মনোজিৎকুমার দাস
তারাশঙ্করের জন্ম পশ্চিমবঙ্গের রাঢ় অঞ্চলের
বীরভূমের লাভপুর গ্রামের এক ক্ষয়িষ্ণু জমিদার বংশে ১৮৯৮ সালের ২৩ আগস্ট। বাবার নাম
হরিদাস বন্দ্যোপাধ্যায় আর মাতার নাম প্রভাবতী দেবী। তারাশঙ্করের ভাষায়, তাঁর বাবা ও
পিসিমা শৈলজা ঠাকুরাণী ছিলেন সেকালের প্রতিনিধি। অন্যদিকে তাঁর মা প্রভাবতী দেবী ছিলেন
পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের সমর্থক ও বিদুষী মহিলা। মাত্র আট বছর বয়সে তারাশঙ্কর বাবাকে
হারান। তিনি তাঁর বিধবা পিসিমা ও নিজের মায়ের স্নেহ ভালবাসায় লালিত পালিত হন।
মাতা প্রভাবতী দেবীর ধর্মশাস্ত্রের অগাধ অনুশীলন এবং পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাব তারাশঙ্করের মানস গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখে। প্রভাবতীর বাস্তব দেশপ্রেম শৈশবেই তারাশঙ্করকে উদ্দীপনা যোগায়। লাভপুরের যাদবলাল হাইস্কুল থেকে তিনি ১৯১৬ সালে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর উমাশশী দেবীর সাথে তাঁর বিয়ে হয়। তারপর তিনি কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হয়ে পড়াশোনা শুরু করেন কিন্তু রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হবার কারণে তাঁর পড়াশোনা আর এগোয়নি। তিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যোগদান করেন। মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তিনি ব্রিটিশবিরোধী কর্মকা-ে আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৩০ সালে আইন অমান্য আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে গ্রেফতার বরণ করেন। বিচারে তাঁর কয়েক মাসের জেল হয়। কারাগারে বসে তিনি সাহিত্যচর্চা শুরু করেন। বাংলা কংগ্রেসের রাজনীতির উপদলীয় কোন্দল ও সংঘাতের কারণে তিনি রাজনীতির প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েন। কারামুক্তির পর তিনি প্রতিজ্ঞা করেন যে সাহিত্য সাধনার মাধ্যমেই তিনি দেশ সেবা করবেন।
মাতা প্রভাবতী দেবীর ধর্মশাস্ত্রের অগাধ অনুশীলন এবং পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাব তারাশঙ্করের মানস গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখে। প্রভাবতীর বাস্তব দেশপ্রেম শৈশবেই তারাশঙ্করকে উদ্দীপনা যোগায়। লাভপুরের যাদবলাল হাইস্কুল থেকে তিনি ১৯১৬ সালে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর উমাশশী দেবীর সাথে তাঁর বিয়ে হয়। তারপর তিনি কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হয়ে পড়াশোনা শুরু করেন কিন্তু রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হবার কারণে তাঁর পড়াশোনা আর এগোয়নি। তিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যোগদান করেন। মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তিনি ব্রিটিশবিরোধী কর্মকা-ে আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৩০ সালে আইন অমান্য আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে গ্রেফতার বরণ করেন। বিচারে তাঁর কয়েক মাসের জেল হয়। কারাগারে বসে তিনি সাহিত্যচর্চা শুরু করেন। বাংলা কংগ্রেসের রাজনীতির উপদলীয় কোন্দল ও সংঘাতের কারণে তিনি রাজনীতির প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েন। কারামুক্তির পর তিনি প্রতিজ্ঞা করেন যে সাহিত্য সাধনার মাধ্যমেই তিনি দেশ সেবা করবেন।
তারাশঙ্করের লেখালেখির সূত্রপাত কবিতা দিয়ে হলেও গদ্যশিল্পী হিসেবে বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে
স্বমহিমায় আত্মপ্রকাশ করেন। তবুও তাঁর লেখা কবিতার কথা না বললেই নয়। একটি মাত্র কাব্যগ্রন্থ
‘ত্রিপত্র’ (১৯২৬) প্রকাশ করেও তিনি ছিলেন মনে প্রাণে আগাগোড়া কাব্যগ্রাহী। পরবর্তীকালপর্বে
তাঁর লেখা গল্প- উপন্যাসের কাব্যিক গদ্যের উপস্থিতি উজ্জ্বল মহিমায় ভাস্বর। তাঁর প্রথম
উপন্যাস ‘চৈতালি ঘূর্ণি’ (১৯৩৯) এর প্রথম কয়টি ছত্র থেকে আমরা তাঁর গদ্যের কাব্যিক
অনুষঙ্গকে নিরীক্ষণ করতে পারি। “অনাবৃষ্টির বর্ষায় খররৌদ্রে সমস্ত আকাশ যেন মরুভূমি
হইয়া উঠিয়াছে; সারা নীলিমা ব্যাপিয়া একটা ধোঁয়াটে কুয়াশাাচ্ছন্ন ভাব। মাঝে মাঝে উত্তপ্ত
বাতাস হু হু করিয়া একটা দাহ বহিয়া যায়।” অবশ্যই এই রচনার মধ্যে কবিতার বিভা ফুটে উঠেছে।
‘চৈতালি ঘূর্ণি’ উপন্যাসে গ্রামের দরিদ্র চাষী গোষ্ঠ ও তার স্ত্রী দামিনী গ্রাম্য শোষণের
হাত থেকে বাঁচার জন্য শহরে যায়। গোষ্ঠ কারখানায় চাকরি নেয়। স্বামী-স্ত্রী বস্তিতে থকে।
ধনতান্ত্রিক যাঁতাকলে পড়ে গোষ্টের পিষ্ট হবার কাহিনী তারাশঙ্কর সুন্দর অনুষঙ্গে ‘চৈতালি
ঘূর্ণি’ উপন্যাসে উপস্থাপন করেছেন। প্রসঙ্গক্রমে আরো বলা যায়, ‘রসকলি’র মতো গল্পে,
‘কবি’ ও ‘রাইকমল’-এর (১৯৪৩) মতো উপন্যাসে রোমান্স আর রসঘন অনুষঙ্গ তারশঙ্করের কবিতা
প্রীতিরই উজ্জ্বল স্বাক্ষর।
বাংলা সাহিত্যে স্বমহিমায় তাঁর আত্মপ্রকাশের পটভূমির প্রতি প্রথমে আলোকপাত করা যেতে
পারে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালপর্বে সারাবিশ্বে নানা ক্ষেত্রের সাথে সাথে বিশ্বসাহিত্যেও
পরিবর্তনের হাওয়া লাগে। বাঙালী জনগোষ্ঠীর মধ্যে যে পরিবর্তন আসে তা বাংলা সাহিত্যের
গল্প-উপন্যাসে ধীর লয়ে প্রতিফলিত হয়। রবীন্দ্রনাথ প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালপর্বের
ঝড়ো হাওয়াকে হৃদয়ঙ্গম করে কালের স্বভাবসিদ্ধ গতিপ্রকৃতিকে তুলে ধরেন তার বিভিন্ন লেখায়।
তারপর এক সময় এলো যখন বাংলা সাহিত্যে বুদ্ধদেব বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র, শৈলজানন্দ,
নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাস, অচিন্ত্য সেনগুপ্ত প্রমুখসহ একদল তরুণের আবির্ভাব ঘটল।
সময়টা ছিল বিশ শতকের তৃতীয় দশক। তারা রবীন্দ্র প্রভাব বলয় থেকে মুক্তিতে উচ্চকিত, তাদের
লেখায় নতুনত্বের আভাস। বয়সের দিক থেকে তারাশঙ্কর সে সময়ের তরুণ লেখকদের চেয়ে অগ্রজ
হলেও লেখালেখির ক্ষেত্রে তাঁর আবির্ভাব তাদের অনেকেরই কিছু পরে।
তারাশঙ্কর তাঁর গল্প-উপন্যাসে বিশেষভাবে তুলে ধরেছেন বীরভূম-বর্ধমান অঞ্চলের সাঁওতাল,
বাগদি, বোষ্টম, বাউরি, ডোম, গ্রাম্য কবিয়াল সম্প্রদায়ের কথা। ছোট বা বড় যে ধরনের মানুষই
হোক না কেন তারাশঙ্কর তাঁর সব লেখায় মানুষের মহত্ত্ব ফুটিয়ে তুলেছেন, যা তার সব লেখার
বড় বৈশিষ্ট্য। সামাজিক পরিবর্তনের বিভিন্ন চিত্র তাঁর অনেক লেখায় গল্প-উপন্যাসের বিষয়।
তাঁর লেখায় ওই সব সম্প্রদায়ের মানুষের অশিক্ষা, সামাজিক উপেক্ষা, অবহেলা, দৈন্যদশা,
রিক্ততা ও কুসংস্কারের বাস্তব চিত্র তিনি অত্যন্ত মুনসিয়ানার সঙ্গে তুলে ধরেছেন। তারাশঙ্করের
প্রথম গল্প ‘রসকলি’ পরে লেখা ছোটগল্পের সাহিত্য সম্ভার হচ্ছে ‘বেদেনী’, ‘তিনশূন্য’,
‘যাদুকরী’, ‘স্থলপদ্ম’, ‘হারানো সুর’, ‘ইমারত’, ‘কামধেনু’, ‘মা’, ‘শ্মশান ঘাটের পথে’,
‘বড় বৌ’, ‘নাটু মোক্তারের সওয়াল গল্প’ ইত্যাদি। এ সব গল্পে তাঁর প্রথম গল্প ‘রসকলি’-এর
প্রতিভার স্বাক্ষরের প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়।
‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’ (১৯৫১), ‘গণদেবতা’ (১৯৪২), ‘ধাত্রী দেবতা’ (১৯৩৮), ‘কাালিন্দী’
(১৯৩৯) ‘মন্বন্তর’ (১৯৪৪), ‘পঞ্চগ্রাম’ (১৯৪৪), ‘সপ্তপদী’ (১৯৫৭), ‘রতিভঙ্গ’(১৯৬২),
‘রাইকমল’ (১৯৪৩), ‘কবি’(১৯৪৪),‘কীর্তি হাটের কড়চা’ (১৯৬৭) ইত্যাদি ধ্রুপদী আঙ্গিকের
উপন্যাস লিখে বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে তিনি বিশেষ আসন লাভ করেছেন।
তিনি চার দশকের বেশিকাল ধরে সাহিত্য সাধনায় ব্রতী ছিলেন। ১৯২৯-৩০ থেকে ১৯৭১ সালের মৃত্যু
অবধি ১টি কাব্যগ্রন্থ, ৬৫টি উপন্যাস, ২০০-এর অধিক ছোটগল্প, ১২টি নাটক, অস্যংখ্য প্রবন্ধ,
স্মৃতিকথা ও আত্মজীবনী রচনা করেন।
তাঁর রচনার বিষয় এবং রচনার চরিত্রগুলোর দিক থেকে দুটো ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমটা হল
গ্রাম্যজীবন ভিত্তিক নিম্নবিত্ত সমাজের ব্রাত্যজনদের সুখ-দুঃখের কাহিনী, আর দ্বিতীয়টা
হল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে লেখা কাহিনী। একটা ভাগ ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’ পর্যন্ত। আর
একটা ভাগ ‘মন্বন্তর’ থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত। ‘মন্বন্তর’ ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’এর
আগে লিখিত হলেও ‘মন্বন্তর’ তাঁর সাহিত্য জীবনের রূপান্তর সূচনা করে।”
‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’ তারাশঙ্করের প্রথম ধারার শেষ পর্বের মহাকাব্যিক উপন্যাস। এই
উপন্যাসে তারাশঙ্কর ভূমি নির্ভর আভিজাত্য বোধে জারিত জীবন ব্যবস্থার মাঝে বিত্ত-মর্যাদা-সচেতন
অর্থদৃপ্ত অহমিকার অনুষঙ্গকে উপস্থাপন করেছেন। ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’-এর একটা অনুষঙ্গ
তাঁর নিজের জীবন কাহিনীরই যেন প্রতিচ্ছবি। উচ্চকোটির জীবন আর নিম্নœকোটির জীবনযাত্রার
সংঘাত এই উপন্যাসে ব্যক্ত হয়েছে। ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’ উপন্যাসে তারাশঙ্কর কৌম সমাজের
গোষ্ঠী জীবনকে বিষয়ভুক্ত করেছেন। উপন্যাসটিতে রয়েছে সমান্তরাল দুটি কাহিনী। বাঁশবাদি
গ্রামের পাশ দিয়ে প্রবাহিত কোপাই নদীর বিখ্যাত হাঁসুলি বাঁকের কাহার সম্প্রদায়ের সুসংহত
জীবনের পতন, কৃষি নির্ভর জীবনের পরিসমাপ্তি ও কাঁশবন ঘেরা উপকথার হাঁসুলি বাঁক বিরানভূমি
পরিণত হওয়ার কাহিনী ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা।’ কাহার সম্প্রদায়ের উচ্ছেদ ও বুর্জোয়া
ধনতান্ত্রিক সমাজের যন্ত্রকলে তাদের দাসে পরিণত হবার কাহিনী ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা।’
তারাশঙ্করের ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনের অন্তর্দ্বন্দ্ব এই উপন্যাস লিখতে তাঁকে সাহায্য
করেছিল বলে ভাবলে বেশি ভাবা হয় না। ১৯১৪ থেকে ১৯১৯ সাল পর্যন্ত প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালে
তারাশঙ্কর বয়ঃসন্ধিক্ষণ পেরিয়ে যৌবনে পদার্পণ করছেন সবেমাত্র। ওই সময় তারাশঙ্করের মনের
উপর যুদ্ধের প্রভাব পড়েছিল। তিনি লক্ষ্য করেছিলেন রাঢ় অঞ্চলের গ্রাম জীবনেও জীবনজীবিকায়
পরিবর্তনের সূচনা দেখা দিয়েছে। ওই সময় বাঙালীরা সদ্যসূচিত কয়লা খনির ব্যবসায় জড়িয়ে
পড়ছ্ েঅনেকেই লাভপুরের ক্ষয়িষ্ণু জমিদারির আওতা থেকে বের হয়ে কয়লাখনির ব্যবসায় নিজেদের
নিয়োজিত করছেন। তাদের এলাকার একটা জমিদারও এ ব্যবসায় আত্মনিয়োগ করে। ওই পরিবারে তারাশঙ্কর
বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন। ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’য় রাঢ় অঞ্চলের গ্রাম্য জীবনের আর্থ-সামাজিক
দ্বন্দ্ব সংঘাতের কাহিনীই তারাশঙ্কর তুলে ধরেছেন কাহিনী নির্ভর কাব্যিক গদ্যে।
দ্বিতীয় ধারার উপন্যাসের প্রসঙ্গে নাম করতে হয় ‘মন্বন্তর’-এর । এ উপন্যাস অনেকাংশে
প্রগতি আন্দোলনের (১৯৩৫-৫০) দ্বারা অনুপ্রাণিত। ‘মন্বন্তর’ উপন্যাসটি গ্রন্থিত আকারে
প্রকাশিত হয় ১৯৪৪ সালে। স্বাধীনতা আন্দোলন ও দেশবিভাগ প্রাক পর্বের রাজনৈতিক, সামাজিক
জটিলতা তারাশঙ্করের মনকে আন্দোলিত করে। ভয়াবহ মন্বন্তরের চিত্র তিনি প্রত্যক্ষ করেন।
তিনি রাজনৈতিক জীবনবোধে উজ্জীবিত হন, তার পরেই তিনি রচনা করেন ‘মন্বন্তর’, ‘গণদেবতা’,
‘পঞ্চগ্রাম’ এর মতো রাজনৈতিক মতাদর্শের অনুষঙ্গে লিখিত উপন্যাসগুলো। তারাশঙ্করের জীবনবোধের
প্রথম থেকেই রাজনীতির উপস্থিতির কথা আমরা জানি। এ জীবনবোধের কারণেই তিনি ‘গণদেবতা’,
‘পঞ্চগ্রাম’, ‘ধাত্রীদেবতা’ উপন্যাস ত্রয় রাজনৈতিক মহাকাব্যিক অনুষঙ্গে লিখতে সমর্থ
হন বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে। তিনি বারবার এসব উপন্যাসে তাঁর স্বভূমি লাভপুরের গ্রাম্যজীবনের
কথাই যেন তুলে ধরেছেন।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর গল্প-উপন্যাসে যে বহুমাত্রিক অনুষঙ্গের অবতারণা করেছেন
তা অন্য লেখকদের মধ্যে খুব কমই দেখা যায়। তিনি তাঁর গল্প- উপন্যাসে ভয়ঙ্কর আদিমতান্ত্রিক
ঐতিহ্য, প্রেম, অপ্রেম, পরকীয়া, সৌখিনতা, বিলাসিতা, বৈরাগ্য, বৈষ্ণব সহজিয়াভাব, অবহেলা,
প্রবঞ্চনা, তঞ্চকতা, দ্বন্দ্ব- সংঘাত, সুখ-দুঃখ, ব্যথা-বেদনা, ভাঙা-গড়ার কাহিনী বিধৃত
করেছেন নানা অনুষঙ্গে, নানা আঙ্গিকে, নানা ঘরাণায়। ধ্রুপদ আঙ্গিকের গল্প-উপন্যাস ছাড়াও
প্রেম-ভালবাসা, বিরহ-বিচ্ছেদ এবং পরকীয়া প্রেমের গল্প- উপন্যাস লিখেছেন তার উদাহরণ
‘চাঁপাডাঙার বৌ’,‘জলসাঘর’,‘ব্যর্থ নায়িকা’, ‘প্রেম ও প্রয়োজন’, ‘ছলনাময়ী’, ‘মঞ্জরী
অপেরা’ ইত্যাদি। তিনি ‘সপ্তপদী’, ‘যতিভঙ্গ’ উপন্যাসে অবাঙালী নাগরিক জীবন নিয়ে প্রগাঢ়
ভালবাসার গল্প লিখেছেন তা নিঃসন্দেহে অসাধারণ।
তারাশঙ্কর যে সমস্ত মঞ্চ সফল নাটক রচনা করেছেন তার মধ্যে রয়েছে ‘কালিন্দী’ (১৯৪১),
‘দুই পুরুষ’, ‘দ্বীপান্তর’, ‘বিংশ শতাব্দী,( ১৯৪৫) ‘পথের ডাক’, ‘চকমকি’ ইত্যাদি। তাঁর
অনেক উপন্যাস ও গল্পের কাহিনী নিয়ে সিনেমা হয়েছে।
বাংলা সাহিত্যে সৃজনশীল সৃষ্টি কর্মের জন্য তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক
পুরস্কারে ভূষিত হন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শরৎস্মৃতি পুরস্কার, জগত্তারিণী স্মৃতি
পুরস্কার লাভ করেন। ‘আরোগ্য নিকেতন’ উপন্যাসের জন্য তিনি রবীন্দ্রপুরস্কার পান। ভারতীয়
সাহিত্য একাডেমি ‘আরোগ্য নিকেতন’ উপন্যাসের জন্য তাঁকে সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার প্রদান
করে। ‘গণদেবতা’ উপন্যাসের জন্য তিনি জ্ঞানপীঠ পুরস্কার লাভ করেন। সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ
ভারত সরকার তাঁকে পদ্মশ্রী ও পদ্মভূষণ খেতাবে ভূষিত করে।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৭১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর লোকান্তরিত হলেও বাংলা সাহিত্যে
অবিস্মরণীয় অবদান রাখার জন্য তিনি চিরভাস্বর হয়ে থাকবেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন