ এবং আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের হাত ধরে সামগ্রিক বাংলা ভাষার উপন্যাসে বাংলাদেশের উপন্যাসের অগ্রযাত্রা। সে-যাত্রায় পরীক্ষিত ধ্বজাধারী যেমন আছেন, তেমন শক্তিমান নতুন অভিযাত্রীও যুক্ত হয়েছেন সময়ের সাথে সাথে। আর এ ধারাবাহিকতাতে বাংলাদেশের উপন্যাস নিশ্চয়ই শিঘ্রই আন্তর্জাতিক মানকে স্পর্শ করতে সক্ষম হবে, এমনটিই সকলের প্রত্যাশা।
রচনাকাল: ২০১২
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন