সোমবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

ভাষারীতি : মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

হাসান আজিজুল হক

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষা ব্যবহার থেকে যে প্রশ্নটি খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দিতে পারে তা এই; ভাষার সঙ্গে বাস্তবের সম্পর্ক কী? ভাষা কি বাস্তবকে প্রকাশ করে? ভাষা কি বাস্তবকে প্রকাশ করতে পারে? বাস্তবকে অবিকৃত প্রকাশ করাটাই যদি লেখকের একমাত্র উদ্দেশ্য হয় এবং ভাষার সর্বোচ্চ ব্যবহার যদি তাঁর আয়ত্তের মধ্যেও থাকে, তবু কি তিনি ভাষা দিয়ে বাস্তবের পুননির্মাণ সম্ভব করতে পারেন? এই প্রশ্নগুলি থেকে আর একটি প্রশ্ন সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে থাকবে মাত্র : বাস্তব বলতে কি বুঝতে হবে? বাস্তবের কি একটিমাত্র অনড় চেহারা পাওয়া যায় যা সহজেই ভাষা দিয়ে তৈরি করা সম্ভব হতে পারে?
বাস্তবটা অবিকল একরকম। ঘরের মধ্যে আলমারিটা অবিকল এরকম-প্রাকৃতিক কারণে তার ভিতরের গতি ও পরিবর্তনের কথাটা ছেড়ে দিয়েও বলা যায় ঘরের আলমারি অবিকল একরকম-কিন্তু প্রশ্ন তা নয়, দশজন লেখক যখন এই অনড় অবিকল বাস্তব আলমারিটা দেখেন, স্পর্শ করেন, তখন এই দশজনে আলমারির অবিকল একই বর্ণনা দেন না কেন? দিতে কি পারেন তাঁরা? ইচ্ছে করলেও? তবে ভাষার সঙ্গে বাস্তবের সম্পর্ক কী?


মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষারীতির আলোচনার শুরুতেই এতগুলি প্রশ্ন তোলার কারণ হচ্ছে একটা ব্যাখ্যা-সাপেক্ষ মত প্রায় কুসংস্কারে দাঁড়িয়ে গেছে যে তিনি একজন বাস্তববাদী লেখক। বাস্তববাদ জিনিসটা কী বোঝার আগে বাংলাসাহিত্যে অনেক অবাস্তববাদী লেখক আছেন এটা মেনে নেওয়া কঠিন। একটা হিসেবে বলা যায় যে সব লেখকই বাস্তববাদী। বস্তুকে সামান্যমাত্র অবলম্বন করে যে কল্পনার জন্ম মনের মধ্যে ঘটে, সে কল্পনাতেও বাস্তব না বলার কোনো কারণ নেই যদি লেখকের মনটাকেও আমরা বাস্তব বলতে রাজি থাকি। কাজেই বোঝা যাচ্ছে আমরা বাস্তবের রকমফের করি এবং একজন লেখককে বাস্তববাদী আর একজনকে কল্পনাবাদী বা ভাববাদী পট্টি সেঁটে দেবার সময় এই রকমফেরটা নিজের বা অন্যের কাছে ব্যাখ্যা না করলেও একরকম করে ঝালিয়ে নিই। আসলে প্রশ্নটা শেষ পর্যন্ত দাঁড়ায় শিল্পী যে মাধ্যমে বা বাহন ব্যবহার করে কাজ করেন তার সঙ্গে বাস্তবে সম্পর্ক কেমন দাঁড়ায় অর্থাৎ চিত্রকরের রেখা আর রঙের সঙ্গে বাস্তবের সম্পর্ক কি, লেখকের ভাষার সঙ্গে বাস্তবের সম্পর্ক কী? সব শিল্পী বাস্তবকেই প্রকাশ করতে চান, আরো জাজ্বল্যমান করে, আরো তীব্র করে, হয়তো বা আরো বাস্তব করে। বাস্তবের পক্ষে আরো বাস্তব হওয়া সম্ভব নয়-সে যা আছে তাই, বেশিও নয় কমও নয়, শিল্পীই একমাত্র চেষ্টা করতে পারেন তাকে আরও বাস্তব করে তুলতে-বলতে কি সাধারণভাবে যা অসম্ভব বলে ধর্তব্যের মধ্যে আসে না তাকেও বাস্তব করে তোলার দুরূহ চেষ্টা একমাত্র শিল্পী ছাড়া এর কেউই করেন না।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষারীতির দিকে একটু মন দিলে ঠিক এই ধারণাটিই তৈরি হয় যে ভাষা তিনি ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন বাস্তবকে শান দেবার পাথর হিসেবে যাতে বাস্তব পাতলা হয়, সূক্ষ্ম হয়, আগুনের মতো উজ্জ্বল তৃপ্ত হয় আর তাতে দেখা দেয় ক্ষুরের ধার। উপমাটা একেবারেই ঠিক হলো না, ভাষা পাতলাও নয়, সূক্ষ্মও নয়, আগুন বা আগুনের রঙের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই, ভাষা নিজে নিজে গরম বা ঠাণ্ডা কিছুই নয়। ভাষাকে যে শান দেবার পাথর বলা গেল সেটাও বোধহয় ঠিক নয়। বাস্তব একটা আলাদা ব্যাপার, তাকে ভাষার পাত্রেই স্ফুলিঙ্গ বের করা যায় হয়তো কিন্তু ভাষা তো পাত্রও বটে, লেখক বাস্তবকে ভাষার পাত্রেই ধরবার চেষ্টা করেন। তখন আর বাস্তবকে ভাষা থেকে কোনোরকমেই আলাদা করা যায় না। তাহলে মনে হয় কথাটা এইভাবে বলা যায় যে বাস্তবের অন্তর্নিহিত অসংখ্য দ্বন্দ্বের অস্তিত্ব মেনে নেওয়া, সেইসব দ্বন্দ্বকে দ্বন্দ্ব হিসেবে শনাক্ত করা, সত্যে আপেক্ষিকতাকেই দিগদর্শন জ্ঞান করা এবং দ্বন্দ্ব অতিক্রম করে একটা কোনো পর্যায়ে সমগ্রতা পাওয়ার প্রক্রিয়াটিকে ভাষা এবং অবশ্যই কোনো লেখকের ভাষারীতির আলোচনায় প্রয়োগ করতেই হবে। অন্যদিকে ভাষা বিষয়ে প্রথম দ্বন্দ্বটিই এই যে ভাষা হচ্ছে তর্কাতীতভাবে, প্রশ্নাতীতভাবে সর্বসাধারণের সম্পত্তি, একশোভাগ পাবলিক প্রপার্টি, পুরোপুরি ভাগের মা। ভাষা এমন একটা নৈর্ব্যক্তিক বিশাল প্রবাহ যে ব্যক্তি তাতে আত্মসমর্পণই শুধু করতে পারে। ‘আমার বাইরে’ এই কথাটা প্রতিমুহূর্তে তাকে মানতে হয়। আবার বাস্তবের সঙ্গে ভাষার সম্পর্ক কখনোই আত্যন্তিক নয়, সে সম্পর্ক কৃত্রিম, বানিয়ে তোলা, আপসে মেনে নেওয়া; শব্দের অর্থ বস্তু, চিন্তা বা আবেগের সূচকমাত্র, শব্দের ধ্বনি-চেহারা প্রতীক ছাড়া আর কিছু নয়। অন্যদিকে ভাষা সম্বন্ধে বিপরীত সত্য হচ্ছে, ভাষা চরম ও চূড়ান্তভাবে ব্যক্তিগত, ব্যক্তি একা বা যৌথভাবে ব্যবহার না করলে ভাষার ব্যবহার নেই। ভাষার গায়ে ব্যক্তি তার নিজস্বতা বা অনন্যতার ছাপ মেরে দিতে চায় কি না, স্বাতন্ত্র্য অর্জনের চেষ্টা করা তার পক্ষে উচিত কি না এসব প্রশ্নই ওঠে না, নিজস্ব ছাপ না লাগিয়ে ব্যক্তি ভাষা ব্যবহারই করতে পারে না। পৃথিবীতে ভাষার সংখ্যা কত এই প্রশ্নের একটা জবাব হতে পারে পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা যত আছে ততই। ভাষা যে সর্বসাধারণের সম্পত্তি সে কথাটা চাপা পড়ে যেতে বাধ্য ভাষার ব্যবহারের কথাটা সামনে এলেই। ভাষা তখন একজন ব্যক্তির, বিশেষ করে একজন লেখকের অস্ত্র, আয়না, বাহন, শানপাথর, ধারণাপাত্র সবই।

বাংলাভাষার অন্যান্য কথাসাহিত্যিকের তুলনায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বেলায় চোখে পড়ার মতো একটি ঘটনা ঘটেছে। ভাষা সর্বসাধারণের সম্পত্তি বলেই ভাষা যেন মানিকের প্রতিপক্ষ। তাঁর কাছে ভাষা একটা চ্যালেঞ্জের মতো, তাঁর সঙ্গে ভাষার সম্পর্ক দাঁড়ায় বিরোধমূলক। ভাষার সর্বসাধারণত্বটিকেই তিনি নাকচ করতে চান, ঝেড়ে ফেলে দিতে চান ভাষার গায়ে লেগে-থাকা সর্বজনের সর্বক্ষণের ব্যবহারের দাগ। তিনি যা কিছু প্রকাশ করতে চান ভাষা তাকেই টেনে নামিয়ে আনতে চায় পদাতিকের দলে; প্রথায়, অভ্যাসে, সংস্কারে বহুকাল থেকে নির্ধারিত হয়ে যাওয়া শব্দের অর্থ, বাক্যবন্ধের পরিচিত ক্ষয়-পাওয়া চেহারা লেখাকে অনুজ্জ্বল ম্যাড়মেড়ে গতানুগতিক করে তুলতে চায়, মানিক প্রাণপণে তার বিরোধিতা করেন, লেখার কাজে নিজের ভাষাকে করে তুলতে চান তাঁর নিজের উৎকট স্বাতন্ত্র্যের বাহন সর্বসাধারণের সম্পত্তিকে আনতে চান একেবারেই নিজের আয়ত্তে। ভাষার সঙ্গে এই লড়াইটা-গড় ব্যবহারের সকলের ভাষাকে নিজের কাজের উপযুক্ত করে নেওয়া যা থেকে স্টাইল বা শৈলী নামে একটা অস্পষ্ট ও অসংজ্ঞায়িত ব্যাপার দেখা  দেয়,  সব লেখককেই করতে হয়। বঙ্কিমচন্দ্র রবীন্দ্রনাথের মতো বড়ো লেখক থেকে শুরু করে মাঝারি ছোটো সবাইকেই। কিন্তু লড়াইটা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে তাঁর লেখা শুরুর সময়ে যতটা মরিয়া হয়ে ওঠে এবং যত দ্রুত তিনি লড়াইয়ে জিতে ভাষার উপর নিজের আধিপত্যটা পাকাপোক্ত করে নিতে পারেন সেটা বিশেষভাবে লক্ষ করতেই হয়। আমি অবশ্য বলতে চাইব না যে, লেখকমাত্রেই কোমর বেঁধে সচেতনভাবে ভাষার সঙ্গে এই ধস্তাধস্তিটা করেন, তবে প্রতিভাধর লেখকমাত্রেই ভাষা ব্যবহার করতে গিয়ে তাঁর এই বিশেষ মাধ্যমটির সীমাবদ্ধতা এবং তার মধ্যে নিহিত কঠিন শর্তগুলো সম্বন্ধে সজাগ ও সতর্ক না হয়েই পারেন না। কারণ কেউ চান আর না চান ভাষার সঙ্গে এই লড়াইয়ের ব্যাপারটা ভাষার নিজের প্রকৃতির মধ্যেই আছেÑএড়ানোর উপায় নেই, অজান্তে হলেও যে কোনো সৃষ্টিশীল লেখককেই ভাষার গতানুগতিকতার আড় ভাঙতেই হবে। মানিক মনে হয় দৃঢ়সঙ্কল্প নিয়েই নিজের ভাষা তৈরি করে নিতে চেয়েছিলেন, কারণ তাঁর মতো তীব্র আত্মসচেতন লেখক তো দেখি না। কিংবা হতে পারে সঙ্কল্পের কোনো প্রয়োজন ছিল না, তাঁর ব্যক্তিত্বের কটু স্বাতন্ত্র্যই গদ্যের স্ব-নির্মাণের কাজে তাঁকে প্রবৃত্ত করেছিল।

রং রেখা যাঁরা ব্যবহার করেন, ধ্বনি ছন্দ তাল নিয়ে যাঁদের কাজ, দৃষ্টিগ্রাহ্য দেহভঙ্গিমায় যাঁরা ফুটিয়ে তুলতে চান কোনো সংবাদ, তাঁদের কাজে মুক্তি বেশি। ভাষা নিয়ে যাঁদের কাজ তাঁদের তা নয়। ভাষা মাটিতে এমনভাবে পড়ে থাকেÑবিশেষ করে গদ্যের ভাষা,  যে তা নড়তে চায় না। তার পাখা নেই। শব্দের অর্থ কোনো একভাবে নির্ধারিত, বারোয়ারি বাজারি, তা বোধহীন ওজনের মতো শব্দকে টেনে নামিয়ে আনতে চায়। শব্দ, বাক্যবন্ধ, শব্দ-সাজানো, বাক্য তৈরি কী ক্লান্তিকরভাবেই না কতকাল ধরে একরকম, কী অবসাদে জড়তায় তাদের অর্থ বাঁধা, কী ভোঁতা কী দৈনন্দিন! কিন্তু এতে কোনোরকম নাড়া না দিয়েই কাজ চালিয়ে নিয়েছেন বহু লেখক যাঁদের লেখা পড়লেই বোঝা যায় ভাষা তাঁরা বারোয়ারি সম্পত্তির মতোই পেয়েছেন, বারোয়ারি সম্পত্তির মতোই তাকে ব্যবহার করতে চান। অর্জন করার কিছু নেই তাঁদের কাছে। এইরকম লেখকদের পক্ষে বাস্তববাদী হওয়াটা তুলনায় সহজ, বাস্তববাদী আখ্যাটি তাঁরা পেয়েও যান সহজে। যে বাস্তব প্রদত্ত হিসেবে গোটাগুটি ইন্দ্রিয়ের সামনে আসে, জীবনের মোটা চেহারা আঁকড়ে ধরে যা আকার পায়, হাতে-পাওয়া ভাষাতে সেটাকে প্রকাশ করতে পারলে তাকে অসম্ভব পরিচিত স্বাভাবিক বলে মনে হতে পারে। স্বীকার করতেই হবে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বাস্তববাদী লেখক ছিলেন না, যখন তিনি তা হবার চেষ্টা করেছিলেন তখন যে সফল হয়েছিলেন আমার তা মনে হয় না। কারণ ভাষার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের দ্বন্দ্বের তীব্রতাকে তিনি ঠিক কখনোই অতিক্রম করে আত্মপ্রসাদ পেতে পারেন নি।

ভাষার সঙ্গে বাস্তবের সম্পর্ক যদি কৃত্রিম হয় এবং সেজন্যে ভাষা-নির্মিত বাস্তব প্রকৃত বাস্তবকে যদি আদৌ ছুঁতে না পারে, তাহলে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো লেখকের পক্ষে যা স্বাভাবিক তিনি ঠিক তাই করেন; তিনি এই কৃত্রিম প্রথাসিদ্ধ সম্পর্ক ভেঙে ফেলে ভাষা, বাস্তব এবং নিজের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সমন্বয়ে ভরা একটা নতুন সম্পর্ক তৈরি করে নিতে চান। তিনি যে ভাষাকে পুরোপুরি নিরপেক্ষ করে তুলতে পারেন তা নয়, তাহলে শব্দকে অর্থহীন করতে হয়, বাক্য ও বাক্যবন্ধনের চেনা চেহারা, পুরনো নিয়ম সবই বাতিল করে দিতে হয়, ভাষাকে করে তুলতে হয় এমন একটি ধারণপাত্র যা নিজে কিছুই ধারণ করে না কিন্তু লেখক স্বর্গমর্ত্যরে যাই-ই রাখুন না তাতে তাই সে ধারণ করতে পারে, ভাষাকে তাহলে করে তুলতে হয় এমন একটি আয়না যা কোনাকুনি, সোজাসুজি, আড়াআড়ি সব রং প্রতিফলিত করতে পারে। এতটা বলা মানিকের পক্ষে সম্ভব না বটে, হয় না কারণ ভাষাই তাতে বাদ সাধে কিন্তু বাংলা গদ্য নিয়ে মানিক এই পথে বহুদূর এগিয়ে যান। এমন একজন লেখককে কীভাবে বাস্তববাদী বলা যায়? বাস্তববাদী তো বটেই, কিন্তু বাস্তববাদী কথাটা মোটেই যথেষ্ট নয় তাঁর পক্ষে অন্য নানারকম লেবেল তাঁর রচনার উপর চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করা যায়, পরাবাস্তববাদ, নব্যবাস্তববাদ, তাতে তেমন পরিষ্কার হবে না মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষারীতির মূল চেহারাটা। লেখক হিসেবে তাঁর জন্যে একমাত্র মাধ্যম যে ভাষা তাকে নিজের সৃষ্টির কাজে লাগাতে গিয়ে একটা সম্পর্ক তাঁকে তৈরি করে নিতে হয়েছে ভাষার সঙ্গে যা সব লেখককেই করতে হয় কিন্তু এই সম্পর্ক পাতাতে গিয়ে তিনি হয়ে উঠেছেন তীব্র আত্মসচেতন আর এই আত্মসচেতনতা এমন করে লেপে দিয়েছেন ভাষার গায়ে যে ভাষার সাধারণ চেহারার সঙ্গে সঙ্গে তার মোটা দাগের দৈনন্দিন ব্যবহারটা অনেক দূর পর্যন্ত ওলটপালট হয়ে গেছে। এই সম্পর্কে মানিক দাঁড়িয়েছেন এক ধরনের বৈরিতায় যাতে ভাষার প্রতিবন্ধক তিনি চুরমার করে দিতে পারেন, যাতে ভাষা কেবল তাঁরই অভিপ্রায়, তাঁর আবেগ, তাঁর চিন্তা-বিশ্লেষণ, জগৎ-ভাবনা সাহিত্যের ভাণ্ডারে মাত্র একবারই সম্পূর্ণ প্রকাশ করতে পারে কোনোরকম প্রতিতুলনা না রেখে। এর ফলে যে ভাষারীতিটা মানিকের দখলে আসে তা দিয়ে তিনি কেবল তাঁরই বাস্তবকে রূপ দিতে পারেন। বাস্তব তখন আর ‘ঐখানের’ একটা বর্ণনীয় বিষয়মাত্র থাকে না, তা হয়ে ওঠে জীবন্ত, স্পন্দমান, দ্বন্দ্ব-সংঘাতে অন্তহীনভাবে সম্ভাবনাময়। মানিক যা করেন লেখকমাত্রেই তাই করেন; করেন মানে করতে বাধ্য হন। বাস্তবের বোধের জন্যে এটাই মানব-শর্ত। লেখক শিল্পীর কথা নয়, ব্যক্তির চেতনায় প্রতিফলিত না হয়ে অভিজ্ঞতা তৈরি হবারই কোনো উপায় নেই, এসব কথা সত্যি তবে অন্যদের সঙ্গে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের তফাৎ এইখানে যে তাঁর চেতনায় বাস্তবের এই প্রতিফলন অত্যন্ত তীব্র আলোয় ঝলসে ওঠে; তা যেমন উগ্র তেমনি স্বকীয়, এমন যে বাংলা গদ্যে তার তুলনা পাওয়া যায় না। তাঁর চেতনায় বাস্তবের এইরকম প্রচণ্ড উদ্ভাস থেকেই তাঁর অনন্য ভাষারীতির জন্ম, না তাঁর অর্জিত ভাষারীতির প্রকাশের ফল এমন বাস্তব, সেটা পুরোপুরি মীমাংসা করা কঠিন। মনে হয় তাঁর বোধ থেকেই তাঁর ভাষারীতির ব্যাখ্যা করা আমাদের জন্যে সহজতর হয় যদিও কাজের সময়টা বোধ আর ভাষারীতির পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারটা নিশ্চয়ই জোরালো হয়ে ওঠে। মাধ্যম হিসেবে ভাষাও প্রচুর ও প্রবল শর্ত চাপিয়ে দিতে পারে। সৃষ্টিকর্মের একেবারে মূলে গিয়ে হয়তো পাওয়া যাবে একটা রেণুতে মেশামেশির প্রক্রিয়া।

তাহলে এমন যে বাস্তব তা কি মানিকের ব্যক্তিগত বাস্তব? কোনো অবস্থাতেই ব্যক্তিকে যে আলাদা করা যায় না তা তো স্পষ্ট। প্রশ্নটা বোধহয় ঠিক তা নয়, ব্যক্তিগত মানে মনগড়া কি না এইটাই প্রশ্ন। অভিজ্ঞতার সম্পূর্ণ অনুপস্থিতিতেও মনের ক্রিয়া আছে। এমনকি অভিজ্ঞতাশূন্য মানসিক তৃপ্তির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াও আছেÑচিন্তার, আবেগের, ইচ্ছার বিরাট কাঠামোর মধ্যে আত্মসঙ্গতিপূর্ণ মজবুত প্রাসাদ বানানো যায়। মানিকের বাস্তব কি এমনি মনগড়া প্রাসাদ? মানিকের সমস্ত সাহিত্য সামনে রেখে এই প্রশ্নের এখন একটিই স্পষ্ট ও দৃঢ় জবাব দেওয়া যায়; তিনি শুধু বাস্তববাদী লেখক নন, কট্টর বাস্তববাদী লেখক; বোধহয় সমস্ত জীবনে এমন একটি বাক্যও লেখেন নি যা কেবল মনের ছায়া, যার পেছনে নেই মনের বাইরের বাস্তবের মাটি। অবশ্য মানিককে কট্টর বাস্তববাদী লেখক বলার সঙ্গে সঙ্গে এটাও বলে নিতে হবে যে বাস্তবের সঙ্গে তিনি কিন্তু বরাবর একই সম্পর্ক রাখেননি, দৃষ্টিভঙ্গি বা মনোভাবের দিক থেকে কথাটা বলছিÑ বলতে চাননি একই কথা। লেখক জীবনের নানা পর্যায়ে বাস্তব নিয়ে তিনি নানাভাবে মনস্থির করেছেন, নিজের সাহিত্যকে দিয়ে অনেক ধরনের কাজ করিয়ে নিতে চেয়েছেন। সাহিত্যে বাস্তবকে নিয়ে গন্তব্য বা লক্ষ্য বদলেছেন ঠিকই কিন্তু সেই বদলের সঙ্গে তাঁর ভাষারীতির সম্পর্ক রাখেননি; সেটাকে আলাদা রাখারই চেষ্টা করেছেন। ভাষারীতি বাহন হিসেবে তাঁর কাজ করে দিয়েছে। এই আলাদা করার কাজটা লেখক ইচ্ছে করলেই করতে পারেন কি না, বাস্তবের বোধ সম্পূর্ণ পাল্টে গেলে তা ভাষারীতিকেও পাল্টে দেয় কি না, দিলে কতটা দিতে পারে এই জটিল সমস্যাটির মধ্যে ঢোকার সুযোগ এই লেখায় নেই। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষারীতির সঙ্গে পরিচয়টা একটু নিবিড় হয়ে এলে এটাও আস্তে আস্তে ধরা পড়তে থাকে যে তাঁর ভাষারীতির নানা পর্যায় আছে। বাস্তব সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি, সাহিত্যে করণীয় সম্বন্ধে তাঁর মনোভাব, শিল্প ও শিল্পীর কাজ সম্পর্কে তাঁর মত, মার্কসবাদ গ্রহণ করার পর লেখার উদ্দেশ্য এবং তাঁর বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ইত্যাদি নানা বিষয়ের সঙ্গে তাঁর ভাষারীতির নানা পর্যায়ের সম্পর্ক যে আছে তাতে সন্দেহ নেই, তাঁর ভাষারীতির এইসব পর্যায় পরস্পরবিচ্ছিন্ন বলে মনে হতে পারে, এমন কি লেখার উদ্দেশ্য সম্পর্কে তাঁর মনোভাবের বদল তাঁর ভাষারীতিকে পুরোপুরি বদলে দিয়েছে বলেও ধারণা হতে পারেÑকিন্তু সত্যটা এই যে তাঁর ভাষারীতির মূল বৈশিষ্ট্যগুলি কখনই বদলায়নি। কারণ ভাষারীতি নিজে সাহিত্য নয়, সাহিত্য বলতে লেখক যা যা বোঝেন, যা যা করেন তাই বয়ে নিয়ে বেড়ায়; একটা দিক থেকে তা বিদ্যুতের তার, বিদ্যুৎ নয়।

চল্লি¬শের দশকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় যখন তাঁর লেখায় সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার প্রয়োগ ঘটাতে সচেষ্ট হন, এখনকার মতো তখন ব্যাপারটাকে স্পষ্ট করে তুলতে পারা যায়নি বরং এদেশে কথাটা আগন্তুক বলে প্রচুর বিতর্কের ধোঁয়া ওঠে এবং সমস্ত কথা ধোঁয়াতেই ঢাকা পড়ে। সাহিত্যে সংস্কৃতিহীন রাজনীতি সমাজে যে ষণ্ডের ভূমিকা নিয়ে থাকে সাধারণত, অতীতে এবং বর্তমানেও,  চল্লিশের দশকে শিক্ষিত মার্কসবাদীদের অনেকে যাঁরা পার্টিতে রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন তাঁরা এই বিতর্কে সাহিত্যের পাশাপাশি রাজনীতির প্রসঙ্গটিও নিয়ে আসেন। এতে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ও একভাবে সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার কথাটা বুঝে নেন। ফল দাঁড়ায় এই যে লেখার ব্যাপারে একটা খুব নির্দিষ্ট লক্ষ একেবারে চৌহদ্দি-টানা উদ্দেশ্য লেখার আগে থেকেই নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে যা তাঁর উপরে চাপানো, যা তিনি নিজে পুরোপুরি নানা সূত্রে অর্জন করেননি। লেখার বিষয়ের সঙ্গে নিজেকে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত করতেই ফাঁপর লাগে তাঁর। এই দোটানা সমস্যার সমাধান আর তিনি বাকি জীবনে করতে পারেন না। তাঁর আগের পর্যায়ের বাস্তবতার বোধ বারবার হানা দিতে থাকে তাঁর পরের লেখায়। এই ত্রিশঙ্কু অবস্থাটাই যে কোনো সৎ লেখকের জন্যে সত্যিকার অর্থে আত্মিক সঙ্কট। দোষ সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার নয়, যাই-ই বোঝাক না এই বিষয়টা,  গোর্কি যখন ‘আমার ছেলেবেলা’ লেখেন বা ‘মা’ উপন্যাসটি রচনা করেন যখন তাঁকে সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার পাঠ নেবার জন্যে কোনো ক্লাশ করতে হয়নি, ওঁর লেখা পড়ে বিষয়টা সম্বন্ধে যা বোঝার তা আমরা ঠিকই বুঝে যাই কারণ সমস্ত ব্যাপারটাই গোর্কির ভিতর থেকে তৈরি হয়ে রূপ নেয়, তিনি যা কিছুর ভিতর দিয়ে গেছেন তার সবই বোনা হয়ে যায় তাঁর লেখায়; তাঁর কষ্ট, তাঁর লড়াই, মানুষের অপার মানবিকতা, মানুষের সীমাহীন অমানবিকতা সমস্ত কিছুই রক্তের ভাষায় লিখে রাখেন। এর নাম সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতা বা এইরকম কিছু একটা দিলেই তা শিখে নেবার ব্যাপার হয়ে দাঁড়াতে পারে না। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভ্যস্ত ভাষারীতি চল্লি¬শের দশকে সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার ধাঁচ মকশো করতে গিয়ে কোনো বড়ো ধরনের ধাক্কা খেয়েছিল কি না বলা কঠিন। অর্থাৎ আধার কি মিলতে চায়নি আধেয়ের সঙ্গে, আমাদের নিঃসংশয় হওয়া কঠিন। কিন্তু ভাষাই যার একমাত্র অবলম্বন সেই লেখক মানুষটি যখন জনগণের সম্পত্তিকে নিজের মতো তৈরি করে নিতে গিয়ে যথাশক্তি নিয়োগ করেন, তখন ভাষা ব্যক্তিত্বের ধাঁচের সঙ্গেই লগ্ন হয়ে যায়, তখন আধেয়কে বহন করা, তাকে রূপ দেওয়াই লেখকের নিজস্ব ভাষারীতির মূল লক্ষ হয়ে দাঁড়ায়।

এত কথার পর হয়তো একটু আশ্চর্যই লাগবে এই দেখে যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু বাংলা গদ্যের বাইরের চেহারাটায় ভাঙচুর তেমন কিছুরই করেননি। বাইরের চেহারা বলতে বুঝছি শব্দ বাছাই, বাক্য তৈরি, বাক্যের মধ্যে শব্দগুলি বসানোর ক্রম, বাক্যাংশগুলির পারস্পরিক সংস্থান এবং সম্পর্কস্থাপন এইসব। ‘দিবারাত্রির কাব্য’ তিনি লিখেছিলেন একুশ বছর বয়েসে, রচনা হিসেবে তাঁর প্রথম উপন্যাস, প্রকাশের দিক থেকে দ্বিতীয়। মানিকের প্রথম ছোটগল্প ‘অতসী মামী’তে শরৎচন্দ্রের ঝাঁজ বেশ জোরালো, হয়তো তাঁর সারাজীবনের সমস্ত লেখার মধ্যে এই একবারই, কিন্তু ‘দিবারাত্রির কাব্য’র আশপাশে কাউকে দেখা যায় না। ভাষার মধ্যে কোথাও কোনোরকম উৎকেন্দ্রিকতার ছাপ নেই, বাক্যগঠন পরিচিত ও চেনা এই অর্থে স্বাভাবিক। খুব সাধারণ আটপৌরে শব্দের ব্যবহারÑ সেটাও বাংলা গদ্যে তখন রীতিমতো চালু হয়ে গেছে, সর্বনাম আর ক্রিয়াপদের চলিত রূপের ব্যবহারও তখন পুরনো হয়ে এসেছে, বলতে কী মানিকের একুশ বছর বয়েসের গদ্যের তখন এই রকম চলন:
সকাল সাতটার সময় রূপাইকুড়ার থানার সামনে হেরম্বের গাড়ি দাঁড়াল। …পূর্ব আর পশ্চিমে কেবল প্রান্তর আর দিগন্ত। মাঝে মাঝে দু একটি গ্রামের সবুজ ছাপড়া বসানো আছে, বৈচিত্র্য শুধু এই। উঁচুতে কেবল পাহাড়। একটি দুটি নয় নৈবেদ্যের মতো অজস্র পাহাড় গায়ে গায়ে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে, অতিক্রম করে যাওয়ার সাধ্য চোখের নেই, আকাশের সঙ্গে এমনি নিবিড় মিতালি।

আন্দাজ করার উপায় নেই কী বিষাক্ত তিক্ত স্বাদ, কী মর্মান্তিক শে¬ষ বিদ্রূপ, কী অসহ্য ভালোবাসা আর গরল এই সরল গদ্যভাষা নিঃশব্দে ঢালতে থাকবে পাঠকের মনে। কেমন আবছা ধোঁয়াটে হয়ে আসবে পরিচিত পৃথিবী, বাস্তবের শক্ত তীক্ষè খোঁচগুলি মোলায়েম হয়ে গলে যেতে থাকবে, সাদা চোখের জগৎ মানুষের চেতনার সম্পূর্ণ দখলে চলে যাবে, তাতেই ডুববে, তাতেই ভাসবে। সাদামাঠা গদ্য ব্যবহার করে এমন অসম্ভব ফল মানিক পান এই কারণে যে বাংলা গদ্যকে তিনি পড়ে থাকা সাদামাঠা গদ্য হিসেবে নয়, নিজের তৈরি হাতিয়ারে পরিণত করতে পেরেছেন এবং সেটা সম্ভব হয়েছে বাস্তব নিয়ে যে তীব্র চেতনা তাঁকে ক্রমাগত তাড়না করে, নিদারুণ যন্ত্রণা দেয়, সেই একই চেতনা তিনি ভাষার মধ্যে, তাঁর বাক্যগুলির ভিতরে স্থাপন করে তাদের বাস্তবের দিকে এগিয়ে দিতে পারেন। মাষ্টামশাইকে বিষ খেতে দেবার পরামর্শ দিলে মালতী হেরম্বকে ঘর থেকে বের করে দেবার পর ‘হেরম্ব আর কোথায় যাবে,’ গেল বাগানে। ‘এখানে আছে ভোরের পাখির ডাক আর অসংখ্য কীটপতঙ্গের প্রণয়। পচা ডোবার জলে হয়তো অ্যামিবা আত্মপ্রণয়ে নিজেকে বিভক্ত করে ফেলেছে, তরু-বল্কলের আড়ালে পিপীলিকার চলেছে শুঁড়ে শুঁড়ে প্রণয়ভাষণ, হেরম্বের পায়ের কাছ দিয়ে এক হয়ে এগিয়ে চলেছে কর্ণজলৌকা দম্পতি, গাছের ডালে ডালে একজোড়া অচেনা পাখির লীলাচাঞ্চল্য।’ দৃষ্টি যাঁর জীবনলীলার এই আদিম নিঃশব্দ বিপুল ক্রিয়াকাণ্ডে প্রোথিত হয়ে গেছে, তাঁর কাছে আর কি আশা? জীবন্ত গোটা স্বাভাবিক মানুষ কিভাবে তাঁর কাছ থেকে আশা করা যায়? হেরম্ব নামে যে ঘুরে বেড়ায় সে কে? আনন্দ কি নর্তকী কিশোরী? অসুস্থতা আর বিকারে ভরা, ভালোবাসা ঘৃণায় বিস্ফোরণমুখী একটা জগতে মানুষের ছায়া, মানুষের টুকরো আসর জাঁকিয়ে বসেছে। মানিক নিজেই বলেছেন, ‘বাস্তব জগতের সঙ্গে সম্পর্ক দিয়ে সীমাবদ্ধ করে নিলে মানুষের কতকগুলি অনুভূতি যা দাঁড়ায় সেইগুলি কেউ মানুষের নয়, মানুষের প্রজেকশন-মানুষের এক টুকরো মানসিক অংশ।’

দ্বিতীয় উপন্যাসে, ‘পদ্মানদীর মাঝি’তে, তাঁর দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ রচনায়, মানিক, মনে হয়, ভাষার বাইরের চিহ্নের হিসেবে প্রথম উপন্যাসটি তুলনায় আরেকটু পিছিয়েছেন। একেবারে সাধুভাষায় ফিরে গেছেন তিনি। ক্রিয়াপদের চলিত রূপ বর্জন করে তার সাধুরূপটিকে ব্যবহার করেছেন। ভাষার এই সাধুরূপে তিনি অনেকদিন লিখেছেন, তাঁর জীবনের সম্ভবত সেরা উপন্যাসটি, তাঁর তৃতীয় উপন্যাস ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ও এই ভাষারীতিতেই লেখা। তবে সাধু বলতে একেবারেই নামমাত্র। ক্রিয়ার সাধুরূপটি নেহাৎ না রাখলেই নয় এইভাবে, মুরুব্বির সামনে মুখটা একটু ঘুরিয়ে বিড়ি টানার মতো কোনোরকমে আছে শুধু। খুবই আলগা ঝুলন্ত। সর্বনামের ব্যাপারে মানিক করেছেন যথেচ্ছাচার। তাহার তার তাহাকে তাকে তাদের তাহাদের সবরকমই আছে আটপৌরে, মুখ-চলতি, নি¤œবর্গের মানুষের মাটি-মাখা, আধ-ফোটা বা ভীষণরকম বিকৃত এমন কি নানাধরনের অশিষ্ট শব্দ মানিক তাঁর উপন্যাসের বর্ণনাংশে ব্যবহার করতে কসুর করেননি। উনিশ শতকের সমালোচকরা তো নির্ঘাৎ গুরুচণ্ডালির অভিযোগ নিয়ে আসতেন তাঁর বিরুদ্ধে। এই অভিযোগের কোনো অর্থ আজ নেই বটে, সেই সময়েও ছিল কি না সন্দেহ, ভাষার নিয়মনীতি বেশি দূর পর্যন্ত খুঁজতে যাওয়ার মানে নেই, প্রতিভাবান লেখকদের বেলায় তো নেই-ই, তবু ভাষাগঠন একটা সন্তোষজনক পর্যায়ে এলে সব ভাষাতেই কিছু নিয়মবন্ধন এসেই যায়Ñ সেদিক থেকে দেখতে গেলে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গদ্যরীতির মধ্যে অরাজকতা অনিয়ম আকছার দেখতে পাওয়া যাবে সন্দেহ নেই। অবশ্য ক্রিয়ার সাধুরূপের ভিতরে সর্বনামের চলিতরূপ মিশিয়ে দেওয়া, বাংলাভাষার সাধু-চলিত চেনার প্রধান চিহ্ন, এবং তাতেও কোনো নিয়ম না মেনে শুধু কলমের মুখের বাক্যটির দিকেই সম্পূর্ণ মনোনিবেশ করা কিংবা বাক্যের মধ্যে শব্দ বা শব্দবন্ধের ক্রমে প্রচুর উল্টোপাল্টা করাকে ঠিক নিয়মভঙ্গের মধ্যে ফেলা যায় কি না সন্দেহ। তবু মানিকের গদ্য পড়তে গেলেই তাঁর সাধু গদ্যরীতির ভঙ্গকুলীন নয়, জাতিচ্যুত বলেই মনে হয়। বাইরের চেহারায় কিছুই প্রায় ধরা পড়ে না সত্যি, কিন্তু পাঠক মর্মে অনুভব করতে পারেন মানিক প্রচলিত সাধুরীতির জাত মেরে দিয়েছেন। এটা স্পষ্ট হয় মানিকের চলিতরীতিতে লেখা রচনাগুলির দিকে নজর দিলেÑ খেয়ালই হয় না যে তিনি রীতি বদলেছেন, সাধুরীতিতে না লিখে চলিতরীতিতে লিখেছেন। তাঁর গদ্যের নিগূঢ় প্রকৃতি এমনি স্বতন্ত্র এমনি অমোঘ যে এক রীতি থেকে আর এক রীতিতে যাতায়াতের পথটাকে ধরতে পারাই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। সাধুচলিত পার্থক্যটা সেক্ষেত্রে নেহাৎ-ই কথার কথা হয়ে দাঁড়ায়, কয়েকটি যান্ত্রিক চিহ্নমাত্র উল্লে¬খ করা ছাড়া আমাদের জন্যে আর বলার কিছু থাকে না। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কোনও কোনও উপন্যাস সাধুরীতিতে লেখা আর কোনও কোনও উপন্যাস চলিতে এটা ভাবতে বসলেই দেখা যাবে স্মৃতিতে সমস্তটাই একাকার হয়ে গেছে। আমার ধারণা একমাত্র মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ই সাধুচলিতের বিতর্কটাকে চিরকালের জন্যে পুঁতে ফেলতে পেরেছেন। তাঁর ভাষা একদিকে চলে গেছে লোকজ ধারার ভিতরে, জটিল শিকড়বাকড় মেলেছে মাটির তলায়। সরু মোটা তারে বোনা জালের মতো ছড়িয়ে গেছে অন্ধকারে, নিভৃতিতে, আদিমতায়, রসে-রহস্যে, আবার জীবনের কলরোলে আনন্দে যন্ত্রণায়। অন্যদিকে তাঁর ভাষা গেছে যুক্তি দার্ঢ্যরে দিকে, বিজ্ঞান আর ন্যায়শাস্ত্রের কঠিন কঠোর শৃঙ্খলার দিকে বিশ্লেষণ আর বিচারের ইস্পাতকঠিন পথে। তাঁর ভাষা ব্যবহারের ধরনটা থেকেই এটা বোঝা যায়। সাধুরীতিতে লিখতে গিয়েও কী অবজ্ঞা তার প্রতি! অবলীলায় লিখছেন ‘বিয়াইয়াছে।’ একবার লিখছেন? বিয়াইয়া, রাগাইয়া, চেঁচাইয়া, ঝিমাইতেছে, ফুটাইতেছে-ক্রিয়াপদের একেবারে অন্ত্যত চেহারাটার সাধুরূপ লিখে যাচ্ছেন, সাধুরীতিটাকে গালাগালি দেওয়ার মতো। তোয়াক্কাই করছেন না তাহাতে তাকে তাহাদের কী যে তিনি লিখছেন! বাক্যের মধ্যে শব্দস্থাপনে যতটা সাধারণ নিয়মের লঙ্ঘন করা যায় তার কিছুই তিনি বাদ দিচ্ছেন না। তাঁর মনের খুব ভিতরের একটি কথাকে তীক্ষমুখ ছুঁচের মতো বাইরে নিয়ে আসার সংকল্পে যেভাবে বাক্য উচ্চারণ করা মানুষের জন্যে অসুবিধেজনক তাও তিনি নির্বিকার চালিয়ে দিতে দ্বিধা করছেন না। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্যে সবচেয়ে বড়ো গাল হচ্ছে তাঁকে ভাষাশিল্পী বলা। কর্মকারের মতো কিংবা হাতে-কলমে কাজ করা মিস্ত্রির মতো মানিক ছাড়া আর কেউই-ই এত একরোখাভাবে বাংলাগদ্যকে ব্যবহার করতে চেয়েছেন বলে আমার জানা নেই। নিজেকে যে তিনি কলম-পেষা মজুর বলতেন সেটা যেন আক্ষরিক অর্থেই ঠিক। আরবি, ফারসি, খাঁটি বাংলা শব্দ, তৎসম শব্দের বিকৃত রূপের ব্যবহার তাঁর গদ্যে এতই প্রবল যে এইসব মিলেমিশে একটা প্রায়-অপ্রীতিকর স্বাদ পাঠকের তালুতে গিয়ে লেগে থাকে; একটা তীব্র অদ্ভুত গন্ধ, ঝাঁঝালো মশলার রান্নার মতো, নাকে এসে ধাক্কা দেয়। সাধু-চলিতের কথাটাই তখন হাস্যকর হয়ে দাঁড়ায়।
ভাষার মধ্যে এইসব অল্পবিস্তর কাজ করে মানিক চমৎকার ফল পান। যে বাস্তব তিনি সৃষ্টি করতে পারেন তা হয়ে ওঠে তীব্র, জীবন্ত পদার্থের মতো বিবর্ধমান, বহুমাত্রিক। বাইরের বাস্তবের ঠিক উলটো হয়ে দাঁড়ায় এই বাস্তবের চরিত্র, তা হয়ে ওঠে ভীষণরকম আত্মসচেতন। তিনি নাটকীয়তাকে একেবারে ছাড়তে চেয়েছেন (ফলে বহু জায়গাতেই তৈরি হয়েছে এক ধরনের গলা-চাপা নাটকীয়তা যা পাঠককে প্রায় শারীরিকভাবে পীড়ন করে), বর্ণনাকে নামাতে চেয়েছেন নিচুগ্রামে, প্রায়ই ব্যবহার করেছেন প্রত্যাশা-রেখার নিচে রাখা নিরুচ্ছ্বাস কথন। বাঙালি সব ত্যাগ করে আদেখলার মতো যেটা চিবিয়ে খাবার চেষ্টা করে আর যাকে ধরে বেঁচে থাকে সেই সেন্টিমেন্টালিটি তিনি নির্মম হাতে ছেঁটে দিতে চেয়েছেন তাঁর লেখা থেকে। তা সত্ত্বেও তাঁর লেখার প্রধান বৈশিষ্ট্য সম্ভবত একটি তীব্র আত্মসচেতনতা যা তিনি কিছুতেই তাঁর কোনো লেখা থেকে আলাদা করতে পারেন না। বহু উদ্দেশ্যসাধক হলেও মানিকের ভাষারীতিতে এই বৈশিষ্ট্য তিনি না চাইলেও থেকে যায়। নিজের একটা অদ্ভুত উপস্থিতি তিনি আড়াল করতে পারেন না। সাধারণ বর্ণনার মধ্যেই দুএকটি অতর্কিত মন্তব্য কিংবা বর্ণনীয় বিশেষ প্রসঙ্গ বিদ্যুতের মতো চোখে ধাঁধা লাগিয়ে দেয়। ‘পদ্মানদীর মাঝি’র শুরু:
বর্ষার মাঝামাঝি।
পদ্মার ইলিশ ধরার মরশুম চলিয়াছে। দিবারাত্রির কোনো সময়েই মাছ ধরিবার কামাই নাই। সন্ধ্যার সময় জাহাজঘাটে দাঁড়াইলে দেখা যায় নদীর বুকে শত শত আলো অনির্বাণ জোনাকির মতো ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। জেলে নৌকার আলো ওগুলি। … শেষ রাত্রে ভাঙা ভাঙা মেঘে ঢাকা আকাশে ক্ষীণ চাঁদ উঠে। জেলে নৌকার আলোগুলি তখনো নেভে না। নৌকার খোল ভরিয়া জমিতে থাকে মৃত শাদা ইলিশ মাছ। লণ্ঠনের আলোয় মাছের আঁশ চকচক করে, গাছের নিষ্পলক চোখগুলিকে স্বচ্ছ নীলাভ মণির মতো দেখায়।

বাস্তব পড়ে থাকে। মানিক তার মধ্যে থেকে কিছু জিনিস বাছাই করে আমাদের দেখান-মৃত শাদা ইলিশ মাছ, মাছের চকচকে আঁশ, তাদের নিষ্পলক চোখ। কুবের এসব দেখতে পায় না, দেখতে পেলেও তার কোনো ছবি তার চেতনায় নেই। পদ্মার জেলে ধরে, দিনের পর দিন, রাতের পর রাত, হয়তো হাজার হাজার বছর ধরে, মানিক লিখে যান:
দিন কাটিয়া যায়। জীবন অতিবাহিত হয়। ঋতুচক্র পাক খায়, পদ্মার ভাঙনধরা তীরে মাটি ধ্বসিতে থাকে, পদ্মার বুকে জল ভেদ করিয়া জাগিয়া উঠে চর, অর্ধশতাব্দীর বিস্তীর্ণ চর পদ্মার জলে আবার বিলীন হইয়া যায়। …জন্মের অভ্যর্থনা এখানে গম্ভীর, নিরুৎসব, বিষণœ। জীবনের স্বাদ এখানে শুধু ক্ষুধা ও পিপাসায়, কাম ও মমতায়, স্বার্থ ও সংকীর্ণতায়। আর দেশী মদে। তালের রস গাঁজিয়া যে মদ হয়, ক্ষুধার অন্ন পচিয়া যে মদ হয়। ঈশ্বর থাকেন ঐ গ্রামে ভদ্রপল্লীতে। এখানে তাঁহাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না।

এই ভাষার ভঙ্গির মধ্যে শুধু যে তীক্ষè আত্মসচেতনতা আছে তাই নয়, আছে একরকমের চিরন্তনতা। নিঃশব্দ, প্রবল, অপ্রতিরোধ্য জীবনপ্রবাহের একটা টানা একঘেয়ে বর্ণনা। কিন্তু এই চিরন্তনতার জাত আলাদা। রবীন্দ্রনাথের মতো তা মানবজীবনের প্রসন্ন অফুরান রসের কথা বলে না। একটি কুটিল ক্রূর নিষ্ঠুর সংগ্রামের কথা যেন মানিকের ভাষার শরীর লেপটে থাকে। জীবনের অতলে আছে যে প্রচণ্ড আসক্তি বিনাশ আর আক্রোশের দ্বন্দ্ব মানিকের ভাষা ঠিক তাকেই প্রকাশ করে দেয়। অবিশ্বাস্য সহজ দু-চারটি বাক্যেই মানিক কুবেরের কুঁড়ের মধ্যে ছোট্ট একটি ঢেঁকির বর্ণনার উপলক্ষে পদ্মা নদীর উত্তাল তরঙ্গ এনে হাজির করতে পারেন। চোখের সামনে পদ্মা তার সুদীর্ঘ ইতিহাস নিয়ে আলো-অন্ধকারের ভিতর দিয়ে বয়ে যেতে থাকে, কখন তার প্রবাহ জীবনপ্রবাহ হয়ে ওঠে ধরতে পারা যায় না।
বাক্যকে সামান্য একটু বাঁকিয়ে কী ভয়ানক শে¬ষ যে তিনি তৈরি করতে পারেন কল্পনা করাও শক্ত হয়ে ওঠে আমাদের জন্যে যেন ছোটো ছোটো ইস্পাতের ফলা, বিষমাখানো তীরের মুখ। ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’-র শুরু এইভাবে:
খালের ধারে প্রকাণ্ড বটগাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়া হারু ঘোষ দাঁড়াইয়া ছিল। আকাশের দেবতা সেইখানে তাহার দিকে চাহিয়া কটাক্ষ করিলেন।

একেবারে দ্বিতীয় বাক্যেই একটিমাত্র শব্দের অপ্রত্যাশিত মোচড় দেওয়া ব্যবহারে মানিক একটি ঘটনাকে তীব্র চেতনায় বিদ্ধ করেন। শব্দটি ‘কটাক্ষ’। ঐ একটিমাত্র শব্দে আমাদের চেতনাকেও ঘটনাটি আকাশের বিদ্যুতের মতোই ঝলকে ওঠে। বাজে পড়া মৃত্যুর দশা। মানিক বর্ণনা করে যান:
হারুর মাথায় কাঁচা-পাকা চুল আর বসন্তের দাগভরা রুক্ষ চামড়া ঝলসিয়া পুড়িয়া গেল। সে কিন্তু কিছুই টের পাইল না। শতাব্দীর পুরাতন তরুটির মূক অবচেতনার সঙ্গে একান্ন বছরের আত্মমমতায় গড়িয়া তোলা জগৎটি তাহার চোখের পলকে লুপ্ত হইয়া গিয়াছে।

বজ্রাঘাতে যার মৃত্যু ঘটল তার মুখের ‘বসন্তের দাগভরা রুক্ষ চামড়া’র উল্লেখ এমন কী গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু মানিকের সে কথাটা জানানোর প্রয়োজন আছে। যে মরে গেছে তার কথা বলতে গিয়ে মানিকের এই হাস্যকর কথাটাও বলার প্রয়োজন আছে, শুধু প্রয়োজন নয়, বলতে তাঁকে হবেই যে চামড়া ঝলসে পুড়ে গেলেও ‘সে কিন্তু কিছুই টের পাইল না।’ এরপরেই মানিকের সেই প্রিয় বর্ণনা, যা তিনি প্রথমদিকের উপন্যাসগুলিতে ফিরে ফিরে করেছেন। প্রকৃতির মধ্যে জীবনের সার্বক্ষণিক ক্রিয়াকাণ্ড। অতি ক্ষুদ্র জীবনকণার একক থেকে শুরু করে জীবনের বৃহৎ ধারার বর্ণনা করেন, জড় থেকেই উঠে আসা প্রাণ আর স্পন্দনের কথা তিনি বলেন: মৃত হারু ধীরে ধীরে জড়ের জগতে ঢুকে পড়ে, এখন জীবনের অন্যরকম কাজে লাগবে সে:

হারু দেখিতে দেখিতে ভিজিয়া উঠিল। স্থানটিতে ওজনের ঝাঁঝালো সামুদ্রিক গন্ধ ক্রমে মিলাইয়া আসিল। অদূরের ঝোপটির ভিতর হইতে কেয়ার সুমিষ্ট গন্ধ ছড়াইয়া পড়িতে আরম্ভ করিল। সবুজ রঙের সরু লিকলিকে সাপ একটি কেয়াকে পাকে পাকে জড়াইয়া আচ্ছন্ন হইয়া ছিল। গায়ে বৃষ্টির জল লাগায় ধীরে ধীরে পাক খুলিয়া ঝোপের বাহিরে আসিল। ক্ষণকাল স্থিরভাবে কুটিল অপলক চোখে হারুর দিকে চাহিয়া থাকিয়া তাহার দুই পায়ের মধ্যে দিয়াই বটগাছের কোটরে অদৃশ্য হইয়া গেল।

মানিকের ভাষারীতি দরকারে দার্শনিকতা প্রকাশ করে এবং তাকে খুব সস্তা দার্শনিকতা বলা চলে না। নিজের অভিজ্ঞতার উপরেই তিনি নির্ভর করেন বেশি। প্রকৃতির দিকে, নিভৃতি ও গূঢ়তার ভিতরে সহজে সরাসরি তাঁর চোখ চলে গেলেও দৃষ্টিটা তার শেষ পর্যন্ত স্থির হয় সমাজে, মানুষের মধ্যে এসে। ‘পদ্মানদীর মাঝি’-তে সমাজ ব্যক্তি মানুষ সবই আছে, তবে এসবের স্থাপনা প্রকৃতির পটভূমিতে, যে প্রকৃতি চালচিত্রও বটে, উপন্যাসের ভালোমন্দের সমস্ত ব্যাপারে অংশগ্রহণকারীও বটে। ফলে মানিকের ভাষা স্বচ্ছন্দ সাবলীল হয়ে উঠতে পারে সহজে। ভাবনায় উলটো পথে ধরে দার্শনিকতা আসে অনায়াসে। শান্ত নিরুচ্ছ্বাস বর্ণনা, মানুষগুলির নানাধরনের উল্টোপাল্টা মনোভাবের সম্পূর্ণ গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা, পক্ষ আর রগরগে ঘটনার অভাব সব মিলিয়ে পাঠকের মনকে উত্তেজিত বা বিচলিত হতে দেয় না; তা যেন জীবনের রাগ-অনুরাগ, ঘৃণা-বিদ্বেষ, কঠোর দারিদ্র্য, দুঃস্বপ্নের মরীচিকা, প্রচণ্ড আসক্তি আর তীব্র বিরাগ, জিভের উপর রেখে যাওয়া তিক্ত স্বাদ এসবের একটা বিশাল বৃত্ত তৈরি করে। এই বৃত্ত বড়ো হতে চায় কেবলই, জীবনের দিকে এগিয়ে আসা মরুভূমির মতো। ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’য় প্রকৃতি বাদ পড়তে শুরু করেছে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষার মধ্যে অস্থিরতা ঢুকছে একটু একটু করে। তীক্ষ শ্লেষ, তীব্র বিদ্রূপে পরিপূর্ণ হয়ে উঠছে তাঁর বাক্যগুলি। প্রেম আর তার ঠিক উলটোপিঠের কঠিন বিমুখতার প্রতিক্রিয়া অসুস্থ করে দিতে চাইছে পাঠকের মন। ইচ্ছামৃত্যুর মতো ভয়ানক আত্মবঞ্চনা প্রকৃতিকে দূরে সরিয়ে রাখছে বা প্রকৃতির ভিতরের শান্তিটুকুও নষ্ট করতে চাইছে; এসব ঘটছে, কারণ ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’য় সমাজ সামান্যই আছে, আছে আলাদা আলাদা ব্যক্তি। শশী সমাজের এতটুকু তোয়াক্কা করে না। এই যে প্রকৃতি থেকে ব্যক্তির দিকে ঝুঁকে পড়া, আরো পরে সমাজকে লেখার কেন্দ্রে নিয়ে আসা, এসবের ধীর বিবর্তন মানিকের নিজের মনের জগতেই ঘটতে থাকে, তা তাঁর ভাষারীতির উপর চাপ ফেললেও তার মূল বৈশিষ্ট্যগুলি কিন্তু অবিকৃতই থেকে যায়। ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’য় প্রকৃতি থেকে মানুষে যাবার প্রক্রিয়া বেশ চোখে পড়ে। শশীর বদ্ধ জগৎটার মধ্যে আমাদের ঢুকে পড়তে হয়। কুসুম-শশীর পরিণতিহীন আসক্তি কেবলই চারদিকে আগুনের ফুলকি ছিটোতে থাকে, বিন্দুর বিকৃতিতে ভরা জীবনের বর্ণনায় আমাদের নিশ্বাসের কষ্ট হয়, তবু থেকে যায় একটা তালপুকুর যার ‘গভীর কালো জলে হাঁস সাঁতার দেয়, তাদের গায়ে ঠেকিয়া লাল ও সাদা মেঘ আর বন্য কপোতের ঝাঁক। শালিখ পাখি উড়িবার সময় হঠাৎ শিস দেয়।…তালপুকুরের নির্জনতাকে সে (মতি) শুধু ভোগ করে গায়ে জড়ানো আঁচলটি কোমরে বাঁধিয়া।’ আর থেকে যায় মাটির টিলাটি যার ‘উপর সূর্যাস্ত দেখিবার শখ এ জীবনে আর একবারও শশীর আসিবে না।’ ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’র পর থেকেই প্রকৃতি ব্যক্তি দুই-ই যেন একটু পিছন দিকে সরে যায়। সামনে আসে সমাজ, সমাজের ভিতরে আটকে থাকা সামাজিক ব্যক্তি-মানুষ। সঙ্গে সঙ্গে মানিকের লেখায় আসতে থাকে কী যে বিরক্তি, কী যে বিবমিষা, অসুস্থতা বিকার! এখন শ্লেষ প্রকাশ করতে গিয়ে তাঁর চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে, দাঁত কড়মড় করার আওয়াজ পাওয়া যায়। চল্লিশের দশকের অনেক ছোটোগল্প, বেশ কিছু উপন্যাসের সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার ধাঁচ মানিকের জন্যে সান্ত¦না আনতে পারে কই। ‘চতুষ্কোণ’-এর রাজকুমার, ‘আরোগ্য’-র ড্রাইভার নায়ক অসুস্থ থাকে অকারণে। তারা জানে না কেন তাদের মাথা ধরে, কোন প্রচণ্ড যন্ত্রণায় কষ্ট পায় তারা। রাজকুমার নির্দোষ বিকারে বৈজ্ঞানিক গবেষণা করতে চায় যুবতী মেয়েদের উলঙ্গ চেহারার সঙ্গে তাদের মনের গড়নের কোনো সম্পর্ক আছে কি না দেখার জন্যে। মানিকের ক্যানভাস ছোটো হয়ে আসে, দৃষ্টির চৌহদ্দিও সঙ্কীর্ণ হয়ে পড়ে। এসব ঘটে বটে তাঁর নানা পর্যায়ের লেখার মধ্যে কিন্তু তাতে তাঁর ভাষা আর কলাকৌশলের মূল চেহারাটার তেমন বদল হয় না, এই ছাড়া যে তাঁর ভাষার শান্তভঙ্গিটি তিক্ততায়, বিরক্তিতে, আত্ম-বিশ্লে¬ষণে, অতি-বৈজ্ঞানিকতায় ক্লিষ্ট হয়ে যেতে থাকে। তাঁর লেখায় প্রতীকী চারিত্র্য বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনা হারায়। তবে তা শেষ পর্যন্ত মানিকেরই ভাষা থেকে যায় তাতে সন্দেহ নেই। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষারীতিকে তাঁর কঙ্কালের কাঠামোয় আনতে পারলে দেখা যাবে ‘দিবারাত্রির কাব্য’, ‘জননী’, ‘পদ্মানদীর মাঝি’, ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ বা এই একই কালপর্বের অসামান্য ছোটোগল্পগুলি যিনি লিখেছেন সেই একই লেখক ফিরতি-বিশ্বাস পাওয়া ‘শহরতলী’, ‘ইতিকথার পরের কথা’ ইত্যাদি উপন্যাস আর ‘আজ কাল পরশুর গল্প’গুলিও লিখেছেন, লিখেছেন ‘চতুষ্কোণ’, ‘আরোগ্য’র মতো উপন্যাস। এমন কি ভাঁটা-পড়া লেখকজীবনে যখন শুকিয়ে-ওঠা নুড়ি-পড়া খাতাটি মাত্র শূন্য পড়ে আছে তখনকার উপন্যাস ‘হলুদ নদী সবুজ বন’ ‘প্রাণেশ্বরের উপখ্যান’-ও এই একই লেখক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনা। ভাষার উপর জমে থাকা আবরণগুলিকে সরালেই সেটা চোখে পড়বে। পরিবর্তন ঘটেছে মানিকের বিশ্বাস, মতে, অবস্থায়, দৃষ্টিতে, দীক্ষায়Ñএই সবই প্রতিফলিত হচ্ছে তাঁর ভাষাভঙ্গিতে, প্রকাশরীতিতে।

মানিকের ভাষা শেষের দিকে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল এই মতের তেমন কোনো অর্থ নেই। আসলে আর তাঁর দেবার মতো কিছু ছিল না। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বাস্তবকে তিনি দেখেছেন, বাস্তব সম্বন্ধে নানাভাবে মনস্থির করেছেন। যত তিক্ততা, যত অবিশ্বাস, যত লোভ, যত আশা বা হতাশা, যত ঘৃণা বা ভালোবাসা, অনুভূতির যতরকম স্তর তাঁর পক্ষে ভাষায় ধরা সম্ভব ছিল তার সবই তিনি তাঁর বেশ সংক্ষিপ্ত ঊনপঞ্চাশ বছর বয়সের মধ্যেই খুব দ্রুত, অমানুষিক পরিশ্রমের ভিতর দিয়ে ধরে রেখে গেছেন। তার ভাষা মূলত বদলায় না বটে কিন্তু যখন আর তাঁর প্রায় কিছুই লেখার নেই তখন কি করতে পারতেন এই কলম-পেষা মজুর? তিরিশের দশকের ক্ষয়, শূন্যতা, ঘুণ, চল্লি¬শের দশকের বিশ্বযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, স্বাধীনতার জন্যে জাতীয় আন্দোলন ও সংগ্রাম, মানুষ জাতির জন্যে স্তালিনের রাশিয়ার বিরাট অর্জন এসব নিয়ে তো লেখা হয়ে গেছে। তারপরে ‘বিজয়শব্দে নয়, গোঙানির আওয়াজ’ করে এসেছে উপমহাদেশের স্বাধীনতা। মানিকের চোখের সামনে তখন বিধ্বস্ত পৃথিবী। ম্যাড়মেড়ে ভারতবর্ষে স্বাধীনতার আলো কুষ্ঠের ক্ষতের উপরে খেলা করছে। অসুস্থ, আশাশূন্য, মোহশূন্য মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সেই সময়ে কলমটাকে পেষা ছাড়া আর কি করতে পারতেন কে জানে। ভাষার মধ্যে কাজেই ফিরে আসে তাঁর সমস্ত মুদ্রাদোষ যা আগে চমৎকার মিশে গিয়েছিল রচনার সঙ্গে। কথাশূন্য, ফাঁপা উলটো-লজিক রাস্তায় ঘন ঘন স্পিডব্রেকারের মতো লেখাকে আটকে ধরে, বৈজ্ঞানিকতা তুচ্ছ বাগাড়ম্বরে দম-চাপা হয়ে মারা পড়ে। বিশ্লে¬ষণ গভীর যুক্তিজাল ছড়ানোর ভান করে, কিন্তু একপা এগোয় না। অপ্রত্যাশিত সিদ্ধান্ত উপহার দেবার প্রাণান্ত চেষ্টা কখনো করুণ, কখনো হাস্যকর হয়ে ওঠে। এমন কী বাক্যের সঙ্গে বাক্য জোড়া দেবার নিবিষ্টতা পর্যন্ত মানিক হারিয়ে ফেলেন। তাঁর এই সময়কালের লেখা পড়া কষ্টকর। লেখকমাত্রেরই ক্ষমতা সীমিত, ফুরিয়ে যেতে হয় সব লেখককেই, তবে বাস্তবকে বাদ দিয়ে যে লেখকের একপা এগোনোর ক্ষমতা নেই, বাস্তবকে দেখার নতুন চোখ আর না মিললে, উপলব্ধির সমস্ত সঞ্চয় পুরোপুরি শেষ হয়ে গেলে এমন কি তলানিটুকু পর্যন্ত শুকিয়ে গেলে একজন লেখকের জন্যে যা ঘটতে পারে, মানিকের জন্যে ঠিক তাই ঘটেছিল।
তিনি অসাধারণ লেখক ছিলেন। অসম্ভব রকম ব্যক্তি লেখক ছিলেন। অনন্যতা স্বকীয়তা তার পরিচয়ের অন্য নাম ছিল। সম্ভবত সেই কারণেই শেষ লেখাগুলিতে যখন আর তাঁর ঝুলিতে তেমন কিছু নেই, তাঁর ভাষারীতি এত শূন্য এত নিঃস্ব হয়ে উঠে।


[হাসান আজিজুল হকের নির্বাচিত প্রবন্ধ থেকে সংকলিত]

ভাষারীতি : মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন