শনিবার, ১৪ মার্চ, ২০১৫

শূন্যের গল্প, শূন্যের উড়াল

সমীর আহমেদ
সাহিত্য একটি চলমান প্রক্রিয়া। সময় বদলের সাথে সাথে যেমন বদলায় আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থা, জীবযাপনের ধরন, পরিবেশপরিস্থিতি তেমনি বদলে যায় সাহিত্যের লক্ষণ বা বৈশিষ্ট্যগুলোও। তবে ক্ষুদ্র সময়খ-ে এ পরিবর্তনগুলো চিহ্নিত করা কঠিন। এ কারণেই বোধহয় সাহিত্যবোদ্ধাগণ দশক বিবেচনায় এনেছেন।
কারণ একটি নির্দিষ্ট সময়ে সাহিত্যের গতিপ্রকৃতি বা লক্ষণ বা বৈশিষ্ট্যগুলো চিহ্নিত করার জন্যই দশকের হিসাবটা প্রয়োজন। ষাট বা সত্তরের দশকের সাহিত্যের সাথে নিশ্চয় আশির দশকের সাহিত্যের লক্ষণগুলো পুরোপুরি মেলানো যাবে না। মেলানো যাবে না আশির দশকের সাহিত্যের সাথে নব্বইয়ের দশকের সাহিত্যের লক্ষণগুলোও। তবে প্রত্যেকটি দশকই উত্তরকালের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। তাই যদি হয়, তাহলে শূন্য দশকের ভিত্তিকাল অবশ্যই নব্বইয়ের দশক। এ দশকদ্বয়ের সাহিত্যের গতিপ্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে খুব বেশি ব্যবধান চোখে পড়ে না। নব্বইয়ের দশকের সাহিত্যের গতিপ্রকৃতি যেসব দিকে ঝুঁকে পড়েছিল, শূন্য দশকের সাহিত্যে সেই লক্ষণগুলোই বিস্তৃত হয়েছে। কবিতায় হয়তো কিছু কিছু লক্ষণ যোগ হয়েছে। তবে ছোটগল্পের ক্ষেত্রে এ পরিবর্তন চোখে পড়ার মতো নয়। ব্যাপারটা আরেকটু খোলাসা করার জন্য নব্বইয়ের দশক থেকে শূন্য দশক পর্যন্ত আমাদের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ও প্রযুক্তিক পরিবর্তনের দিকে নজর দেওয়া যেতে পারে।
নব্বইয়ের দশক থেকে নগরায়ন-গতি বৃদ্ধি পেতে থাকে। বৃদ্ধি পেতে থাকে কর্পোরেট বাজারের আয়তনও। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, নতুন নতুন বৈজ্ঞানিব উদ্ভাবন এবং কর্পোরেট বাজারের কারণে বিচিত্র পণ্য ও সেবাকর্মের ক্রমবর্ধমান চাহিদার কাছে নতজানু আমরা। আজ নগরায়নের থাবা গ্রামকেও টেনে আনছে তার লালসার কাছে। কিংবা ছড়িয়ে দিচ্ছে তার লালসার লালা। ফলে নগর ও গ্রামের মানুষের মধ্যে আজ চাহিদার প্রভেদরেখা দ্রুতই সংকুচিত হচ্ছে। গ্রাম নির্ভর অর্থনীতি ও সমাজ-সংস্কৃতি ভেঙে মিশ্র অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও সমাজ-সংস্কৃতিতে রূপ নিচ্ছে। চারপাশের মানুষগুলো বদলে যাচ্ছে দ্রুত। মানুষের মনোজগৎ এখন জটিল, দ্বন্দ্বসংঘাতময়,  লোভ ও রিরংসাতাড়িত। কারণ তাদের জীবনের আশাআকাক্সক্ষা, স্বপ্ন, প্রেম, কামনাবাসনা, আনন্দ ও সুখশান্তি প্রতিনিয়ত গ্রাস করে নিচ্ছে বাজার অর্থনীতির বিশাল অজগর। এ কারণে নব্বই দশকের ছোটগল্পে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে অনেক বেশি জায়গা করে নিয়েছে ব্যক্তিক সংকট, অস্তিত্বরক্ষার লড়াই, দ্বন্দ্বময় জটিল মনোজগৎ, যা কেবলই বিচ্ছিন্নতাবোধ ও নৈঃসঙ্গ্যযাতনায় ভারাক্রান্ত। শূন্য দশকের ছোটগল্পেও এর ক্রমবিস্তৃতি  ঘটেছে।
কর্পোরেট বাজারের দৌরাত্ম্যে, অপরিকল্পিত বহুমুখি শিল্পায়নের ফলে কলকারখানার বর্জ্যে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। নগরায়ন গ্রাস করছে আবাদি জমি, সবুজ বনভূমি। মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে আমাদের পরিবেশ। সারা বিশ্বে আজ পরিবেশরক্ষার জোর আন্দোলন অব্যাহত। আমাদের ছোটগল্পেও পরিবেশবাদী চেতনা ধীরে ধীরে সঞ্চারিত হচ্ছে।
উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা বিশেষ করে স্যাটেলাইট টিভি, মোবাইল, ইন্টারনেট ব্যবস্থার সাথে নব্বইয়ের দশকেই আমাদের পরিচয় ঘটে। শূন্য দশকে এসে এগুলোর ব্যবহার মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুন। বিশ্ব আজ আমাদের হাতের মুঠোয়। নিজস্ব বৃত্ত ভেঙে এখন আমরা বিশ্বায়নের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছি। ব্যক্তি এখন নিজেকে বিশ্বায়নের আয়নায় পর্যবেক্ষণ করে, তার সমস্যা ও সংকট এবং সম্ভাবনা নিয়ে চিন্তাভাবনা করে। তবে বিশ্বায়ন যতো বিস্তৃত হচ্ছে, ততোই আমাদের কাছে যা কিছু এতোদিন সত্য ও সুন্দর বলে মনে হয়েছে, তা বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে, ধসে যাচ্ছে আমাদের ঐতহ্যি ও মূল্যবোধ। যোগাযোগ ব্যবস্থায় পরস্পরের কাছে এসেও আমরা বিচ্ছিন্ন, আত্মকেন্দ্রীক। নিতান্ত অসহায় ও অসুখী মানুষ। এসব মানুষই আরো বিচিত্ররূপে উঠে এসেছে শূন্য দশকের  ছোটগল্পে।
রাজাকার ও মৌলবাদ বিরোধী চেতনা নব্বইয়ের দশকে নতুন মাত্রা পায়। সাথে সাথে  ইসলামি জঙ্গিদের উত্থান, তাদের জঘণ্য মানবধ্বংসাত্মক কর্মকা-ে জানমালের নিরাপত্তাহীনতায় আতঙ্কিত হয়ে পড়ে জনগণ। জঙ্গিবাদবিরোধী চেতনা কারো কারো গল্পে উঠে এলেও তা যথেষ্ট নয়। তবে এই একবিংশ শতাব্দীতেও সমাজে বিদ্যমান মাজারপ্রীতি ও অন্ধ পীরবাদী ভক্তি-বিশ্বাস, ফতোবাজদের মানবতাবিরোধী কর্মকা- বিশেষ করে নারী নির্যাতনের নির্মম চিত্র, শিল্পম-িত ব্যঞ্জনায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে শূন্য দশকের কারো কারো গল্পে।
এছাড়া আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা শূন্য দশকের ছোটগল্পেও বিচিত্ররূপে উঠে এসেছে। আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, বিশ্বাস ও মূল্যবোধ শূন্য দশকের ছোটগল্পের ভূবনকে করেছে আরো বেশি সমৃদ্ধ।
সাতচলি¬শে দেশ বিভাজনের পর এদেশের সংখ্যালঘু হিন্দুদের অনেকেই ভারতে চলে যায়। অনুরূপ ভারত থেকেও অনেক মুসলমান এদেশে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকে। বাষট্টি সালে দাঙ্গার পর সংখ্যা লঘুদের সংখ্যা আরো কমে যায়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পাকসেনাদের অত্যাচারে এদের সংখ্যা আরো হ্রাস পায়। তারপরও যারা দেশপ্রেম ও নাড়ীর টানে এদেশে থেকে যান, তাদের ওপর সমাজের সম্পদলোভী স্বার্থান্বেষী মহল, সুযোগ পেলেই নির্যাতন চালিয়ে, এদেশ থেকে বিতাড়িত করে তাদের ঘরবাড়ি, জায়গাজমি দখল করার বিচিত্র পায়তারায় মেতে ওঠে। সংখ্যালঘু হিন্দুদের দুঃখবেদনা, স্বপ্নভঙ্গের যাতনা উঠে এসেছে শূন্য দশকের অনেকের গল্পে। চক্রান্তকারীদের মুখোশ উন্মোচনের পাশাপাশি, আপদকালে সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়ানোর মতো বিবেকবান মানুষের সাহসী ভূমিকাও চোখে পড়ে পাঠকের।
নব্বইয়ের দশকে উত্তরাধুনিক চেতনা বাংলাদেশের ছোটগল্পে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। যদিও তা পাশ্চাত্য থেকে আমদানি করা। তারপরও এই ধারণাকে মাথায় রেখে অনেকে ছোটগল্পচর্চা চালিয়েছেন। বাঁক বদল ঘটাতে চেয়েছেন নিজেদের সৃষ্টির গতিপথ। কতোটা সফল হয়েছেন তাঁরা, তা নিশ্চিত করে বলা না গেলেও সময় থেকে পিছিয়ে যে পড়েননি, সামনের দিকেই হেঁটেছেন, তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। তবে শূন্যের দশকে উত্তরাধুনিক আন্দোলন অনেকটাই ঝিমিয়ে পড়লেও অনেকেই এ ধারায় ছোটগল্প লেখার চেষ্টা করছেন এখনো।
ছোটগল্পে সাহিত্যতত্ত্বের প্রয়োগকৌশলের নতুন নতুন নিরীক্ষা যেমন নব্বইয়ের দশকে হয়েছে, তেমনি শূন্য দশকের কথাকারও বসে নেই। শূন্য দশকের অনেকের গল্পেই জাদুবাস্তবতা ও মনোলোগের প্রয়োগ লক্ষ্যযোগ্য হয়ে উঠেছে। এছাড়া চেতনার অন্তঃশীল প্রবাহ, স্যাটায়ার, অধি বাস্তবতা ইত্যাদি তো রয়েছেই।
নব্বইয়ের দশকের অধিকাংশ ছোটগাল্পিকগণ মাটিবর্তীর দিকে ঝুঁকে পড়েছিলেন। শূন্য দশকের ছোটগল্পের কথাকোবিতগণ এদিকে আরো বেশি মাত্রায় ঝুঁকে পড়েছেন। ভাষা প্রয়োগের ক্ষেত্রে তারা ক্রমশ প্রমিত রীতি ছেড়ে কথ্যরীতি বা মানুষের মুখের ভাষার দিকেই ঝুঁকে পড়েছেন। শুধু ছোটগল্পের ডায়লগ নির্মাণে নয়, আখ্যানের বয়নেও নিঃসংকোচে তাঁরা জায়গা করে দিয়েছেন লোকজ ভাষার। ফলে বিভিন্ন অঞ্চলের লোকজ ভাষার দাপুটে উপস্থিতি পাঠককে বিস্মিত ও চমৎকৃত করে।
শূন্য দশকরে গল্পের-এর আলে, আল থেকে জমিনে, একের পর আরেক নেমে যেতে পারি এবং দেখতে পারি তাঁদের চাষবাসের কলাকৌশল এবং উৎপাদিত ফসলের জৌলুস। আর এ প্রসঙ্গে আমরা দুটি সম্পাদিত গল্পসংকলন, যথাক্রমে ‘শূন্যের গল্প : শূন্য দশকের নির্বাচিত গল্প’ (২০১১) ও শূন্যদশকের গল্প : গল্পপঞ্চাশৎ’ (২০১৩) সামনে রাখতে পারি। প্রথম গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে ‘ত্রৈবিদ্য প্রকাশ’ থেকে। সম্পাদনা করেছেন শূন্যদশকের বিশিষ্ট কবি ও কথাশিল্পী লতিফ জোয়ার্দ্দার। দ্বিতীয়টি ‘ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ’ থেকে; সম্পাদক শূন্যদশকের অন্যতম কথাকোবিত, গবেষক ও প্রাবন্ধিক চন্দন আনোয়ার। এছাড়াও গতিধারা থেকে প্রকাশিত হয়ছে আরেকটি গল্পসংকলনÑ  ‘এই সময়ের নির্বাচিত গল্প তৃতীয় খ-’।  সম্পাদক মোহাম্মদ আবদুল মান্নান ও রাশেদ রহমান। তবে শেষোক্তটি, যেহেতু সম্পূর্ণ শূন্যদশকের নয়, শিরোনামও সেরকম কিছু দাবি করে নাÑ প্রকৃতপক্ষে সংকলনটি প্রথম ও দ্বিতীয় দশকের গল্পের একটি সংমিশ্রিত রূপ, সেহেতু এই সংকলনটি আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত হবে না। অন্তর্ভুক্ত না হলেও যে খুব বেশি ক্ষতি হবে, তা নয়, কারণ শূন্যদশকের প্রায় সকল গল্পকারের গল্পই পূর্বোক্ত দুটি সংকলনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। আবার অনেক গল্পকার আছেন, পূর্বোক্ত দুটি বা তিনটি সংকলনেই তাঁদের গল্প মুদ্রিত হয়েছে। এ নিবন্ধ সংক্ষিপ্ত রাখার স্বার্থে একজনের একাধিক গল্প আলোচনা করা হবে না। প্রথম সংকলনে প্রত্যেকের গল্প এবং এ সংকলনে যাদের বাদ পড়ে দ্বিতীয় সংকলনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, তাঁদের গল্প নিতান্তই ছোট্ট পরিসরে আলোচনা করা হবে।
লতিফ জোয়ার্দ্দার সম্পাদিত শূন্যদশকের প্রথম গল্পসংকলনের প্রথম গল্পÑ নদীভাঙা, নিঃস্ব মানুষের যন্ত্রণাপীড়িত উপাখ্যান ‘কাল উৎসব হবে’। এ গল্পের কারিগর অভীক সোবহান (১৯৭৫- )। মূলত কবি। ছোটকাগজ ‘দ’ সম্পাদনা করেন। মাঝে মাঝে গল্পও লিখেন। তবে বেশি না, অল্পই বলা যায়। ‘কাল উৎসব হবে’ গল্পের নায়ক প্রায় সত্তর বছর বয়স্ক মুক্তিযোদ্ধা মইনু মিয়া। নদী ভাঙনে সব কিছু হারিয়ে নিঃস্ব সে। জীবন ও জীবিকার তাগিদে প্রিয়জন ছেড়ে বৃদ্ধ বয়সেও ঢাকা এসেছেন রিকশা চালাতে। ঘটনাক্রমে তার সাথে পরিচয় হয় কলেজ শিক্ষক সংকরের। একজন মইনুর গল্প বলতে গিয়ে ঢাকা শহরের কলুষিত রূপ, অন্তসারশূন্যতা, সন্ত্রাস ও রূঢ় বাস্তবতার জীবনচিত্র আঁকার প্রয়াস চালিয়েছেন তিনি। শহরের এসব তিক্ত অভিজ্ঞার স্বাদ গ্রহণের পর গল্পকার তাঁকে ফিরিয়ে নিয়ে গেছেন গ্রামে। পুনর্বাসনের সাহায্যসহ মোট হাজার বার শ টাকা তাঁর পকেটে। তাতে কী? অনেকদিনপর নাতি-নাতনিদের সাথে দেখা হওয়াটাই বৃদ্ধ মুক্তিযোদ্ধা মইনু মিয়ার কাছে উৎসবের মতো। গল্পে অপ্রয়োজনীয় বিষয় যেমন উঠে এসেছে, তেমনি প্রয়োজনীয় বিষয়ও কিছুটা বাদ পড়েছে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গল্পটি মুক্তিযোদ্ধা মইনু মিয়া কেন্দ্রিক হলে ভালো হতো।
অরণ্য প্রভার (১৯৭০- ) পেশা সাংবাদিকতা। সাহিত্যের ছোট কাগজ ‘পু-্র’ সম্পাদনা করেন। ২০০৮ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থÑ ‘পঞ্চমী তৎপুরুষ’। তাঁর গল্পে নি¤œবর্গীয় মানুষের জীবনচিত্র লক্ষ্যযোগ্য হয়ে ওঠে। ‘চাতাল’ নিম্নবর্গ মানুষের গল্প। পরীবানু, রিকশাচালক আরমান আর তাদের শিশু কন্যা ফুলবানুকে নিয়ে গড়ে উঠেছে এ গল্পের আখ্যান। মাতৃত্বই এই গল্পের প্রধান বিষয়। পরীবানুর কন্যা সন্তান হওয়ায় তাকে পছন্দ করে না আরমান। পরীবানুর আশঙ্কা স্বামী তার নাড়ীছেঁড়া ধন ফুলকে গলা টিপে মেরে ফেলবে। এ কারণে একদিন সকালে সে আরমানের সংসার থেকে পালিয়ে আশ্রয় নেয় দূরে এক ধানের চাতালে। একরাতে ম্যানেজার তাকে প্রলুব্ধ করে দেহব্যবসায় নামায়। মাঝে মাঝে আরমানের পরিচিত বড়ো সাহেব তার রিকশায় চাতালে ফুলবানুর কাছে আসাযাওয়া করে। একদিন বড়ো সাহেবও তাকে চাতালে পাঠায়। ঘরে ঢুকে কন্যার মুখ দেখে সে বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। গল্পে শেষের দিকে অতি নাটকীয়তা হোচট খেতে হয় পাঠককে। গল্পের গাঁথুনীতে পরিপক্কতার ছাপ নেই। দ্বিতীয় প্যারা থেকেও গল্পটি শুরু হতে পারতো। শব্দ চয়নেও সমস্যা আছে। তারপরও গল্পটির দু’ একটি দৃশ্যে পাঠকের চোখ আঁটকে যায়। যেমন, ‘শিশুটি কাঁদতে কাঁদতে লাল হয়ে গেলেও মাঝে মাঝে ঠোঁটে লেগে থাকা দুধের প্রলেপ চুক চুক করে চাটতে চাটতে আবোরো তীব্র কান্নায় মেতে ওঠে।’ এতেই বোঝা অরণ্যর লেখার ক্ষমতা আছে। তবে প্রয়োজন শুধু কৌশলটি রপ্ত করা।
আহমদ জসিমের (১৯৭৭- ) জন্ম চট্টগ্রামে। তাঁর গল্পগ্রন্থের নামÑ ‘যে ভাবে তৈরি হলো একটি নীড়’। সময়কে দৃষ্টিকোণে ধারণ করে পরিমাপ করেন তার গভীরতা। মনোজগত উন্মোচনের কারিগর। ‘রহিম-বাদশার টি স্টল’ গল্পে ভ- মুছুল¬ী রহিমের মুখোশের আড়ালে প্রকৃত ব্যবসায়ীর রূপটি উন্মোচন করেছেন আহমদ জসীম। মুখোমুখি দুটি হোটেল। একটি মালিক রহিম। আরেকটি বাদশার। বাদশার দোকানে ডিশ লাইন নেই। রহিমের হোটেলে ডিশ লাইনে হিন্দি ছবি দেখার জন্য কাস্টমাররা এসে ভিড় করে। বাদশার বিক্রিবাট্টা লাটে ওঠে। রমরমা ব্যবসায় রহিম ধার্মিক হবার ভাণ করে। নামাজ-রোজা করার জন্য স্ত্রী-কন্যার ওপর সে চাপ সৃষ্টি করে। বাসায় টিভি নেই তার। নিজে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়লেও হোটেলে সে কাস্টমারদের সাথে হিন্দি ফিল্ম দেখে। একদিন হঠাৎ, হয়তো হতাশায় মারা যায় বাদশা। সংসার চালানোর জন্য বাদশার বিধবা সুন্দরী স্ত্রী আর তার যৌবতবতী কন্যা খাবার হোটেলের ব্যবসা শুরু করে। রক্তমাংসের সুন্দরী রমণী দেখোর জন্য চতুর কাস্টমাররা বাদশার হোটেলে ভিড় করে। তা দেখে রহিম মিয়ার মাথা খারাপ হবার উপক্রম। ব্যবসা ধরে রাখার জন্য সে-ও তার স্ত্রী-কন্যাকে একটু খোলামেলা পোশাক পরে হোটেলে গিয়ে বসতে বললে তাদের টাসকি লেগে যায়। আহমদ জসীমের লেখনির ধার আছে। চরিত্রের সাথে সামঞ্জস্য পারপার্শ্বিক অবস্থা বা বাস্তবতা তিনি নিপুণভাবে তুলে ধরার ক্ষমতা রাখেন। তারপরও ‘রহিম-বাদশার টি স্টল’ তার নিবিড় পরিচর্যার দাবি রাখে। 
আহমেদ ফিরোজ (১৯৭৬- ) একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক ও সম্পাদক। মনোলোগ ফর্মুলায় অনেক গল্পে তিনি আধুনিক মানুষের জটিল মনস্তত্ত্ব, বিচ্ছিন্নতাবোধ, নৈঃসঙ্গ্যযন্ত্রণা ও অস্তিত্বসংকট নির্মোহভাবে তুলে ধরেন। বিভিন্ন শব্দকে ভেঙেচুরে বা যোজন করে আরেকটি নতুন শব্দ তৈরি করার চেষ্টা করেন। এতে শব্দের আয়তন অনেক সময় দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে থাকে। ২০০৫ সালে তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থÑ ‘দি লাইট অফ ডেড নাইট’ প্রকাশিত হয়। তারপর আর কোনো গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি। ‘ঘর’ একটি পরিবারের গল্প। মা হারা তিনটি মেয়ে বাবার আদরে বেড়ে ওঠে। মাঝে মতিবিভ্রমের কারণে বাবা বড়ো মেয়ের বান্ধবী এষাকে বিয়ে করতে গিয়ে ফিরে আসে। ঘটনাক্রমে দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়। ছোট মেয়েটিই গল্পের কথক। সে বাবার সাথে থাকে। বাবা নিঃসঙ্গ। ছোট মেয়েটিও। সমাজে তারা একঘরে। মাস্তানরা বাড়িটি দখল করার জন্য আসে। ‘ঘর’ রক্ষার জন্য কথক স্বেচ্ছায় তাদের লালসার শিকার হয়। গল্পটিতে হাসান আজিজুল হকের ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ এর ছায়া থাকলেও গল্পবয়নের ক্ষেত্রে কথাশিল্পী হিসেবে ফিরোজের ক্ষমতাই প্রধান হয়ে ওঠে।
আবু তাহের সরফরাজ (১৯৮৩-)। কবিতা ও গল্প লিখেন। তাঁর গল্পে মানুষের মনোদৈহিক জটিলগ্রন্থি খুলে যায়। ‘যখন আঁধার যখন কুয়াশা’ গল্পটি আয়তনে আরো ছোট। মাত্র দেড় পৃষ্ঠার কিংবা তার চেয়ে একটু বড়ো। এর মধ্যেই পোনা মাছের ঝাকের মতো গল্প জমিয়ে তুলেছেন আবু তাহের সরফরাজ। একটি মানসিক প্রতিবন্ধি যৌবনবতী মেয়ের সম্ভোগের গল্প বলেছেন তিনি। তবে তা-ও শেষপর্যন্ত বোঝা গেল মনোদৈহিক চেতনা থেকে উদ্ভূত। তবে যথাস্থানে বিরামেিচহ্নর ব্যবহার না থাকায় পড়তে গিয়ে কিছুটা সমস্যার সৃষ্টি হয়।
ঈশান সামীর (১৯৮১- ) পেশা, সরকারি চাকরি। কবিতা ও গল্প লিখেন। সম্পাদনা করেন ছোট কাগজ, ‘অভিজন’। নিরীক্ষার চেয়ে উপাখ্যান বয়নের দিকেই তিনি নজর দেন বেশি। ‘টুনু’ গল্পে চালিতাডাঙ্গা গ্রামের জনপ্রতিনিধি ভ-, প্রতারক ও লোভী চেয়ারম্যনের মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে। রাতের আঁধারে প্রশান্তর স্ত্রীর ওপর পাশবিক নির্যাতন করে, তাদের ভিটামাটি ছাড়া করে তা গ্রাসের পায়তারা করছিল চেয়ারম্যান। তার পাগলাটে কামলা  টুনুর হাতেই সে ধরা পড়ে। চেয়ারম্যানের কাকুতি মিনতিতে ঘটনাটা সে হয়তো চেপেই যেত। কিন্তু চেয়ারম্যান শালিস ডেকে তার প্রতিপক্ষ মোবারককে দোষী সাব্যস্ত করার চেষ্টা করলে টুনুর বদৌলতে তা ফাঁস হয়ে যায়। গল্পটি ভালোই হয়েছে। তবে গল্পটি অন্যদিকেও মোড় নিতে পারতো। আর গল্পের মাঝখানে টুনুর হাতে ধৃত চেয়ারম্যানকে আরেকটু আড়ালে রাখতে পারলে ভালো হতো।
‘ভগ্নাংশ’ গল্পে চালচুলোহীন, বেকার এক তরুণ সাহিত্যিকের অপূর্ণ, অতৃপ্ত, টানাপোড়েন জীবনের মর্মন্তুদ গল্প ফেঁদেছেন এমদাদ রহমান। গল্পটির শেষের দিকে আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘আমার কণ্ঠস্বর’ এ বোহেমিয়ান কবি নির্মলেন্দু গুণ ও আবুল হাসানের হোটেলে ফাও খাওয়ার কথা মনে পড়ে যায়। দৃশ্যের পর দৃশ্যে এমদাদ শুধু অস্বস্তিকর ঢাকা শহরের নয়, বাংলাদেশেরই জীবন ও সমাজবাস্তবতা তুলে ধরেছেন। 
কথাকোবিত কবীর রানা (১৯৬৮- ) সরকারি কলেজে অধ্যাপনা করেন। ছোট কাগজ ‘নিজকল্পা’র সম্পাদক। এ পর্যন্ত তাঁর দুটি গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে, যথাÑ ‘জল আসে মানুষের দীঘিতে’ (২০১২) ও ‘মানচিত্রকর’ (২০১৪)। শূন্য দশকের নিরীক্ষা প্রবণ ছোটগল্পের অন্যতম কারিগর তিনি। তাঁর গল্পবয়নকৌশল এবং নির্মেদ ভাষাশৈলীর মধ্যে স্বতন্ত্র এক কণ্ঠস্বর ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত। আমাদের চারপাশের চেনাজানা বাস্তবতা এবং ব্যক্তির মনোজগতের প্রতীকী রূপায়ন ঘটে তাঁর ছোটগল্পে। ভিন্ন স্বাদ এবং স্টাইলে তা পাঠকের সামনে উপস্থাপিত হয়। ‘মানচিত্রকর’ গ্রন্থে তাঁর নিরীক্ষাপ্রবণতা অধিক মাত্রায় লক্ষ্যযোগ্য হয়ে ওঠে। অনেকটা কাব্যিক ভাষায় প্রতীকীরূপে সৃষ্টিউন্মাদ মানুষের গল্প বুনেছেন তিনি ‘জল আসে মানুষের দীঘিতে’। শিক্ষাসফরে পুরাকীর্তি দেখতে গিয়ে গল্পকার এবং তাঁর বন্ধু বার্কি দু’জনেই হারিয়ে যান অতীতে। ইতিহাসে অবগাহন করার পরই তাঁদের মনে জলরোলের শব্দ শুনতে পান বা কোনো কিছু সৃষ্টির উল¬াস অনুভব করেন।
চন্দন চৌধুরী (১৯৭৫- )  সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত। কবিতা ও গল্প লিখেন। ‘আয়নাপাথর’ তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ। ছোটদের জন্যও তিনি গল্প লিখেন। ‘গোল্ড ফিস ও একটি প্রজাপতি’, ‘শহর জুড়ে বাঘ ভালুকের মিছিল’, ‘দুষ্টরা দশ মিনিট আগে’, ‘হ্যালো ফড়িংমিয়া’ ইত্যাদি তাঁর শিশুতোষ গল্পগ্রন্থ। তাঁর ভাষা গতিশীল। জাদুবাস্তবতার মোড়কে ‘মানুষ ও ছায়া’ গল্পে চন্দন চৌধুরী নিম্নবর্গীয় মতির বাবা কনু মিয়ার মনস্তুাত্ত্বিক সংকট মুড়িয়েছেন। গল্পকার কিছু স্পষ্ট করে না বললেও আমরা বুঝতে পারি পাশের বাড়ির বিলকিসের মার সাথে কনুর অবৈধ প্রণয় ছিল। তাদের প্রণয়ের ফসল বিলকিস। একারণেই বিলকিসের সাথে মতির প্রেম ও সম্ভোগবার্তা অলৌকিকভাবে জানার পর কনুর মাথা খারাপ হয়ে যায়। সে মতির ভালোবাসার মানুষ বিলকিসের পোয়াতি কুকুর ঘরে আবদ্ধ করে হত্যা করে। তারপরই তার থেকে অশুভ ছায়া সরে যেতে দেখে মতির মা। কুকুর এখানে ভালোবাসা ও অমঙ্গলের প্রতীক হয়ে উঠেছে। গল্পটির বয়নও চমৎকার।
জাহেদ মোতালেবের (১৯৭৪- ) প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ দুটিÑ ‘লা লা পা পা’ (২০০৯) ও ‘খেলাবুড়া’ (২০১২)। মানবমনের অলিগলির অনুসন্ধান করেন তিনি। ‘রানার’ গল্পে কিশোর আজগরের অন্তর্দ্বন্দ্ব বা মনস্তুাত্ত্বিক সংঘাত ফুটে উঠেছে। রানার যেমন মানুষের চিঠিপত্র, পার্শ্বেল নিয়ে দিন নেই, রাত নেই ছোটে। কিশোর আজগরও মদ্যপ বাবার অবৈধ ব্যবসায়িক পণ্য মদের প্যাকেট নিয়ে রাতের আঁধারে বাড়ির দিকে ছোটে। সকাল বিকালে সে সেগুলো পৌছে দেয় বাবার নির্দেশিত জায়গায়। একাজটাকে সে মনে মনে ঘৃণা করে খুব। কিন্তু বাবা মালেকের মারের ডরে তা না করেও পারে না। দুঃসহ স্মৃতি ও স্বপ্ন দেখতে দেখতে রাতের আঁধারে বাড়ি ফেরার সময় আছাড় খেয়ে সে পড়ে গেলে স্যালাইনের একটা প্যাকেট ছিঁড়ে মদ কিছুটা পড়ে যায়। বাবার ডরে পুকুর থেকে অর্ধেক জল মিশিয়ে সে প্যাকেটটা আবার পূরণ করে। তারপর বোঝাটা কাঁধে তুলে হাঁটা শুরু করে। তারপরই গল্পকারের বিরাচিহ্নহীন উক্তিÑ ‘জয়ী হও’। এতো এতো জঞ্জালের মধ্যে একটু আবর্জনা সরিয়ে কি আদৌ জয়ী হওয়া যায়? মনে হলো চলন্ত কোনো গাড়িকে হঠাৎ থামিয়ে দেয়া হলো। আরেকটু সামনে এগিয়ে যাওয়া কি সম্ভব হতো না জাহেদ মোতালেবের? ছোট ছোট বাক্যে পারপিার্শ্বিক দৃশ্যও চমৎকার এঁকেছেন তিনি। তাঁর ভাষা তো এতো তাড়াতাড়ি থামবার নয়।
২০০৬ সালে ঐতিহ্য থেকে প্রকাশিত হয় তৌহিন হাসানের (১৯৭৭- ) প্রথম গল্পগ্রন্থÑ ‘রাষ্ট্রের ঘুনপোকা ও বিবিধ ঝিঁ ঝিঁ’। মূলত চিত্রশিল্পী তৌহিন। গল্পও তাঁর হাতে ভালো আসে। চিত্রকর্ম ও গল্পে তিনি ফুটিয়ে তোলেন আধুনিক মানুষের জীবনচেতনা ও নৈঃসঙ্গ্যযাতনা। ‘গণিত মাস্টার’ গল্পই তার প্রমাণ। ‘ভাঙবে কিন্তু মচকাবে না’ জীবনে হার না মানা এমনই এক নির্লোভী গণিত শিক্ষক হরিনাথ বাবুর গল্প ‘গণিত মাস্টার’। তিনি যেমন ভালো শিক্ষক, তেমনি ভালো দাবারুও। তার বাবাও ভালো দাবারু ছিলেন। জমিদার শশীনারায়ণ রায় তার কাছে পরাজিত হতেন। জীবনে দাবা খেলায় শুধু একবার জিততে চেয়েছিলেন তিনি। লোভও দেখিয়েছিলেন অনেক। কিন্তু হরিণাথ বাবুর বাবা রাজি হননি। শেষপর্যন্ত জমিদার ক্রুদ্ধ হয়ে তাকে হত্যা করেন। তারই তো জেলে হরিণাথ মাস্টার! ভালো শিক্ষক হওয়া সত্বেও প্রাইভেট পড়ান না, কোচিং-এ ক্লাশ নেন না। ফলে দারিদ্র্য তার সংসারে আসন গেঁড়ে বসেছে। স্ত্রী অসুস্থ। বড়ো মেয়ে স্বামী পরিত্যক্তা। ছোট মেয়ে টাকার জন্য পাড়ার তরুণ ছেলেদের সাথে অবাধে মেলামেশা করে। একমাত্র ছেলে বখাটে, নেশাখোর। চাহিদা মতো টাকা না পেয়ে অকথ্য গালিগালাজ ও বাড়ির জিনিশপত্র ভাঙচুর করে। এসব দেখেও না দেখার ভাণ করে সে পড়ে থাকে দাবা নিয়ে। এজন্য মাঝে মাঝে ছেলে বিধু তাকে খুনও করতে চায়। সমাজসংসারে হরিনাথ মাস্টারের কোনো মূল্য নেই, সম্মান নেই। একদিন জমিদার শশীনারায়ণের পোড়ো বাড়িতে পাওয়া গেল তার লাশ। মাথাটা থেতলানো। তার মানে হয়তো সে বিধুর হাতেই খুন হয়েছে। কিন্তু এই বিষয়টাই তৌহিন এনেছেন জাদুবাস্তবতার মাধ্যমে। তাঁর গদ্যশৈলী নদীর স্রোতের মতো, পাঠককে ভাসিয়ে নিয়ে যায়।
তুহিন দাস (১৯৮৩- ) কবিতা ও গল্প লিখেন। তবে কবিতার দিকেই তাঁর ঝোঁক বেশি। সম্পাদনা করেন ছোট কাগজ। ‘নিদ্রাপরী’ গল্পে তিনি বৃদ্ধাশ্রমে একজন দুর্ভাগ্যতাড়িত বৃদ্ধের জীবনযাতনা চিত্রিত করেছেন। বৃদ্ধাশ্রমে যারা বাস করেন, তাদের প্রত্যেকের জীবনেই রয়েছে বেদনাঘন গল্প। সুখের স্মৃতিও রয়েছে কারো কারো। তুহিন দাস নস্টালজিক মোহে আক্রান্ত এক ঘুমকাতরে বুড়োর গল্প বাস্তবতার রূঢ় সূচে বেদনার সুতো দিয়ে যেন সেলাই করেছেন। তবে গল্পটি  হঠাৎ থেমে গেছে। বাকি অংশ পাওয়া গেল ৮২ পৃষ্ঠায়। এ ত্রুটি সম্পাদকের চোখে কেন ধরা পড়লো না, বিস্ময়ের ব্যাপার।
নুরুননবী শান্ত (১৯৭১- ) একটি বেসরকারি সংস্থায় শিক্ষা উন্নয়ন কর্মী। প্রকাশিত গল্পসংকলন দুটিÑ ‘গ্রামে প্রচলিত গল্প’ (২০০৯) ও ‘রাস্তা’ (২০১১)। প্রান্তিক মানুষের জীবনচেতনা ও অস্তিত্বসংকট রূপায়িত হয় তাঁর ছোটগল্পে।‘চটেভদ্র তারাজুল’ আমাদের এই সমাজ-বাস্তবতারই প্রতিচ্ছবি। নির্মোহদৃষ্টিতে নিম্নবর্গীয় মানুষ তারাজুলের বেদনাময়, ব্যঙ্গাত্মক ও কৌতুককর চরিত্রটি চিত্রিত করেছেন তিনি। গল্পটির উপস্থাপনকৌশলও চমৎকার। ভূমিকা বা তৃতীয় বন্দনীর পর গল্পের প্রধান চরিত্র তারাজুলের ওপরই ছেড়ে দিয়েছেন কথকের দায়ভার।
প্রান্তিক অরণ্যের (১৯৮১- ) গল্পে আমাদের প্রান্তিক জনপদ, সমাজ ও রাজনীতি উঠে আসে। ‘করাতকল’ গল্পটি আমাদের দেশে বিদ্যমান রাজনীতির রূপক বা প্রতীক হয়ে উঠেছে। ‘রাজায় রাজায় লড়াই হয়, উলুখাগড়ার প্রাণ যায়’ এই প্রবাদেরই প্রতিধ্বনি যেন শুনতে পাই তার গল্পে। রেলওয়ের জমিতে গড়ে উঠা সমস্যাবহুল বস্তির সুখি দম্পত্তি মজিদ-সোহাগী। মজিদ রিকশা চালায়। সামান্য আয়। তা দিয়ে ভাত-ভর্তা, ডালভাজি খেয়ে, বস্তির ভাঙাচুরা ভাড়াঘরে থেকেও তারা সুখি। কিন্তু মাঝে মাঝে হরতালের কারণে রিকশা চালানো বন্ধ হলে তাদের সুখের ঘরে অভাবের ডঙ্কা বেজে ওঠে। তখন মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে ওঠে মজিদের। কোনো কিছু ভালো লাগে না তার। হরতালের পর এমনি একদিন না খেয়ে রিকশা চালাতে গিয়ে তারই মতো আরেকজনের সাথে রাজনীতি বা হরতাল বিরোধী বাগবিত-ায় লিপ্ত হলে মার খেয়ে বাসার দিকে রওয়ানা হয় সে। এদেশে রাজনীতি নামক করাতকল চিরকালই ইচ্ছেমতো কাঠরূপী মজিদদের চিড়েফেঁড়ে ফেলে। 
প্রবীর পাল (১৯৭২- ) গণিতে ¯œাতকোত্তর হলেও চলচ্চিত্র আন্দোলন ও গল্পলেখার সাথে যুক্ত। তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘গরহাটবার’ প্রকাশিত হয়েছে ২০১৩ সালে। আমাদের সমাজের অন্ধকার, কুসংস্কার ও নিষ্ঠুরতা তুলে ধরতে তাঁর মুনশিয়ানা রয়েছে। ‘মাছের প্রতিবেশী’ গল্পটি অন্য গল্পের তুলনায় বেশ বড়োই বলতে হবে। গল্পের প্রধান চরিত্র কালিপদ। নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোই যার প্রধান কাজ। পুকুরে মাছ ধরার নিরব প্রতিযোগিতায় নিধুবাবুকে হটিয়ে সে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এরপর নিত্যানন্দ বাবু তার কাছে মাছ ধরার বিশেষ কলাকৌশল শিখতে চায়। কিন্তু কালিপদর কাছে এধরনের কোনো তন্ত্রমন্ত্র নেই। নিত্যানন্দবাবু তা বিশ্বাস করে না। এর পরই খুন হয় কালিপদ। আর সেই খুনটা যে নিত্যানন্দ বাবুই করেছে, তা বোঝা যায়। এরপর ভূতরূপে কালিপদর আবির্ভাব হলে, তার ডরে সবাই কুপোকাত হতে থাকে। গল্পটিতে জাদু বাস্তবতার প্রয়োগ ঘটিয়েছেন প্রবীর।
ফজলুল কবিরীর (১৯৮১- ) গল্পগ্রন্থÑ ‘মগজের নাটাই’। শুধু মানুষের মনোজগতই উন্মোচন করেন না কবিরী। সমাজ ও ধর্মের অধঃপতিত রূপটিও তুলে আনেন গল্পে। তাঁর গল্পবয়নকৌশল চমৎকার। অনেকটা হ্যামিলনের বাঁশিঅলার মতো ঘটনা, জঙ্গিবাদীরা ধর্মের মন্ত্রে হিপটোনাইজ করে যেভাবে আমাদের তরুণ সমাজকে বিপথগামী করে মানবধ্বংসাত্মক কাজে লাগায় বা জঙ্গি হিসেবে গড়ে তোলে, তা-ই ফজলুল কাবিরী প্রতীকীরূপে তুলে ধরেছেন তাঁর ‘বারুদের মুখোশ’ গল্পে।
ফারুক আহমেদের (১৯৭৯- ) পেশা সাংবাদিকতা। তবে গল্পবয়নেও তিনি সিদ্ধহস্ত। প্রথম গল্পসংকলন  ‘বাস্তবতা দোলানো মুখ’ । এছাড়াও শিশুদের জন্য রয়েছে একটি গল্পগ্রন্থÑ‘গল্পগুলো সবুজ’ (২০১০)। গল্পকে প্রতীকী করার একটা চেষ্টা ফারুকের মধ্যে বিদ্যমান। জাদুবাস্তবতার দিকেও তাঁর ঝোঁক আছে। দৃশ্যের পর দৃশ্য তিনি বুনে যান অবলীলায়। তাঁর গল্প শেষপর্যন্ত আমাদের আশাকে প্রজ্জ্বলিত করে তোলে। ‘অন্ধকারের উপর আলো আছে?’ গল্পটি তাঁর উজ্জ্বল স্বাক্ষর। আমরা জানি, ঝড়ের পরই নিরবতা, অন্ধকারের পরই থাকে আলো। ম্যানহোলের অন্ধকার গহ্বরে জীবনমৃত্যুর দোলাচলে শেষপর্যন্ত মুক্তির প্রত্যাশাই জেগে উঠেছে এ গল্পে। বন্ধুকে এগিয়ে দিতে গিয়ে ফেরার পথে দু®কৃতকারীরা আদনানকে ফেলে দেয় ম্যানহোলের ভয়ানক গহ্বরে। রাতের আঁধারে, মাথার ওপর গাড়ির গর্জন, সন্ত্রাসীদের হত্যাযজ্ঞ চলতে থাকে। আদনান উপরে উঠে আসার সাহায্যের জন্য চিৎকার করে। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসে না। ভয়ঙ্কর তিক্ত অভিজ্ঞতার পরও শেষপর্যন্ত তার প্রত্যাশা বেঁচে থাকার। আদনান যেন আমাদের এই অধঃপতিত সমাজেরই একজন। সন্ত্রাসীরা এ সমাজের শাসকের প্রতীক। তারা আমাদের নিক্ষেপ করেছে ম্যানহোলের ওই অন্ধকার গহ্বরে।
ফেরদৌস মাহমুদের (১৯৭৭- ) পেশা সাংবাদিকতা। মূলত কবি। তবে মাঝে মাঝে গল্পও লিখেন। মার্কেজীয় জাদুবাস্তবতার কৌশল প্রয়োগ করে দুর্দান্ত ভাষাস্রোতে পাঠককে ভাসিয়ে নেবার ক্ষমতা আছে তাঁর। ‘মোরগ, নদী, প্রেম ও অপ্রেমের গল্প’-এর উজ্জ্বল স্বাক্ষর। গল্পের শিরোনামে যদিও তিনি ‘অপ্রেমের’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন, তবে শেষপর্যন্ত তা আর ‘অপ্রেমের’ থাকেনি। হয়ে উঠেছে দুজন মানবমানবীর নিটোল প্রেমের গল্প। তবে উপস্থাপনকৌশলে ফেরদৌস এতোটাই চতুর যে পাঠক সচেতন না হলে ধরতেই পারবে না এটা একটা প্রেমের গল্প।
বদরুন নাহার (১৯৭৭- ) ছোটকাগজ ‘শূন্যপুরাণ’ সম্পাদনা করেন। শিশুতোষসহ প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ পাঁচের অধিক। ‘গল্পগুলো ব-দ্বীপের’ (২০০৬), ‘ঢেন্টনপা’র দেশে’ (২০০৮, ‘এই নামের ট-এর মাত্রা পড়ে যাবে, মূলত ঢ-এর সঙ্গে ণ হবে), ‘ভাতগল্প’ (২০১১), শিশুতোষ গল্পগ্রন্থÑ ‘ককরোজ-নকরোজ’ (২০১২)।  গল্প পড়লেই বোঝা যায়, মোটামুটি প্রস্তুতি নিয়েই কথাাসহিত্য বয়নকর্মে নেমেছেন তিনি। তাঁর ‘ভাত’ গল্প মুগ্ধ করেছে আমাকে। তারপর ‘হাসোই ও লেটুর গল্প’। আর সর্বশেষ আলোচ্য গল্প ‘এনকাউন্টার’।  একটা সামান্য বিষয়কেই গল্প করার ক্ষমতা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর। যদিও ‘এনকাউন্টার’ কোনো সাধারণ বিষয় নয়। মানবতাবিরোধী, বিচারবর্হিভূত হত্যাকা-ে জড়িত র‌্যাবের মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে তাঁর এই গল্পে। অনেক নিরীহ দেশপ্রেমিক মানুষও যে র‌্যাবের ভুল সিদ্ধান্তে প্রাণপাত হচ্ছে এবং অনেক সময় সমাজের কাছে সে বা তারা কালপ্রিট থেকে যাচ্ছে, মূলত এই বিষয় তিনি তুলে ধরেছেন ‘এনকাউন্টার’।
বিজয় আহমেদ (১৯৮৩- ) কবিতা ও গল্প দুটোতেই পারদর্শী। তাঁর গল্পে সমাজের মধ্যবিত্ত ও শ্রমজীবী মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রাম ও স্বপ্ন চিত্রিত। ‘ম্যারাডোনার গল্প’-এও আমরা এর ব্যতিক্রম দেখি না। ম্যারাডোনা যেমন তাঁর পেশাদারী ফুটবলনৈপুণ্য দিয়ে বিশ্বনন্দিত হয়েছিলেন, অন্নের সংস্থানে গ্রাম থেকে শহরে ছুটে আসা শ্রমজীবী সৎ মানুষের বজ্রবর্ষী উচ্চারণ ‘বাহে, আমরা কাজ করে খাই!’ যেন তেমনি দিগি¦দিক ছড়িয়ে পড়ে। নিম্নবর্গের এই শ্রমজীবী মানুষরাই আমাদের অহংকার। গৌরব। এই বক্তব্যই বিজয় আহমেদ তুলে ধরেছেন ‘ম্যারাডোনার গল্প’-এ।
মাজুল হাসানের (১৯৮০- ) পেশা সাংবাদিকতা। ‘বাবুই’ নামে একটি ছোটকাগজ সম্পাদনা করেন।  প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ ‘টিয়ামন্ত্র’ (২০০৯)। ‘লালচিয়া ফুল ও ওসমান গনির কালকেউটা’ গল্পে কথাকোবিত মাজুল হাসান হুসনাগ্রামে একে একে ঘটে যাওয়া নানারকম কা-কীর্তির মধ্যে সম্পর্কে ফুফু-ভাতিজার অবৈধ প্রণয়লীলাও তুলে ধরেছেন সুনিপুণ ভাষাশৈলীবয়নে। নানারকম অসম্ভব আগাম খবরের জন্য হুসনাগ্রামে যে ওসমান গনি সকলের আশাভরসার পাত্র হয়ে উঠেছিল, তার মেয়ে জামিলা অবৈধপ্রণয়ে গর্ববতী হয়। সমাজের দ-মু-ের কর্তা পাটোয়ারী ওসমান গনির বিচারও করে। তারপরই দেখা যায় ওসমান গনির বিরাট আজদাহা বা কালকেউটাই তাকে গিলে খেয়ে ফেলে। তারপর পাটোয়ারী পাগল বনে যান। গল্পটিতে শহীদুল জহিরের ‘ডুমুর খেকো মানুষ’ এর ছায়া পড়েছে বিশেষ করে ওসমান গনির চরিত্র ও তার পরিণতির মধ্যে।
কবিতা ও গল্প লিখেন মাদল হাসান (১৯৭৬- )। ছোটকাগজ ‘বোধ’ ও ‘গৌড়জন (যৌথভাবে)’ সম্পাদনা করেন। জামালপুরের দূরমুঠে শাহ কামাল আউলিয়ার মাজারে পীরবাদে বিশ্বাসী, ভক্তবৃন্দের অসামাজিক কর্মকা-ের চিত্র তুলে ধরেছেন মাদল হাসান ‘দূরমুঠ’ গল্পে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের মতোই নিরাবেগ জীবন ও খরখরে বাস্তবতায় চিত্রিত হয়েছে গল্পটি। লোকজ ডায়লগ নির্মাণে খুবই দক্ষ মাদল হাসান। কবি হলেও এ গল্পে তিনি একজন শক্তিশালী কথাশিল্পী হিসেবে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।
‘ভাতের ঘ্রাণ’-এর গল্পশিল্পী মুন্না মানসী। তাঁর গল্পে ধরা পড়েছে দেশবিভাগোত্তরকালে ভারত থেকে সবকিছু ফেলে পালিয়ে আসা নিঃস্ব, অভুক্ত মানুষের বেদনা, ভাতের জন্য তাদের হাহাকার, কষ্ট। এ গল্পের প্রধান চরিত্র সুনীল। দেশবিভাগের সময় ভারত থেকে পালিয়ে এসেছিল সে। কিছুটা অপ্রকৃতিস্থ সে। মানুষের কাছে চেয়েটেয়ে খেতো। এভাবে দীর্ঘ সংগ্রামের মাধ্যমে টিকে ছিল সে। কেয়ারটেকার আমলে যৌথবাহিনির নির্মম নির্যাতনের ফলে মৃত্যুমুখে পতিত হয় নিরপরাধ সুনীল।  
রানা ভিক্ষু (১৯৭৯- ) একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় কাজ করেন। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর অধিকার, জনচেতনা ও গ্রামীণ দারিদ্র্য বিষয়ে বিভিন্ন স্বীকৃত জার্নাল ও মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বেশ কিছু গবেষণা ও প্রতিবেদন। তাঁর ছোটগল্পে অস্তিত্বের সংগ্রাম ও মধ্যবিত্ত মনস্তত্ত্ব ধরা পড়ে। ‘কোট’ গল্পে  ফুটপাত থেকে কেনা একটি কোটকে কেন্দ্র করে নগর মানুষের মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা, প্রেমভালোবাসা ও অন্তসার শূন্যতা তুলে ধরার প্রয়াস চালিয়েছেন তিনি। সামান্য রেলওয়ে কর্মচারীর মেয়ে উহ্য। ভালোবেসে বিয়ে করে এক বেকার যুবককে। উহ্যর চাকরির পয়সায়ই সে চলে। উহ্য তাকে ফুটপাত থেকে একটি কোট কিনে দেয় যা তার স্বামীর গায়ে লাগে না। যুবক ফকির থেকে শুরু করে নিম্নবিত্তের কয়েকজন মানুষকে কোটটি দান করতে চাইলেও কেউ তা নেয় না। অবশেষে পিপূল ম্যানশনে নিলামে তা অপ্রত্যাশিত দামী হয়ে ওঠে। স্ত্রীর নিষেধ সত্বেও শেষপর্যন্ত কোটটি বিক্রি না করে গায়ে চড়ায় যুবক।
রুবাইৎ আহমেদ (১৯৭৮- ) ছোটকাগজ ‘দ্বৈত’র সম্পাদক। কবিতাই বেশি লিখেন। তবে মাঝে মাঝে তাঁর গল্পও দেখতে পাওয়া যায় পত্রপত্রিকায়। তাঁর গল্পে নগর ও গ্রামীণ সমাজের অন্তর্ক্ষতগুলো উন্মোচিত হয়। ‘ক্ষণজন্মা আলো চিরন্তন অন্ধকার’ গল্পেও এই চিত্র পরিলক্ষিত হয়। আমাদের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থা দেখে শামসুর রাহমান যেমন লিখেছেন ‘অদ্ভুত উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’ কাব্য, তেমনি কথার জাদুকর রুবাইয়াৎ আহমেদও সেই উদ্ভট ‘স্বদেশ’ বা নগরের আজগুবিরূপী বাস্তবতা তুলে ধরেছেন এ গল্পে। এই নগরে যা বলা হয়, ঘটে তার ঠিক উল্টো। যেমন ‘অমুককে এবার সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘নগর উন্নয়ন পদক’র জন্য মনোনীত করা হয়েছে।’ তাহলে ধরে নিতে হবে তার মৃত্যু দ-াদেশ কার্যকর করতে আর দেরী নেই।’ এ ধরনের পুরস্কার প্রদানের নামে নগরের এক সত্যবাদী কবিকে একদিন হত্যা করে নগর প্রশাসন।
রাহাদ আবির পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে।  ছোটগল্প ছাড়াও অনুবাদ ও টিভি নাটক লিখেন। নগর মানুষের হতাশা ও বিচ্ছিন্নতাবোধ তুলে ধরার প্রয়াস চালান রাহাদ। টিকটিকির মতোই আধুনিক নগর মানুষের যান্ত্রিক কর্মব্যস্ততা গিলে খায় তাদের প্রেম, সম্ভোগবাসনা। তাদের মধ্যে জাগিয়ে তোলে নিরন্তর হতাশা, বিচ্ছিন্নতাবোধ, স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গেরবেদনা। তাঁর ‘টিকটিকি’ গল্পে লাজুদম্পত্তির জীবনে এসব চিত্রই ফিেট উঠেছে।
লতিফ জোয়ার্দার (১৯৭০- ) লেখালেখিকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। ‘চৌকাঠ’ ও ‘সবুজ স্বর্গ’ নামে সাহিত্যের দুটি ছোটকাগজের সম্পাদক। কবিতা, গল্প ও উপন্যাস লিখেন।  ছোটগল্পে তিনি নি¤œবর্গীয় মানুষের জীবন ও বাস্তবতা তুলে ধরার চেষ্টা করেন। মুসলিম সমাজে তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীর সাথে পুনরায় ঘর করতে চাইলে হিল্ল¬া বিয়ার ব্যবস্থা করতে হয়। ‘চানবানুর ঘর’ গল্পে কথাশিল্পী লতিফ জোয়ার্দার এ বিষয়টি তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। চানবানুর প্রথম স্বামী ইজ্জত আলী দিনমজুর। কাজের ধান্দায়, মাঝে মাঝে মাসের পর মাস তাকে অন্য অঞ্চলে গিয়েও থাকতে হয়। এই সুযোগে চানবানুকে কাছে পাবার জন্য গ্রামের বিত্তশালী নজর আলী একদিন আচমকা চানুবানুর ঘরে ঢোকে। চানবানুর বারবার তাগাদা সত্বেও, সন্ধ্যা উতরে রাত নেমে গেলেও ঘর থেকে বের হয় না সে। অনেকদিন পর ইজ্জত আলী বাড়ি ফিরে তা দেখে আর সহ্য করতে পারে না। চানবানুকে মারধোর করে তালাক দেয়। বিচারশালিশে চানবানুকে বউ করে ঘরে নিতে বাধ্য হয় নজর আলী। কিন্তু সন্তান দিতে না পারায় সেই ঘরে তার বেশি দিন ঠাঁই হয় না। এদিকে ইজ্জত আলী তাকে আবারো স্ত্রী হিসেবে পেতে চায়। তারপর হিল¬া বিয়ার আয়োজনের মধ্য দিয়েই শেষ হয় গল্পটি। চানবানুর ঘরে নজর আলীর অনেকক্ষণ অবস্থানের মধ্যে নাটকীয়তা রয়েছে। এছাড়া এ গল্পে হিল্ল¬া বিয়া নিয়ে তেমন কোনো সংকট তৈরি হয়নি। হিল্ল¬া বিয়ার সংকট নিয়ে নব্বইয়ের দশকের প্রতিশ্রুতিশীল কথাশিল্পী মহিবুল আলম,(সম্ভবত, বর্তমানে নিউজিল্যান্ডে প্রবাসী) একটি চমৎকার গল্প লিখেছেন। গল্পটি পড়া থাকলে লতিফ জোয়ার্দার হয়তো গল্পের ডাইমেনশন অন্য কোনো দিকে ঘুরিয়ে দিতে পারতেন।
একজন অস্বচ্ছল স্কুল শিক্ষকের জটিল মনস্তত্ত্ব এবং তাঁর টিকে থাকার বিচিত্র সংগ্রামের গল্প ‘পোলিও’। সংসারের চালাতে গণিতের এ শিক্ষককে টিউশনি করতে হয়। তারপরও ছাত্ররা তাঁর হাত ফসকে অন্য জায়গায় চলে গেলে ক্লাশে কঠিন কঠিন অংক কষতে দেন তাদের। না পারলেই মারধোরের মাধ্যমে ঝাল মেটান। সেই ছাত্রের জন্য তার মায়াও হয়। তখন ভেতরে ভেতরে খুব অনুতপ্ত হন শিক্ষক। ঘামে ভেজা নোটটি তুলে দিতে চান মারখাওয়া ছাত্রদের। আর নোটখানাই কিনা পোলিও আক্রান্ত রোগীর মতো। ঠিক মতো দাঁড়াতে পারে না। কাত হয়ে পড়ে যায়। পোলিও রোগীর প্রতীক আমাদের শিক্ষকদের নির্মম বাস্তবতা শেখ লুৎফর তুলে ধরেছেন ‘পোলিও’ গল্পে।
 শুভাশিস সিনহার (১৯৭৮- ) পড়াশোনা নাটক ও নাটতত্ত্বে। মনিপুরী থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা। ছোটগল্প ও কবিতা দুটোতেই সিদ্ধহস্ত তিনি। তাঁর ছোটগল্পে নিম্নবর্গীয় মানুষের বেঁচে থাকার বিচিত্র সংগ্রাম বা অস্তিত্ববাদী চেতনা ধরা পড়ে। ‘জিন্দা মুর্দা সমাচার’ গল্পে, দুমুঠো খেয়ে বেঁচে থাকার জন্য পিতাপুত্র রমজান আর রহিম বিভিন্ন ধরনের পেশা বেছে নেয়। চুরিধারিও বাদ যায় না। কিন্তু কোনোকিছুতেই সুবিধা করতে পারে না। শহরে গিয়ে রমজান মড়ার ভাণ করে পড়ে থাকে, আর ছেলে বাপকে দেখিয়ে কেঁদেকেটে পয়সা তোলে। একদিন রমজান সত্যি সত্যিই মারা যায়। আর ছেলে চিৎকার করে গলা ফাটায়। কিন্তু তার পিতা রমজান আর উঠে না।
শাজান শীলন (১৯৬৭- ) ‘কহন’ নামক একটি ছোটকাগজ সম্পাদনা করেন। খুব বেশি লিখেন না। কিন্তু অল্পস্বল্প লেখা দিয়েই বোদ্ধা পাঠকের মন জয় করে নিয়েছেন। কথাশিল্পের জন্য ইতোমধ্যেই অর্জন করেছেন জেমকন তরুণ থাসাহিত্য পুরস্কার ও ইউনিসেফের মীনা মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড। খুবই ধীরস্থির মানুষ। নিজেকে তৈরি করেই তিনি পা দিয়েছেন কথাসাহিত্যের ভূবনে। গ্রামের নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনসংগ্রাম ও সমাজবাস্তবতার নিপুণচিত্র তিনি দক্ষ ফটোগ্রাফারের মতো একের পর আরেক মেলে ধরেছেন পাঠকের সামনে। পড়লে মনে হয়, এই তো আমার চারপাশের চেনাজানা মানুষ, প্রকৃতি ও পরিবেশ। এক কথায়, এই তো বাংলাদেশের দারিদ্র্যপীড়িত গ্রামীণ সমাজের চিরায়ত ছবি। ‘জ্যান্ত সাপের চক্কর’ পড়লেই বোঝা যায় তা। এর আখ্যানের চরিত্ররা আমাদের প্রায় সকলেরই চেনাজানা মানুষ। বিত্তহীন রবজেল ঠিকমতো পরিবারপরিজনের মুখে অন্ন জুটাতে পারে না বলে আদরের ছোট্ট মেয়ে মমতাকে দূরের এক গ্রামে কাজের মেয়ে হিসেবে রেখে আসে। অবুঝ মেয়েটি পিতার খুব ন্যাওটা। সেখানে সে মোটেও থাকতে চায় না। রবজেলও মমতাকে কাছছাড়া করতে চায় না। কিন্তু তা না করেও তার উপায় থাকে না। একরকম জোর করেই তাকে রেখে আসে সে। তারপর কন্যার জন্য রবজেল এবং তার স্ত্রীর যে মানসিক যন্ত্রণা তা-ই শাজান শীলন তুলে ধরেছেন তাঁর গল্পে। কী নির্মোহ তাঁর কথার বয়ন! এবং তার মধ্যেই তৈরি করেছেন বেদনার মৌচাক।
সৈকত আরেফিন (১৯৭৭- ) অধ্যাপনা করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০১৪ সালে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থÑ ‘পাতা ও পতত্রি’। সৈকতের গল্পে মধ্যবিত্ত মানুষের জীবনযন্ত্রণা, বোধ ও মনন এবং বিচ্ছিন্নতাবোধ ও নৈঃসঙ্গ্যচেতনা ফুটে ওঠে। ‘বৃত্ত’ গল্পে আমরা দেখি, মধ্যবিত্ত সমাজের মানুষগুলো জীবন ও সমাজের বিভিন্ন ঘটনার আবর্তে ঘুরপাক খেয়ে, অভিজ্ঞতা লাভ করে বেড়ে উঠতে উঠতে নিজের অজান্তেই তৈরি করে নৈঃসঙ্গ্যযাতনার এক অভেদ্য বৃত্ত। একমাত্র মৃত্যু ছাড়া সেখান থেকে বেরোনোর আর কোনো পথ খুঁজে পায় না তারা। ‘বিন্দু’ থেকে গল্পটির শুরু। তারপর ‘পরিধি’, ‘ব্যাসার্ধ-১’, ‘ব্যাসার্ধ-২’ ও ‘ব্যাস’ এসব উপশিরোনামে গল্পটির সমাপ্তি ঘটেছে। এক ধরনের নিরীক্ষাই বলা যায়। তবে গল্পবয়নকৌশল ও ভাষাশৈলীর ক্ষেত্রে সৈকতের ওপর প্রভাব বিস্তার করে আছে মাহবুব মোর্শদ ও প্রয়াত শহীদুল জহির।
সাইদুল ইসলাম (১৯৭৭- ) ছোটকাগজ সম্পাদনা করেন। কবিতা ও গল্প লিখেন। ‘খাট’ একটি প্রতীকী গল্প। সমাজ ও রাষ্ট্রের অনাচার, অবিচারের সাথে বিবেকবান মানুষগুলো খাপ খাওয়াতে পারেন না। কিন্তু বিবেকসত্তাটি যদি ছেটে ফেলা যায়, তাহলে কি এতো কষ্ট হয়! ‘খাট’ গল্পে আমরা দেখি খাট ছোট হওয়ায় একজন লোক ঠিকমতো পা মেলে শুতে পারে না। এ যন্ত্রণায় তার ঘুমও আসে না। শেষপর্যন্ত সে দুপায়ের বর্ধিত অংশ কেটে পা মেলে আরামে ঘুমিয়ে পড়ে! কিন্তু বিবেকের রক্তক্ষরণ কি বন্ধ করা যায়?
চন্দন আনোয়ার সম্পাদিত শূন্যদশকের ছোটগল্পের দ্বিতীয় সংকলনের প্রথম গল্প নিরমিন শিমেলের (১৯৬৬- ) ‘গ্রাস’। গল্পের জন্য ২০০৫ সালে তিনি পেয়েছেন ‘রোমেনা আফাজ স্মৃতি পুরস্কার’। ২০০৪ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘নিমগ্ন ¯্রােতে নির্বাসন’। গল্পবোদ্ধাদের চমকে দেয়ার মতো গল্পে নতুন কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান না শিমেল। সাদামাটা বয়ানের মাধ্যমে চিত্রিত করেন চিরায়ত গ্রাম-বাংলার শোষক ও শোষিতের বৈচিত্রময় রূপ। ‘গ্রাস’ গল্পে এরকমটিই লক্ষ করা যায়। করম আলি গরীব কৃষক। বেশি লাভের আশায় কোল্ডস্টোরে আলু মজুত করে সে। এদিকে মৌসুমি বেকারত্বের চক্করে পড়ে অন্ন জুটে না তার। তাই হালের বলদটা গ্রামের গেদু বেপারির কাছে ক্ষণিক সময়ের ন্য বন্ধক রেখে কিছু টাকা ধার নেয় সে। শর্ত থাকেÑ আলু বিক্রি করে সুদে-আসলে গেদু বেপারির টাকা ফেরত দেয়ার। চতুর গেদু বেপারি ধর্মের দোহাই দিয়ে, সুদের কথা এড়িয়ে স্বল্প সময়ের জন্য বলদটা কিনে নেয়ার ফন্দি আঁটে। হাটে আলুর দামের বিপর্যয় ঘটে। রাগে-ক্ষোভে করম সব আলু পানির দরে বিক্রি করে, সেই টাকা দিয়ে বলদটা ছাড়িয়ে আনতে যায়। গেদু বেপারি তখন সুযোগ বুঝে বন্ধকের কথা অস্বীকার করে, বলদের চড়া দাম হাঁকে, যা পরিশোধ করা করম আলির সম্ভব হয় না।  সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রভাবশালীদের লোভের থাবায় নিঃস্ব হচ্ছে করম আলির মতো সহায়-সম্বলহীন মানুষগুলোÑএ আর বিচিত্র কী! তবে চরিত্র চিত্রণ ও আঞ্চলিক ডায়ালগ বা শব্দ প্রয়োগে লেখক বেশ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।
সৈয়দ ওমর হাসানের (১৯৬৭- ) প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘স্বপ্ন ভালোবাসা ও অন্যান্য পরমাণু’ ২০০৮ সালে প্রকাশিত হয়। অর্থের বিনিময়ে বিদেশীদের বাংলা ভাষা কাম গালিগালাজ শেখানোকে কেন্দ্র করে ‘উপসংহার’ নামে একটি চমৎকার গল্প বুনেছেন তিনি। বিদেশীদের বাংলায় গালিগালাজ শেখানো নিয়ে আড্ডায় নানারকম তর্কবিতর্ক হয়। যুক্তি, পাল্টা যুক্তি চলে। এক পর্যায়ে ‘মিজান রাগত স্বরে বল্ল, কোন বিদেশি যদি আপনপার দেশের কোন মুক্তিযোদ্ধাকে কিংবা আপনাকে রাজাকার বলে তখন কি আপনপার খারাপ লাগবে না! মুস্তাক ভাই অভিমান নিয়ে মিহি গলায় বললেন, না লাগবে না। মিজান মুস্তাক ভাই কথায় রেগে উঠল। আপনি কি বলতে চান? স্পষ্ট করে বলেন। মুস্তাক ভাই বললেন, যে দেশে স্বাধীনতার চল্লিশ বছর ধরে রাজাকারেরা সুখে শান্তিতে বসবাস করে সে দেশে একটা শব্দ কতটুকু আর গায়ে লাগে! সে দেশের সবাই তো রাজাকার হয়ে যায়!’Ñ নিশ্চয় এ দেশবাসীর জন্য একটা ব্যঙ্গাত্মক চপেটাঘাত। তবে শেষোক্ত বাক্যটি না থাকলেও বোধ হয় এ চপেটাঘাত উপলব্ধিতে কোনো অসুবিধা হত না। সৈয়দ ওমর হাসানের গল্পবয়নকৌশল ও ভাষাশৈলীতে সাবলীল ও স্বতঃস্ফূর্তভাব লক্ষ করা যায়।
হান্নান কল্লোলের (১৯৬৮- ) প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘নীল দহন, প্রণয় ও পরিত্রাণের গল্প’। ‘কুমারীমাতা’ গল্পে শিল্প¯্রষ্টার জটিল ও দ্বন্দ্বময় মনোজগত উন্মোচিত হয়েছে। শিল্পের প্রয়োজনে ‘কুমারীমাতা’র যন্ত্রণা উপলব্ধি করার জন্য চারুকলার ছাত্রী উপমা বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের মাধ্যমে গর্ভধারণ করে। তার চিত্রকর্ম বিশ্বনন্দিত হয়। কিন্তু উপমা? শেষপর্যন্ত আত্মহত্যা করে সে। সমাজের ভ্রুকুটির কাছে পরাজিত হয় শিল্পীসত্তারÑ যা আসলে মেনে নেয়া যায় না। শিল্পের প্রয়োজনে যে মেয়ে কুমারীভ্রুণ গর্ভে ধারণ করতে পারে, সন্তানের জন্মদানের পর সে আত্মহত্যা করতে পারে না। গল্পের শেষাংশটুকুও (৭ নং অধ্যায়) বেশ নাটকীয় হয়ে উঠেছে। এ অধ্যায়টি জুড়ে না দিলেই বরং ভাল হত। বিষয় ও ভাবনার ক্ষেত্রে আরেকটু যতœবান হলে এ গল্পটি কল্লোল আরও শিল্পম-িত করতে পারতেন বৈকি!
সাকিল আহাম্মেদ (১৯৬৮- ) ছোটকাগজ, ‘তমাল’, ‘অতএব আমরা’ সম্পাদনা করেন। ছোটগল্প ও উপন্যাস লিখেন। ‘ঊনবসন্ত’ তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ। লোভী, স্বার্থপর ও ধান্দাবাজ লোকের কাছে সততার কোনো মূল্য নেই। অন্যায়ভাবে নিজের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য তারা মরিয়া। সাকিল আহাম্মেদ-এর ‘জমিন’ গল্পে এমনই চিত্র ফুটে উঠেছে। ডিসি আকরাম আলি সৎ মানুষ। শৈশবে সে খালাত ভাই তোরাব আলিদের আশ্রয়ে থেকে লেখাপড়া করে। সেই সুবাদে তোরাব আলি খাস জমি নিজের নামে বন্দোবস্ত করার জন্য ডিসি আকরাম আলিকে চাপ দেয়। এমনকি তাকে একটা ভাগ নেয়ার জন্যও বলে। আকরাম আলি রাজি না হওয়ায় রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে সেই জমি নিজের করিয়ে নেয় তোরাব। তারপর আকরাম আলিকে কটুভাষায় গালিগালাজ করে।
মানস চৌধুরীর (১৯৬৯- ) প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ চারটি, যথাÑ ‘কাকগৃহ’ (২০০৮), ‘আয়নাতে নিজের মুখটা’ ২০১০, ‘ময়নাতদন্তহীন একটি মৃত্যু’ (২০১০) ও ‘প্রেম কিংবা পানশালা থেকে পলায়ন’। তাঁর গল্পে আমাদের উত্তরাধুনিক জীবন ও সমাজচিত্র অত্যন্ত নিখুঁতভাবে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বর্তমান যুগ ডিজিটালের যুগ। কম্পিউটারে ইন্টারনেট সংযোগের মাধ্যমে আমরা এমন এক জগতে প্রবেশ করি যার অস্তিত্ব আসলে বাস্তবে নেই, কিন্তু ইন্টারনেট ওপেন করলে সেই জগতকে আমরা অস্বীকার করতে পারি না, কারণ তা বাস্তবের মতই। এই ডিজিটাল বাস্তবতার নাম ভার্চুয়াল রিয়ালিটি। মানস চৌধুরীর ‘ওকুনোমিয়াকি’ গল্পে এই ভার্চুয়াল জগত উন্মোচিত হয়েছে।  ওকুনোমিয়াকি খাওয়ার কারণে তার পেট খারাপ হচ্ছেÑ এ কথা জানিয়ে মৃত ফুকোকে সে চিঠি লিখে ইয়াহু মেইলে। ভার্চুয়াল জগতে প্রবেশের পর আরও নানারকম সমস্যা তৈরি হলেও শেষপর্যন্ত সেগুলোর সমাধানও পেয়ে যান গল্পকথক।
শাশ্বত নিপ্পনের (১৯৭০- ) প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘অনতিক্রম’ প্রকশিত হয় ২০১৩ সালে। লোভ ও রিরংসাতাড়িত মানুষের জীবনভাস্কর নিপ্পন ‘দেবাসুর’ গল্পে ভগবানরূপী প্রতিমাশিল্পী নন্দের মুখোশ উন্মোচন করেছেন। কিছু অতিপ্রাকৃত ক্ষমতার কারণে উজ্জ্বলপুরের কুসংস্কারাচ্ছন্ন হিন্দুরা তাকে ভগবান জ্ঞান করে। কিন্তু নন্দ তো ভগবান নয়Ñজৈবিক প্রতিক্রিয়াচেতনা সম্পন্ন একজন মানুষ। তাই একদিন নি¤œবর্ণের বিধবা  গঙ্গার সেবা নিতে গিয়ে তাকে সে ধর্ষন করে। তখন গঙ্গার কাছে তার প্রকৃত অসুরের রূপটি উন্মাচিত হয়। 
 ২০১২ সালে সাবরিনা আনামের (১৯৭০- ) প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘ফেরা’ প্রকাশিত হয়। তাঁর গল্প আমাদের সৎ ও প্রতিবাদী হবার প্রেরণা যোগায়। নারীকে যোগায় শক্তি ও সাহস। তাঁর ‘নারী বলে...’গল্পে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নানা অনিয়মের চিত্র চিত্রিত হয়েছে। একটি বেসরকারি স্কুলের শিক্ষক শেফালি খাতুন। বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি কসিম মোল্লা স্কুল রেস্ট্রিশনের নামে শিক্ষকদের কাছে মোটা অংকের ঘুষ দাবি করে। তার প্রতিবাদ করায় শেফালি খাতুনকে স্কুল থেকে বিতাড়িত করার হীন কুটকৌশল চালে কসিম। শেষপর্যন্ত একজন নারী শিক্ষাকর্মকর্তার কারণে শেফালি রক্ষা পায়। উন্মোচিত হয় কসিম মোল্লার মুখোশ।
 মেঘ অদিতির (১৯৭০- ) প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘জলডুমুরের ঘুম (কাব্যগল্প)’ । তাঁর গল্পের ভাষা অনেকটা কাব্যগন্ধি। ছোট পরিসরের মধ্যেই তিনি মানবমনস্তত্ত্বের জটিলতার চিত্র আঁকেন। ‘অস্পষ্ট আলোর ঘোড়া’ গল্পে একটি হত্যাকৃত ভ্রুণের জন্য মাতৃ-হৃদয়ের গভীর আর্তির অনুরণন বেজে উঠেছে। গল্পে স্পষ্ট করে কিছু বলা না হলেও অনুমান করে নেয়া যায় যে ভ্রুণটি মিলি আর রূপমের সম্পর্কের ফসলÑযা গর্ভচ্যুত করতে কারুশিল্পী মিলিকে পরাগ চাপ দিয়েছিল। সেই যাতনা থেকে মিলির মধ্যে তৈরি হয় মনস্তাত্ত্বিক সংকট।
রেজা নুরের (১৯৭০- ) প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘একদিন কপোতাক্ষ ও অন্যান্য গল্প’। প্রকাশিত হয় ২০১২ সালে। সহজ-সরল ভাষায় তিনি জীবনকে তুলে আনেন। নস্টালজিক সুর বেজে উঠেছে তাঁর ‘আশ্রয়’ গল্পে। বহুদিন পর জীবনের অপরাহ্নে আনিস সাহেব গ্রামে আসেন নিজের এবং স্ত্রীর কবরের জায়গা ঠিক করতে। গ্রামে ফিরেই সে শৈশব কৈশোরের নানা স্মৃতি-বিস্মৃতির ভেতর তলিয়ে যায়।
আকিম মহমদ (১৯৭১- ) এর গল্পে ধরা পড়ে সমাজ ও রাষ্ট্রের অন্ধকার ও অধঃপতিত রূপ। ‘বিষাক্ত বীজে বেড়ে ওঠা বৃক্ষ’ তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ। নগরায়ন আলোর অধিক অন্ধকার নিয়ে আসে। বদলে যায় চারপাশের চেনাজানা দৃশ্যপট। বিত্তবানদের জৌলুস বাড়লেও তা অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়  নি¤œবর্গীয় মানুষের জীবনে। পতনের শব্দ ও অন্ধকারে দিশেহারা জবেদ আলির জীবন-যাতনা চিত্রিত হয়েছে আকিমের ‘অন্ধবৃত্তে আবর্ত ছায়াগুলো’ গল্পে।
গল্পচর্চায় একজন নিষ্ঠাবান কথাশিল্পী হাসান অরিন্দম (১৯৭২- )। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থের সংখ্যা তিনটি। যথাÑ ‘বিদ্যা ছায়াবিদ্যা ও অন্যান্য গল্প’(২০০৭), ‘কালোসাপের অথবা সাপের কালো কিংবা নীল (ওরফে ব্লু) গল্প’ (২০১০), ‘ক্রিকেট বিকেল ও একটি দোয়েল পাখি’ (কিশোরগল্প, ২০০৬)। এছাড়াও অনূদিত একটি গল্পগ্রন্থ রয়েছে তাঁর। গল্পবয়নে জীবন ও বাস্তবতাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার ক্ষমতা আছে তাঁর। ‘ঘুঘু কুকুর আর মানুষের উপাখ্যান’-এ তিনি জীবনের প্রতি আসক্তি, ভালবাসা, তারুণ্যের প্রতি দুর্বার মোহকে জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। সিমিয়ন ও ইয়ানুজ দুই প্রজন্মের দুজন হলেও তাদের প্রত্যেকেরই রয়েছে জীবন সম্পর্কিত সুগভীর বোধ; পাখি ও প্রাণির প্রতি ভালবাসা। গল্পের শেষে বৃদ্ধ ইয়ানুজের দৃষ্টিতে ‘সবজিগুলো কি টাটকা, কত সুন্দর’ এর মধ্যে ব্যঞ্জিত হয়েছে তারুণ্যের জন্য সুগভীর আর্তি ও মোহ। 
 আবু হেনা মোস্তফা এনাম (১৯৭২- ) প্রতিশ্রুতিশীল গল্পশিল্পী। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ তিনটি, যথাÑ ‘ক্রুশকাঠের খ-চিত্র অথবা অভাবিত শিল্পপ্রণালী’ (২০০৫), ‘নির্জন প্রতিধ্বনিগণ’ (২০১০) ও ‘প্রাণেশ্বরের নিরুদ্দেশ এবং কতিপয় গল্প’ (২০১০)। জীবন, সমাজ ও রাষ্ট্র সম্পর্কিত বিচিত্র বোধ ও ভাবনা উঠে আসে তাঁর ছোটগল্পে। ‘সমারূঢ়’ গল্পে এর চমৎকার রসায়ন ঘটিয়েছেন তিনি। পাঁচটি উপ-শিরোনামে একজন কবির দৃষ্টিতে উন্মোচিত হয়েছে সমাজের ক্ষত, রাষ্ট্রের অনাচার; মানবিকতা ও মূল্যবোধের  পতন।
শফিক আশরাফের (১৯৭৫- ) ‘অন্ধকারে বেড়ে ওঠা’ গল্পেও সমাজে অধঃপতিত মানুষগুলোর মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে।
হামীম কামরুল হক (১৯৭৩- ) সাংবাদিকতাসহ নানা পেশা যুক্ত হয়ে এখন থিতু হয়েছেন বাংলা একাডেমীতে।  ২০১৪ সালে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর ‘শূন্যপরাণ ও অন্যান্য গল্প’ গ্রন্থ। তাঁর গল্প-উপন্যাসে যৌনতা শিল্পচেতনায় ভাস্বর হয়ে ব্যক্তির মুখোশ উন্মোচিত হয়। ব্যক্তির অন্তর্গত সত্তাকে  তিনি নিবিড় পরিচর্যায় মেলে ধরেন পাঠকের সামনে। সমাজ ও রাষ্ট্রে ব্যক্তির পতন ও অন্ধকারে নিমজ্জন হওয়ার চিত্র আঁকেন সুনিপুণভাবে। তাঁর ‘শূন্যপরান’ গল্পেও চিত্রিত হয়েছে ব্যক্তির আদর্শ ও ঠুনকো আভিজাত্যের অন্তর্গত সংঘাত। গল্পের প্রথম বাক্য ‘আমরা কোথায় যাচ্ছি?’ এর উত্তর আমরা পেয়ে যাই গল্পটির পাঠ অন্তেÑ সুশিক্ষা ও মেকী আভিজাত্যের  দ্বন্দ্বের ভেতরে। ভারতের নাগরিক পার্থচরণ ভট্টাচার্য বিদেশের একটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক। সারাটা জীবন ব্যয় করে চলেছেন অর্থনৈতিক গবেষণা কাজে। বিদেশের সব সুবিধা ত্যাগ করে তিনি স্বদেশের টানে, সরকারের প্রয়োজনে ভারতে চলে আসেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি নিয়ে। বাংলাদেশের একটি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাতা কাওসার আলমের আমন্ত্রণে তিনি তার বাড়িতে যান। কাওসার আলমও এককালে অধ্যাপক ছিলেন।  অধ্যাপনা ছেড়ে দিয়ে এখন শিল্পপতি। এক সন্ধ্যায় পার্থচরণ  তার বাড়িতে পৌছান। বিত্তশালী কাওসার আলম তাকে ঘুরেফিরে দেখান তার ঠুনকো অভিজাত্যের জৌলুস, যা হজম করা বিদ্বান পার্থচরণের জন্য বেশ কষ্টকর হয়ে ওঠে। নির্বোধ কাওসার আলম শুধু নিজের নয়, বাংলাদেশেরও ইজ্জত খুইয়ে দেন তার কাছে।
রাশিদা সুলতানার (১৯৭৩- ) গল্পগ্রন্থের সংখ্যা দুইÑ ‘আপনা মাঁসেঁ হরিণা বৈরী’ (২০০৪), ‘এবং আধি’ (২০০৭)। তাঁর ‘পাখসাট’ গল্পের কথাবলা পাখিটি যেন আমাদের বিবেকসত্তার একটি প্রতীকী রূপ। সব অন্যায় বা অপকর্মের সময় কিংবা পরে আমাদের এ সত্তা পাখির মতই জাগ্রত হয়ে ওঠে। কিন্তু আমরা তাকে আমল না দিয়ে গল্পের পাখিটির মতই পুড়িয়ে মারি কিংবা হত্যা করি।
ছোটকাগজ ‘দ’ এর সম্পাদনার সাথে যুক্ত মনিরুজ্জামান ম-ল (১৯৭৪- )। ‘ধোঁয়া যাত্রীরা যেহেতু ফানুস হয়ে ভাসেন’ (২০০৭) ও ‘দীঘিপাড়ের জলছবি’ (২০০৯) তাঁর দুটি ছোটগল্প গ্রন্থ। ছোট পরিসরে বৃহৎ ভাবনার ব্যঞ্জনা শোনা যায়। ‘দীঘিপাড়ের জলছবি’ গল্পটি প্রতীকী। ধীরেন কর্মকারের জালের মাছ খেয়ে ফেলে ঢোঁড়া সাপ। মাছ হল বিত্তহীন  ধীরেনদের কষ্টার্জিত সম্পদ আর সাপ শোষকের স্বরূপ।
নাজনীন সীমনের (১৯৭৪- ) প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘প্রতত রক্তাক্ত চিৎকার’। গ্রন্থের শিরোনামধারী গল্পটি আমাদের নি¤œবিত্ত সমাজে নারী ও শিশুর ওপর নির্মম নির্যাতনের বাস্তব চিত্র। নবীতন ফি বছর কন্যা সন্তানের জন্ম দেয় বলে আশরাফ মিয়া তার ওপর ভীষণ বিরক্ত। নবীতন আবারও গর্ভবতী। তার কাছে আশরাফের প্রত্যাশা একটি ছেলে সন্তানের। অভাবের তাড়নায় দশ বছরের আয়শাকে সে শহরের একটি বাসায় কাজ করতে দিয়ে আসে। তিনদিন কষ্টভোগের পর নবীতন আরেকটি কন্যা সন্তান প্রসব করে। আর শহরে ফাঁকা বাসায় চৈতীর চাচা হিং¯্র পশুর মত ধর্ষন করে আয়েশাকে। মা-মেয়ে দুজনের যোনিই রক্তাক্ত। তবে দু কারণে। তবে দুজনই পুরুষ দ্বারা চরমভাবে নির্যাতনের শিকার।
২০০৯ সালে প্রকাশিত হয় আবু নোমানের (১৯৭৪- ) প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘মেঘ ভেঙে ভেঙে’ । নগরায়ন আমাদের বিশ্বাস ও মানবিক সম্পর্কের সূতোগুলো ঘুড়ির মতই ছিঁড়ে ফেলেছে সেই বহুকাল আগে থেকে। সেই কথাই আবার নতুন করে জানিয়ে দিলেন তিনি,  ‘ঘুড়ি’ গল্পে।
  মহি মুহাম্মদ (১৯৭৫- ) পিতার কর্মসূত্রে শৈশব থেকে বেড়ে উঠেছেন চা-বাগানে। অত্যন্ত কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন চা-বাগানের কুলিকামিনদের জীবনবোধ ও সংগ্রাম। তাদের জীবন ও সমাজের বাস্তবতা সম্পর্কে লব্ধ অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেন ‘আড়াইপাতা’ উপন্যাস। তাঁর ‘কালো হাত কিংবা অহল্যার গল্প’-এও উঠে এসেছে তাদের জীবনচেতনা, সুখ-দুখ, স্বপ্ন-দুঃস্বপ্ন, রিরংসা, লোভ ও নিষ্ঠুরতা।
পিন্টু রহমান (১৯৭৫- ) ছোটকাগজ ‘জয়ত্রী’র সম্পাদক। মুক্তিযুদ্ধের একটুকরো ছবি এঁকেছেন পিন্টু ‘তিনটি কঙ্কাল এবং আমরা গল্প’-এ। মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর কালে রাজাকারদের উত্থান, সমাজ ও রাষ্ট্রে তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বিস্তারের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার দুঃসহ যন্ত্রণার সুর বেজে উঠেছে এতে।
 শোয়ায়েব মুহাম্মদ (১৯৭৬- ) গল্পের ছোটকাগজ ‘উত্তরফাল্গুনী’র সম্পাদনার সাথে যুক্ত। ‘বাঘ পাখি খুন’ গল্পে ফুটে উঠেছে মুক্তিযুদ্ধকালীন একটি অঞ্চলের অরাজক অবস্থার চিত্র। রাজাকাররা শাবনুরকে ধরে নিয়ে যায় ক্যাম্পে। কয়েক মাস পর ছেড়েও দেয়। তখন সে মস্তিষ্কবিকৃত এক নারী। যুদ্ধের পর সে জন্ম দেয় অবাঞ্ছিত একটি যুদ্ধশিশুর।
শাহনেওয়াজ বিপ্লবের (১৯৭৬- ) প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘টিকটিকি ও আধুলির গল্প’। শাহনেওয়াজের গল্প আবেগবর্জিত, নির্মোহ। টিকটিকি বিষয়ক গ্রামীণ কুসংস্কার বা বিশ্বাস এবং জেএমবিদের বোমা বিস্ফোরণে স্বামীর মৃত্যুর পর সেই বিশ্বাস ভেঙে যাওয়া লতার দীর্ঘশ্বাসের প্রতিধ্বনি শুনিয়েছেন শাহনেওয়াজ বিপ্লব ‘টিকটিকি ও আধুলির গল্প’-এ।
সাগুফতা শারমিন তানিয়ার (১৯৭৬- ) প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘ভরযুবতী, বেড়াল ও বকিরা’ প্রকাশিত হয় ২০১১ সালে। নারীর শরীরকে কেন্দ্র করেই পরিবার, সমাজ-সংসার, বিশ্বাস, ভালবাসা ও সুখ। আবার এ শরীরকে কেন্দ্র করেই পরিবার ও সমাজে অবিশ্বাস, দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও ভাঙনের সুর বেজে ওঠে। তানিয়া ‘শরীর। শরীর’ গল্পে এ বিষয়টিই তুলে ধরতে সচেষ্ট হয়েছেন।
 সুমন সুপান্থ (১৯৭৭- ) ছোটকাগজ ‘¯্রােতচিহ্ন’র সম্পাদক। ‘ভ্রমান্ধ দৃশ্যের বায়স্কোপ’ (২০১২) তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ। সুমনের গল্পে শব্দরা অনুভবচৈতন্যে ছড়িয়ে যায় সমগ্র সত্তায়। গ্রন্থের শিরোনামধারী গল্পে সুমন সুপান্থ চিত্রিত করেছেন এক সংগ্রামী নারীর মুখ। তার স্মৃতিরোমন্থনের মধ্যে উঠে এসেছে টুকরো টুবরো অধরা স্বপ্নের প্রতিচ্ছবি, যা বেদনার বল্লম হয়ে বারবার ঘাই মেরে রক্তাক্ত ও জখম করে আমাদের।
চন্দন আনোয়ার (১৯৭৮- ) গল্পচর্চায় আত্মনিবেদিত কথাশিল্পী। সব সময় গল্প ও গল্প বিষয়ক প্রবন্ধ-নিবন্ধ লেখায় মশগুল তিনি। গল্প ও গল্পভাষ্যের ছোটকাগজ ‘গল্পকথা’ সম্পাদনা করেন। পেশা সরকারি কলেজে অধ্যাপনা। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থের সংখ্যা তিনটি, যথাÑ ‘প্রথম পাপ দ্বিতীয় জীবন’ (২০১০), ‘অসংখ্য চিৎকার’ (২০১২) ও ‘পোড়াবাড়ি ও মৃত্যুচিহ্নিত কণ্ঠস্বর’ (২০১৩)। তিনি আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য, রাষ্ট্র, সমাজ ও জীবনঘনিষ্ঠ গল্পকার। নারী নির্যাতন, পুঁজিবাদের আগ্রাসন, মৌলবাদবিরোধী ও যুদ্ধোপরাধচেতনা, নষ্ট রাজনীতি ইত্যাদি তাঁর গল্পের প্রধান বিষয় হয়ে ওঠে।  ‘মা ও ককটেল বালকেরা’ গল্পটি আমাদের নষ্ট রাজনীতিরই প্রতিফলন। এ গল্পে চন্দন ঢাকার আগারগাঁর বস্তির তিন বালক জামাল, শাকু ও আইনার জীবনবোধ এবং বস্তির মর্মন্তুদ চিত্র তুলে ধরেছেন। হরতালে, সামান্য টাকার বিনিময়ে ককটেল ফাটিয়ে কিংবা গাড়িতে গান পাউডার দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারার মতো নির্মম ও ভয়ঙ্কর কাজে নিযুক্ত হয় আইনারা, রাজনৈতিক নেতার নির্দেশে। এ সব কাজ করতে গিয়ে ইতিপূর্বে তারা পুলিশের প্যাঁদানি খেয়ে জেলেও গিয়েছিল। রাজনৈতিক নেতা বা গডফাদারের প্রচেষ্টায় তারা জেল থেকে ছাড়া পায়। এবার হরতালে ককটেল ফাটিয়ে বস্তিতে ফিরে দেখে সব তছনছ করে গেছে পুলিশ বাহিনি। যাকে সামনে পেয়েছে তাকেই বেদম পিটিয়ে কাভার্ড ভ্যানে তুলে নিয়ে গেছে কিংবা মুমুর্ষু অবস্থায় ফেলে রেখে চলে গেছে। নারী-পুরুষ বলে কোনো বাছবিচার নেই।  বস্তি যেন এক মৃত্যুপুরী। আইনার  মাতৃসম মনিরা খালা পড়ে আছে মৃতবৎ অবস্থায়। আইনাকে না পেয়ে তার ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতন চালিয়েছে তারা। এ দৃশ্য দেখে সহ্য করতে পারে না আইনা। হয়তো প্রতিশোধ নেয়ার স্পৃহায় সেখান থেকে বেরিয়ে সদর রাস্তা দিয়ে দৌড়াতে থাকে। বস্তিবাসি শাকু, জামাল আর আইনার জীবনবোধ বা চরিত্র অত্যন্ত নিপুণভাবে চিত্রিত করেছেন আনোয়ার। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে নেতারা মানুষের জন্য কাজ না করে হরতালের নামে তাদের মেরে ফেলার ভয়ানক খেলায় মেতে ওঠে। সংসদভবনের বাউন্ডারির মধ্যে পুড়িয়ে মারা মানুষের খুলি বেশ ক্ষোভের সাথে ফেরে দেয় আইনারা। এই ব্যাপারটিও বেশ প্রতীকী করে তোলেছেন আনোয়ার। সংসদ যেন এখন আর জনগণের সেবার জন্য নয়, বরং তাদের খুলি নিয়ে ফুটবল খেলার ভূমিকায় অবতীর্ণ। সব মিলিয়ে গল্পটি চমৎকার। এ সংকলনে  যে কয়েকটি ভাল গল্প আছে, তার মধ্যে এটি একটি।
 সোলায়মান সুমন (১৯৭৯- ) এর ‘পশুটা আসলে কে ছিল’ গল্পেও আমরা টোকাইদের মর্মন্তুদ জীবনচিত্র দেখতে পাই। মাতাল টোকাই বদু এবং টালমাটাল রাজনৈতিক অবস্থার মধ্যে জনতার ওপর আর্মির নির্যাতন-নিস্পেষণ কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে, তা নির্মোহদৃষ্টিতে তুলে ধরেছেন সুমন। আর্মির গাড়িকে হিং¯্র পশু রূপে চিত্রিত হয়েছে গল্পে।
কাফি কামাল (১৯৮০- ) এর পেশা সাংবাদিকতা। প্রতিনিয়ত কত না সংবাদের মুখোমুখি তাঁকে হতে হয়। সমাজ ও রাষ্ট্রের ছোট বড় নানারকম অসংগতি, তাই, সহজেই ধরা পড়ে তাঁর ছোটগল্পে। ‘মেইট্টাল’ ও ‘লবঙ্গ কন্যা’ নামে তাঁর দুটি ছোটগল্প গ্রন্থ রয়েছে। তাঁর ‘রক্তভোর’ গল্পে অহেতুক একটি খুনের দৃশ্যে পাঠকের চোখ আটকে যায়। মৃধাবাড়ির নিরীহ সুলায়মান এক ভোরে নিজের পুকুরঘাটে খুন হয়। খুনি সলিমুদ্দিন। প্রতিপক্ষের সাথে লড়াই করতে গিয়ে পালিয়ে আসে। পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে পথে খুন করে ফেলে সুলায়মানকে, অথচ সে প্রতিপক্ষের কেউ ছিল না। মানুষের মনুষ্যত্ব কতটা অধঃপতিত হয়েছে, তাই এ  গল্পের মূল বিষয়।
শঙ্কর পাল (১৯৭৮- ) গল্প লিখছেন অনেকদিন ধরে। এখনো তাঁর কোনো গল্পগ্রন্থ  প্রকাশিত হয়নি। ‘আরূঢ়’ নামে একটি ছোটকাগজ সম্পাদনা করেন।  রাজনীতি করে অর্থবিত্তে হঠাৎ ফুলেফেঁপে ওঠা আরজু একদিন গুলি খেয়ে মারা যায়। তার পাশের বাড়ির ছেলে মনি রাজনীতি করে না। লেখাপড়া শিখে একটা চাকরি জুটাতেই তাকে গলদঘর্ম হতে হয়। মনি অক্ষত থাকে বটে কিন্তু বেশ টানাপড়েনে। এক সময়ে দাপুটে আরজুর নাম ধীরে ধীরে মানুষের মন থেকে মুছে যেতে থাকে। আমাদের সমাজের চিত্রই এঁকেছেন শঙ্কর পাল, ‘পাশের বাড়ির ছেলে’ গল্পে।
এমরান কবির (১৯৭৯- ) গল্প ও কবিতা লিখেন। ‘নিদ্রাগহন মহাশূন্যে’ (২০১২) তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ। গল্পের জন্য ২০১০ সালে তিনি জেমকন তরুণ কথাসাহিত্য পুরস্কার পান। তাঁর গল্প সম্পর্কে বদরুন নাহার বলেন, ‘শূন্যতা মানুষকে গ্রাস করলে তাঁর আত্মকণ্ঠের প্রতিধ্বনি বুঝি এমনি দূরাহত কোকিলের কায়া হয়ে ওঠে। নিজের সঙ্গে বোঝাপড়াকে ছড়িয়ে দেওয়া যায় পাঠক হৃদয়ে, যেখানে পাঠকও সাক্ষী হয়ে ওঠেন সেই আহত পাখির। এমনই এক বিষণœ বিউগলের সংগীত হয়ে ওঠে এমরান কবিরের গল্প’। বন্ধুদের সাথে ব্যাঙ খেয়ে ঘুমের গভীরে ডুবে যাওয়া স্বপ্নাচ্ছন্ন রাজুর আনন্দের নতুন ভূবনে প্রবেশ এবং ব্যাঙ খাওয়া নিয়ে ধর্মীয় কুসংস্কারের চিত্র তুলে ধরেছেন এমরান কবীর ‘নিদ্রাগহন মহাশূন্যে’ গল্পে। পরিবর্তন, অনুসন্ধান মানসিকতা কিংবা নতুন কিছু উদ্ভাবন করাকে মানুষ সহজে মেনে নিতে পারে না, এ সত্যই হয়তো বা এমরান তুলে ধরতে চেয়েছেন এ  গল্পে।
সালাহ উদ্দিন শুভ্র’র (১৯৮০- ) প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘মানবসঙ্গবিরল’। গল্পে প্রতিবেশ তৈরির ক্ষেত্রে তাঁর দৃষ্টি বেশ তীক্ষè। ঠাসবুনট ভাষা। ‘হলুদ রঙের ফুল’ গল্পে শিশু মনের ওপর আমাদের ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কতটা চাপ সৃষ্টি করে তাই তিনি তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, আনন্দহীন শিক্ষা আসলে শিক্ষাই নয়। শৈশব থেকেই আমাদের শিক্ষার সাথে আনন্দের সংশ্রব নেই। বইকে মনে হয় বোঝা। শিক্ষকদের রূঢ় আচরণের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিবেশ তার কাছে অসহ্য। তাই শৈশবের হলুদ রঙের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি বড় হওয়ার পরও তার কাছে কারাগারের মতই মনে হয়। 
স্বকৃত নোমান (১৯৮০- ) গল্প ও উপন্যাস লিখেন। ২০১২ সালে পেয়েছেন ‘এইএসবিসি-কালি ও কলম পুরস্কার’। তাঁর ‘ডিউটি’ গল্পটি ‘গেলাপী এখন ট্রেনে’ ফিল্মটির কথা মনে করিয়ে দেয় আমাদের। যাহোক, ডিউটির নামে বর্ডার গার্ডদের ব্যক্তিগত আক্রোশ ঢালার মোক্ষম সুযোগের সদ্ব্যবহারের ফলে গোলাপীর মত চোরাকারবারি জোহরাদের জীবনে অত্যাচারের খড়্গ কতটা ভয়াবহরূপে নেমে আসতে পারে, তা কিছুটা উপলব্ধি করা যায় ্ গল্পটি পড়ে। বিডিআরের চোখ এড়িয়ে একটি ছেলে নোম্যানসল্যাড অতিক্রম করলে বিএসএফরা তাকে ধরে নিয়ে যায়। জোহরার কারণে সেই খবর বিডিআর প্রধানের কানে গেলে সুবেদার মালেককে ধাতানি দেয় সে। সেই ক্ষোভে মালেক হিং¯্র পশুর মত জোহরার ওপর ঝাপিয়ে পড়ে। ‘ডিউটি’ শব্দটি বেশ ব্যঙ্গাত্মকভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন নোমান।
 তারিক স্বপন (১৯৮০- ) অভিনয়শিল্পী। মাঝে মাঝে গল্পও লিখেন। তাঁর ‘কালিদহের কুহক’ গল্পে এককালে তুমুল প্রবহমান নদী কালিদহ সম্পর্কে প্রচলিত নানারকম কুহককথার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি ছড়িয়ে মরানদীকে নিয়ে নস্টালজিক মোহের বেদনাদায়ক ধূলো উড়িয়েছেন নগরের একটুকরো ব্যালককনিতে। কালিদহ যেন, হয়ে উঠেছে আমাদের হারানো ঐতিহ্যের প্রতীক।
আনিফ রুবেদের প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘মন ও শরীরের গন্ধ’। গল্পের জন্য ২০১২ সালে পেয়েছেন জেমকন তরুণ কথাসাহিত্য পুরস্কার’। আনিফ রুবেদের গল্পের চরিত্রগুলো, নিজেরাই নিজেদের মতো করে কথা বলে ওঠে। গল্পকারের এখানে কোনো ভূমিকা থাকে না। তিনি বিভিন্ন উপকরণের সাথে মানুষের একটা সম্পর্কের সূতো তৈরি করে দেন মাত্র। ‘পাগলপ্রবাহ’ গল্পে পাগলামি যেন সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়েছে একজন থেকে আরেকজনের মধ্যে। হতে পারে এ পাগলামি সৃষ্টিশীলতার মোহ বা শক্তি যার বিনাশ নেইÑ একজনের পর আরেকজনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েÑচিরকাল প্রবহমান।
 মোজাফ্ফর আহমেদ (১৯৮৬- ) ছোটকাগজ ‘শাশ্বতিকী’ সম্পাদনা করেন। ছোটগল্পগ্রন্থ দুটি, যথাÑ ‘দ্বিধা’ (২০১১) ও ‘আদিম বুদবুদ অথবা কাঁচামাটির বিগ্রহ’ (২০১৩)। ২০১২ সালে পেয়েছেন ‘অরণি ছোটগল্প পুরস্কার’। মিডিয়া যেমন যেকোনো ব্যক্তিকে মুহূর্তে হিরো বানিয়ে ফেলতে পারে, তেমনি জিরোও। মোজাফ্ফর হোসেনের ‘মিডিয়া ভার্সেস নোবডি’ গল্পে এমনটিই পরিলক্ষিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কাম কবি আফছার আজমের গাড়ি দুর্ঘটনায় মৃত্যুসংবাদ মিডিয়ার মাধ্যমে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়লে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, প্রতিষ্ঠান সকলের কাছে সে নোবডি হয়ে উঠেন। তিনি যে বেঁচে আছেন কেউই তা বিশ্বাস করতে চায় না কিংবা কাউকে তিনি বিশ্বাস করাতে পারেন না। এ হেন অবস্থায় নিজের অস্তিত্ব নিয়ে নিজেই তিনি সন্দিহান হয়ে উঠেন। বর্তমান বিশ্বে মিডিয়া শক্তির কাছে ব্যক্তির অস্তিত্ব কতটা ঠুনকো, বা নিরস্তিত্ব তাই মোজাফ্ফর তুলে ধরতে সচেষ্ট হয়েছেন এ গল্পে।
মুহাম্মদ মেহেদী হাসানের (১৯৮৬- ) গল্পগ্রন্থ দুটিÑ ‘দৈশিক’ (২০০৯) ও ‘কৈরবীলগ্নে’ (২০১০)। অদ্ভুত নস্টালজিক ঘেরাটোপের ভেতর তাঁর গল্পের চরিত্ররা মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। ‘ঘুম’ গল্পে তিনি পাঠককে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছেন যৌথ পারিবারিক বন্ধনের শিকড়ে। দাদার মৃত্যুর পর শিকড়ছিন্ন হয়ে নগরবাসি হলেও বিভিন্ন অকেশনে তাঁর মনে পড়ে যায় দাদার মুখ, নানা সুখ-দুঃখের স্মৃতি। মাহবুব মোর্শেদের ‘কোট’ গল্পের কিছুটা ছায়া পড়েছে এ গল্পে। তবে শেষের দিকে এসে গল্পটি কিছুটা দুর্বল মনে হয়েছে।
কবিতা নারীর মতো কিংবা নারী কবিতার মতো। নারী বা কবিতার অন্তর্গত সৌন্দর্য অবলোকন করার দৃঢ় সংযমি ক্ষমতা থাকে কেবল কবির। কিন্তু  শুধুমাত্র এ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে কবি নিজেকে ক্লান্ত বা নিঃশেষ করেন না। বরং তা উপেক্ষা করে দর্পিত পায়ে হেঁটে যান সামনের দিকে নব সৃষ্টির উন্মাদনায়। ‘কবি ও নিষ্ঠুর রাজকন্যা’ গল্পে রাতুল পাল (১৯৮৮- ) হয়তো এসত্যই উন্মোচন করতে চেয়েছেন।
 মেহেদী উল্লাহ (১৯৮৯- ) গল্পে নতুন নিরীক্ষার অনুসন্ধান করেন। আধুনিক মানুষের মুখোশ উন্মোচন করে প্রদর্শন করেন অন্তর্গত বীভৎসতা। ২০১৩ সালে গল্পের জন্য পান ‘জেমকন তরুণ কথাসাহিত্য পুরস্কার’। ২০১৪ সালে তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘তিরোধানের মুসাবিদা’ প্রকাশিত হয়। এ সংকলনেরই একটি গল্প ‘অবশিষ্ট জীবনাংশে মৃত্যু ব্যথিত প্রাণ’। এ গল্পে নুরুদ্দিনের মৃতদেহকে কেন্দ্র করে স্ত্রী-কন্যা-পুত্রদের আহাজারি, স্মৃতিরোমত্থন চলে, এর মধ্যেই প্রত্যেকের অন্তর্গত সত্ত্বার মধ্যে জেগে উঠে বৈষয়িক ভাবনা।  শোকের মধ্যে আসল ও কৃত্রিমতা কত সহজেই না লুকিয়ে থাকে। মানুষের অন্তর্জগত উন্মোচন করার প্রয়াস চালিয়েছেন মেহেদী উল্লাহ। তবে গল্পটিতে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘দোজখের ওম’র মৃত্যুপথযাত্রী কামাল উদ্দিন এবং তার সন্তানদের ভাবনার কিছুটা হলেও ছায়া পড়েছে।
উপর্যুক্ত চুয়াত্তরজন গল্পকারের গল্প ছাড়াও শূন্য দশকের আরো অনেক গল্পকার রয়েছেন। পত্রপত্রিকায় তাঁদের গল্প পড়েছি। ভালো লেগেছে অনেকের গল্প। এ মুহূর্তে যাঁদের নাম মনে পড়ছে তাঁরা হলেন, উম্মে মুসলিমা, রুদ্রাক্ষ রহমান, নির্লিপ্ত নয়ন, আখতার জামান, জিয়া আহমেদ প্রমুখ। যেমন আখতার জামানের কথাই ধরা যাক। তিনি জনপ্রিয়তার তুঙ্গ স্পর্শকারী কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদকে চেতনে অবচেতনে অনুসরণ করেন। বিচিত্র বিষয় এবং চরিত্র তাঁর গল্পে বেশ উপভোগ্য হয়ে ওঠে। শব্দভ্রম গল্পে হুমায়ূনীয় প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেছেন তিনি। আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন উচ্চপদে আসীন রাজাকারদের প্রতীকী হয়ে উঠেছে পাক আমলের একটি পুরনো সিলিং ফ্যান। মুক্তিযুদ্ধ-উত্তরকালে রাজাকাররা কিছুটা কোনঠাসা হয়ে পড়লেও পরবর্তীকালে সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তরে তারা তাদের অবস্থান পাকা করে নেয়। সাধারণ জনগণের মাথার ওপরে থেকে তারা আমাদের জাতীয় পরিকল্পনা ভ-ুল করে দিচ্ছে। অঙ্কুরে বিনষ্ট হচ্ছে আমাদের স্বপ্ন। মাথার ওপর থেকে ফ্যানটিকে সরানোর মতো যেমন কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছেন হাওলাদার সাহেব, তেমনি আমরাও রাজাকারদের সমূলে উৎপাটন করতে পারছি না।
জিয়া আহমেদ-এর অরেকটি নাম জিয়াউদ্দিন খোকা। এ নামেই তিনি গল্প, কবিতা ও সাহিত্য-সমালোচনা লিখতেন। গল্প নামক ছোটকাগজ সম্পাদনায় এসে তিনি নাম পাল্টে হয়ে গেলেন জিয়া আহমেদ। বর্তমানে এ নামেই লিখছেন তিনি। তাই হিজল বনে শিকারী শহর-কে এ নামেই চালিয়ে দিতে হল। নগরায়নের রাক্ষুসে থাবায় প্রতিনিয়ত গ্রাস হচ্ছে আমাদের গ্রাম, হাজার বছরের গ্রামীণ সংস্কৃতি। ক্রমবিস্তারি নগরের শকুনে দৃষ্টির কোপানলে গ্রাম কেবল সংকুচিত হচ্ছে। বাস্তু-উচ্ছেদ মানুষ অন্যত্র গড়ে নিচ্ছেন নিজস্ব নিবাস। মাটির সাথে তাদের জন্ম জন্মান্তরের সম্পর্ক ছিন্ন করার যে মনোবেদনা তা-ই জিয়া আহমেদ ফুটিয়ে তুলেছেন এ গল্পে। 
এ মুহূর্তে উম্মে মুসলিমা, রুদ্রাক্ষ রহমান, নির্লিপ্ত নয়নের গল্প হাতের কাছে না থাকায় আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হলো না। তাই এ নিবন্ধটি অসম্পূর্ণই বলা যায়। ভবিষ্যতে তাঁদের গল্পগুলো হাতের কাছে পেলে এ নিবন্ধের কলেবর বৃদ্ধি করা হবে।
কালের গগনে এক ঝাঁক দুরন্ত বলাকার মতো পাখা মেলেছে শূন্য দশকের তরুণ ছোটগাল্পিকগণ। সমাজ-সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য, মানুষের বিশ্বাস ও মূল্যবোধ এবং মানবতার প্রতি সমান দায়বদ্ধ থেকেই তাঁরা যাত্রা শুরু করেছেন। তাঁদের অনেকের লক্ষ্য আকাশ ছোঁয়ার। নিজের ভৌগোলিক সীমা অতিক্রম করে আন্তর্জাতিক সাহিত্য অঙ্গনে দৃপ্ত পদচারণার জন্য নিজেকে তৈরি করে চলেছেন কেউ কেউ। তাঁদের গল্পের বিষয়, বয়নকৌশল, বাকরীতি এবং নিরন্তর নিরীক্ষাধর্মী চেতনা বা সাহসী পদক্ষেপ ছোটগল্পের অঙ্গনকে করবে আরো বিস্তৃত, আরো শক্তিশালী, আরো সমৃদ্ধÑ এইটুকু সচেতন পাঠকের প্রত্যাশা। 
- See more at: http://rnews24.com/art-literature/2015/03/13/35319#sthash.QCBt8yHf.zIHT10x4.dpuf

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন