শনিবার, ১৩ মে, ২০১৭

আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ‘দি ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সী’

তানভীর আহমেদ

আর্নেস্ট হেমিংওয়ে এর বিখ্যাত উক্তি ...
আরনেস্ট হেমিংওয়ে
--- হার স্বীকার নয়, নিরন্তর সংগ্রামই জীবন...
কাহিনীটা শুরু হচ্ছে এভাবে : ‘বুড়োমানুষ, ডিঙিতে চেপে গালফ স্ট্রীমে একাকী মাছ ধরে বেড়ায়। আজ চুরাশি দিন একটিও মাছ পায়নি ও। প্রথম চল্লিশ দিন একটা ছেলে ছিল ওর সঙ্গে। কিন্তু চল্লিশ দিন পরেও যখন কোন মাছ উঠলো না, ছেলেটার বাবা-মা ওকে বলল বুড়ো এখন নির্ঘাত গালাও, অর্থাৎ চরম অপয়া হয়ে গেছে।


ওদের নির্দেশে অন্য নৌকায় চলে গেছে ছেলেটা এবং পয়লা হপ্তায়ই বড় বড় তিনটে মাছ ধরেছে ওরা। রোজ রোজ বুড়োকে শূণ্য ডিঙি নিয়ে ফিরতে দেখে খারাপ হয়ে যায় ছেলেটার মন। বুড়ো এলেই ও দৌড়ে চলে যায় কাছে; মাছধরা দড়ি বা কোঁচের বোঝা, হারপুন আর নয়ত মাস্তলে গোটান পাল বয়ে আনতে সাহায্য করে। পালে ময়দার বস্তার অসংখ্য তালি, গোটান অবস্থায় দেখে মনে হয় যেন স্থায়ী পরাজয়ের ধ্বজাটি। বুড়োর চেহারা রুগ্ন, কিষ্ট। অসংখ্য বলিরেখা নেমে গেছে ঘাড়ের নীচে। ওর গালে রোদপোড়া ক্রান্তীয় সমুদ্রের প্রতিফলনে হিতৈষী ক্যান্সারের বাদামী ফুসকুড়ি। মুখের অনেকদূর অবধি নেমে গেছে ওগুলো। হাত দুটো ক্ষতবিক্ষত, বড়শির দড়িতে ভারি মাছ টেনে তুলবার ফল। তবে ওগুলোর কোনটিই তাজা নয় - মাছহীন মরুভূমির ক্ষয়ের মতই প্রাচীন। ...........ওর সবকিছুতেই কেমন যেন প্রাচীনত্বের ছোঁয়া। শুধু চোখ দুটোই যা ব্যতিক্রম, সেখানে সাগরের নীল; জ্বলজ্বলে ও অপরাজেয়। --------------এই ক’টা লাইনেই আমরা পেয়ে যাই একটা সমাজের চালচিত্র। জেলেপাড়ার সেই জীবন-প্রণালীর অত্যন্ত ক্ষুদ্র এই দিক্টা স্পষ্ট করে তোলে আতœ-প্রবণতামুখীন সামাজিক প্রেক্ষিতটি। কাহিনীর প্রধান চরিত্রটি সময়ের সঙ্গে লড়াই করতে করতে বিপন্ন, বিপর্যস্ত হতে হতে পৌঁছে গেছে বার্ধক্যে। তবুও বেঁচে থাকার সংগ্রামে মাছ ধরতে যায় সে গালফ স্ট্রীমে। আমরা জানতে পারছি যে একটা ছেলে যেত ওর সঙ্গে, কিন্তু একটানা চুরাশি দিন কোন মাছ না ওঠায় বুড়োর ডিঙিতে, ছেলেটার বাবা-মা বুড়োর কাছ থেকে ছেলেটাকে সরিয়ে নিয়ে অন্য নৌকায় দিয়ে দেয়। বেঁেচ থাকার তাগিদে মুনাফা-নির্ভর সমাজে মানুষ কি করে একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তার একটি চিত্রকল্পও স্পষ্ট হয় আমাদের কাছে। একই সঙ্গে বুড়োর প্রতি ছেলেটির মমতা এবং সহমর্র্মিতা প্রমাণ করে যে মুনাফা আর লোভের অন্তহীনতা নিঃশেষ করে দিতে পারে না মানুষে মানুষে মানবীয় সম্পর্কটিকে। সেটি অবশিষ্ট থাকে বলেই স্বপ্ন দেখতে পারে মানুষ, সুন্দর সময়ের স্বপ্ন। যে সময়ে মুনাফা নয়, পুঁজির অব্যাহত শাসন নয়, মানবিক সংষ্কৃতিই নির্ধারক ভূমিকা নেবে জীবনের চরিত্র নির্মাণে।

তবে এই উপন্যাসে সমাজের চরিত্রটি আসলে ততোটা গুরুত্বপূর্ন নয়, যতোটা গুরুত্বপূর্ন ব্যক্তির চরিত্র। ব্যক্তির কথাই আসলে বলে এই উপন্যাসটি, সেই ব্যক্তির কথাই ঘুরে-ফিরে আসে, যে সংগ্রামী এবং স্বপ্ন দেখে। কাহিনীর শুরুতেই আমরা দেখতে পাই প্রধান চরিত্র বুড়ো লোকটা খুব বেশি একা, নিঃসঙ্গ। জীবন সংগ্রামে পিছিয়ে পড়া একজন ও। প্রাচীন থেকে প্রাচীনতর হচ্ছে তার সবকিছুই, কিন্তু চির উজ্জল ওর দুটি চোখ ব্যতিক্রম সব কিছু থেকেই। হেমিংওয়ে বলছেন, সেই চোখ দুটোতে অস্তিত্বমান সাগরের নীল - যা জ্বলজ্বলে ও অপরাজেয়। এবং সবশেষে, এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে আমাদের আর দ্বিধা থাকে না যে, হেমিংওয়ের ‘দি ওল্ড ম্যান এন্ড দ্য সী’র মূল প্রতিপাদ্যটি হচ্ছে এই যে : হার স্বীকার নয়, নিরন্তর সংগ্রামই জীবন।

হেমিংওয়ে তাঁর লেখা চারটি উপন্যাসের মাঝে সর্বশেষটি ‘দি ওল্ড ম্যান এন্ড দ্য সী’ লেখেন ১৯৫৪ সালে, যখন তাঁর নিজেরই বয়স প্রায় বার্ধক্যে উপনীত - তিপ্পান্ন; তবে তাঁর নিজের বয়স তাঁকে এই উপন্যাসের কেন্দীয় চরিত্র বাছাইয়ে বুড়ো সান্তিয়াগোকে নির্বাচনে উৎসাহিত করেছে, সেটি মনে করা অবান্তর। তাঁর নিজের অর্জিত দীর্ঘ সময়ের সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতায় উদ্ধুদ্ধ হয়েই এই ক্যাসিক উপন্যাসটা লিখেছেন হেমিংওয়ে। আর শেষপর্যন্ত উপন্যাসটা অনেকটা রুপকধর্মী রচনায় প্রতিস্থাপিত হয়। জীবনের মূল নির্যাসের খুব, খুবই কাছাকাছি চলে যাই আমরা সান্তিয়াগোর ছোট্ট ডিঙি নৌকায় চেপে!

১৮৯৯ সালের ২১ জুলাই আর্নেস্ট মিলার হেমিংওয়ে জন্মগ্রহন করেন। স্থানটা শিকাগোর উপকন্ঠে, ইলিনয়ের ওল্ডপার্ক অঞ্চলে। হেমিংওয়ের যে মানস-গঠনটি তৈরী হয় ধীরে ধীরে তাতে তাঁর ডাক্তার পিতার প্রভাব সর্বাধিক, পরিবারের সবার মাঝে। সেই হেমিংওয়ে ছোটবেলা থেকেই অত্যন্ত বৈচিত্র্যময় জীবনের অধিকারী হোন। আশৈশব ডানপিটে এই মানুষটি বাসা থেকে পালিয়ে দিন মজুরি করেছেন এবং তাঁর সময়কালে সংঘটিত প্রতিটি যুদ্ধে জড়িত হয়েছিলেন আন্তরিকতার সঙ্গে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তো আছেই, সেই সঙ্গে আছে ১৯৩৬ সালের স্পেনের গৃহযুদ্ধও। সেই গৃহযুদ্ধে তিনি ছিলেন একজন সাংবাদিক, যদিও মূল ভূমিকাটা তিনি রেখেছেন স্পেনের স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত নিপীড়িত জনগনের পক্ষাবলম্বন করে।

যে আর্নেস্ট হেমিংওয়ের কথা আমরা জানি, তিনি আসলে তাঁর ভিন্ন এবং এক, অর্থাৎ বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ দুটি সত্তার সংমিশ্রণ। ‘বীর হেমিংওয়ে’ এবং ‘সাধারণ মানুষ হেমিংওয়ে মিলে গড়ে উঠেছে প্রবাদপুরুষ আর্নেস্ট হেমিংওয়ে। এই কালজয়ী মানুষটি তাঁর জীবনকে অতিক্রম করতে দেখেছেন হাজারো ঘাত-প্রতিঘাতের ভেতর দিয়ে। যে তিনটি বিয়ে তিনি করেছিলেন সেগুলোর কোনটাই শেষপর্যন্ত টেকেনি। ১৯১৮ সালে প্রথম মহাযুদ্ধে ইতালীর ফসালটা ডি-পিয়ার্ভায় মর্টার শেলের আঘাতে হেমিংওয়ে আহত হলে একের পর এক অস্ত্রোপচারে তাঁর শরীর থেকে বেরিয়ে আসে ২৩৭টি লোহার টুকরো। এছাড়া যুদ্ধক্ষেত্রে আরো নানা ধরণের দুর্ঘটনা তো আছেই, এগুলো বাদ দিয়েও দু’বার অটো এবং দু’বার প্লেন দূর্ঘটনায় পড়েন তিনি। মগজে হেমিংওয়ে চোট পান বারো বার। বাবার শেষ বয়সে আত্মহত্যা প্রচন্ড মানসিক চাপ সৃষ্টি করে তাঁর ওপর। কিন্তু হেমিংওয়ে তাঁর সেই আত্ন-প্রত্যয়ের জোরে সেই আঘাত আর বিঘ্নগুলোকে অতিক্রম করে যান শেষ পযর্ন্ত। বুড়ো সান্তিয়াগোও তার শ্রষ্টার মতোই অন্তর্গত শক্তিতে পর্বতময় বাধা আর বিঘ্নগুলোর কাছে পরাজিত না হয়ে এগিয়ে যায় সামনের দিকে। হেমিংওয়ের সৃষ্ট অন্যান্য কেন্দ্রীয় চরিত্রগুলোও প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে এক সুস্পষ্ট অপরাজেয় দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে উপস্থিত হয়। পরাজয় জীবনের শেষ কথা নয়, এগিয়ে চলার অভীপ্সায়ই জীবনের এগিয়ে চলা - হেমিংওয়ে নিজস্ব এবং তাঁর সৃষ্ট গল্প-উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্রগুলোর যাপিতে জীবনের মাধ্যমে এ কথাই বলেন নিরন্তর।

আমরা ব্যাক্তি হেমিংওয়ের জীবন অথবা তাঁর রচনার সাহিত্যমূল্য নির্ণয়ে এ মুহূর্তে উৎসাহী নই। এ লেখার উদ্দেশ্য হেমিংওয়ের ‘দি ওল্ডম্যান এন্ড দ্য সী’র মাধ্যমে যে বক্তব্য এবং রুপকল্প আমাদের সামনে উপস্থিত হয় তাকে অনুধাবন করা। ওই যে আগেও বলা হলো কয়েকবার, হার স্বীকার নয়, এগিয়ে যেতে হবে সংগ্রামের ভেতর দিয়ে, এই বিষয়টাই ঘুরে-ফিরে আসে এই উপন্যাসে এবং আমরা এই মূল এবং প্রসঙ্গক্রমে গূঢ় বিষয়টার উপস্থাপনা ‘দি ওল্ডম্যান এন্ড দ্য সী’তে কত বিচিত্রমাত্রিকভাবে এসেছে তাই দেখার চেষ্টা করবো। হেমিংওয়ের জীবন নিয়ে আলোচনা করতে হলো এ কারণে যে, নানান ঘাত-প্রতিঘাতের ভেতর দিয়েও পরাজয় মেনে না নিয়ে হেমিংওয়ের ক্রমঅগ্রসরমানতা নিয়ে দু’চার কথা বলাকে জরুরী মনে হয়েছে। সান্তিয়াগোকে নির্মাণ করেছেন হেমিংওয়ে তাঁর সমস্ত জীবনলব্ধ অভিজ্ঞতাকে আশ্রয় করে। তাই ‘দি ওল্ডম্যান এন্ড দ্য সী’র আলোচনায় হেমিংওয়ের জীবনের বিচিত্র চিত্ররুপের আলোচনাটা প্রাসঙ্গিকই বৈকি।

হেমিংওয়ের লেখায় বিশ্বমানবতার একটা চেতনা খুঁেজ পাওয়া যায়। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-মতবাদ নির্বিশেষে সমগ্র মানবের যে সাধারণ অনুভব-অনুভূতি তার সঙ্গে অবলীলায় মিশে যেতে হেমিংওয়ের বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয়নি। তাঁর সুস্পষ্ট উপলদ্ধি ছিল মানুষের নিঃসঙ্গতা, ্একাকীত্ব নিয়ে; মানুষ প্রচন্ডভাবে একা এবং দারুণভাবে নিঃসঙ্গ - এ কথা হেমিংওয়ে জানতেন স্পষ্ট করেই। অসম লড়াই সে করে তার বিরুদ্ধকার হাজারো হাজারো প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে; মারাত্নক কঠিন, বন্ধুর পথ ধরে এগিয়ে চলে সে তার অভীষ্ট লক্ষ্যপানে, এ কথাও হেমিংওয়ে জানতেন। তবে যে কথা তিনি সবচে বেশী করে জানেন ও মনে-প্রাণে বিশ্বাস করেন তা হলো, সেই অসম লড়াইয়ে মানুষ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে, তবু তার কাছে পরাজয় স্বীকার করে না পৌরুষাকার। আর ঠিক এ মর্মবাণীটিই প্রকাশিত হয় হেমিংয়ের ‘দি ওল্ডম্যান এন্ড দ্য সী’তে। হেমিংওয়ে এখানে প্রগাঢ় যত্ন নিয়ে অংকন করেন এমন কিছু পরিস্থিতি, যাতে স্বপ্ন দেখে বুড়ো সান্তিয়াগো। এই উপন্যাসের, সেই সঙ্গে প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে জীবন-কাহিনীর নায়ক সান্তিয়াগোকে যখন মনে হয় সে সবকিছু হারিয়ে পরিণত হয়েছে বিপর্যস্ত, বিপন্ন মানবে; হতাশায় ডুবে গেছে আকন্ঠ; ঠিক তখুনি হেমিংওয়ে প্রচন্ড ঝাঁকুনী দেন পাঠকদেরকে। তিনি দেখান, আপাতদৃষ্টিতে সবকিছু খুইয়ে বসা সান্তিয়াগো আসলে হারায়নি তার অথবা মানুষের - যাই বলি না কেন - আসল ঐশ্বর্যটাই - স্বপ্ন! জীবন নামক সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গ-বিক্ষুব্ধতার কাছে হার স্বীকার করে না সান্তিয়াগো, স্বপ্ন দেখে সে - আফ্রিকার সাদা সমুদ্র সৈকতে কেশর ফোলান সিংহের স্বপ্ন। অত্যন্ত সহজ, সরল উপস্থাপন; কিন্তু জীবনের কী প্রচন্ড শক্তিই না প্রকাশিত হয় এই স্বপ্ন দেখার মধ্য দিয়ে ! 

বলছিলাম জীবন নামক সমুদ্রের কথা। হ্যাঁ, সমুদ্র এই উপন্যাসে রুপক হিসেবে এসেছে। হেমিংওয়ে সমুদ্রকে জীবন হিসেবে উপস্থাপন করেছেন ‘দি ওল্ডম্যান এন্ড দ্য সী’তে জীবনটা আসলেও সমুদ্রই; সেটি কখনো উত্তাল, কখনো শান্ত। তরঙ্গ বিক্ষুদ্ধ কখনো তার রুপ, কখনো বা নিস্তরঙ্গ নিথর। আর আমরা এই মানুষেরা, সেই সমুদ্রের মূল শ্রোতধারা ধরে অনুকূলতা বা প্রতিকূলতার মাঝ দিয়েই এগিয়ে যাই সামনের দিকে। সমুদ্রের রুপকধর্মী প্রকাশ এ উপন্যাসের রুপকাশ্রিত ঘটনা প্রবাহের মাঝ দিয়ে এর মূল চেতনা সম্পর্কে আমাদেরকে সচেতন করে। আমরা দেখতে পাই সমুদ্র যেমন ‘দি ওল্ডম্যান এন্ড দ্য সী’তে একটি রুপক, তেমনি কিশোর ম্যানোলিন চরিত্রটিও এ উপন্যাসে এসেছে প্রতীকীভাবে। ম্যানোলিন আসলে সান্তিয়াগোর ফেলে আসা কৈশর-যৌবন। সিংহ অনুষঙ্গের বারে বারে ফিরে আসার কথাটিও উল্লেখ করা যায়। সান্তিয়াগোর অবচেতনায় দূরবর্তী সিংহশাবকের স্মৃতি কিশোর ম্যানোলিনের অপেক্ষাকৃত সাম্প্রতিক ইমেজের সঙ্গে মিলিত এবং দ্রবীভূত হয়ে গেছে। এই দুয়ের একত্রিত শক্তি সান্তিয়াগোর এই বৃদ্ধ বয়সে তার যন্ত্রণা এবং সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে বিজয়ের মুহূর্তে তার শক্তির আধার, এমনটিই আমাদের মনে হয় নানা প্রতীকায়ণের মধ্য দিয়ে পরিস্ফুটিত পরিস্থিতি আর প্রেক্ষিতগুলোতে।

সমাজের কথা এসেছে অনেকভাবেই কিউবার রাজধানী হাভানার বার মাইল উত্তরে অবস্থিত কোহিমার ধীবর পল্লীকে আশ্রয় করে এই উপন্যাসটি লেখেন হেমিংওয়ে। স্বাভাবিকভাবেই জেলেদের জীবনের নানা বর্ণময় উপস্থিতি এই উপন্যাসের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে। নিবন্ধের শুরুতেও এই বিষয়টার উল্লেখ করা হয়েছে। মুনাফাকেন্দ্রিক সমাজের অন্তর্ভূক্ত এই ধীবর শ্রেনীও মুনাফার জন্য নয়, শুধুমাত্র বেঁচে থাকার তাগিদেই অর্থের মানদন্ডে নির্মাণ করে নিচ্ছে তাদের মধ্যকার সম্পর্ককে। কিশোর ম্যানোলিনের বুড়ো সান্তিয়াগোর কাছ থেকে প্রাথমিক বিছিন্নতাকে এই প্রেক্ষিতে তুলে ধরা যায়। তবে মানিক বন্দোপাধ্যায়ের কালজয়ী সৃষ্টি ‘পদ্মা নদীর মাঝি’তে জেলেদের সমাজ জীবন এবং সেই সঙ্গে সেটি সংশ্লিষ্ট তথাকথিত ভদ্র সমাজ জীবনের যে অনুপুঙ্খ বর্নণা আমরা পাই, ‘দি ওল্ডম্যান এন্ড দ্য সী’তে সেই বিস্তৃত বর্নণার অনুপস্থিতি আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়। কারণ, ব্যক্তির চরিত্রই প্রধান এই উপন্যাসে। মানুষের অন্তর্শক্তির একটি আন্তরিক বিবরণ উপস্থাপনে তাই হেমিংওয়েকে ব্যস্ত মনে হয় আমাদের কাছে। তারপরও, মানুষ যেহেতু সামাজিক এবং সংবদ্ধ হয়েই তার বাস, সে কারণে সমাজের একটি চিত্র হেমিংওয়ে যে তুলে ধরেন না তা নয়। তবে সমাজের এ চিত্র সুন্দর নয়, নয় সুখেরও। এ চিত্রটি অত্যন্ত কুৎসিত এবং নির্মম সত্য। আমরা দেখি বুড়ো সান্তিয়াগো তার অত্যন্ত কষ্টার্জিত অর্জন - পঁচাশি দিনের মাথায় ধরা একটি বিশাল মার্লিন মাছ, যার সঙ্গে তিনদিন ধরে ক্রমাগত অসম সাহসী লড়াই করে জিতেছে সে - তাকে রক্ষা করার জন্য লড়ছে সে সমুদের হিং¯্র, নিষ্ঠুর হাঙরের সঙ্গে। আসলেও, এই মুনাফানির্ভর পুঁজিবাদী সমাজে আমাদের সকলকেই সংগ্রাম করতে হয় আমাদের শ্রেষ্ঠ অর্জনগুলোকে রক্ষার জন্য মুনাফালোভী হাঙরদের কাছ থেকে। কিন্তু বুড়ো সান্তিয়াগোর মতে, সাময়িক পরাজয়ে হাল ছেড়ে দেয়াই নেই কোন মুক্তি। রবীন্দ্রনাথের মতোই বিধ্বস্ত সান্তিয়াগোও বিশ্বাস করে আশা হারিয়ে ফেলাটা একটা পাপ। 

হেমিংওয়ের এই ‘দি ওল্ডম্যান এন্ড দ্য সী’-র প্রথম, প্রধান এবং শেষ কথাই হলো, আশা জাগিয়ে রেখে ক্রমাগত সংগ্রাম করে যাওয়া। অত্যন্ত চমৎকার একটি উক্তি বুড়ো সান্তিয়াগোর মুখ দিয়ে হেমিংওয়ে আমাদের বলেন : ‘Man is not made for defeat. Man can be destroyed, but not defeated!’ আসলেই, মানুষের জন্ম তো হার স্বীকারের জন্য নয়। মানুষ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে, কিন্তু কখনো পরাজিত হয় না। শত প্রতিকূলতা, কুৎসিতের মুহূর্মুহু আক্রমণ, একে অপরের থেকে ক্রমাগত বিচ্ছিনতা, শ্রেষ্ঠ আর সুন্দরতম অর্জনগুলো ছিনতাই হয়ে যাওয়া - এই চরম হতাশার মাঝেও তবু আমাদেরকে বেঁেচ থাকতে হয়। আমাদেরকে বাঁচিয়ে রাখে-স্বপ্ন। সুন্দরতম আগামীর সে স্বপ্ন নিরন্তর আমাদের জানিয়ে যায় : আসলে সকল সময়ই দুঃসময়, যদি আত্নসমর্পণ করা হয়। আর সে অসম লড়াইয়ে ক্ষত বিক্ষত হতে হতেও পরাজয় স্বীকার না করা এক সাহসী যোদ্ধা বুড়ো সান্তিয়াগো, চিরতারুণ্যকে ধারণ করে আমাদেরকে অবিরাম প্রেরণা দিয়ে যায় এই বলে যে, আত্নসমর্পনে কোন মুক্তি নেই, কখনো ছিলও না এবং মানুষ হার স্বীকারের জন্য জন্মেনি; সে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে, কিন্তু কখনো পরাজিত হয় না ! 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন