শুক্রবার, ২৩ অক্টোবর, ২০২০

একান্ত আলাপে শওকত আলী



 ‘মৃত্তিকালগ্ন মানুষ আজীবন আমাকে টেনেছে’শওকত আলী

 ভূমিকা ও সাক্ষাৎকার : নূর কামরুন নাহার

বাংলা কথাসাহিত্যে শওকত আলী এক প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব। ১৯৩৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি দিনাজপুরের রায়গঞ্জে তাঁর জন্ম। পারিবারিকভাবেই বেড়ে উঠেছেন রাজনীতি-সচেতন, সংস্কৃতিমনা পরিবেশে। বাবা সক্রিয়ভাবে কংগ্রেসের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। মা রাজনীতিতে পুরোমাত্রায় সক্রিয় না থাকলেও ছিলেন রাজনীতি-সচেতন। ছোটবেলা থেকেই সংস্পর্শে এসেছেন বইয়ের।

বর্ণাঢ্য আর সংগ্রামমুখর জীবন তাঁর। উত্তাল সময় আর ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পালাবদলের সাক্ষী তিনি। মাত্র এগারো বছর বয়সে দেখেছেন দেশভাগ। শিকার হয়েছেন নির্মম বাস্তবতার। মাতৃভূমির মাটি, মাটির গন্ধ আর প্রকৃতির নৈকট্য ছেড়ে তাঁকে আসতে হয়েছে নগরে। জন্মস্থান ছেড়ে আসার এই সুতীব্র বেদনা তাঁর রক্তে বপন করেছে সাধারণ মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। জাতীয়তাবাদের জাগরণ, জাতিসত্তা আর মাটির মানুষের জন্য সংগ্রামের সুদীর্ঘ পথে দৃঢ়তার সাথে হেঁটে চলার বাসনা তাঁকে টেনে নিয়ে আসে রাজনীতিতে। ছাত্রাবস্থায়ই তাই জড়িয়ে পড়েন ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতিতে। করেন কারাবরণ । জেল গেটে বসেই বিএ থার্ড ইয়ারের পরীক্ষা দেন। মুক্তি পেয়ে পাস করেন বিএ। তারপর বেকারজীবন, অর্থকষ্ট, স্কুলে শিক্ষকতা এবং পাশাপাশি সাহিত্যচর্চা। একসময় আসেন ঢাকায়। জগন্নাথ কলেজে অধ্যাপনায় যোগ দেন।

কর্মজীবনে একধরনের স্থিরতা এলেও শওকত আলীর মানসিক জগত্ ছিল বিশ্রামহীন। সাধারণ নিপীড়িত জনতার মুক্তি আর সৃষ্টির উন্মাদনায় উন্মাতাল, উত্তাল। শওকত আলী যেমন আপোসহীন ছিলেন তৃণমূল মানুষের মুক্তি ও প্রাপ্তির জায়গায়, তেমনি শিল্পসৃষ্টি লেখনী ও প্রকাশের জায়গায়। তাই তাঁর উপন্যাস-গল্পে যেমন ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়েছে সাধারণ মানুষের শোষণ, নির্যাতন, বঞ্চনা এবং মুক্তির আকাঙ্ক্ষা তেমনি প্রকাশের ঋজুতা, বর্ণনা, ভাষা ও প্রকাশভঙ্গির ভিন্নতায় তা হয়ে উঠেছে শিল্পোত্তীর্ণ জীবনের ঘনিষ্ঠ পাঠ।

শওকত আলীর উপন্যাস ও গল্পের প্রধান অংশজুড়ে রয়েছে নিম্নবর্গের মানুষ, তাদের শোষিত জীবনের কথকতা। সামন্তবাদী সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে শওকত আলীর মনের বিদ্রোহ আজীবন। খুব কাছ থেকে তিনি দেখেছেন অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষদের। তাদের দুঃখ-বেদনা, হাহাকার, বঞ্চনার সাথে একাত্ম হতে পেরেছেন। তাঁর গল্পের নিপীড়িত জনতা তাই জ্বালিয়ে দেয় প্রতিরোধের আগুন, খড়ের গাদায় পুড়িয়ে দেয় মহাজনের ঘর, কড়ায়-গণ্ডায় হিসাব চায় মুখোমুখি দাঁড়িয়ে।

শওকত আলী জীবনকে দেখেছেন নির্মোহভাবে। তাঁর কলমের দক্ষতায় এঁকেছেন মানুষের জীবনছবি। সে জীবনছবি আমাদের ইতিহাস, শ্রেণী, শ্রেণীসংগ্রাম আর জীবন-আকাঙ্ক্ষার।

কথাসাহিত্যের এ কিংবদন্তি এখন সময় কাটান টিকাটুলীতে তাঁর বাসার নির্জন কক্ষে। বার্ধক্যের নানা শারীরিক সমস্যায় এখন আর তেমন লিখতে পারেন না। একটা পূর্ণাঙ্গ আত্মজীবনী লেখার ইচ্ছা বহু দিনের। কাজটায় হাতও দিয়েছিলেন। কিন্তু স্মৃতি মাঝেমাঝেই তাঁকে প্রতারিত করে। অনেককিছুই স্মরণ করতে পারছেন না। লিখতে না পারলেও বই তাঁর অবসরের প্রিয় সঙ্গী। পড়েন গল্প, উপন্যাস, রাজনীতি, ইতিহাসের বই। ১২ ফেব্রুয়ারি, তাঁর ছিয়াত্তরতম জন্মদিনে, এসব নিয়েই কথা হয়—

আজ আপনার ছিয়াত্তর বছর পূর্ণ হলো, বলা যায় বেশ বড় একটা সময় পার করেছেন। আপনার এই বেড়ে ওঠা, আপনার শৈশব নিয়ে কিছু জানতে চাই—

জন্মের সাল সঠিক বলতে পারব না। তবে সম্ভবত ১৯৩৫; ১৯৩৬-ও হতে পারে। আমার স্কুলে জন্মসাল তা-ই দেখানো আছে, তারিখ ১২ ফেব্রুয়ারি। জন্ম রায়গঞ্জ নামের এক থানাশহরে। আমি মায়ের তৃতীয় সন্তান। কিন্তু সন্তানদের মধ্যে চতুর্থ কারণ, আমার দু-বোন যমজ। বেশ বড় একটা বাড়িতে বড় হয়ে উঠি। অনেকখানি জায়গাজুড়ে পুকুর, চারদিকে বাগান ছিল। বাবা দাদা-দাদির প্রথম সন্তান ছিলেন। আমার জন্মের আগেই দাদা মারা যান। দাদি আমাকে খুব আদর করতেন। রাতে দাদির কাছেই থাকতাম। বাবা লেখাপড়ার প্রতি খুবই আগ্রহী ছিলেন। প্রচুর বই ছিল। মাও লেখাপড়ার দিকে আগ্রহী ছিলেন। ইংরেজি শেখার জন্য মা ইংরেজি স্কুলের একজন দিদিমণিকে রেখেছিলেন। স্মৃতি যত দূর যায়, শিশু বয়সে ওই গাছপালা, বাগান, প্রকৃতি দেখতাম আর দাদির কোলে বসে কাহিনি শুনতাম।

জন্মের পর থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত রায়গঞ্জেই ছিলাম। তারপর শ্রীরামপুর। হুগলি জেলায়। সেখানে টেক্সটাইল ইনস্টিটিটিউটে মা ভর্তি হলেন ডিপ্লোমা করতে। স্কুলজীবন শুরু হয় শ্রীরামপুর মিশনারি স্কুলে। খুব প্রাচীন স্কুল। উইলিয়াম কেরী সম্ভবত স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বাবা ছিলেন হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার। বাবাও শ্রীরামপুর চলে এলেন। ডাক্তারির প্র্যাকটিস শুরু করলেন। তখন শ্রীরামপুর থেকে কলকাতা যাতায়াত করা সহজ ছিল। বাবা কলকাতায় হোমিওপ্যাথিক ডিগ্রি নিতে ভর্তি হলেন, ডিগ্রি নিলেন। পরে আবার রায়গঞ্জে ফিরে আসি। ভর্তি হই রায়গঞ্জ করোনেশান স্কুলে। ওখান থেকেই মেট্রিক পাস করি।

তাহলে বলতে হয়, মাঝের দু-তিন বছর ছাড়া রায়গঞ্জেই আপনার শৈশব-কৈশোরের উল্লেখযোগ্য সময়টা কেটেছে। এ সময়টা আর রায়গঞ্জের স্মৃতি কি আপনার লেখালেখির জীবনে ভূমিকা রেখেছে?

উনিশশ খ্রিষ্টাব্দের আগেই আমদের পরিবারে শিক্ষা প্রবেশ করেছিল। রায়গঞ্জের উকিলপাড়ায় থাকতাম। ও পাড়ায় আমরাই ছিলাম একমাত্র মুসলিম পরিবার। সে সময়টায় মুসলিম পরিবারে মেয়েদের লেখাপড়ার চল ছিল না। আমাদের পরিবারের মেয়েরা লেখাপড়া করেছিল। আমার মা লেখাপড়া শিখেছিলেন। মেদিনীপুরে একটা মিশনারি স্কুলে ছয় মাস চাকরি করেছিলেন। পরে রায়গঞ্জ প্রাইমারি স্কুলে চাকরি নেন। পরবর্তী সময়ে গার্লস স্কুলে শিক্ষকতা করেন এবং ১৯৪৯ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ওই স্কুলেই চাকরি করতেন।

কংগ্রেসের ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে বাবা সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন, মা মুসলিম লীগের পাকিস্তান আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন। ওটা রাজনীতির একটা জটিল সময় ছিল। আমাদের মানসিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হতো, আবেগ আসত, ভেতরে একটা বোধ কাজ করত—ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। মুসলমানরা অবহেলিত, তাদের অবস্থার উন্নতি করতে হবে। এগুলো পরবর্তী সময়ে লেখার প্রেরণা জুগিয়েছে, খোরাক জুগিয়েছে।

বাড়িতে ইংরেজি পত্রিকা, মাসিক পত্রিকা মোহাম্মদী, পরে সওগাত, আনন্দবাজার, যুগান্তর পত্রিকা আসত। আর ওই ছোটবেলায় আমার প্রকৃতি—রায়গঞ্জে প্রচুর বৃষ্টি হতো—বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে আম কুড়ানো, লুকিয়ে বিল-খালের উজানে মাছ ধরা—এগুলো খুব আনন্দ দিয়েছে। এগুলো নানাভাবে আমার লেখায় প্রভাব ফেলেছে।

কলেজজীবনে আপনি রাজনীতিতেও জড়িয়ে পড়েন। আপনার রাজনৈতিক বিশ্বাস, সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া, আপনার লেখকজীবনকে কীভাবে প্রভাবিত করেছে?

কলেজে পড়ার সময় ছাত্র ইউনিয়ন করতাম। ছাত্র ইউনিয়ন বামপন্থী চিন্তাধারায় বিশ্বাসী। তৃণমূল মানুষের জন্য কাজ করা, তাদের মুক্তির জন্য লড়াই করা—ওটাই ছিল রাজনৈতিক বিশ্বাস। তারপর বাঙালি জাতীয়তাবাদের জাগরণ শুরু হয়। রাষ্ট্রভাষার জন্য আন্দোলন হয়, পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলন হয়। ১৯৫৪-র ৯২ (ক) ধারা জারি হয়। আমি আর ফরহাদ একসাথে জেল খাটি। হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিখ্যাত নেতা ছিলেন। তাঁর সাথেও সক্রিয় রাজনীতি করি; জেলও খাটি। রাজনৈতিক মতাদর্শ জীবনের একটা প্রধান দিক। সেটা তো অবশ্যই লেখাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। আমার বিশ্বাস ও দর্শন আমার লেখায় উঠে এসেছে।

আপনার এখনকার রাজনৈতিক বিশ্বাস কী?

আমি কোনো দলের চিন্তা করি না। রাজনীতিক কর্মসূচিও দেখি না। সাধারণ মানুষের মুক্তির কথা যেখানে বলা আছে, সাধারণ মানুষের জীবনের পরিবর্তন যাতে আসে এবং সাধারণ মানুষের যাতে ভালো হয়—সেটাই সমর্থন করি।

আপনার সেই স্মৃতির রায়গঞ্জের সাথে এখনও কি কোনো যোগাযোগ আছে?

নাহ। বহু দিন রায়গঞ্জের সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ নেই। ১৯৫৬ সালে শেষবারের মতো যাই। দেশভাগের পর ওটা ওপার বাংলার অংশ হয়ে গেল। ওখানে আমাদের বাড়ি-ঘর নেই। আমাদের জায়গা-জমি সব দখল হয়ে গেল। ষোল বছর বয়সে আমরা দিনাজপুর শহরে চলে আসি। দিনাজপুর শহরে একটা বাড়ি কিনি। সেটা ১৯৫২ কি ৫৩ সাল।

আপনি তো দেশভাগের সময়টার স্বাক্ষী। শুধু তা-ই নয় দেশভাগের কারণে ছেড়ে আসতে হয়েছিল আপনার জন্মস্থান। এই যে দেশভাগ, জন্মস্থান ছেড়ে চলে আসা, এর যে বেদনা ও জ্বালা তা কি আপনার পুরো লেখালেখিতে গভীর রেখাপাত করেছে?

জন্মস্থান হারানোর এ বেদনা তো অপরিসীম। সেটা ভাষায় ব্যাখ্যা করা যায় না। আগেই বলেছি, আমরা দিনাজপুর শহরে আসি। আমরা এলেও বাবা রায়গঞ্জ থেকে যান। কিন্তু বেশি দিন তিনি থাকেননি। তিনিও একসময় দিনাজপুর এলেন। তারপর আর ফিরে যাননি। পরে আমাদের দখল হয়ে যাওয়া জমি সরকার উদ্ধার করে। একটা ক্ষতিপূরণও নির্ধারণ করে। কিন্তু বাবা তা আনতেও আর যাননি। ঠিক জানি না কেন, তবে একধরনের অভিমান আর কষ্ট থেকেই বাবা এটা করেন। এ বিষয়টি আমার লেখালেখিতে বিচ্ছিন্নভাবে এসেছে।

আপনার ‘ওয়ারিশ’ উপন্যাসে আমরা এমন একটা চিত্র দেখি—

হ্যাঁ, তা আছে। ওই উপন্যাসে আমি শ্রীরামপুরের কথাও উল্লেখ করেছি।

দেশভাগের এই যে একটা প্রভাব, তা তো আমাদের সবকিছুকেই নানাভাবে প্রভাবিত করেছে।

দেশভাগের একটা ব্যাপক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া আছে। আমাদের সমাজিক-রাষ্ট্রীয়-পারিবারিক—সকল জীবনে এটা গভীর প্রভাব রেখেছে এবং এখনও অব্যাহত আছে। দেশভাগ থেকেই আমাদের জাতীয়তার উপলব্ধি স্পষ্ট হয়েছে এবং জাতিসত্তার জাগরণ ঘটেছে। যারা ওখান থেকে চলে এসেছে, তাদের সংগ্রাম করতে হয়েছে। নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হয়েছে। তারপর এখানের সামাজিক-রাজনৈতিক জীবনের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ, এই দেশ এবং সবকিছুর সাথে নিজেকে একাত্ম করতে হয়েছে। এই যে সমন্বিত চিন্তাধারা, আলাদা জীবনধারা, স্বতন্ত্র অস্তিত্ব—সেটাই তো জাতিসত্তা। যতদিন পাকিস্তান ছিল তখন মনে হতো বাধ্য হয়ে আমরা এখানে আছি। পাকিস্তান থেকে যখন আবার বাংলাদেশ হলো, তখন তাতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছি। জাতিসত্তা মনে ও রক্তে ধারণ করেছি। বাঙালিরাই পাকিস্তান বানিয়েছিল। কিন্তু তারা বুঝতে পেরেছিল, সেটি তাদের জন্য সঠিক হয়নি।

এ জাতিসত্তার জাগরণ তো অনেক আগেরই একটি বিষয়; এ দেশের মানুষ তো ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনও করেছিল, এ জাতিসত্তার উন্মেষ থেকেই করেছিল।

সেটা তো অবশ্যই করেছিল। তৃণমূল মানুষেরাই সেসব আন্দোলন করেছিল। তবে তাতে জাতিসত্তার উন্মেষ এত স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কলকাতাকে রাজধানী বানাল। উনিশ শতকের বাঙালি পণ্ডিত এবং যারা সমাজ নিয়ন্ত্রণ করত, তারা অধিকাংশই ছিল উচ্চবর্ণের হিন্দু। তারা এ সময় জ্ঞান অর্জন করতে পেরেছিল, বিশ্ব সম্বন্ধে ধারণা নিতে পেরেছিল, রাজনীতি সম্পর্কে সচেতন ছিল। রাজনীতিতে যাঁরা অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং যাঁরা বিলেত গিয়েছিলেন, এঁরা তো তাঁরাই, তাই না! জাতীয়তার তত্ত্ব তখন ইউরোপে সুপ্রখর ছিল। কারণ ইউরোপের সবই জাতিরাষ্ট্র। জাতিরাষ্ট্র কী, জাতীয়তার চেতনা কী, জাতিসত্তা কী—এগুলো তাঁদের না জানার কথা নয়। তাঁরা তা জানতেন। তবুও বাঙালিদের মধ্যে তখন জাতীয়তার সে জাগরণ ছিল না।

ইস্ট ইন্ডিয়া যখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের শাসনের অন্তর্ভুক্ত হলো, ভূমি-ব্যবস্থায় জমিদারি প্রথা প্রচলিত হলো, তখন দালাল শ্রেণীর উদ্ভব হলো এ সুবিধাবাদী শ্রেণীর সহায়তায়ই। এই দালাল শ্রেণীর মাধ্যমে তারা এ দেশ শাসন করতে পেরেছিল। এ শ্রেণীর মধ্যে অনেকেই ধন-সম্পদের অধিকারী হয়েছিল আর উচ্চ শ্রেণীর হিন্দুরা তো ছিলই। মুসলমানদের মধ্যে অল্পসংখ্যক যারা ছিল, তারাও ছিল নবাব বংশীয়। এর ফলে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী সাধারণ ভূমিলগ্ন মানুষ—তারা অবহেলা এবং নির্যাতনের যাঁতাকলে পিষ্ট হতে থাকে। এবং এই অবহেলিত সাধারণ মানুষই একাধিকবার ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। তারপর ব্রিটিশরা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষে এই সাম্রাজ্য শাসনের দায়ভার ত্যাগ করার জন্য প্রস্তুত হয়, কেননা ব্রিটিশ শাসন বিরোধী আন্দোলন তখন ব্যাপক ও তীব্র হয়ে উঠেছিল। মুসলমানদের রাজনীতিক দল মুসলিম লীগ সক্রিয় ও শক্তিশালী ছিল। আর মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস তো সমগ্র ভারতেই একটি শক্তিশালী রাজনীতিক দলে পরিণত হয়েছিল। এ রকম একটা পরিবেশে একটা রেফারেনডাম হয় এবং তারই ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়।

এখন বিষয় হচ্ছে, পাকিস্তান হবার আগেও বাঙালি মুসলমানরা নিগৃহীত ছিল। সাধারণ মানুষ নিগৃহীত ছিল। সাধারণ বাঙালি মুসলমানেরা ভেবেছিল, পাকিস্তান হলে তারা এই নিপীড়ন থেকে মুক্ত হতে পারবে। কিন্তু নতুন রাষ্ট্রের সূচনালগ্নেই একটি প্রশ্ন উত্থাপিত হয়; ভাষার প্রশ্ন। রাষ্ট্রভাষার আন্দোলন ধরেই উঠে আসে প্রাদেশিক স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবি। এবং তার অল্প কিছু দিন পরই স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার প্রক্রিয়া এবং সংগ্রাম, যা বাংলাদেশ নামে নুতন রাষ্ট্রের জন্ম দেয়। এবং এই প্রথম জাতিসত্তার উপলব্ধিটা পুরোপুরি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই উপলব্ধির পেছনে যে চিন্তা-চেতনা কাজ করেছিল, সেটাই হচ্ছে জাতীয়তাবাদের চিন্তা।

তাহলে এ কথা বলা যায়, এ অঞ্চলের অর্থাত্ পূর্ব বাংলার বাঙালিদের দ্বারাই এ জাতিসত্তার উন্মেষ ঘটে।

বলা যায়। পূর্ববঙ্গের মানুষ জাতিসত্তার জাগরণে যেভাবে জেগে উঠেছিল, সেভাবে এটাকে সংগঠিত করেছিল। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ সেভাবে করেনি।

আপনার ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ ব্যাপক আলোচিত একটি উপন্যাস। অনেকেই এটাকে ঐতিহাসিক উপন্যাস বলে চিহ্নিত করেন—

এটাকে ঠিক ঐতিহাসিক উপন্যাস বলা যাবে না। ঐতিহাসিক একটি সময় বা পর্যায়ের উপন্যাস। কারণ, আমি তো সময় বা ঘটনার প্রামাণিক কোনো কিছুকে উপস্থাপন করিনি। কাহিনি ও ইতিহাস যখন পড়তাম, তখন আমার মনে অনেক জিজ্ঞাসার সৃষ্টি হতো। যেমন লক্ষণ সেন। রাতের খাবার না খেয়েই লক্ষণ সেন পালিয়ে গেল। বখতিয়ার খিলজি কিন্তু তখনও বাগেরহাট সীমানায় আসেননি। এই যে ইতিহাসের এসব ঘটনা—আমাকে খুব ভাবায়। সেই সাথে আমার মনে জাগে—ইতিহাসের এই পালাবদল—এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে সাধারণ মানুষের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল? এসব ভাবতে ভাবতেই ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ লেখার চিন্তা হয়। যারা শাসক গোষ্ঠী, রাজা-মহারাজা তারা যে জনগণের কথা ভাবত না এবং জনগণের সমর্থন পেত না, তার কল্পনা করেই এ উপন্যাস লেখা হয়। উপন্যাসের নামকরণটাও কিন্তু সে চিন্তা থেকেই এসেছে। প্রদোষকাল মানে দিন ও রাত্রির মাঝামাঝি সময়। হিন্দু শাসন চলে যাচ্ছে, মুসলমান শাসকেরা আসছেন, এই মাঝামাঝি সময়ে সাধারণ মানুষের কী অবস্থা, তারা কী ভাবছে? ওই উপন্যাসে কিন্তু সামপ্রদায়িকতার কোনো কথা নেই। সাধারণ মানুষের যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, তা-ই উপস্থাপন করা হয়েছে।

আপনি বললেন সাধারণ মানুষের দিনযাপন, এই সাধারণ মানুষের দিনযাপনটা আপনি কীভাবে সংগ্রহ করলেন। সেটা কি ইতিহাস থেকেই, না কি এখানে ঔপন্যাসিকের কল্পনা। ঔপন্যাসিক তো কিছু নিজস্বতা সৃষ্টি করবেনই…

সাধারণ মানুষের দিনযাপন, আশা-আকাঙ্ক্ষা—এগুলো কিছুটা তো অবশ্যই কল্পনা করেছি। তবে কিছু কিছু কাহিনি আমি পেয়েছি। লক্ষণ সেনের মন্ত্রী হলায়ূধ মিশ্র, সংস্কৃত ভাষায় কাব্য লিখেছিলেন ‘সেক শুভোদয়া’ নামে। ওই বইটির খণ্ডিত অংশ আমি পেয়েছিলাম। আমি যেহেতু কিছু কিছু সংস্কৃত জানতাম, তাই আমি এটি পড়েছিলাম। যদিও হলায়ূধ মিশ্রকে নিয়েও বেশ বিতর্ক ছিল। তবু ওখানে ওই সময়কার চিত্র রয়েছে। আরব থেকে অনেক লোকজন আসত ঘোড়া বিক্রি করতে। তাদের যবন বণিক বলা হতো। যবন বণিকরা অশ্ব বিক্রি করে চলে যেত। তাদের চলাফেরা-কাজকর্ম হলায়ূধ তাঁর শুভোদয়াতে লিখেছিলেন। সেখানে দেখা যায়, ওইসব বণিকেরা প্রভু-ভৃত্য একসাথে খাবার খেত। সবাই একসাথে সন্ধ্যায় জোরে জোরে প্রার্থনা করত। সে সময়ের প্রেক্ষাপটে তা অকল্পনীয় ছিল। যবনদের জন্য আলাদা যবন কেন্দ্র ছিল, যবন ভিক্ষুরা সেসব কেন্দ্রে থাকত। যারা সাধারণ মানুষ, তারা ওইসব কেন্দ্রে যেত। এ বিষয়গুলো আমার মনে অনেক নাড়া দেয়। বিষয়টা হলো, সাধারণ মানুষ সবসময়ই নিগৃহীত ছিল।

আর কল্পনা তো অবশ্যই আছে। ওই সময়টাকে আমি নিজের মতো করে সাজিয়ে নিয়েছি। সে জন্যই তো এটাকে আমি প্রথাগত ইতিহাসভিত্তিক উপন্যাস বলছি না।

উপন্যাসের নায়ক শ্যামাঙ্গের মনে একধরনের ক্ষোভ ছিল। শ্যামাঙ্গ আবার একজন আধুনিক মানুষ এবং অস্তিত্বের প্রতি তার জিজ্ঞাসা ছিল। শেষ পর্যন্ত তার মৃত্যু হয় কিন্তু সে জিজ্ঞাসা, ক্ষোভের উত্তর তো আমরা পাইনি।

এর উত্তর তো ইতিহাস দেয়নি। উত্তর বলো, আর যা-ই বলো একটাই কথা। সেটা হচ্ছে এগিয়ে যাওয়া। শ্যামাঙ্গও সে কথাই বলে গেছে।

‘দক্ষিণায়নের দিন’, ‘কুলায় কালস্রোত’ এবং ‘পূর্বরাত্রি পূর্বদিন’ যেগুলোকে ত্রয়ী উপন্যাস বলা হয়, সেটার জন্য তো আপনি ফিলিপস্ পুরস্কার পান। ওই উপন্যাসেও তো জাতীয়তাবাদের চেতনার উন্মেষ দেখি।

ষাটের দশকের মানুষের মধ্যে চিন্তাভাবনার যে পরিবর্তন আসছে, সেটাই ‘দক্ষিণায়নের দিন’ যার মানে হচ্ছে শীতকাল আসছে। ‘কুলায় কাল স্রোত’ হচ্ছে পরিবর্তন যেখানে আঘাত করছে। আর ‘পূর্বরাত্রি পূর্বদিন’ হচ্ছে নতুন সময়টি আসার একেবারে আগের সময়টি।

মূলত ষাটের দশকে আমাদের মধ্যবিত্ত এবং সমগ্র সমাজব্যবস্থায় একটা পরিবর্তন আসে। নতুন একটা চিন্তা-চেতনা দ্বারা আলোড়িত হয় পুরো সমাজ। ধ্যান-ধারণা চাল-চলন জীবনব্যবস্থায় একটা পরিবর্তনের সুর বেজে ওঠে। সেসবই উপন্যাসে আনতে চেয়েছি।

দক্ষিণায়নের দিন’ উপন্যাসে দেখা যায় নায়িকা রাখিকে ভাইয়ের বন্ধু—যে একজন বিপ্লবী—তার সাথে মিলিত হতে। যদিও রাখি তার স্বামী কর্তৃক প্রতারিত। বিবাহ বহির্ভূত এ রকম দৈহিক মিলন কি আপনি তখন সমর্থন করেছিলেন, না কি প্রচলিত প্রথাকে ভেঙে ফেলার জন্য অথবা নায়িকাকে প্রতিবাদী হিসেবে দেখানোর জন্য এ কাহিনির নির্মাণ?

উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর তরুণ-তরুণীদের মধ্যে তখনই কিন্তু একটা ভিন্ন বোধেরও সূচনা হয়েছিল। বিভিন্ন পার্টিতে যাওয়া, হোটেলে যাওয়া—এসবের শুরু কিন্তু তখনই হয়েছিল। ওই সময়ের আমার চেনা-জানা সার্কেলের মধ্যে এবং আধুনিক তরুণ-তরুণীর কাছেও চিন্তা ছিল শুধু বিবাহিত হলেই দৈহিক সম্পর্ক আর বিবাহিত না হলে এমন সম্পর্ক হবে না—এগুলো পুরোনো সংস্কার। বিয়ে কি আর থাকছে? যাকে ভালো লাগে, তার কাছাকাছি হবে। ঘনিষ্ঠ হবে। এগুলোই স্বাভাবিক।

এই যে চিন্তার পরিবর্তন, সেটাই তুলে ধরছি; সমর্থন করিনি। কারণ রাখির পরিণতি কিন্তু ভালো হয়নি। আমি আসলে ষাটের দশকের প্রথমদিককার নাগরিক জীবন, সে সময়ের জীবনবোধকেই আঁকতে চেয়েছি।

মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে একটা নতুন ধারার জন্ম হলো, এটা বাংলা সাহিত্যকে কীভাবে সমৃদ্ধ করল?

ষাটের দশক থেকে আরম্ভ করে উপন্যাস, গল্প, নাটকের যে বিকাশ ঘটেছে, জীবনকে ধারণ করার যে চেষ্টা হয়েছে—সেগুলোই তো বড় প্রমাণ যে বাঙালি জাতীয়তার উন্মেষ ও বিকাশে আমাদের সাহিত্যে প্রচুর কাজ হয়েছে। এ সময় যদি বলা হয় কবিতা, তাহলে কবিতায়; যদি বলা হয় গল্প, তাহলে গল্পে—এমনি প্রত্যেকটি শাখায় প্রচুর কাজ হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয় হিসেবে নয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে অনেক লেখা হয়েছে। শুধু মুক্তিযুদ্ধ নিয়েই তো অনেকে লিখেছেন; লিখছেন। এটা আলাদাভাবে বলার প্রয়োজন নেই। একটা ধারারই সৃষ্টি হয়েছে এতে। মুক্তিযুুদ্ধের ওপর আমার ছোট গল্প আছে, উপন্যাস আছে। অনেক লেখায়, উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধ এসেছে।

কলকাতার সাহিত্যচর্চার সাথে আমাদের সাহিত্যচর্চার কোনো পার্থক্য আছে বলে মনে করেন?

পূর্ববঙ্গে যে সাহিত্যচর্চা হতো, তার কোনো স্বীকৃতিই ছিল না। কলকাতায় যাঁরা সাহিত্যচর্চা করতেন, তাঁরাই উজ্জ্বল ছিলেন। সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা পুরোটাই কলকাতাকেন্দ্রিক ছিল। এখান থেকে যারা কলকাতা গিয়েছিলেন চল্লিশের দশকের শেষে বা পঞ্চাশের দশকের শুরুতে, যারা আবার ফিরে এলেন তাঁরা সাহিত্যচর্চা শুরু করলেন, এখানে সাহিত্যচর্চার যে ধারা ছিল তাকে বিকশিত ও বেগবান করলেন। বিষয়, আঙ্গিক, ভাষা—এসব উপাদানের ক্ষেত্রে নতুন ধারার সৃষ্টি হলো, ঢাকাকেন্দ্রিক সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চাও খুব ভালোভাবেই শুরু হলো। ঢাকা একটা কেন্দ্র হলো।

ওখানকার জীবনযাপন যে অবস্থায় রয়েছে, তার প্রতিফলন ঘটেছে তাদের সাহিত্যে। আমাদের জীবনযাপন আমাদের সাহিত্যে উঠে এসেছে। তবে আমার যেটা মনে হয়, বাঙালি জাতীয়তার সত্তা, বর্তমানে আমাদের সাহিত্যে স্পষ্ট হয়েছে বেশি।

আপনার সমসাময়িক সাহিত্যিকদের সাথে আপনার লেখার পার্থক্যটা কোথায়?

আমার সমসাময়িক যাঁরা, যেমন সৈয়দ হক অথবা আমার থেকে দু-তিন বছরের ছোট হাসান আজিজুল হক। আরও পরের জেনারেশনে লেখকদের মধ্যে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, আহমদ ছফা—এঁদের সাথে একটা বিষয়ে মিল ছিল, আমি যেসকল বিষয় থেকে চেতনা পেতাম তাঁরা সেসকল বিষয় থেকেই চেতনা ও উপলব্ধি নিয়েছেন। আমাদের চেতনা ও উপলব্ধির জায়গাটা এক, তবে ভাষা-আঙ্গিকে তো অবশ্যই পার্থক্য রয়েছে।

আপনার সমসাময়িক নারী লেখকদের সম্পর্কে কিছু বলুন। ‘নারী লেখক’ এই অভিধা কি আপনি মানেন?

আমার সমসাময়িক নারী লেখকদের মধ্যে রাজিয়া খান, রিজিয়া রহমানের কিছু লেখা পড়েছি। সেলিনা আমার ছোট। ওর লেখাও পড়েছি। আর কারও লেখা নিশ্চয়ই পড়েছি, এখন স্মৃতি সেভাবে কাজ করে না। তাঁদের লেখা আমার ভালো লেগেছে। তাঁরাও তাঁদের কাল এবং জীবনকে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছেন।

লেখক লেখকই—নারী-পুরুষে কিছু আসে-যায় না। তবে নারীদের জন্য বাধাটা পুরুষদের চাইতে বেশি। সে রকম বাধা অতিক্রম করে যে নারীরা লিখেছেন এবং সুফিয়া কামালের মতো কবি এবং অন্য লেখকেরা বেরিয়ে এসেছেন—এটাই আমাদের জন্য বড় প্রাপ্তি।

আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের লেখা সম্পর্কে অভিযোগ আছে যে, তাঁর ভাষা বেশ কঠিন। এ সম্পর্কে কিছু বলবেন?

ইলিয়াস যেভাবে বলতে চেয়েছে, যে বিষয়কে যেভাবে আনতে চেয়েছে রূপকের মাধ্যমে হোক, আঙ্গিকের মধ্যে হোক, তা এ ভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় আনা সম্ভব ছিল না। ‘খোয়াবনামাই’ তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

আপনার ছোটগল্পে আমরা দেখি নিম্নবর্গীয় মানুষের জীবন ও বিচরণ। আদিবাসীর জীবনও উঠে এসেছে আপনার গল্পে। জীবনের বেশির ভাগ সময় নগরেই কাটিয়েছেন কিন্তু আপনার গল্পে নগরজীবনকে কম প্রত্যক্ষ করা যায়—

নগরে থাকলে কী হবে? আমার বাল্যকাল কেটেছে আদিবাসীদের কাছাকাছি। তাদের জীবনধারা দেখেছি। আমি তাদের কিছু কিছু শব্দও জানি। সাঁওতালদের ভাষায় দু-একটি কথাও বলতে পারি। তাই মাটি ও মানুষের প্রতি আমার জন্মগত একটা আকর্ষণ ছিল। সেটাই লেখায় উঠে এসেছে। মৃত্তিকালগ্ন মানুষ আজীবন আমাকে টেনেছে। আমি কিছুকালের জন্য স্কুলশিক্ষক ছিলাম। তখন গ্রামের একেবারে সাধারণ মানুষের সাথে মেশা হয়েছে। তখনও তাদের খুব কাছ থেকে দেখতে পেরেছি।

‘লেলিহান স্বাদ’ গল্পে আমরা দেখি শেষ পর্যন্ত প্রতিবাদী মানুষ আগুন ধরিয়ে দেয়। ‘শুন হে লখিন্দর’ গল্পে দেখি মহাজনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে হিসাব চায় নিপীড়িত মানুষ। প্রতিশোধে সাপের ঝাঁপি খুলে দেয় অন্ধকারে। বাস্তবে কিন্তু প্রায়ই এ রকম ঘটে না কারণ, শেষ পর্যন্ত ক্ষমতাবানদেরই জয় হয়। নিপীড়িতরা কিন্তু নতুন করে আবার নির্যাতনের শিকার হয়। নিপীড়িত মানুষের জয় কি আপনার নিজস্ব লালিত স্বপ্ন, যাকে আপনি গল্পে দেখিয়েছেন?

বাস্তবে অনেক সময় এ রকম ঘটে না, এটা হয়তো অনেক ক্ষেত্রে ঠিক। নিপীড়িত মানুষের পক্ষে জয় সূচিত হয় না—এটা ঠিক আছে। কিন্তু প্রতিরোধ বা প্রতিশোধের আগুন কিন্তু তাদের ভেতরেই থাকে। তাদের ভেতর থেকেই জ্বলে ওঠে। তাদের ভেতর কিন্তু আকাঙ্ক্ষা থাকে—জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে শেষ করে দেব। সেটাই আমি তুলে ধরতে চেয়েছি। শোষিত মানুষ যতক্ষণ না ঘুরে দাঁড়াচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত শোষণের শেষ হবে না। আর আমার মধ্যে তো একটা স্বপ্ন কাজ করেছেই যে, তৃণমূল মানুষের জয় হোক।

এখনকার সময়ের ছোটগল্প-উপন্যাস সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
এখনকার সময়ের ছোটগল্পে আমি যে বিষয়টা দেখি, তৃণমূলের মানুষের জীবন এবং সংগ্রাম খুব বেশি দেখা যায় না। ভাষা, আঙ্গিক আধুনিক ও পরিশীলিত। কিন্তু শিল্প সৃষ্টির জন্য যে আদিমতার প্রয়োজন হয়, মৃত্তিকালগ্নতার প্রয়োজন হয়, সেটা সচরাচর ঘটছে বলে মনে হচ্ছে না।

তৃণমূলের মানুষরা এখনকার উপন্যাসে তো আসছে না। কৃষকদের অধিকার, মাটির মানুষের অধিকার নিয়ে তেমন উল্লেখযোগ্য লেখা কই? এত বছরে আমাদের কৃষকের যে জীবন, তার যে পরিবর্তন, চাষাবাদের জমি বদলেছে, চাষাবাদের পদ্ধতি পরিবর্তিত হয়েছে, একটা জমিতে এখন নানা রকম ফসল হচ্ছে—এগুলো এখন আমাদের সাহিত্যে কই?

এখন বছরে অনেক ঈদসংখ্যা হচ্ছে। এসব সংখ্যার জন্য ছোট সাইজের উপন্যাস লেখা হচ্ছে। বলা যায়, পৃষ্ঠা গুণে এসব ফরমায়েসি উপন্যাস লিখতে হচ্ছে। লেখক তাঁর স্বাধীনতা অনুযায়ী বা বিষয়কে ধারণ করতে উপন্যাসের কলেবর যা হওয়া উচিত, সেভাবে লিখতে পারছেন না। আমাদের দেশের বড় বড় লেখকেরাই এভাবে লিখছেন। এ ধরনের উপন্যাস সম্পর্কে আপনার অভিমত কী?

একটা উপন্যাস বা গল্প সে যা-ই হোক, কোনো বিষয় বা জীবনকে প্রকাশ করতে যতটুকু প্রয়োজন হবে, ততটুকুই তার কলেবর হতে হবে। কোনো উপন্যাস ছোটও হতে পারে। কিন্তু ওই উপন্যাসের জন্য হয়তো এটাই সাইজ। ঈদসংখ্যার জন্য এ ধরনের ফরমায়েসি উপন্যাস আমিও লিখেছি, তবে আমি মনে করি এতে সৃষ্টিটা পরিপূর্ণতা পায় না। লেখা বা সৃষ্টির জন্য এটা শুভ নয়।

জনপ্রিয় লেখক-সিরিয়াস লেখক এবং জনপ্রিয় উপন্যাস-সিরিয়াস উপন্যাস—এমন একটা বিভাজনের বিষয় দেখা যায়। এটাকে আপনি কীভাবে দেখেন?

জনপ্রিয় লেখা-সিরিয়াস লেখা—এটা সব সময় সব দেশেই ছিল। আমাদের দেশে আগেও ছিল, এখনো আছে। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে এভাবে বিভাজন করতে চাই না বা বিশ্বাস করি না। উপন্যাস হলো কি না—এটাই বড় কথা। সৃষ্টি পাঠক বা পাঠকের মনকে স্পর্শ করতে পারছে কি না, সেটাই বিবেচ্য। অনেক সিরিয়াস উপন্যাসও অনেক জনপ্রিয় হতে পারে। আবার অনেক জনপ্রিয় উপন্যাসও হয়তো পাঠক একসময় আর পড়ছে না। ফলে এ রকম জনপ্রিয় উপন্যাস বা পাঠক বিশ্বজুড়েই আছে। এটি সমগ্র সাহিত্যচর্চারই একটা অংশ।

আপনার অনেক লেখাতেই আমরা নারী-পুরুষের সম্পর্ক এবং যৌনতার বিষয়গুলোর উপস্থাপন দেখি। সাহিত্য বা শিল্পে কতটুকু যৌনতা আনা সমীচীন?

আমি আমার লেখায় যৌনতাকে এনেছি। যে জায়গায় আনা প্রয়োজন, সেখানেই তা এনেছি। যে পরিবেশে এলে এ ধরনের বিষয়গুলো প্রাসঙ্গিক, যে পরিবেশ বা পরিস্থিতি হলে ওই ঘটনাটা ঘটবে এবং কাহিনি যেটা দাবি করে, সেটা জঙ্গলে, বনে বা কুটিরে—যেখানেই হোক, ওই পরিবেশ বর্ণনা করতে গিয়েই যৌনতা আনতে হয়েছে। যৌনতা ততটুকুই আনতে হবে, যেটা গল্পের জন্য প্রয়োজন। গল্পের মূল অথবা চরিত্রের মূল প্রকাশ করার জন্য যতটুকু দাবি করে। যদি আমি মানবসভ্যতার আগের কোনো কাহিনি লিখতে চাই, তাহলে কী লিখব? সে সময়ে নারী-পুরুষের যে সম্পর্ক, তা তো আমাকে লিখতে হবেই, তাই না!

গল্পের প্রয়োজন ছাড়া অকারণ যৌনতার বর্ণনাকে কি সাহিত্যে অশ্লীলতা সৃষ্টি—বলা যাবে?

এক অর্থে তো বলা যাবে। কাহিনিতে অকারণ যৌনতাকে আনা হলে বোঝা যাবে, সে জীবনকে ধারণ করতে চায় না। জীবন-বিরোধী বোধ এর মধ্য দিয়ে প্রকাশ ঘটাতে চায়। সাহিত্যকে, শিল্পকে বুঝতে হলে এর জন্য প্রেম প্রয়োজন। প্রেম তো প্রয়োজন আছে জীবনের জন্যও। প্রেম না হলে জীবন হয় না। জীবনের কথা যে লিখতে চায়, জীবনকে যে সামনে আনতে চায়, তার লেখায় তো প্রেম আসবেই। আর প্রেমেও যৌনতা থাকবে। তবে প্রেমপূর্ণ যৌনতা প্রেমে পূর্ণতা আনে আর অকারণ যৌনতা প্রেমকে পরিপূর্ণতা দেয় না বরং বিকৃত করে।

আমাদের ভাষা ও সাহিত্যর অগ্রগতি অথবা যাত্রাকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

কোনো ভাষার সাহিত্যই কোনো সুনির্দিষ্ট পথে যাত্রা করে না। সে বিভিন্নভাবে বাধাপ্রাপ্ত হয়, ঘাত-প্রতিঘাতের সম্মুখীন হয়। সে কিছু হারায় আবার কিছু সঞ্চয় করে। জীবন যেভাবে বিকশিত হয়, সাহিত্যও হয়। কথা হচ্ছে, জনগণ ভাষাটাকে ধরে রাখতে চায় কি না। কিছু লোক ছিল পাকিস্তান আমলে উর্দু ভাষায় কথা বলতে পছন্দ করত। তারা পাঞ্জাবি চালচলনেই আগ্রহী ছিল। ব্রিটিশ আমলে অনেক লোক ছিল, যারা ইংরেজি বলতে পছন্দ করত। ইংরেজদের অনুকরণে পোশাক পরতে পছন্দ করত। এগুলো কিন্তু ভাষা ও সংস্কৃতি বিকাশের ক্ষেত্রে একধরনের বাধাস্বরূপ। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাংলা সাহিত্য মরে যায়নি। বাঙালিত্ব মরে যায়নি। তার মানে জনগণ এটাকে ধারণ করে। অল্প কিছু লোক আধুনিকতার নামে এটা-সেটা করলেও কিন্তু মূল ধারা বা স্রোতকে তো আর রুদ্ধ করতে পারে না। মূলস্রোত এবং যেটা জনগণ চাইবে, তা কিন্তু অব্যাহতই থাকে। আমাদের ভাষা ও সাহিত্য সেভাবেই চলছে।

এখন কথা হলো, আমাদের অগ্রগতি অথবা অর্জন কতটুকু? বাংলাভাষা চর্চা যেখানে যেখানে হচ্ছে। পৃথিবীর সব চাইতে কঠিন কঠিন তত্ত্বগুলো, দর্শনগুলো আমি প্রকাশ করতে পারছি কি না অর্থাত্ পৃথিবীর তাবত্ উপলব্ধিগুলো আমি জানতে পারছি কি না। আমাদের দেশে তো এখন প্রচুর অনুবাদ হচ্ছে। পৃথিবীর তাবত্ জ্ঞান আর ভাবের সাথে তো আমার পরিচয় ঘটছে। তার মানে কী—আমার ভাষা তো এগোচ্ছে।

এ অগ্রগতি কি সন্তোষজনক?

অগ্রগতিকে তো নানাভাবে বিশ্লেষণ করা যায়। বাংলাদেশ বলে এখন যে অঞ্চল রয়েছে, এখানে তো শিল্প-সাহিত্য কলকাতার মতো এত অগ্রসর ছিল না। ৪৭-এ দেশভাগ হলো। ৫২-তে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন হলো। বাংলা রাষ্ট্রভাষা হলো। বাংলার চর্চা শুরু হলো। এখানে শিল্প-সাহিত্য-ভাষা বিকশিত হতে থাকল। মুক্তিযুদ্ধের পর আমাদের শিক্ষায়, প্রশাসনিক ক্ষেত্রে—সব জায়গায় শুরু হলো বাংলার চর্চা। এই ব্যাপক প্রচার, প্রসার এবং বিস্তার—এটা কত বছর? ধরো, চল্লিশ বা আরও একটু বেশি যদি ধরি, তবে পঞ্চাশ বছরের ব্যাপার, কলকাতায় সেটা শুরু হয়েছিল ব্রিটিশ শাসনের শুরু থেকে। প্রায় দুশ-আড়াইশ বছর আগে। এই পঞ্চাশ বছরে আমাদের অগ্রগতি কলকাতার সমকক্ষ বলব না। তবে কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, পেইন্টিং—সব ক্ষেত্রে আমরা কি একটা অবস্থানে পৌঁছাইনি? এটা কি খুব দ্রুতই অর্জিত হয়নি, আমরা খুব পিছিয়ে আছি কি? তার পরেও কথা থাকে—আমাদের এ অগ্রগতি আরও হয়তো হতে পারত। আরও সুসমন্বিত হতে পারত।

আপনার পাঠকদের প্রতি কিছু বলবেন?

জীবনকে, দেশকে, দেশের মাটিকে ভালোবেসে তারা যেন জনগণকে শোষণ-যন্ত্রণা থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করে।

এতটা জীবন কাটিয়ে এলেন। ইতিহাসের অনেক ভাঙা-গড়া দেখেছেন। জীবনে অনেক সৃষ্টি করেছেন, অনেক মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন, লেখার স্বীকৃতিও পেয়েছেন। এখন এই জীবনসায়াহ্নে এসে জীবন সম্পর্কে আপনার উপলব্ধি কী?

জীবনে উপলব্ধি হচ্ছে, যত দিন বাঁচি, বাঁচতে হবে। আনন্দকে গ্রহণ করতে হবে। চারপাশের মানুষ তাদের জীবনধারার সাথে নিজেকে যুক্ত করতে ব্যস্ত। ঘাত-প্রতিঘাত আর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে জীবন যাপন করলাম, তাতে আমার কোনো আফসোস নেই। সৃষ্টি করার এই যে প্রক্রিয়া, তা আগেও ছিল এখনও আছে। পূর্ণতা অর্জনের একটা আকাঙ্ক্ষা এখনও আছে, আর এটাই জীবন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন