“মা মারা গেছেন আজ। হয়তো গতকাল, আমি ঠিক জানি না।” এভাবেই শুরু হয় ‘দি আউটসাইডার’ উপন্যাসটি। প্রধান চরিত্রের দেওয়া প্রথম উক্তিটি বিভিন্নভাবে অগণিতবার ব্যবহৃত হয়ে বিখ্যাত হয়ে আছে সাহিত্য সমাজে। দর্শনভিত্তিক এ উপন্যাসটির ফরাসি নাম লেত্রঁজে (L’Étranger) । ইংরেজিতে ‘দ্য স্ট্রেইনজার’ নামটিও প্রচলিত। ‘দি আউটসাইডার’ একটি গভীর তত্ত্বভিত্তিক উপন্যাস, যেখানে জীবনের অযৌক্তিকতা (absurdism) ও অস্তিত্ববাদকে (existentialism) উপস্থাপনা করা হয়েছে অত্যন্ত সহজ এবং বাস্তবভিত্তিক জীবন দিয়ে। মানুষ হিসেবে জীবনের তাৎপর্যের অনুসন্ধান করা কতটুকু সার্থক তা বিশ্লেষণ করা হয়েছে বিশ্বাসযোগ্য দৃষ্টান্ত ও উপমা দিয়ে।
মরসোঁ (Meursault) নৈতিকতা ও অনুভূতিহীন এক নায়ক, যার মুখ দিয়ে লেখক বলিয়েছেন জীবন সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গির কথা। বিষয়ের বিচারে উপন্যাসের ফরাসি শিরোনামই যথার্থ, যার অর্থ অপরিচিত বা অচেনা বা ভিনদেশী। নায়ক মরসোঁ সত্যিই অচেনা এক মানুষ। আমাদের সমাজে মরসোঁ’র মতো ব্যক্তি পছন্দনীয় নয়। সমাজ তাদেরকে একঘরে করেই রেখেছে যুগ যুগ ধরে। কখনও কখনও করেছে বাকরুদ্ধ অথবা নিপীড়ন অথবা হনন! অথচ তাদের জীবন ও দর্শন দিয়ে যে বিমূর্ত সত্যকে উপস্থাপন করেছেন তা বুঝার চেষ্টা ক’জনে করে?
দি আউটসাইডার থেকে প্রাপ্ত কিছু বিছিন্ন অনুভূতি জানাবার জন্য এ লেখা। এবিষয়ে আরও লেখা দিতে চাই। অনুবাদ করতে চাই ফরাসি লেখকের এই কালজয়ী ক্যাসিক উপন্যাসটি। তবে যেহেতু আমি কোন লেখক নই, সেক্ষেত্রে পাঠকের প্রেরণাই আমার একমাত্র সম্বল।
‘দি আউটসাইডার’ থেকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্ধৃতি:
১) “মিনিটখানেক পর সে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, আমি তাকে ভালোবাসি কি না। উত্তরে আমি বললাম, আমার কাছে ওটার কোন অর্থ নেই। তাকে বললাম যে, ওরকম কোন চিন্তা আমার মনে নেই।” চতুর্থ অধ্যায়ে ম্যারির সাথে কথোপকথন। এখানে মরসোঁর নিরাবেগ এবং অনুভূতিহীন মনোভাবের একটি চিত্র পাওয়া যায়। সে সবসময় এরকমই ভাবলেশহীন পুরো গল্পে। তার উত্তরটি যতই সততায় পূর্ণ থাকুক, এতে অজ্ঞতারও পরিচয় পাওয়া যায়। এখানে ম্যারি’র প্রশ্নের আবেগের বিষয়টি মরসোঁ একটুও বুঝতে পারে নি। মরসোঁ’র কাছে প্রেমের কোন অর্থ নেই, মানে হলো তার জীবনেরও কোন অর্থ নেই। তার এরকম মনোভাবকে হয়তো পাঠক গ্রহণ করবেন না, কিন্তু ওরকম দৃষ্টিভঙ্গির পেছনের কারণটিকে কেউ গ্রহণ না করে পারবেন না।
২) “আমি তাকে বললাম যে, মানুষের জীবন খুব একটা বদলায় না; যত যা-ই হোক একজনের জীবন অন্যের জীবনের চেয়ে খুব একটা ভিন্ন নয় এবং আমি আমার জীবন নিয়েও তেমন অসন্তুষ্ট নই।” কথাগুলো বলছিলো গল্পের নায়ক এবং বর্ণনাকারী মরসোঁ তার বসকে। পঞ্চম অধ্যায়ে, মরসোঁ প্যারিসের অফিসে স্থানান্ততি হলে তার জীবনে কী উন্নয়ন আসবে, সেকথাই বলছিলেন তার বস। মরসোঁ’র উত্তরে মানুষের জীবন ও জীবনের গুণগত উন্নয়ন সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়। মানুষের জীবনে খুঁটিনাটি বিষয়গুলো একেকজনের একেক রকমের হলেও একে অন্যের জীবনে বিশেষ কোন পার্থক্য নেই। সকলেরই জীবন প্রায় এক। জীবন সম্পর্কে এ নিরাশাবাদি দর্শনই সত্য হয় যখন শেষ অধ্যায়ে মৃত্যুদণ্ডের মাধ্যমে তার জীবনের অবসান হয়।
৩) আমি উন্মুক্ত হলাম পৃথিবীর মৃদু উদাসীনতার সামনে।
৪) কীসে আমার আগ্রহ ছিলো, তা হয়তো নিশ্চিত জানতাম না, কিন্তু কীসে আমার আগ্রহ ছিলো না তাতে আমি নিশ্চিত ছিলাম।
৫) গ্রীষ্মের মাঝে আমি আমার মাঝে অনুভব করলাম এক অপ্রতিরোধ্য শীতকে। তাতে আমি খুশি হই। কারণ এটি আমাকে বলছে যে, পৃথিবীর আঘাত আমার ওপর যতই কঠিন হয়ে আসুক না কেন, আমার ভেতর আরও শক্তিধর এমন কিছু আছে, যা ওই আঘাতকে প্রতিরোধ করবে।
৬) আমি চেয়েছিলাম তাকে নিশ্চিত করতে যে, আমি অন্যদের মতোই – ঠিক অন্য দশজনের মতো।
দি আউটসাইডার সম্পর্কে প্রাসঙ্গিক কিছু তথ্য:
*প্রকৃত নাম: লেত্রঁজে (L’Étranger)
*ইংরেজি/পরিচিত নাম: The Outsider/ The Stranger
*মূল ভাষা: ফরাসি
*লেখার সময় ও স্থান: ৪০এর দশক, ফ্রান্স
*প্রকাশের সময় ও প্রকাশক: ১৯৪২, লাইব্রেরি গালিমার্দ
*সাহিত্যের প্রকার (type): উপন্যাস
*লেখার ধরণ (genre): অস্তিত্ববাদী, অপরাধ বিষয়ক লেখা
*লেখার পটভূমি: আলজেরিয়া, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কিছু পূর্বে
*বাংলাদেশি সংস্করণ: ‘দি আউটসাইডার’ মুনতাসীর মামুন, কাকলি প্রকাশনী, ২০০৪
*মূলবক্তব্য: মরসোঁ আলজেরিয়ার এক অতি সাধারণ যুবক, যে ছিলো সামাজিক এবং মনস্তাত্ত্বিকভাবে একা ও অচেনা। মায়ের মৃত্যুর পর যথাযথ আবেগ দেখাতে পারে নি বলে সে শুরু থেকেই আবেগহীন মানুষ হিসেবে আবির্ভূত হয়। ঘটনার পরিক্রমায় হত্যা করে ‘আরবি’ হিসেবে পরিচিত এক ব্যক্তিকে। কোন বিশেষ কারণ ছাড়াই। এজন্য গ্রেফতার হয় মরসোঁ এবং মুখোমুখি হয় প্রথাগত বিচারের। এ হত্যার বিভিন্ন যৌক্তিক কারণ খুঁজে বের করে মরসোঁ’র সমাজ। তার সংগ্রাম ছিলো সেই যৌক্তিক কারণ আর আইনি ব্যবস্থার বিপক্ষে।
আলবেয়ার ক্যামু সম্পর্কে দু’টি কথা:
“আমার পেছনে হাঁটবে না, হয়তো আমি পথ দেখাবো না; আমার সামনে হাঁটবে না, হয়তো আমি অনুসরণ করবো না; ঠিক আমার সাথে হাঁটো এবং আমার বন্ধু হও।” এ উক্তির জন্য Albert Camus কে অনেক পূর্ব থেকেই জানতাম। “মানুষই একমাত্র প্রাণী যে নিজেকে মেনে নিতে চায় না।” তার আরেকটি উক্তি।
নোবেল সাহিত্য পুরস্কার বিজয়ী আলবেয়ার ক্যামু’র ইংরেজি বানান Albert Camus দেখে শুরুতেই বিভ্রান্ত হয়েছি। ফরাসি ভাষার এ হলো ব্যতিক্রম: বানানের সাথে উচ্চারণের মিল খুঁজে পাই না। ‘জাঙ্গল বুক’-খ্যাত রাডিয়ার্ড কিপলিং-এর পর তিনি হলেন সর্বকনিষ্ঠ নোবেল পুরস্কার বিজয়ী (১৯৫৭)। এ স্বীকৃতির মাত্র দু বছর পর ১৯৬০ সালে গাড়ি দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় তার। বুক পকেটে ছিলো ট্রেইনের টিকেট – পরিকল্পনা ছিলো পরিবারকে নিয়ে বেড়াতে যাবার!
১৯১৩ সালে আলজেরিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন আলবেয়ার ক্যামু এবং সেখানেই বড় হয়েছেন। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের সমতল আর আফ্রিকা অঞ্চলের তপ্ত রৌদ্রে উন্মুক্ত আলজেরিয়া তার লেখায় তাপ ছড়িয়েছে দারুণভাবে। জন্মের পরবর্তি বছরে অর্থাৎ ১৯১৪ সালের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মারা যান তার পিতা। বধির মায়ের অপ্রতুল সহায়তায় ক্যামু বড় হন। বাল্যজীবনের অবাধ জীবন পেয়ে ক্রিড়াবিদ হয়ে ওঠেন ক্যামু। আলজিয়ার্স বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনের ছাত্র থাকা অবস্থায় যক্ষ্মা রোগে মৃত্যুর দরজা থেকে ফিরে আসেন। অধিকাংশ জীবন কাটে পুলিসের কেরানি এবং বিক্রয়কর্মী হিসেবে। অবশেষে সাংবাদিকতায় যোগ দেন। তিনি বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন এবং কমব্যাট নামে একটি আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকা চালাতেন। অন্যান্য উপন্যাস: দ্য প্লেইগ, দ্য ফল, আ হ্যাপি ডেথ, দ্য ফার্স্ট ম্যান। দর্শনভিত্তিক প্রবন্ধ: দ্য রেবেল এবং দ্য মিথ অভ সিসিফাস।
ক্যামু’র অযৌক্তিকতা ও অস্তিত্ববাদ:
অযৌক্তিকতা (absurdism)’র মধ্যে absurd মানে যৌক্তিক অযৌক্তিতা বুঝায় না, এর অর্থ হলো মানবিকভাবে অযৌক্তিক। দর্শনশাস্ত্রে উদ্ভট বা অযৌক্তিক বলতে মানব মনের সেই অন্তর্দ্বন্দ্বকে বুঝায়, যেখানে অভ্যন্তরীণ মূল্যবোধ বা জীবনের মানে খুঁজতে চায়, কিন্তু মানবিকভাবে যা অসম্ভব।
অযৌক্তিকতাবাদ ও অস্তিত্ববাদ (existentialism) অনেক কাছাকাছি ধারণা বহন করে। জীবনের অযৌক্তিকতাকে অস্তিত্বের সংগ্রাম দিয়ে মোকাবেলা করাই হলো অস্তিত্ববাদ। মূলত অযৌক্তিবাদ ধারণাটিকে আলবেয়ার ক্যামু অস্বীকার করার ফলশ্রুতিতে ইউরোপিয়ান অস্তিত্ববাদিদের বিশ্বাস ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। সুখ-দুঃখ, আলো-আঁধার, জীবন-মৃত্যু ইত্যাদি ধারণা পাশাপাশি উপস্থাপন করে ক্যামু অযৌক্তিকতাবাদের নতুন সংজ্ঞা উপস্থাপন করেন। সুখ অস্থায়ী এবং মানুষের জীবনের নিশ্চিত গন্তব্য মরণ। ক্যামু’র সাথে অযৌক্তিতাবাদ ও অস্তিত্ববাদের অন্যতম প্রবক্তারা হলেন ডেনমার্কের সোরেন কিয়ার্কাগাদ (Søren Kierkegaard)।
শেষ কথা:
ছাত্রজীবনে একবার পড়েছিলাম উপন্যাসটি, শুধুই ‘পড়েছি’ বলার জন্য – মনে তেমন দাগ কাটে নি। কিন্তু এবার পড়ে সত্যিই দারুণ নাড়া খেলাম পুরো অস্তিত্বে! বেশ কিছুদিন আবেশ কাটাতে পারি নি। তখনই ভেবেছিলাম, সমগ্র উপন্যাসটি অনুবাদ করবো, তাতে আরও অধ্যয়ন করার সুযোগ হবে। কিন্তু ইন্টারনেটে খ্যাতিমান লেখক ও গবেষক মুনতাসীর মামুন কর্তৃক অনূদিত একটি প্রচ্ছদ চোখে পড়ার পর সে উৎসাহে একটু ভাটা পড়েছে। অরুন্ধতী রায়ের ‘গড অভ স্মল থিংস’ ইংরেজি পড়ার পর যখন একটি বাংলা অনুবাদ পড়লাম, তখন অনুবাদের ছিরি দেখে রাগে দুঃখে মাথার চুল ছিঁড়তে মন চেয়েছিলো। এরপর থেকে পরিচিত কোন ইংরেজি লেখা আর বাংলা অনুবাদ পড়তে যাই না। অনুবাদ সত্যিই এক কঠিন কাজ – আমার মতে তা মৌলিক লেখার চেয়েও কঠিন! মৌলিক লেখায় কাউকে অক্ষরে অক্ষরে অনুসরণ করতে হয় না, যা অনুবাদের বেলায় হয়। অনুবাদ সম্পর্কে এরকম ‘নিরাপত্তাহীনতার’ কারণে এখন নিজেই নিজেকে আস্থা করতে পারি না। এ পরিস্থিতিতে প্রিয় পাঠক ও সহব্লগারদের সদয় পরামর্শ কাম্য।
গ্রন্থপঞ্জি ও তথ্যসূত্র:
১. আলবেয়ার ক্যামু, দ্য স্ট্রেইন্জার, ভিনটিজ বুক (নিউ ইয়র্ক), ১৯৪৬: স্টুয়ার্ট গিলবার্ট কর্তৃক ফরাসি থেকে অনূদিত।
২. স্পার্কনোটস ডট কম এবং উইকিপিডিয়া।
৩. সকল ছবি গুগল অনুসন্ধান থেকে।
৪. বাংলায় আলবেয়ার ক্যামু নামে পরিচিত হলেও আসল উচ্চারণ আলবাখ ক্যামি। সূত্র: উইকিপিডিয়া।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন