সোমবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

আমাদের নদীকেন্দ্রিক উপন্যাস

র কি বু ল  হা সা ন 



প্রাচীনকালে রচিত সাহিত্য থেকে শুরু করে এ সময়কালের সাহিত্যেও নদী অপরিহার্য বিষয়। গীত, কবিতা, উপন্যাসসহ সাহিত্যের সব শাখাতেই নদী যুক্ত হয়েছে কখনো প্রধান ভূমিকায়, কখনো বিষয়বস্তুর প্রয়োজনে। এটি শুধু বাংলা সাহিত্যে নয়, বিদেশি সাহিত্যেও নদী গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। মানুষের জীবনযাপন, সভ্যতার বিকাশ ও ঐশ্বর্যনির্মাণ, ইতিহাস, আন্দোলন-সংগ্রাম-সবকিছুতেই নদী দৃঢ়তর ভূমিকা পালন করে। মানুষের জীবনে নদী কখনো বন্ধু, কখনো ভয়ঙ্কর প্রতিপক্ষ ও ধ্বংসকারী। নদীকে এড়িয়ে মানুষের জীবন গড়া ও সভ্যতার ঐশ্বর্য নির্মাণ অকল্পনীয়। নদীভিত্তিক আঞ্চলিক বিভিন্ন উপন্যাসে এ সত্য নানাভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। নদী ও মানুষ একে-অপরের সম্পূরক। উপন্যাসে এ সত্যতা ধরা পড়েছে বিভিন্ন রূপে।



উপন্যাসের নানাদিক বিবেচনায় গ্রাহ্য করে বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাসের মর্যাদা ‘আলালের ঘরের দুলাল’কেই পরনো হয়েছে। যদিও উপন্যাস হিসেবে এ গ্রন্থটির প্রচুর সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তারপরও বাংলা উপন্যাসের সফলযাত্রা মূলত এখান থেকেই শুরু। এরপর বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র বাংলা উপন্যাসকে নিয়ে গেছেন অবিশ্বাস্য উচ্চতর এক মাত্রায়।



আর সময়ের সিঁড়ি ধরে উপন্যাসেও নানা বাঁক পরিবর্তন ঘটেছে। বিষয়বস্তু থেকে শুরু করে নানাক্ষেত্রে এসেছে নান্দনিক পরিবর্তন। টানাপড়েনের যে অমোঘ আকর্ষণ উপন্যাসের জন্মের মূলসূত্র, সময়ের স্রোতে উপন্যাস সেখান থেকে বেরিয়ে ইতিহাস, সমাজ-সমকাল, রাজনীতি, প্রেম, নিষিদ্ধ প্রণয়, মনস্তÍাত্তি¡ক বিশ্লেষণ, বিপ্লবচেতনা, শাহরিক ও গ্রামীণজীবন- নানামাত্রিক রূপ গ্রহণ করেছে। এ ধারাতে যুক্ত হয়েছে নদীকেন্দ্রিক আঞ্চলিক উপন্যাস। যা বাংলা উপন্যাস-সাহিত্যে উজ্জ্বতর এক যোজনা। বিদেশি সাহিত্যেও আঞ্চলিকতা-নির্ভর উপন্যাস রচিত হয়েছে। সে সব উপন্যাসও গুরুত্বপূর্ণ শিল্পকর্ম হিসেবে মর্যাদা লাভ করেছে। বাংলা সাহিত্যের নদী ও নদীকেন্দ্রিক উপন্যাস কম লেখা হয়নি। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’, অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’, সমরেশ বসুর ‘গঙ্গা’, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘ইছামতী’, আবু ইসহাকের ‘পদ্মার পলিদ্বীপ’ প্রভৃতি নদীভিত্তিক উপন্যাস। নদী ও মানুষের জীবন যে এই সূত্রে আবদ্ধ, সে সত্যতা ধারণ করেই বিভিন্ন মাত্রিকে নির্মিতি পেয়েছে উপন্যাস। যা উপন্যাস সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য এক প্রবাহধারা। এ ধারার পাশ্চাত্য লেখকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মারিয়া এজওয়াথ, টমাস হার্ডি, আর্নল বোনেট, উইলিয়াম ফকনার, মিখাইল শলোকভ, এমিলিয়া পারডো বাজান, গ্রাজিয়া ডেলেহডা, ইভান সাংকার, জিন গিয়োনো প্রমুখ।



বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। নদী আর মানুষের জীবন এ দেশে যেন একই সূত্রবদ্ধ।



বাংলা সাহিত্যে সে কারণে নদী অপরিহার্য। এ দেশে নদীকে ঘিরেই নদীকেন্দ্রিক মানুষের অর্থনৈতিক জীবন আবর্তিত। ‘আবহমানকাল ধরে বাংলা সাহিত্যে শ্রমজীবী মানুষের প্রসঙ্গ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’ নদীকে ঘিরেই নিয়ন্ত্রিত হয় মানুষের জীবন, নদীর ক‚লেই গড়ে ওঠে মানবসভ্যতার ঐশ্বর্য। আবার নদীকেন্দ্রিক মানবসভ্যতা ও ঐশ্বর্য ধ্বংসও হয়েছে নদীর বুকেই। নদীর রয়েছে নিজস্ব এক অদ্ভুত রহস্যময়ী রূপ। যেখানে সে মানুষের বেঁচে থাকার প্রেরণা যেমন, তেমনি ধ্বংসের রাহুগ্রাসীর মতো ভয়ঙ্করও। নদীভিত্তিক উপন্যাসগুলোতে এ সত্য যেমন ধরা পড়েছে, তেমনি এ ধারার উপন্যাস প্রতিষ্ঠা পেয়েছে স্বতন্ত্র মর্যাদায়। যা বাংলা সাহিত্যে নদীভিত্তিক আঞ্চলিক উপন্যাস হিসেবে স্বীকৃত। ‘অঞ্চলিক’ শব্দটি এখানে যুক্ত থাকলেও এ সব উপন্যাস সর্বজনীনতায় ব্যাপৃত। পূর্ণাঙ্গ জীবনকে ধারণ করে মহত্ত্বম শিল্প হিসেবে এ ধারার অনেক উপন্যাস কালোত্তীর্ণ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছে। বাংলা সাহিত্যে নদীভিত্তিক আঞ্চলিক উপন্যাসগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯০৮-১৯৫৬)-এর ‘পদ্মা নদীর মাঝি (১৯৩৬), অদ্বৈত মল্লবর্মণ (১৯১৪-১৯৫১)-এর ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ (১৯৫৬), তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৮-১৯৭১)-এর হাঁসুলী বাঁকের উপকথা (১৯৪৭), হুমায়ুন কবীর (১৯০৬-১৯৬৯)-এর ‘নদী ও নারী’, সমরেশ বসু (১৯২৪-১৯৮৮)-এর ‘গঙ্গা’ (১৯৫৫), আবু ইসহাক (১৯২৬-২০০৩)-এর ‘পদ্মার পলিদ্বীপ’ (১৯৮৬), আলাউদ্দিন আল আজাদ (১৯৩২-২০১০)-এর ‘কর্ণফুলী’ (১৯৬২), শহীদুল্লা কায়সার (১৯২৭-১৯৭১)-এর ‘সারেং বৌ’ (১৯৬২) প্রভৃতি।

দুই.


কোনো বাঙালি উপন্যাস লিখেছেন কিন্তু নদীকে স্পর্শ করেননি এমন দৃষ্টান্ত বিরল। যদিও সাহিত্যের প্রাচীনকাল থেকেই বাংলা সাহিত্যে নদী একটি অপরিহার্য বিষয় হয়ে আছে। সাহিত্যের প্রত্যেকটি শাখাতে তার গুরুত্বপূর্ণ উপস্থিতি বা ভূমিকা স্পষ্ট। নদীবিহীন জীবন যেমন বাঙালির কাছে অকল্পনীয়, সাহিত্যেও নদীর ভূমিকা যেন একই সত্য ধারণ করে। ‘চর্যাপদ’, ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য’, ‘মহাভারত’, ‘মনসামঙ্গল কাব্য’, ‘চণ্ডীমণ্ডল কাব্য’, ‘অন্নদামঙ্গল কাব্য’, ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’, ‘মেঘনাদবধ কাব্য’, ‘ব্রজাঙ্গনা’, ‘চতুর্দশপদী’ কবিতা প্রভৃতি তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এ সব সাহিত্যে নদী এসেছে নানাভাবে, বিচিত্র রূপে। পরবর্তীতে উপন্যাসের যাত্রা শুরু হলে সেখানে নদী এসেছে অপরিহার্যতার অংশ হিসেবে। কখনো নদীকে ঘিরেই উপন্যাস নির্মিত হয়েছে। আবার নদীকে ঘিরে পুরো উপন্যাস নির্মিত না হলেও উপন্যাস বা উপন্যাসের জীবনের প্রয়োজনে নদী এক প্রধান শক্তি হয়ে উঠেছে। উপন্যাসে যুক্ত করেছে নতুন মাত্রা। আধুনিক বাংলা উপন্যাসের প্রথম সার্থক শিল্পী বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসেও নদীর কথা আছে। ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ (১৮৭৮) এক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত। ‘দুর্গেশনন্দিনী’তেও নদীর প্রসঙ্গ আছে। তবে বঙ্কিমচন্দ্র নদীকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন ‘চন্দ্রশেখর’ উপন্যাসে। রবীন্দ্রনাথের অসংখ্য কবিতা ও উপন্যাসে নদীর অপরিহার্যতা উজ্জ্বল। ‘নৌকাডুবি’তে নদীকেন্দ্রিক জেলে-মাঝিদের জীবনচিত্র আছে। ‘গোরা’তেও নদী আছে জীবনের গভীর উপলব্ধিতে। শরৎচন্দ্রের ‘রড় দিদি’ উপন্যাসে নদীর ছবি আছে, যে নদীকে ঘিরে আছে সাধারণ মানুষের জীবনকথা। ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসে জেলেদের জীবনচিত্র উঠে এসেছে আরো ব্যাপকভাবে। ‘শুভদা’ও এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। বিভূতিভূষণ ‘পথের পাঁচালী’র জন্য বাংলা সাহিত্যে অমরত্ব লাভ করেছেন। কিন্তু নদীকেন্দ্রিক উপন্যাসও তিনি লিখেছেন। সরাসরি নদীকেই উপন্যাসের বিষয় ও নামকরণ করেছেন। নদীভিত্তিক বাংলা উপন্যাসে তাঁর ‘ইছামতী’ উল্লেখযোগ্য সংযোজন। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কালিন্দী’ ও ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’ উপন্যাসে কালিন্দী ও কোপাই নদী মানুষ ও সমাজের জীবনে কীভাবে ভূমিকা রেখেছে তার অসাধারণ শিল্পবুনন লক্ষণীয়। তবে এ উপন্যাসের বিশেষ দিক ভৌগোলিক ও সামাজিক বিবর্তনে কোপাই যে ভূমিকা রেখেছে তা এ নদীকেন্দ্রিক মানুষেরা নিজেদের ঋণাবদ্ধে বন্দি মনে করে। দক্ষিণবঙ্গের নদী, নদীর ক‚লবর্তী মানুষ ও সুন্দরবনকে কেন্দ্র করে মনোজ বসু লিখেছেন ‘জল জঙ্গল’। ময়ূরাক্ষী নদীকে নিয়ে তিনি লিখেছেন ‘ময়ূরাক্ষী’ উপন্যাস। এ উপন্যাসে নদী ও বিনোদিনী যেন একাত্ম হয়ে গেছে। নদীর ভেতরই বিনোদিনী নিজেকে খুঁজে পেতে চেষ্টা করেছে। নদীর নিঃশব্দ বয়ে চলার ভেতরই নিজের জীবনকেই যেন দেখতে পায় বিনোদিনী। পদ্মা নদীকে কেন্দ্র করে অমরেন্দ্র ঘোষ লিখেছেন ‘চরকাশেম’ উপন্যাস। নদীভিত্তিক উপন্যাসগুলোর মধ্যে এ উপন্যাসটি সেভাবে আলোচিত নয়। ‘অথচ নদী ও চরজীবনকে কেন্দ্র করে উপন্যাসটি যথেষ্ট ব্যতিক্রম’। ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ বাংলা সাহিত্যে একটি বিখ্যাত উপন্যাস। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অসামান্য সৃষ্টি। জেলেপাড়ার মানুষের কাছে পদ্মা তাদের মায়ের মতো। পদ্মাকে ঘিরেই তাদের জীবন-স্বপ্ন-বেঁচে থাকা। পদ্মা আর জেলেপাড়ার মানুষ যেন অভিন্ন এক সত্তা। ‘অন্তর্জলী যাত্রা’ কমলকুমার মজুমদারের বিখ্যাত সৃষ্টি। নদীভিত্তিক অন্যান্য উপন্যাস থেকে এটি আলাদা। গঙ্গা নদীকে কেন্দ্র করে ‘অন্তর্জলী যাত্রা’ নির্মিত হয়েছে। কাহিনীর সর্বপর্যায়ে নিয়ন্ত্রিত হয়েছে গঙ্গা কর্তৃক। এ উপন্যাসের শুরু গঙ্গাতে, শেষও হয়েছে গঙ্গাতেই। ‘মহানন্দা’ উপন্যাসের রচয়িতা নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়। মহানন্দা নদীকে ঘিরেই এ উপন্যাসের বিষয়-আশয়। অমিয়ভূষণ মজুমদার-এর উপন্যাস ‘গড় শ্রীখণ্ড’। উপন্যাসে নদীকেন্দ্রিক উপন্যাসগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ‘গড় শ্রীখণ্ডে’ পদ্মা নদীর কথা বলা হয়েছে। ‘অন্তর্মুখী জীবন জিজ্ঞাসা আর বস্তুময় জীবন-সত্যের সমাহার দিয়ে পদ্মা তীরবর্তী পাবনার সেই অঞ্চল যা ফরিদপুর-নদীয় ঘেঁষা, আর চিকন্দি, বুধেডাঙা, চরণকাশি, মানিকদিয়ার গ্রাম ও বন্দর দিঘাকে পটভূমি হিসেবে ব্যবহার করে গড়ে উঠেছে ‘গড় শ্রীখণ্ড।’ অমিয়ভূষণ মজুমদারের অন্য বিখ্যাত উপন্যাস ‘মধু সাধুখাঁ’। নদীর প্রবাহের মতোই যে মানুষের জীবন-নদীর মতোই নানা বাঁক-খাওয়া, সে সত্যই এ উপন্যাসে প্রতিষ্ঠিত।

তিন.


ঔপন্যাসিক আকবর হোসেনের বিখ্যাত উপন্যাস ‘অবাঞ্ছিত’তেও নদী আছে। নায়িকা রোকেয়া নিজের জন্মভিটা ত্যাগ করে দাদুর সঙ্গে রাতের আঁধারে নদী পাড়ি দিয়েই আজমীরে রওয়ানা দিয়েছিল। তাঁর ‘দুদিনের খেলাঘরে’ উপন্যাসেও গড়াই নদীর কথা আছে। উপন্যাসের শুরুই হয়েছে গড়াই নদীর বর্ণনা দিয়ে। আকবর হোসেনের নিজের বাড়িও ছিল গড়াই নদীর পাড়ঘেঁষে। ধলেশ্বরী চরের মানুষের জীবনের উত্থান-পতনের কাহিনী নিয়ে কাজী আফসার উদ্দিন রচনা করেছেন ‘চর ভাঙা চর’। এটি পূর্ব-বাংলার প্রথম উপন্যাস হিসেবে স্বীকৃত। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ বাংলা সাহিত্যে বিখ্যাত প্রতিভা। তিনি ‘লাল সালু’ উপন্যাসের জন্য ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। ‘লাল সালু’ বাংলা উপন্যাসে যুগান্তরী এক সৃষ্টি। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ ‘লাল সালু’র মতো খ্যাতি অর্জিত উপন্যাস না হলেও সাহিত্যমূল্যে এর অবস্থান অনেক উচ্চে। নদীকে নামকরণে প্রধান করলেও এ উপন্যাসটি পুরোমাত্রায় নদীভিত্তিক নয়। নদীর অনুষঙ্গ আছে, আর সে নদীটির নাম বাকাল নদী। গঙ্গা এবং জেলেদের জীবন যে একই বৃত্তে বন্দি সে সত্য সবচেয়ে বেশি গভীর হয়ে উঠেছে সমরেশ বসুর ‘গঙ্গা’ উপন্যাসে। গঙ্গাকে ঘিরেই জেলেদের জীবন। গঙ্গাই যেন জেলেদের জীবনের নিয়ন্ত্রক। গঙ্গাকে ঘিরেই তাদের হাসি, তাদের কান্না। তাদের স্বপ্ন তৈরি এবং স্বপ্নভঙ্গের বেদনা-যন্ত্রণা সবই এই গঙ্গাকে ঘিরে। শামসুদ্দীন আবুল কালাম-এর নদীকেন্দ্রিক উপন্যাস ‘কাঞ্চনমালা’ ও ‘কাশবনের কন্যা’। ‘কাঞ্চনমালা’ উপন্যাসে পদ্মা এবং এর নানা শাখা-প্রশাখার কথা থাকলেও ‘কাশবনের কন্যা’ উপন্যাসে সুনির্দিষ্টভাবে কোনো নদীর নাম উল্লেখ নেই। কালী নদীকে কেন্দ্র করে সত্যেন সেন লিখেছেন ‘একুল ভাঙ্গে ওকুল গড়ে’। ‘পদ্মা প্রমত্তা নদী’র লেখক সুবোধ বসু। নদী যে মানুষের জীবনে কতোভাবে প্রভাব ফেলে অথবা নদী মানুষের জীবনকে কতোভাবে নিয়ন্ত্রণ করে তার দৃষ্টান্ত হতে পারে এ উপন্যাসটি। সারেংদের জীবন নিয়ে শহীদুল্লা কায়সার ‘সারেং বৌ’ রচনা করলেও, এ উপন্যাসেও রয়েছে নদীর কথা। নদীটির নাম কয়াল। এ নদীটি কদম ও নবিতুনের জীবনে মাতৃমমতায় বন্দি। কয়াল নদীটি এখানে শুধু নদী নয়- যেন মমতাময়ী এক মায়ের ছবি হয়ে ফুটে উঠেছে। ‘ধলেশ্বরী’ একটি উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। প্রবোধবন্ধু অধিকারী ধলেশ্বরী নদী এর পার্শ্ববর্তী মানুষের জীবনের কীভাবে প্রভাব ফেলেছে সে ছবিিিট নিখুঁতভাবে এ উপন্যাসে উপস্থাপন করেছেন। আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘কর্ণফুলী’ গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস। এ উপন্যাসে তিনি কর্ণফুলীর তীরে যে সব বিশেষ সম্প্রদায় বসবাস করে তাদের জীবনচিত্র তুলে ধরেছেন। বাংলাদেশের সব নদীর বুকেই নৌকা শোভাবর্ধন করে। সে সব নৌকো নানা ধরনের। নৌকাই যেন নদীর প্রধান অলংকার। কর্ণফুলী এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। তার বুকে শোভাবর্ধন করে সাম্পান। সাম্পান ছাড়া কর্ণফুলীকে কল্পনা করা যায় না। ঔপন্যাসিক এ উপন্যাসে সে ছবি সযতœভাবে এঁকেছেন। আবু বকর সিদ্দিক কবি হিসেবে খ্যাতি অর্জন করলেও উপন্যাস-রচনাতেও দক্ষতা দেখিয়েছেন। আবু ইসহাকের ‘পদ্মার পলিদ্বীপ’ বত্রিশ খণ্ডের উপন্যাসের বিস্তৃতায়নে পদ্মার চরের জীবন ব্যবস্থাপনা, চর দখল-বেদখলের প্রক্রিয়া পদ্ধতি, চরের বসতির অনিশ্চিত-উদ্বিগ্ন ‘ব্যক্তি’ মানুষের চালচিত্র, শোষক শক্তি জঙ্গুরুলার জয়-পরাজয়ের কার্যকর কাহিনী এবং আরশাদ মোল্লার মেয়ে রূপজানের উত্থাপন প্রয়াস- বস্তুত মূল কাহিনী। সাধারণত দুটো কাহিনীর একদিকে চর দখলকে কেন্দ্র করে আবর্তিত ঘটনাপ্রবাহ অন্যদিকে রূপজান-জরিনা-ফজলকেন্দ্রিক প্রেম-অনুবর্তী আখ্যান। কিন্তু তা মোটেই সমান্তরাল নয়, বরং পরিপূরক বর্ণিত। উপন্যাসকারের লক্ষ্যবিন্দু শ্রেণিশোষণ কাঠামো নিরূপণ; স্থিরকৃত-পরাস্ত কোনো জীবন নয়, যুদ্ধে জয়ী মানুষকে সমাজ বিবর্তনের পটে উন্মোচিত করা। তাই কেন্দ্রীয় চরিত্র ফজলের অতীত-বর্তমান ও তার আশ্রিত পেশা বা অবলম্বন বিচার করে লেখক কাহিনী শুরু করেন। মূলত ভেতর কাঠামোর-পট খুঁজে দ্ব›েদ্বর সূত্রকে স্পষ্ট করতে চান লেখক। উপন্যাস আরম্ভে ফজলের মাছ ধরা, মাছ বিক্রি, সংসারের হিসেব-টানাপড়েন বলতে গিয়ে ফ্ল্যাশ ব্যাকে আসে এরফান মাতবরের বাড়ি; ভাঙন, ‘পাতনা’ দিয়ে দিনগুজরান এবং বর্তমানে বসতির প্রসঙ্গ। বর্ণনের এ পর্যায়ে লেখক ফজলের মাছ ধরা সম্পর্কে বলেন, ‘ফজল লুকিয়ে-চুরিয়ে মাছ বেচে। গেরস্থের ছেলের পক্ষে মাছ বেচা নিন্দার ব্যাপার। আত্মীয়-কুটুম্বরা জানতে পারলে ছি-ছি করবে। হাসাহাসি করবে গাঁয়ের লোক। দুষ্ট লোকের মুখে মুখে হয়তো একদিন মালো বা নিকারি খেতাব চালু হয়ে যাবে।’ বাস্তবতায় ফজল সমস্ত সংস্কারের ঊর্ধ্বে উঠতে যেমন বাধ্য হয় এবং অন্যকেও তেমনি তার প্রয়োজন বোঝাতে সক্ষম হয়। উপন্যাসে খুনের চরের উদ্ভাবন, পুনরুদ্ধার, প্রত্যয়, মর্যাদা, বেদখলের কারণ, বড় ভাই রশীদের মৃত্যু, বৈষয়িক বুদ্ধিসম্পন্ন এরফান মাতবরের চর পুনর্দখলের প্রতিক্রিয়া এবং পরের অধ্যায়ে পদ্মার পলিদ্বীপের প্রতিরোধী যুদ্ধের ইঙ্গিত আচ্ছন্নতায় লটাবনিয়ার ইতিহাস, মাতবর আর সর্দারের দ্ব›দ্ব, রশীদের মৃত্যুর কারণ ও প্রতিক্রিয়া উচ্চারিত। আবুবকর সিদ্দিকের ‘জলরাক্ষস’ একটি বিশিষ্ট রচনা। এ উপন্যাসে সুনির্দিষ্টভাবে কোনো নদীর পরিচয় না থাকলেও তিনি ‘খুলনা-বাগেরহাটের নিম্নভূমির সংস্পর্শে আসা নদীর জীবন্ত চিত্র উপস্থাপিত করেছেন।’ বিভিন্ন উপন্যাসে নদী ও মানুষ একে অপরের সম্পূরক হিসেবে উপস্থাপিত হলেও, এক্ষেত্রে ‘জলরাক্ষস’ ব্যতিক্রম। এ উপন্যাসে নদী সব সময়ই মানুষের জীবনে নীতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। বরং সে মানুষের জীবনে নির্মম নিষ্ঠুর প্রতিপক্ষ ও ভয়ার্তরূপে ধ্বংসকারী। প্রফুল্ল রায়ের নদীভিত্তিক উপন্যাস ‘কেয়াপাতার নৌকো’। এ উপন্যাসে মানুষ ও নদী যেন একে অপরের বন্ধু। অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে’ শতিলক্ষ্যা নদী ও তার তীরবর্তী মানুষের সুখ-দুঃখের ছবি ফুটে উঠেছে। মেঘনা নদীও এ উপন্যাসে অনুষঙ্গ। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘খোয়াবনামা’তে নদীর ছবি আছে। সাধন চট্টোপাধ্যায়ের ‘গহিন গাঙ’ এবং তপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নদী মাটি অরণ্য’ নদীকেন্দ্রিক উপন্যাস। ‘নদী মাটি অরণ্য’ উপন্যাসে সুন্দরবন এলাকার মুড়িগাঙ, কালনাগিণী, ঘুঘুডাঙা, গোবাদিয়া, সপ্তমুখী প্রভৃতি নদীর কথা আছে। আছে পশ্চিমবঙ্গের ভাগীরথী ও হুগলী নদী। শওকত ওসমানের ‘জলাংগী’ নদীভিত্তিক ভিন্নমাত্রার উপন্যাস। মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে যে সব উপন্যাস রচিত হয়েছে, সে সব উপন্যাসেও নদী অপরিহার্য অনুষঙ্গ। ‘জলাংগী’ তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সেলিনা হোসেনের নদীভিত্তিক গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস ‘জলোচ্ছ¡াস’ ও ‘পোকামাকড়ের ঘরবসতি’। ‘জলোচ্ছ¡াস’ উপন্যাসে আগুনমুখা নদী আছে বেশ জোরালোভাবে। আর ‘পোকামাকড়ের ঘরবসতি’ উপন্যাসের ‘কাহিনী নদীকেন্দ্রিক নয় সমুদ্রকেন্দ্রিক। কিন্তু যে সমাজের জীবন-জীবিকার সন্ধান মেলে, তাদের বসবাস আসলে সমুদ্র মোহনায় প্রবাহিত নাফ নদীর তীরে। উপন্যাসের পাত্র-পাত্রীদের অন্নের সংস্থান হয়েছে সমুদ্রে। কিন্তু তাদের আশ্রয়স্থল হয়েছে নাফ নদীর তীরবর্তী অঞ্চল।’


চার.


বাংলা উপন্যাস-সাহিত্যে নদীর বিষয়টি নানাভাবেই অপরিহার্য হয়ে পড়ে। আকর্ষণ-বিপ্রকর্ষণে নদী প্রতিটি মানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ত। মানুষের জীবনযাপন, সভ্যতা, ইতিহাস, আন্দোলন-সংগ্রাম-সবকিছুতেই নদী দৃঢ়তর ভূমিকা পালন করে। মানুষের জীবনে নদী কখনো বন্ধু, কখনো ভয়ঙ্কর প্রতিপক্ষ ও ধ্বংসকারী। নদীকে এড়িয়ে মানুষের জীবন গড়া ও সভ্যতার ঐশ্বর্য নির্মাণ অকল্পনীয়। নদীভিত্তিক আঞ্চলিক বিভিন্ন উপন্যাসে এ সত্য নানাভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। শিল্পে প্রকরণ-বৈশিষ্ট্যের মধ্যে পাঠ (ঞবীঃ) যাচাই করা যায়। নদী-বিষয়ী উপন্যাসকাররা কেমন রচনাকার, তাঁর স্বাতন্ত্র্য কি, বিষয়-নির্বাচনে তার যৌক্তিকতার ইঙ্গিত কোন ধরনের- এ প্রশ্নগুলোতে সরল ভাষ্যে হয়তো যে কোনো লেখককেই চিনে নেয়া যায়। কিন্তু লেখক বিশেষত এখানকার আলোচ্য বিষয়ক উপস্থাপনে চর-নদী-অঞ্চল জীবনাগ্রহ- তার নির্মাণ-প্রক্রিয়া, সংহার মূর্তির শৈলী-ভাষা-শিল্প হওয়ার প্রক্রিয়ায় পদ্ধতির ব্যবহার কিংবা আবহ রচনার সৃষ্টি-কৌশলে সামগ্রিকভাকে প্রয়োজনীয় দিকসঞ্চারী- যা উপর্যুক্ত আলোচনায় উঠে এসেছে। তাই প্রাসঙ্গিকভাবে বলা চলে : অং ষধহমঁধমব, রং ঢ়ঁঃ ঃড় বীঢ়ৎবংং ঃযব য়ঁধষরঃু ড়ভ ঃযব বীঢ়বৎরহপব রহ য়ঁবংঃরড়হ; ধহফ ঃযব ঁংবং ড়ভ ঢ়ড়রহঃ ড়ভ ারবি হড়ঃ ড়হষু ধং সধফব ড়ভ ফৎধসধঃরপ ফবষরসরঃধঃরড়হং, নঁঃ সড়ৎব ঢ়ধৎঃরপঁষধৎষু, ড়ভ ঃযবসধঃরপ ফবভরহরঃরড়হ.’

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন