শনিবার, ১৬ মে, ২০২০

দেবেশ রায় : সাহিত্যিক মূল্যায়ন

  • অভীক মজুমদার
  • অনির্বাণ রায়
  • গৌতম চক্রবর্তী 
  • সুমন গুণ 
  • সুমন রহমান 
  • খোরশেদ আলম 
  • হাসান নাঈম

উপরিউক্ত ৭ জন লেখকের ভিন্ন ভিন্ন মূল্যায়নে সাহিত্যিক দেবেশ রায়কে চিহ্নিত করা হয়েছে। লেখাগুলোতে সন্নিবেশ ঘটেছে তাঁদের সুচিন্তিত বক্তব্য। কখনো ব্যক্তি অনুভবের আলোয় রেখাঙ্কিত।

পুরাণ-বৃত্তান্তের দেশকথা

বাংলা সাহিত্যে বিকল্প আদর্শের সন্ধানী, বিরল ভাবুক দেবেশ রায়

 

অভীক মজুমদার

তাঁর কথাই প্রথমে শুনে নিই একটু। ...জলপাইগুড়ির গ্রাম, তার রাজবংশী মানুষজন, সেই মানুষজনে বিবৃত প্রকৃতি, রাজবংশী বাচন, তিস্তা নদী, চা বাগানের শ্রমিক, ডুয়ার্স, ফরেস্টের লোকজন, ফরেস্টের গাছপালা-জঙ্গল-পশুপাখির এক ভুবনে আমার অধিকার কায়েম হতে শুরু করল, দিনের পর দিন ধরে, বছরের পর বছর ধরে। রাজনীতির অজস্র দৈনন্দিন কাজের আষ্টেপৃষ্ঠে লিপ্ততা ছাড়া এ অধিকার আয়ত্ত করা অসম্ভব ছিল কারণ এ কোনো ভ্রমণের অধিকার নয়, এ কোনো দর্শন-শ্রবণের অধিকার নয়, এ এক জনপদের প্রতিদিনের জীবনযাপনের সঙ্গে লেপ্টে যাওয়া, সেই জীবনযাপনের ইতিহাস-ভূগোলের সঙ্গে সেঁটে থাকা। আমার আর কোনো উদ্ধার ছিল না। বা, সেই ছিল আমার একমাত্র উদ্ধার।... বছরের পর বছরের অজস্র গ্রন্থিতে এমন এক বিদ্যুৎ-সংবহন ব্যবস্থার ভিতরে আমি নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছি যার বাইরে আমার কোনো প্রজ্বলন নেই, কোনো শিহরন নেই। আবার অন্যদিকে, জলপাইগুড়ির কোনো লোকজীবনই যেন এখনো আমার গল্প-উপন্যাসের পরীক্ষাভূমি তা সে ঘটনা বা চরিত্র ভারতবর্ষের যে-অঞ্চলেরই হোক না কেন। (ভূমিকা/ গল্পসমগ্র)
বা, এই শব্দগুলো: একজন ঔপন্যাসিক লিখতে চাইছে ব্যক্তির ঐতিহাসিকতা। ব্যক্তির ইতিহাস মানে ব্যক্তির জীবনী নয়। সেই জীবন যে-ইতিহাসের অংশ সেই ইতিহাসে সেই ব্যক্তিকে স্থাপন করাই উপন্যাসের কাজ। (সাক্ষাৎকার/ ১৩৯৬)

দেবেশ রায় (১৯৩৬-২০২০) বাংলা কথাসাহিত্যের সেই বিস্ময় যিনি নিজস্ব ঘরানা-বাহিরানায় সমাজবিশ্ব আর ব্যক্তিমানুষকে আশ্চর্য নৈপুণ্যে গভীর সংবেদনে তরঙ্গায়িত করেন। তাঁর সমগ্র কথাসাহিত্য সেই দূরপাল্লার নৌবহর। দূরবিনের দুই দিক দিয়ে তিনি ক্রমান্বয়ে দেখে গিয়েছেন দেশকাল, প্রান্ত প্রান্তিক, ভণ্ড ধ্বস্ত অথচ প্রতিরোধী বাস্তবতা। ইতিহাস পুরাণের প্রেক্ষিতে ব্যক্তিমানুষের উত্থান তাঁর প্রিয় বিষয়। এখানেই তিনি স্বতন্ত্র, সমুজ্জ্বল। 
যযাতি, মানুষ খুন করে কেন, আপাতত শান্তিকল্যাণ হয়ে আছে থেকে মফস্বলি বৃত্তান্ত, তিস্তাপারের বৃত্তান্ত, সময় অসময়ের বৃত্তান্ত, তিস্তাপুরাণ, বরিশালের যোগেন মন্ডল কিংবা সাম্প্রতিক সাংবিধানিক এজলাস (২০১৯) সেই অভিযাত্রার প্রতিচিত্রায়ণ। কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী হিসেবে তাঁর জনবৃত্তে পদার্পণ, সে কথা বারংবার মনে করিয়ে দেন তিনি, কিন্তু তাঁর সমগ্র রচনায় ‘পার্টি’তন্ত্র বা দলদৃষ্টি নয়, এক বহুবিচিত্র সুরসঙ্গতি ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ে। সমাজ-সংসার অতীত-বর্তমান ক্ষুদ্রতুচ্ছকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে তিনি মহাকায় এক ভবিষ্যতের আভাস পাঠককে দেন। 

হয়তো সে জন্যই প্রথম দিকের রচনায় তিনি প্রতীক এবং সঙ্কেতকে বারংবার ব্যবহার করেন। চলন্ত, বন্ধ ট্রেনের কামরায় বাইরে থেকে যারা ঢুকতে চাইছে তাদের নিয়ে কামরার মানুষ ভয়ার্ত, নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত। ‘এই চার যুবক কোন্‌ দলের? মারবার না বাঁচাবার? এই চার মানুষ কী চায়? মারতে না বাঁচতে?’ গল্পের নাম নিরস্ত্রীকরণ কেন? অকল্পনীয় ব্যঞ্জনা! আপাতত শান্তিকল্যাণ হয়ে আছে কাহিনির শেষে বীভৎস ফ্যান্টাসি সেই মৃত্যু উপত্যকাকে সঙ্কেতে ধরে ফেলে। ‘শান্তিকল্যাণ’ শব্দের বিস্ফোরণ ধ্বনিত হয়।

দেবেশ রায়ের কলমের সাহস এবং ধারণক্ষমতা এমনই। প্রবহমান, একটু নৈর্ব্যক্তিক জলধারার মতো ঘটনাবলির আখ্যান তৈরি হয়। ক্রমে স্পষ্ট হয়ে ওঠে তার মহা-অবয়ব। চরিত্র, ঘটনা, কথকভাষ্য, অতীত, বর্তমান, ইতিহাস, সংবাদ, রেডিয়ো, সরকারি তৎপরতা অথবা নিষ্ক্রিয়তা, চায়ের দোকানের আলোচনা, রান্নাঘর, অরণ্যবাস্তবতা, হাসিকৌতুক, বিবরণ সব মিলেমিশে অত্যাশ্চর্য আখ্যান-উৎসবের জন্ম দেয়। বিস্ময়াবৃত এবং অসহায় পাঠক যেন কাহিনির মধ্যে জাদুবলে আখ্যানের শিল্পরূপে ভেসে যেতে থাকে। হয়ে ওঠে ওই ইতিহাসপ্রবাহের শরিক। 

১৯৮৯ সালে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘প্রথম পরিচ্ছেদে লেখক হিসেবে লিখেছি, দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে পাঠক হিসেবে react করেছি, বাইরে থেকে দেখলে প্রথম পরিচ্ছেদ উপন্যাস, দ্বিতীয়তে আত্মসংলাপ। এই ভাবে। কিন্তু উপন্যাস তো ঐভাবে তৈরি হয় না। ফর্মটাকে আমি বাইরের জিনিস মনে করি না। একটা ফর্ম যখন তৈরি হয় তখন লেখক বিষয়টাকে কীভাবে ধারণ করছেন, তাই ফর্ম হয়ে যায়।... আমি লিখবার সময় পাঠককে এটুকুই সাবধান করতে চেয়েছি যে তাঁরা যেন একে আমার অভিজ্ঞতা মনে না করেন। পাঠক ও লেখকের সম্মিলিত অভিজ্ঞতা করে তুলতে চেয়েছি।’
আখ্যানের ফর্ম বা আঙ্গিক নিয়ে দেবেশের মতো এত ‘সচেতন’ ভাবুক বাংলা সাহিত্যে বিরল। আছেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, নবারুণ ভট্টাচার্য এবং রবিশংকর বল-ও। তবে তাঁরা কেউই দেবেশ রায়ের মতো এত ধারাবাহিক নিষ্ঠায় ‘বিকল্প আদর্শ’ খুঁজে যাননি। বঙ্কিমচন্দ্র প্রযোজিত ইউরোপীয় নভেল ঘরানার প্রতিস্পর্ধী এক ‘নিজস্ব’ ‘দেশীয়’ ঐতিহ্যের আখ্যান খুঁজেছিলেন দেবেশ। সে জন্য ফিরে গিয়েছিলেন পালাকীর্তনে মঙ্গলকাব্যে কিংবা গ্রামীণ বাচনে। আক্ষেপ করে বলেছেন, ‘তাই বয়স বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে, নবীন-নবীন আধুনিকতার সঙ্গে-সঙ্গে, বাংলা গল্প-উপন্যাস বাঙালির লোকজীবন থেকে সরে গেছে। তার ভাষা থেকে ঝরে গেছে লোকবাচনের রহস্যময়তা অথচ স্পষ্টতা, লোককৌতুকের প্রবল পৌরুষ, পৌরাণিককে ভেঙে ফেলার অদম্য লোকায়ত সাহস আর কাহিনীকারের নিজস্ব বিবরণের স্পষ্টতা।’ (উপন্যাস নিয়ে, পৃ ২৮) আমরা সহজেই বুঝতে পারি, কেন তাঁর কথাসাহিত্যে ‘বৃত্তান্ত’, ‘পুরাণ’, ‘প্রতিবেদন’ নামকরণে ফিরে ফিরে আসে। 
এখানেই শেষ নয়। দেবেশ রায় একই অনুসন্ধিৎসায় পৌঁছে যান বাখতিন-এর ‘ডায়ালজি’ থেকে ‘পলিফনি’ উদ্ভবের হালহদিশে। কিংবা থিয়োডর আডোরনো-র ‘নাৎসিবাদ বিরোধী’ শিল্প-সাহিত্যতত্ত্বের সন্নিকটে, জনসংযোগের পদ্ধতিচর্চায়। বলা চলে তাঁর আখ্যানরচনা এক সুবৃহৎ মহাপ্রকল্প, তার কেন্দ্রীয় শব্দ ‘বিকল্প আদর্শ’ প্রতিষ্ঠা। 
‘বিকল্প আদর্শ’ শুধু আখ্যানেই সীমাবদ্ধ রাখেননি দেবেশ, হয়তো তাঁর দীর্ঘ জীবনচর্যায় লেখকের আত্মসম্মান-চিহ্নিত ‘স্বাধীনতা’কেও তিনি ‘বিকল্প’ হিসেবে রক্ষা করতে চেয়েছেন। লেখার ‘মান’ যখন আপস করে বাজারি পণ্যের সঙ্গে, যখন বছরে বছরে লেখককে বাধ্যত লিখে যেতে হয় পরিকল্পনাহীন, অগভীর পৌনঃপুনিকতায়, সাহিত্যশ্রেষ্ঠীর অঙ্গুলিনির্দেশে, তখন দেবেশ মনে করেন, জনপ্রিয়তার হাতছানিতে বিনষ্ট হয় লেখকের ‘স্বাধীনতা’, লেখকের ‘দার্ঢ্য’। তিনি এই ‘বিকল্প’ অবস্থানের শরিক, সে জন্য এক-একটি রচনার জন্য হয়তো পাঁচ-সাত বছর নিতেও তাঁর আটকায়নি।
এই বিকল্পসন্ধানী লেখকসত্তার জোরেই তাঁর গদ্যরীতিও সচেতন ভাবে পল্লবিত হয়। তরল, সহজপাচ্য গদ্যে এই বিশাল অঙ্গসংস্থান হয়তো সম্ভবও ছিল না। স্বাধীনতা-উত্তর, বিশেষত বিশ শতকের শেষ দশকগুলিতে দেশদুনিয়ার পরিবর্তমান পরিস্থিতি, উত্তর-ঔপনিবেশিক পরিমণ্ডল, পুঁজির নতুন নতুন জটিল কৌশল, প্রভুত্ব আর কর্তৃত্বের নতুন নতুন নকশা, রাষ্ট্রক্ষমতার নিষ্পেষণ আর নয়া জীবন-বাস্তবতা তিনি যত্নে ধরেছেন কথাসাহিত্যে। 

ঠিক এই প্রসঙ্গেই ঢুকে পড়ে আরও একটি প্রাসঙ্গিক শব্দ। ‘প্রত্যাখ্যান’। দেবেশ রায়ের উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্ররা ‘আধুনিক’ উন্নয়নের সমস্ত প্রক্রিয়াকেই প্রত্যাখ্যান করে। হয়ে ওঠে পুরাণ বা লোকগাথার আদিম অতিকায় এক প্রাকৃতিক শক্তি। সে প্রান্তিক থেকে হয়ে যায় মহাবিকল্পের দ্যোতনাবাহী লোকনায়ক। ইতিহাস থেকে তার উত্থান, ‘আধুনিকতা’কে তার প্রত্যাখ্যান। ‘বাঘারু এই ব্যারেজকে, এই অর্থনীতি ও এই উন্নয়নকে প্রত্যাখ্যান করল। বাঘারু কিছু কিছু কথা বলতে পারে বটে কিন্তু প্রত্যাখ্যানের ভাষা তাঁর জানা নেই। তার একটা শরীর আছে। সেই শরীর দিয়ে সে প্রত্যাখ্যান করল।... এই প্রত্যাখ্যানের রাত ধরে বাঘারু মাদারিকে নিয়ে হাঁটুক, হাঁটুক, হাঁটুক...’ (তিস্তাপারের বৃত্তান্ত) 
ব্যক্তিগত স্মৃতি-বিস্মৃতি সর্বদাই নশ্বরের সঞ্চয়। পিতৃবন্ধু হিসেবে আশৈশব তিনি ঘনিষ্ঠজন। মতান্তর, দূরত্বে স্নেহে কখনও ঘাটতি দেখিনি। মাস পাঁচেক আগে তাঁর বাড়িতে দেখা হয়েছিল, অসুস্থতার মধ্যেও বার বার বলছিলেন, ‘লিখতে সব থেকে ভাল লাগে। রোজ লিখি। নতুন নতুন করে ব্যাপারটাকে বুঝতে পারি।’ মুখে ফুটে উঠছিল এক অমর্ত্য বিভা।
আজ মনে হয়, ‘লিখন’ এই শিল্পরূপটির চূড়ান্ত পর্যায়ে তিনি পৌঁছেছিলেন। যখন কাহিনি, চরিত্র, ঘটনা, পরম্পরা, বক্তব্য, সব তুচ্ছ করে দিয়ে ভাষা আর অনুভব বিমূর্ত উচ্চতায় স্বরাজ প্রতিষ্ঠা করে। তখন লেখক তুচ্ছ, পাঠক তুচ্ছ, সমকাল তুচ্ছ, সংসার তুচ্ছ, সমাজ তুচ্ছ, ব্যক্তিসঙ্কট তুচ্ছ, শুধু শিল্পরূপ ডানা মেলে দেয় নীল শূন্যতায়। 
শেষে একটা কথা। উইকিপিডিয়ায় লেখক দেবেশ রায় নামে কোনও এন্ট্রি গতকাল ‘খুব বারোটা’য়ও দেখতে পাইনি। কার জয়? কার পরাজয়? না কি ‘কোকাকলোনাইজেশনের সময় এরকম ঘটে থাকে’?

তিস্তার পাড়ে বাঘারুরা আছেনই

অনির্বাণ রায়

এই প্রত্যাখ্যানের রাত ধরে বাঘারু মাদারিকে নিয়ে হাঁটুক, হাঁটুক, হাঁটুক....। 
তিস্তাপারের বৃত্তান্ত এ ভাবেই শেষ করেছিলেন দেবেশ রায়। বৃহস্পতিবার রাতেই তিস্তাপার জেনে গিয়েছে, তাঁদের প্রিয় দেবেশ রায় আর নেই। দেবেশ যে সময়ের কথা লিখেছেন, সে সময়ের চরিত্র ছিলেন বাঘারুরা। সময় বদলেছে, তিস্তা পাড়ের এখনকার বাসিন্দারা দাবি করছেন, তাঁদের জীবনযাত্রা-অর্থনীতি এখনও দেবেশে-র তিস্তাপারের কাহিনি লেখার সময়েই পড়ে রয়েছে। চরিত্রের নাম বদলেছে, কিন্তু বাঘারু-মাদারিদের ব্যথা বদলায়নি।
করোনা সংক্রমণে লকডাউনে এমনিতেই বিষন্ন ছিল তিস্তাপারের পরিবারগুলি। প্রায় প্রতি পরিবারেরই কেউ না কেউ ভিনরাজ্যে কাজ করতে গিয়ে আটকে রয়েছে। কেউ বা সরকারি ট্রেন-বা বাস না পেয়ে দূরের রাজ্য থেকে রোদে পুড়ে, পুলিশের মার খেয়ে হেঁটে আসছে বাড়ির দিকে। তিস্তাপারের বৃত্তান্তের শেষে বাঘারু-মাদারিদের হেঁটে চলার মতো। বাঘারু-মাদারিরাও তো শেষমেশ পরিযায়ী-ই বনে যায়।

সেবক পাহাড় থেকে নেমে মালবাজার, ময়নাগুড়ি হয়ে জলপাইগুড়ি শহর ছুঁয়ে ঘুঘুডাঙা, বোয়ালমারি গ্রাম দিয়ে বয়ে তিস্তা নদী ঢুকে গিয়েছে বাংলাদেশ। এই অংশে তিস্তা নদীর দু পারের জীবনযাত্রার সঙ্গে দেবেশ রায়ের তিস্তাপারের বৃত্তান্ত যেন এক হয়ে রয়েছে এখনও। জলপাইগুড়ির সারদাপল্লির বাসিন্দা বাবু মণ্ডল। দেবেশের উপন্যাসের সময়টা বাবু চোখে দেখেছেন। বাবু বলেন, বই পড়িনি ঠিকই, কিন্তু ওই বই পড়ে বহু লোক আমরা কেমন ভাবে থাকি তা দেখতে এসেছে। বইয়ে কী লেখা আছে তা শুনেছি।’’ তিস্তাপারের কাহিনি লেখার সময়ে ময়নাগুড়ির প্রবীণ বামপন্থী নেতা নির্মল চৌধুরী দেবেশকে কাছে থেকে দেখেছেন। নির্মলবাবুও তিস্তাপারের মানুষ, এখন বৃদ্ধ। তিনি বলেন, লেখকের মৃত্যুর খবর শুনে স্বজন হারানোর কষ্ট হচ্ছে। তিস্তাপারের বাসিন্দাদের সঙ্গে লেখক একাত্ম ছিলেন।”

একাত্ম না হলে তিস্তাপারের বৃত্তান্ত উপন্যাসটি লেখক ওঁদেরকেই উতসর্গ করবেন কেন! বইয়ের প্রথম পাতা উল্টে দেখলেই বেরিয়ে আসে উতসর্গ লিপি। যেখানে নন্দনপুর-বোয়ালমারি, ঘুঘুডাঙা, বানারহাট, গয়েরকাটার নিতাই সরকার, আকুলুদ্দিন, যমুনা উরাওনি রাবণচন্দ্র রায়ের নাম লেখা। সেই সঙ্গে এ-ও লেখা, “এই বৃত্তান্ত তারা কোনদিনই পড়বে না, কিন্তু তিস্তাপারে জীবনের পর জীবন বাঁচবে।”

তিস্তার পাড়ে বসতি বেড়েছে। ঘুঘুডাঙার সেচখালে জলও আসে। যে ব্যারেজের সেচখাল পার হয়ে এগিয়ে গিয়েছিল বাঘারু। যে বাঘারির হাতে পতাকা ‘ধরিয়ে দিতেই সে মিছিলের লোক হয়ে যায়।’ নেতা-মন্ত্রী-রাষ্ট্র বুঝে নিয়ে যে বাঘারুই বলে, “মোর কুনো মিছিল নাই।” দেবেশ সান্নিধ্য পাওয়া জলপাইগুড়ির শিক্ষক-শিল্পী শৈবাল বসু বলেন, “এমন বাঘারু-মাদারিদের সঙ্গে এখনও দেখা হয় তিস্তাপারে।’’


গৌতম চক্রবর্তী

বাঘারু তিস্তাপার ছেড়ে চলে যাচ্ছে।… এই নদীবন্ধন, এই ব্যারেজ দেশের অর্থনীতি বদলে দেবে, উৎপাদন বাড়াবে। বাঘারুর কোনও অর্থনীতি নেই, কোনও উৎপাদনও নেই। বাঘারু এই ব্যারেজকে, এই অর্থনীতি ও উন্নয়নকে প্রত্যাখ্যান করল।
গত কয়েক সপ্তাহে দেশ জুড়ে অভুক্ত পরিযায়ী শ্রমিকদের মাইলের পর মাইল হাঁটার দুর্দশা দেখে ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’ উপন্যাসের কথা মনে পড়ছিল। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণবাজি থেকে অর্থমন্ত্রীর খুদকুঁড়ো দান, সাহায্যের নামে ঋণদানের তঞ্চকতা, সব কিছুকেই মাদারি ও বাঘারুরা করোনা-পরিস্থিতির ঢের আগে থেকেই প্রত্যাখ্যান করে। বাংলা সাহিত্যের জয় বোধহয় এখানেই!
৫ অগস্ট, ১৯৪৭। ট্রেনে চড়ে করাচি রওনা দিয়েছে বরিশালের যোগেন মন্ডল। পূর্ব পাকিস্তানের এই মানুষটি দেশভাগের পর পাকিস্তানে গিয়ে মন্ত্রী হয়েছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন, এ দেশে নমঃশূদ্র ও নিম্নবর্ণের হিন্দুরা মুসলমানদের পাশাপাশিই থাকে। দুই পক্ষই উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের অত্যাচারে জর্জরিত। দেবেশ রায়ের উপন্যাসের শেষে এক বিকেলে করাচিগামী ট্রেন পঞ্জাবের এক ছোট্ট স্টেশনে থামে। যোগেন ভাবে, ‘এই পথেই তো আর্যরা এসেছিল। তাদের সঙ্গে কোনও শূদ্র ছিল না। তার পর দুই হাজার মাইল হেঁটে হেঁটে তারা শূদ্র পেতে থাকে ও শেষে মৈস্তারকান্দি, যোগেনের পূর্বপুরুষকে শূদ্র বানাতে।… যোগেন নিঃসংশয় জানে মুসলিম লিগও আর্য। তারও শূদ্র দরকার।’ যোগেন মণ্ডল কেন শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানে মন্ত্রিত্ব ছেড়ে এ দেশে চলে আসেন এবং মারা যান, সে সব ইতিহাসের সত্য। কিন্তু সাহিত্যের এবং 
জীবনের সত্য দেবেশের ওই ক্ষুরধার লাইন, ‘মুসলিম লিগও আর্য। তারও শূদ্র দরকার।’
দেবেশ এগিয়েছেন ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’, ‘সময় অসময়ের বৃত্তান্ত’-এর মতো উপন্যাস বা ‘দুপুর’-এর মতো গল্পের রাজবর্ত্ম ধরে। বাংলা মঙ্গলকাব্যে ঝুড়ি ঝুড়ি বাল্যবিবাহ অক্লেশে উঠিয়ে আনেন তিনি, ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে শ্রীকৃষ্ণ যখন আইহনের স্ত্রী রাধার প্রতি আকৃষ্ট হন, তখন রাধার বয়স এগারো বৎসর মাত্র। কালকেতুর যখন বিয়ে হয়, তখন সে ‘একাদশ বৎসরের যেন মত্ত হাতী’, ফুল্লরার বয়স আরও কম।’ রাধার খোঁপায় চাঁপাফুল, বেহুলার নাকে মোতি, কানে কুণ্ডলের ব্যাখ্যা করতে করতে তিনি অক্লেশে জানিয়ে দেন, ষোড়শ শতকে মহিলাদের অন্তত ষোলো রকমের পুষ্পালঙ্কার ছিল। তাঁর আত্মজীবনীর শেষ খণ্ড ‘বিপুলা পৃথিবী’ বছর তিনেক আগে আনন্দ পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছিল। নীরদচন্দ্র চৌধুরীর মতো তাঁর এই আত্মজীবনীও ব্যক্তির নিজস্ব গণ্ডিকে ছাপিয়ে হয়ে উঠেছে সমসাময়িক সমাজ ও রাজনৈতিক ঘটনার দর্পণ।
সব যোদ্ধাই এক রকম নন। কেউ একটু বক্তিমে দেন, কেউ বা তাতে ভিতরে ভিতরে কুঁকড়ে যান। মিছিলের সবাই কি এক রকম হয়? তিস্তাপারের বৃত্তান্তে যেমন নেংটি পরা বাঘারুকে দেখে শ্রমিকশ্রেণির মিছিলটা হাসে, মজা পায়। এই নেংটি পরা নগ্নতা মিছিলের সয় না। মিছিল এবং মুক্তিযুদ্ধের গ্র্যান্ড ন্যারেটিভের বাইরেও যে উচ্চাবচ, অস্পৃষ্ট এক মানবজমিন থাকে, বাংলা ভাষার দুই প্রান্তের, দুই ভিন্ন দেশের সমাজসচেতন গদ্যকার সেটিই তুলে ধরেন। কেউ আত্মজীবনীতে, কেউ বা উপন্যাসে। (সংক্ষেপিত/বাছাইকৃত অংশ)

 

সুমন গুণ


দেবেশ রায়ের লেখালেখির পাঠক হবার সাধনা আমার শুরু নয়ের দশকে, তাঁর 'আপাতত শান্তিকল্যাণ হয়ে আছে' গল্পপাঠের মধ্য দিয়ে। দেবেশদার সঙ্গে আমার সম্পর্ক গাঢ় হয়েছিল বারাসাতে রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সূচনা থেকে। আমরা চেয়েছিলাম বাংলা বিভাগের সঙ্গে আমাদের সময়ের মান্য লেখকদের যুক্ত করতে। দেবেশ রায়, সুধীর চক্রবর্তী, সত্যজিৎ চৌধুরী সহ আরো অনেকের সঙ্গে কথা বলেছিলাম আমি, সবাই আমার প্রতি স্নেহবশত এবং একটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্বোধনে সাহায্য করার সদিচ্ছায় সাগ্রহে ক্লাস নিতে রাজি হয়েছিলেন। বিভাগের পাঠক্রম রচনার জন্য সভয়ে অনুরোধ জানিয়েছিলাম শঙ্খবাবুকে। তিনিও, ভাবলে এখনও শ্লাঘা ও পুলক দুটোই হয়, আমায় ফেরাননি। দেবেশদার কাছে ক্লাস করার অলৌকিক অভিজ্ঞতার কথা সেই সময়ের ছাত্রছাত্রীরা অনেকেই আজ লিখেছে, আমি আর কিছু লিখলাম না। বিশ্ববিদ্যালয়টি আজ অপসৃয়মান, কেন, কার জন্য, কাদের জন্য, সেসব আলোচনার জায়গা এটা নয়। আমাদের ভাষায় যাঁরা গল্প-উপন্যাস লিখেছেন, খেয়াল করে দেখলে পরিষ্কার টের পাওয়া যাবে যে, তাঁদের মধ্যে তাঁরাই শিরোধার্য হয়ে উঠছেন যাঁদের নিজস্ব ভাষা আছে। সেই ভাষার রকমফের থাকতে পারে, আলোছায়ার তর-তম থাকতে পারে, কিন্তু যিনি লিখছেন, তাঁর অব্যবহিত ব্যবহারটুকু ধরা থাকছে কিনা লেখায়, সেটাই বড়ো কথা। জীবনানন্দ অথবা কমলকুমার, সন্দীপন কিংবা দেবেশ রায়, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বা নবারুণ--- সবাইকেই সময় মেপে নিচ্ছে তাঁদের গদ্যভাষার সৌজন্যে। দৃষ্টিভঙ্গির মৌলিক স্বচ্ছতাও অকেজো হয়ে যায় ভাষার দাম্পত্য না পেলে। আশ্চর্য, যে-নামগুলো লিখলাম তাঁরা সবাই আজ আমাদের নাগালের বাইরে।
দেবেশদার মত মৌলিক ও মনস্ক লেখককে আমাদের ভাষায় আমরা অর্জন করেছিলাম, এর চেয়ে গৌরবের আর কী আছে! 

(লেখকের ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে সংগৃহীত)

 

সুমন রহমান

দেবেশ রায়ের "তিস্তাপারের বৃত্তান্ত" পড়া হয় ১৯৯০-৯১ সালের দিকে। তখন আমরা "দামোদর" দ্বিতীয় সংখ্যার কাজ করছি। মোহাম্মদ রফিক বইখানা আমাকে রিভিউ করতে বললেন। আমি তখন পুরাদস্তুর দস্তয়েভস্কি-ফ্যান। অসহ্য প্যাশন ছাড়া সাহিত্যে আর কোনোকিছুই সহ্য হত না। ফলে, বাঘারুকে নিয়ে রায়সাহেবের ক্যারিকেচার খুব বুদ্ধিবৃত্তিক লাগতে লাগল। রিভিউ করলাম না। মোহাম্মদ রফিক পরে সৈয়দ শরীফকে দিয়ে একখানা রিভিউ করিয়ে নিলেন। ছাপা হল দামোদর-এ।

"মফস্বলী বৃত্তান্ত" পড়েছি আরো অনেকদিন পরে। তখনো ঘটনাচক্রে আমি ভয়ানকভাবে হুয়ান রুলফো দিয়ে অবসেসড। ফলে "মফস্বলী বৃত্তান্ত"ও খুব টানলো না।

দেবেশ রায়ের শক্তিমত্তা ভীষণভাবে টের পাই তার নন-ফিকশনে। বিশেষত "বাংলা সাহিত্যে ঐতিহ্য ও আধুনিকতা" প্রবন্ধে। এই এক লেখা, বাংলা সাহিত্যকে দেখবার ধরনই বদলে দিয়েছে। দেবেশ রায়ই প্রথম ব্যক্তি, যিনি বাংলা সাহিত্যের শুরুর দিকের দুটো মৌলিক ডিলেমা শনাক্ত করে দেখান: ঈশ্বরগুপ্ত বনাম মাইকেল ডিলেমা, আর প্যারিচাঁদ বনাম বঙ্কিম ডিলেমা। তিনি দেখিয়েছিলেন, ইংরেজি-শিক্ষিত বাঙালি মাইকেল আর বঙ্কিমকে বাছাই করল, ফলে ঈশ্বরগুপ্ত আর প্যারিচাঁদের অরিজিনালিটি থেকে পরবর্তী বাংলা সাহিত্য আর কিছুই নিতে পারলো না।
এই একটা প্রবন্ধের জন্যই দেবেশ রায় চির স্মরণীয় হয়ে থাকবেন আমার কাছে। এই যে এখনকার অত ক্রিটিক্যাল চিন্তা -- পূর্ববঙ্গের সাহিত্য, পূর্ববাংলার ভাষা, মানভাষা বনাম প্রমিতভাষার লড়াই -- এসবেরই আঁতুড়ঘর হল দেবেশবাবুর সেই প্রবন্ধ।

Firoz Ahmed
সুমন ভাই, মান ভাষা বনাম প্রমিত ভাষার লড়াইয়ের আঁতুড়ঘর, মানে জন্মস্থান কি করে সেই প্রবন্ধ হয়?
Sumon Rahman
 আপনার প্রশ্নটাই বুঝি নাই। প্রবন্ধটা পড়েছেন? সেক্ষেত্রে একটু বিশদ করে বলেন কি বলতে চাইছেন?
Firoz Ahmed
 জি , সুমন ভাই পড়েছি। প্রবন্ধটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বাংলা সাহিত্যের সূচনার যে ডিলেমাটা তিনি দেখিয়েছিলেন, সেটা তার মৌলিক অবদান, যেটা আপনি বলেছেন। কিনতু পূর্ববঙ্গের ভাষা, মান ভাষা বিষয়ক লড়াই এসব বিষয়ক তর্কের আঁতুড়ঘর এই প্রবন্ধটাকে বলা যাবে কি না, সেটা ভাবছিলাম। কারণ এই বিষয়ক অজস্র পুরনো তর্ক আছে, এমনকি দৈনিক পত্রিকাতেও। ১৮৯০ এর দিকেও এই তর্ক কোলকাতা বনাম ঢাকার পত্রিকাতে ছিল, রীতিমত ভাষার ঐতিহাসিক ও গাঠনিক বিতর্কগুলোকে পুঁজি করে।
Sumon Rahman
আমি সাম্প্রতিক তর্কটার কথা বলছিলাম। আশির দশক থেকে যেটা আমরা করে চলছি।


Faruk Wasif
তাঁর উপন্যাস আপনার ভাল লাগতে না-ই পারে, কিন্তু ইশারায় বলা যে, তাঁর উপন্যাসের চাইতে প্রবন্ধই ভাল; সেটা কি কোনো কথা হলো?
Sumon Rahman
 উপন্যাস ভাল লাগে নাই। প্রবন্ধ লেগেছে। আর কিভাবে সেটা বলা যেতো বলেন তো?
Faruk Wasif
 দেবেশ রায়ের শক্তিমত্তা ভীষণভাবে টের পাই তার নন-ফিকশনে। এটা আপনার একটা স্টেটমেন্ট না? প্রকারান্তরে বলা ফিকশনে তিনি দুর্বল। একজন ফিকশন রাইটার যিনি বিরাট বিস্তৃত কাজ করে গেছেন ফিকশনে, অথচ নন ফিকশনে তিনি বেশি শক্তিমান, এভাবে বলায় কিন্তু সাহিত্যিক হিসেবে তাঁর ব্যর্থতার নিবন্ধন হলো আপনার তরফে। রুচি ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু দুর্বল বলে গণ্য করাটা নিতে পারি নাই। আপনার কথায় জেনারেল স্টেটমেন্টের টান চলে এসেছিল, সেটুকু নিয়ে আপত্তি।
দ্বিতীয়ত, তিস্তা পারের বৃত্তান্তে বাঘারু সভ্য মানুষের বুদ্ধির অগম্য একটা প্রায় বুনোপ্রাকৃতিক সত্তা। অরণ্য, নদী আর মহিষের সঙ্গে সে বেশি সহজ। এই নির্মাণকে বুদ্ধিবৃত্তিক বলা যায় না। এধরনের এক অজ্ঞেয় মনকে আধুনিক উপন্যাসের নায়ক বানানোর উদাহরণ আর পাই না তেমন (তমিজের বাপ কিছুটা আসে)। বলা হয় আধুনিক উপন্যাসে ব্যক্তি লাগবে, বাঘারুতে ব্যক্তি কোথায়? ভূমিকোচঅরণ্যের সমাজতত্ত্বের মধ্যে বাঘারুর মতো প্রাগৈতিহাসিক ক্যারেক্টার বসানো বিরাট ইমাজিনেশনের ব্যাপার।
আপনার মনে আছে কিনা, শালবনে মহিষের পাালের সঙ্গে তার ভাব কিংবা শালগাছের সঙ্গে বাঁধা বাঘারু তিস্তার তলদেশে স্রোতের টানে ডুবছে আবার ভাসছে, পানির তলায় বড় বড় পাথরের সংঘর্ষের আওয়াজ, এসবের যে বর্ণনা, মাতাল বাঘারুর সংলাপ; অসামান্য কল্পনা প্রতিভা ছাড়া (জীবনানন্দের ভাষায়) সম্ভব হবার না।
Faruk Wasif
আমার কথা তো পরিষ্কার। তার ফিকশন টানে নাই। প্রবন্ধ টেনেছে। ভীষণভাবে। ফিকশন কেন টানে নাই, সেই আলাপ আরো শক্ত খুঁটির উপর বসানো যেত। না করে আমি বরং আমার নিজের অবসেশন ইত্যাদির দোহাই দিলাম। বিষয়টাকে ব্যক্তিগত বয়ান আকারেই দেখার জন্য। কিন্তু আপনার বাঘারু মন তবুও আহত হয়ে গেল! সমবেদনা 

(লেখকের ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে সংগৃহীত) 


দেবেশ রায় এবং বাংলা উপন্যাসের দুর্বলতা ও শক্তি 

খোরশেদ আলম

দেবেশ রায় বাংলা উপন্যাসে এর মধ্যেই প্রবাদপ্রতিম লেখক হয়ে উঠেছিলেন। তিনি ঔপন্যাসিক একই সঙ্গে উপন্যাস-তাত্ত্বিক। তাঁর উপন্যাস-ভাবনায় কিছু বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। একটা উপন্যাসে কতকগুলো মৌলিক বিষয় থাকে। যেমন চরিত্র। তবে উত্তরাধুনিক উপন্যাস হলে এই কেন্দ্র না-ও থাকতে পারে। আধুনিক উপন্যাসের ক্ষেত্রে কেন্দ্রে থাকা চরিত্র হচ্ছে ব্যক্তিমানুষ। কিন্তু সেই ব্যক্তিমানুষের জীবন কীভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় সেটাই তাঁর আগ্রহের জায়গা। এক্ষেত্রে নানা ধরনের নিয়ন্ত্রকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হচ্ছে রাষ্ট্র।অর্থাৎ মানুষ কীভাবে রাষ্ট্র কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে সেটা হবে উপন্যাসের একটা অপরিহার্য উপাদান। এক্ষেত্রে দেবেশ রায় আমাদের উপন্যাসের দীনতা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, “আমাদের উপন্যাসে সমাজ আছে, কিন্তু রাষ্ট্র অনুপস্থিত।”

অন্যদিকে এটাও সত্য-- দেবেশ রায় উপন্যাস বলতে একটা নির্দিষ্ট ধারণা বা আদর্শের কথা বলেন। বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত উপন্যাস-পাঠ ও বিশ্লেষণের অভিজ্ঞতাও সেখানে রয়েছে। তাঁর কথায়: ‘উপন্যাস বলতে ডন কুইকসোট, টম জোনস, স্কারলেট অ্যান্ড ব্ল্যাক, হিউম্যান কমেডি, ওয়ার অ্যান্ড পিস, আনা কারেনিনা, ব্রাদার্স কারামোজভ, এদের দ্বারা নির্দিষ্ট আদর্শ বোঝায়। এ উপন্যাসগুলোতে সমসাময়িক রাজনীতি আর ব্যক্তিমানুষের নিয়তি যেমন ওতপ্রোত, আমাদের ভাষায় তেমন উপন্যাসের অভাব’ (উপন্যাসচিন্তা, সময় ও সমকাল)

বাংলা উপন্যাসে দেবেশ রায়ের এই অভাববোধটা নেতিবাচক। কিন্তু তাঁর ইতিবাচক ও তাৎপর্যপূর্ণ পর্যবেক্ষণও রয়েছে। যেসব বিদেশী উপন্যাসের মডেলে তিনি বিষয়টাকে হাজির করেছেন, সেই তিনিই আবার তা ভুল প্রমাণ করেছেন। যেমন পরবর্তীকালের পাশ্চাত্য উপন্যাসগুলোয় রাষ্ট্র আর তেমন উপস্থিত নয়। বরং জীবনের চরম বিচ্ছিন্নতাবোধ, সভ্যতার সংকট ও পুঁজির দড়িতে ফাঁস লাগানো মানুষ, কিংবা অস্তিত্বের দার্শনিক সংকটই প্রধান উপজীব্য। কাফকা, কাম্যু প্রমুখের লেখায়ও তা আছে। দেবেশ রায় মনে করেন-- বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর পশ্চিমী উপন্যাসে এই লক্ষণসমূহ প্রকাশের পূর্বেই জগদীশ গুপ্ত বা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে বাংলা উপন্যাসে সেসব এসে গেছে। ফলে এদিক থেকে আমরা ইউরোপেরও পূর্বসূরী।

কাজেই দেবেশ রায় যেমন বাংলা উপন্যাসের দুর্বলতার বিষয়টি অকপটে স্বীকার করেছেন তেমনি অভিনবত্বের বিষয়টাতেও মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন। ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’, ‘মফস্বলী বৃত্তান্ত’ ‘শিল্পায়নের প্রতিবেদন’ কিংবা ‘খরার প্রতিবেদন’ প্রভৃতি মহৎ উপন্যাসের লেখক দেবেশ রায় আপনি ভালো থাকুন ওপারে। 

(লেখকের ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে সংগৃহীত)



হাসান নাঈম

সাহিত্যের জগতে যারা রাজা মহারাজা হয়ে থাকবেন, দেবেশ রায় তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর রচনা বর্ণনাত্মক। তিস্তাপারের বৃত্তান্ত, মফস্বলী বৃত্তান্ত, সময় অসময়ের বৃত্তান্ত যেন সত্যিকার অর্থেই বৃত্তান্ত। প্রতিবেদনগুলো কলেবরে ছোট হলেও শৈলী একই। তিনি ছিলেন রুশ সাহিত্যের একনিষ্ঠ পাঠক এবং সংস্কৃত সাহিত্যের সমঝদার ও একনিষ্ঠ ভক্ত। তাঁর উপন্যাসের বর্ণনা প্রবাহ অনেকটা তলস্তয়, দস্তয়ভস্কির মতো মনে হলেও প্রকৃত অর্থে তিনি তা নন, বরং অনেকটা যেন মঙ্গল কাব্য বরং তাও নয়। আমরা মুকুন্দরামের সেই নগর পত্তন অংশের কথা জানি, কবি সেখানে তিন পৃষ্ঠা ব্যাপী শুধু ঘাসের নাম বলেছেন। তিস্তাপারের বৃত্তান্তের কথাই ধরুন না কেন শ্রমিকদের পোষাকের বর্ণনা দিতে গিয়ে তাদের টি-শার্টের কলারের বর্ণনা কতোক্ষণ দিয়েছেন তা মনে থাকার কথা, আর শ্রী দেবীর নাচ নিয়ে তো অধ্যায়ের পর অধ্যায় রচনা করেছেন "ম্যাঁ তেরি দুশমন দুশমন তু ম্যারা, ম্যাঁ নাগিন তু সাপেরা!" (লেখকের ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে সংগৃহীত)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন