খোরশেদ
আলম
তোমরা একটা কালো ভেড়ার বিষয়ে কথা বলছিলে। সেই ভেড়াটাকে আমি নিয়ে এসেছিলাম দূর পাহাড়ের দেশ থেকে। যে পাহাড়ে মানুষের পায়ের ছাপ আবিষ্কার করে তোমরা উল্লসিত হয়েছিলে। আসলে ওগুলো মানুষের পায়ের ছাপ ছিল না। তোমরা বুঝতে পারোনি ওগুলো ছিল মৃত মানুষদের আত্মার চলাফেরার দাগ। আত্মাদের আবার পা থাকে নাকি তোমরা আমার কথায় সন্দেহ করতে পারো।
কিন্তু আমি সে কথায় আমল দেবো না। কারণ আমি তো তোমাদের মতো জীবিত নই! এখন আমি যদি বানানো কথাও বলি তোমাদের কী সাধ্য আছে আমাকে স্পর্শ করবে?
হঠাৎ করেই একদিন শহরে বিজ্ঞাপন ঝুলানো সাইনবোর্ডের মতো স্ক্রিনে শহরের মানুষের জন্য একটা ঘোষণা আসে। তারা শুনতে পায় ঐ কালো ভেড়ার বীর্য থেকে হাজার হাজার ভেড়া উৎপাদিত হবে। সেই ভেড়ার বীর্য দিয়ে আরো কয়েকলাখ ভেড়া খুব দ্রুত সময়ের মধ্যেই তৈরি করা হবে। ইতোমধ্যে শহরের বুদ্ধিজীবী মানুষ যারা ঘরে বন্দি হয়ে ছিল তারাও যেন প্রাণ ফিরে পায়। তারা টেলিভিশনে চোখ বন্দি না করে নিজেরাই টেলিভিশন আর কম্পিউটারের মধ্যে ঢুকে পড়ে। তখন শহরের মানুষ আর তাদেরকে দেখতে পায় না। তারা কেবল নিজেরাই নিজেদেরকে দেখে। আর বলতে থাকে—এ তো এক আশ্চর্য আয়না! প্রযুক্তির অতি উন্নতির ফলে এই আয়নাগুলো বাইরের দৃশ্য প্রতিফলিত করে না। কেবল যার যার প্রতিচ্ছবিটুকুই ঐ আয়নাগুলোয় দেখা যায়। আর তাতেই উল্লসিত হয়ে আরো কিছু বুদ্ধিমান মানুষ তাদের দল ভারি করতে থাকে। তাদেরকে দেখা না গেলে বরং তাদের জন্য মঙ্গল—এই তত্ত্ব কথাটা বেশ ফলাও করে সংবাদপত্রে ছাপা হয়। পরদিন দেখা যায় কয়েকটি কালো ভেড়া সেই সংবাদপত্রগুলো পড়ছে। তাদের চোখে হাজার পাওয়ারের নীল চশমা। সেই চশমা দিয়ে তারা ধর্ষণ ও অজাচারের দৃশ্য দেখতে পেয়ে তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে শূন্যে মিলিয়ে যায়।
কিন্তু আকাশে উঠে বুঝতে পারে তারা আসলে নীল মোটা চশমার ভেতর দিয়েই ঘটনাগুলো দেখছিলো।
এদিকে ব্যবসায়ীরা শহরের কারখানাগুলো ভাড়া নেয়। মহামারির কারণে কারখানাগুলো এতদিন বন্ধ হয়ে ছিল। সেগুলো আবার প্রাণ ফিরে পায়। সবখানে তখন ভেড়া উৎপাদনের সাইনবোর্ড। শহরের বন্ধ দোকানগুলো খুলে যায়। বিশেষ করে সৌখিন দ্রব্যের দোকানগুলো পরিবর্তিত হয়ে যায় ভেড়ার কালো লোম আর সঞ্জীবনী পানীয় ভেড়ার বীর্য রাখার বোতলের দোকানে। অনেক মদ্যপায়ী মদ পান ছেড়ে দিয়ে ঐ কালো ভেড়া থেকে উৎপাদিত বোতলজাত বীর্য কেনার জন্য ভিড় করতে থাকে। এদিকে রাজনীতিবিদ ও নেতারা শহরে ঘুরে বেড়ানো শয়তানের দখলে থাকা ভেড়াগুলোর ছোট ছোট শিঙগুলোর সঙ্গে নিজেদের মাথা ঘষাঘষি করা শুরু করে। এই ভেড়াগুলো থেকে যদি সৌভাগ্যের ছোঁয়া তাদের মধ্যে সংক্রমিত হয় কেবল সেইজন্যই। কিন্তু ভেড়াগুলো তাদের মুখে লাল ছায়া লক্ষ করে দৌড়ানো শুরু করে। পাতি নেতারা তখন ভেড়াগুলোর সাথে বন্ধুত্ব তৈরি করার জন্য ভেড়ার দলেই মিশে যায়। ইয়াবাখোররা ভেড়ার গুটিমল সংগ্রহ করার উদ্দেশ্যে ভেড়ার পশ্চাদ্দেশের নিকটবর্তী হওয়ার চেষ্টায় লিপ্ত থাকে সবসময়।
কবরে শুইয়ে থাকা মৃত মানুষটি তখন দেখে তার হাড়গোড় ফেলে দিয়ে নতুন কবর রচনা হচ্ছে। চারিদিকে একটা শোরগোল সে স্পষ্টই শুনতে পায়। আর তা হল পৃথিবীতে কবরের স্থান সংকুলানের অভাব।
আমি এর কিছুই ঠিক বুঝতে পারি না। সর্বক্ষমতার অধীশ্বরকে বলতেও পারি না যে, ব্যাপারটা কার্যকারণহীন।
আমি যেদিন মারা গেলাম সেদিন ছিল
তোমাদের উৎসবের দিন। আমার মরার জন্য উৎসব নয়। কারণ আমি মানুষটা ছিলাম অতি সাধারণ। আমাকে
নিয়ে হইচই বা গভীর দুঃখপ্রকাশ কোনোটাই কারো মানায় না।
ঐদিন তোমরা আমাকে কবরে নামানোর সময়ও ঝগড়া করছিলে। আমার বেশ মনে আছে। তোমাদের ঝগড়ার বিষয়টা মৃত্যু বা পরপারের জীবন নিয়ে ছিল না| সেকথা আমি স্পষ্টই স্মরণ করতে পারি।
ঐদিন তোমরা আমাকে কবরে নামানোর সময়ও ঝগড়া করছিলে। আমার বেশ মনে আছে। তোমাদের ঝগড়ার বিষয়টা মৃত্যু বা পরপারের জীবন নিয়ে ছিল না| সেকথা আমি স্পষ্টই স্মরণ করতে পারি।
তোমরা একটা কালো ভেড়ার বিষয়ে কথা বলছিলে। সেই ভেড়াটাকে আমি নিয়ে এসেছিলাম দূর পাহাড়ের দেশ থেকে। যে পাহাড়ে মানুষের পায়ের ছাপ আবিষ্কার করে তোমরা উল্লসিত হয়েছিলে। আসলে ওগুলো মানুষের পায়ের ছাপ ছিল না। তোমরা বুঝতে পারোনি ওগুলো ছিল মৃত মানুষদের আত্মার চলাফেরার দাগ। আত্মাদের আবার পা থাকে নাকি তোমরা আমার কথায় সন্দেহ করতে পারো।
কিন্তু আমি সে কথায় আমল দেবো না। কারণ আমি তো তোমাদের মতো জীবিত নই! এখন আমি যদি বানানো কথাও বলি তোমাদের কী সাধ্য আছে আমাকে স্পর্শ করবে?
ঐ কালো ভেড়াটাকে আমি বড় করে তুলেছিলাম।
তোমরা হয়তো বলবে, ভেড়া আবার কালো হয় নাকি? কিন্তু আমার কাছে সত্যি সত্যি একটা কালো
রঙের ভেড়া ছিল। এই ভেড়াটাকে আমি ছোটবেলা থেকে বেশ যত্ন করে গড়ে তুলেছিলাম। তোমাদের
অগোচরে মাঝেমধ্যেই আমি পাশের জঙ্গলটাতে চলে যেতাম। আমার যারা বন্ধু ছিল তারাই হয়তো
ব্যাপারটা খেয়াল করেছে। অবশ্য সবাই নয়, কেরামত আলী আমার প্রতি একটু মনোযোগী ছিল। বাকিরা
কেবল দৈনন্দিন জীবনের মধ্যে বন্দি।
মানুষ তো এই দৈনন্দিন জীবন নিয়েই বেশি ভাবে, তাই না? নইলে সে কীভাবে জীবনসমুদ্র পাড়ি দেবে? জীবনটা তার কাছে খাঁচা ছাড়া পাখিও নয় সবসময়। তাই সমুদ্রের সঙ্গে জীবনের তুলনা দেওয়াতে তোমরা বিরক্ত হইও না। আর তোমরা বিরক্ত হলেও আমি বলতে পারি—তাতে আমার কী? আমি না ছিলাম তোমাদের কারো আপন, আর না ছিলাম কোনো কেউকেটা ব্যক্তি।
মানুষ তো এই দৈনন্দিন জীবন নিয়েই বেশি ভাবে, তাই না? নইলে সে কীভাবে জীবনসমুদ্র পাড়ি দেবে? জীবনটা তার কাছে খাঁচা ছাড়া পাখিও নয় সবসময়। তাই সমুদ্রের সঙ্গে জীবনের তুলনা দেওয়াতে তোমরা বিরক্ত হইও না। আর তোমরা বিরক্ত হলেও আমি বলতে পারি—তাতে আমার কী? আমি না ছিলাম তোমাদের কারো আপন, আর না ছিলাম কোনো কেউকেটা ব্যক্তি।
তোমরা তো কেউ জিজ্ঞেস করলে না—আমি সেই জঙ্গলে গিয়ে কী করতাম? তোমরা কীভাবেই বা জিজ্ঞেস
করবে? তোমরা যদি আমার মতো আত্মায় পরিণত হতে তাহলে অনায়াসে আমার কথাগুলো বাতাসের বেগে
বুঝতে পারতে। কালো ভেড়াটা একটা শয়তানের প্রতিমূর্তি হয়ে আমাকে প্রতিনিয়ত তোমাদের বিষয়ে
খোঁচা দিতো। আমি কিন্তু শয়তান বিষয়ে তোমাদের চেয়ে কম জানতাম। ফলে শয়তান আমাকে দ্রুতই
ধোকা দেয়ার কৌশলটা অর্জন করে। আর আমি যেহেতু সমাজের বাইরে থাকা পছন্দ করতাম, শয়তানটা
তার কালো ছায়া ফেলে আমাকে প্রায়ই বোকা বানাতো। আর জানো তো কালো ছায়া আমার ছোটবেলা থেকেই
পছন্দের ছিল। শয়তানটা তা-ও জানতে পেরেছিল। ওর সহজাত ক্ষমতা দিয়ে সে আমাকে ঠিকই বুঝতে
পেরেছিল। আমি তাই প্রায়ই এ বিষয়ে চিন্তিত থাকতাম। কেননা শয়তান কেবল আমার সঙ্গে লড়তে
আসে কেন? সে কিন্তু তার শক্তি দিয়ে আমার মুখোমুখি দাঁড়াতো না। কালো ভেড়াটা সে আমার
অনুপস্থিতিতে দেখভাল করতো। আমি তাকে কোনো ভাড় না দেয়া সত্ত্বেও এ কাজটা করে যাচ্ছিল।
আমি বিরক্ত হলেও সে আমার অগোচরে এসে পড়তো।
তোমরা যেদিন মাত্র কয়েকজন লোক আমাকে
কবরে নামানোর জন্য সদাব্যস্ত ভঙ্গিতে বাড়ি ফেরার কথা ভাবছিলে সেদিন কেরামত আলী দূর
থেকে দাঁড়িয়ে আমার পাশে এসে দাঁড়ানো শয়তানটার সঙ্গে চোখাচোখি করছিল। কেরামত আমার ছোটবেলার
বন্ধু অথচ সে ঐ শয়তানটার সঙ্গে চোখে চোখে কী কথা বলতে পারে?
আমার জীবদ্দশায়ও এই পরিস্থিতির মুখে পড়িনি। কারণ আমি ভাবতাম শয়তানের অধিকারটা কালো ভেড়ার বদৌলতে কেবল আমারই পাওনা ছিল।
আমার জীবদ্দশায়ও এই পরিস্থিতির মুখে পড়িনি। কারণ আমি ভাবতাম শয়তানের অধিকারটা কালো ভেড়ার বদৌলতে কেবল আমারই পাওনা ছিল।
কালো ভেড়াটাকে কোথায় আমি বেঁধে
রেখেছিলাম আমার মনে নেই। না বাধলেও সে অন্য কোথাও যেতো না। কারণ আমার সঙ্গে তার যে
সখ্য তৈরি হয়েছিল, তাতে তাকে না বেঁধে রাখলেও চলতো। আমি তবুও অন্যের অধিকারে যাতে না
যায় সেজন্যই কাজটা করতাম। এতে একটা লাভ হয়েছিল। আর সেটা হচ্ছে—শয়তান আমার কালো ভেড়াটার একচ্ছত্র অধিকার
পেতো না। না হলে ভেড়াটাকে সে হয়তো অন্য কোথাও নিয়ে গিয়ে তালিম দেবার সুযোগ পেতো। এই
তালিম দেয়ার বিষয়টা আমি বরাবরই এড়িয়ে চলতে চাইতাম।
তবে জেনো রাখো, আমি যদি সত্যিই
চাইতাম তাহলে শয়তান আমাকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারতো না। কিন্তু কেরামত যেদিন শয়তানের চোখে
চোখে কথা বললো সেদিনই দেখলাম সে আরেকটা শয়তানে পরিণত হয়েছে। এখন আমি কবরে শুয়ে আমার
কথাই ভাববো না কেরামতের কথা? তোমরা হয়তো জানো না—মৃত মানুষ আরো বেশি স্বার্থপর হয়। আমার
ভেতরেও সেই জিনিসটা কাজ করলো। ফলে কালো ভেড়াটার কথা ভুলে গিয়ে আমি সেটাকে শয়তানের হাতে
তুলে দিয়েছিলাম। আর আমার পক্ষে এর চেয়ে বেশি কিছু করার ছিল না। কারণ কালো ভেড়াকে আমি
অনেক ভালবাসা সত্ত্বেও তাকে কবরে নিয়ে আসা সম্ভব না।
তো সেই কালো ভেড়াটাকে অনেকেই আমার
মৃত্যুর পর গুরুত্ব দিয়ে দেখতে থাকলো। ওটাকে ছেলেপিলেরা তামাশার জিনিস ভাবলো। কিন্তু
বড়রা সেটা ভাবতে পারেনি। সেটা অবশ্য আমার স্বভাবের জন্যই। আমি তো কারো সাথে তেমন মিশতাম
না কেবল কেরামত ছাড়া। সেই কেরামতও যখন আমাকে ছেড়ে শয়তানের সাথে চোখাচোখি করলো তখন জীবন
সম্পর্কে আমার আর কোনো আশা রইলো না। আমি কিন্তু তখন মৃত। তবুও আমার আশা ছিল। আর আশা
জেগে থাকাটা মৃত মানুষের ধর্ম। কালো ভেড়ার প্রতি আমার কষ্টটা কেউ বুঝতে পারেনি।
সেটাকে নিয়ে অনেকে গ্রামকে গ্রাম, শহর থেকে শহর, মহাদেশ থেকে মহাদেশ ঘুরে নিয়ে বেড়াতে লাগলো। যেন সে কোনো সার্কাসের জন্তু, মানুষকে তামাশা দিয়ে বেড়াবে।
সেটাকে নিয়ে অনেকে গ্রামকে গ্রাম, শহর থেকে শহর, মহাদেশ থেকে মহাদেশ ঘুরে নিয়ে বেড়াতে লাগলো। যেন সে কোনো সার্কাসের জন্তু, মানুষকে তামাশা দিয়ে বেড়াবে।
আসলে পরে আমি বুঝলাম ওটা ছিল কেরামতেরই
কারসাজি। কেরামত আগে থেকেই তামাশা করে অর্থ উপার্জন করা পছন্দ করতো। যখন সে স্কুলে
যাওয়া শিখেছিল ঠিক তখন থেকেই এলাকার মানুষকে তামাশা দেখাবার জন্য নানাকিছুর আয়োজন করতো।
তার এই আয়োজনের মধ্যে ছিল কানা সেজে লাঠি হাতে ভর দিয়ে পা দুটো হেলেদুলে বেড়ানো। একটু
বড় হলেবাজারের নষ্ট মেয়েমানুষের সঙ্গে ইয়ারকি ঠাট্টায় মেতে ওঠা। কিংবা বড়দের সঙ্গে
মিশে বিড়ি বা গাঁজার কলকি ধরে টান মারা, ‘বাবা’ খাওয়া।
যাই হোক, সেই কেরামতই কিন্তু আমার
কালো ভেড়াটাকে পৃথিবী পর্যটন করাচ্ছিল। পাড়ার লোকজন বলে, সে নাকি এই ভেড়াটা নির্জন
পাহাড়ে কুড়িয়ে পেয়েছে। অথচ তারা একবার চিন্তা করলো না যে, পাহাড়ি ভেড়া প্রথম দিন থেকেই
পোষ মানার কথা নয়। ফলে তারা তাদের বিশ্বাসটাকে নিজেদের ভেড়ার সঙ্গেই কেবল মেলাতে চায়।
তাদের সাদা ভেড়াগুলো পৃথিবী পর্যটনের সুযোগ পায়নি বলেও হয়তো এই ঈর্ষাটা মনে মনে কাজ করতে পারে। কিন্তু তারা কি জানে না ঈর্ষা মানুষের জন্য ক্ষতিকর?
তাদের সাদা ভেড়াগুলো পৃথিবী পর্যটনের সুযোগ পায়নি বলেও হয়তো এই ঈর্ষাটা মনে মনে কাজ করতে পারে। কিন্তু তারা কি জানে না ঈর্ষা মানুষের জন্য ক্ষতিকর?
এখন মনে হয় শয়তানটাই ভেড়ায় রূপান্তরিত
হয়েছে। নইলে ওর রঙ কালো হবার কথা নয়। কিন্তু সাথে সাথে কেরামতের শরীরেও যখন কালো কালো
ছোপ দেখা দিলো তখন অনেকেই পাপের ছায়া বলা শুরু করলো। আসলে কিন্তু কেরামত অতটা পাপও
করেনি। সে কারো সাথে ঝগড়া বিবাদও কখনো করেনি। তবে কি ঐ কালো ভেড়াটা নিয়ে বিভিন্ন স্থানে
সার্কাস দেখাবার ফল?
কেরামত চিকিৎসা নেবার আগেই এক মহামারি
শুরু হয়ে যায়। সেই মহামারিতে পৃথিবীব্যাপী প্রতিদিন এক লক্ষ লোক মৃত্যুবরণ করতে থাকে।
গ্রামের সবাই ভাবতে থাকে—এটা কেরামতের কালো ভেড়ার প্রভাবে হচ্ছে। ফলে তারা কেরামতকে গ্রামছাড়া
করে। কেরামত সেই কালোছোপ ছোপ দাগ পড়া অসুস্থ শরীর নিয়েই শহর অভিমুখে রওনা হয়। সেই শহরটাতে
যেখানে এর আগে কালো ভেড়া প্রদর্শন করে সে পয়সা কামাই করতো। তার পরিবার ছিল না বলে সেই
পয়সা সে ব্যয় করতো গ্রামের ছেলে-ছোকড়াদের পেছনে। বিশেষ করে যাদের খেয়াল থাকতো বাজারের
নষ্ট মেয়েমানুষ, গাঁজার কলকি আর ‘বাবা’র প্রতি। পুরনো অভ্যাসটা সে ছাড়তেই পারেনি। কেরামত গ্রাম
ছাড়া হবার সময় কয়েকজন ছেলে-ছোকড়া তার সঙ্গী হতে চেয়েছিল। এমনকি তার সঙ্গে যেতে চেয়েছিল
ইয়ারকি করা কয়েকটা মেয়েমানুষও।
কিন্তু কেরামত জানতো শহরে এদেরকে নিয়ে যাওয়া মানে তার নিজের বাঁচার পথটাও রুদ্ধ করা।
কিন্তু কেরামত জানতো শহরে এদেরকে নিয়ে যাওয়া মানে তার নিজের বাঁচার পথটাও রুদ্ধ করা।
শহরের পুরনো বস্তির মধ্যে কেরামত
ফিরে আসে। কিন্তু বস্তির মানুষরা তাকে এড়িয়ে যেতে শুরু করে। তার শরীরের কালো কালো দাগের
জন্য এটাকে ছোঁয়াচে ভেবে দূরে থাকা শুরু করে। কিন্তু বস্তিগুলো গায়ে গায়ে লাগানো বলে
বিশেষ লাভ হয় না। তখন শয়তানের নির্দেশে সেই কালো ভেড়াটা আপাতত সভ্য হয়ে যায়। কালো ভেড়ার
পক্ষে এছাড়া আর কীই বা করার আছে? শহরে আর নতুন তামাশা নেই। গায়ে মোটা খাদি কাপড় পড়া
হুইসেল বাজানো মানুষগুলো কালো ভেড়ার কাছে অচেনা মনে হতে থাকে। ওকে খাবারের অভাবে বস্তি
থেকে ছেড়ে দেয় কেরামত। কিন্তু শয়তান ওর রশিটা ধরে রাখে। আর তা টের পাওয়ার আগেই কালো
ভেড়া বস্তির বাইরে চলে আসে। সেখানে কুকুরগুলো খাবারের অভাবে মানুষের ফেলে দেওয়া মাস্ক
ধরে টানাটানি করে। বেড়ালগুলো হাসপাতালের পাশে ঘুর ঘুর করে। তারা পরিত্যক্ত কিছু মাছের
কাঁটা পায় কিন্তু সেগুলোতে বোটকা গন্ধ পায়। ফলে না খেয়েই তারা দ্রুতগতিতে পালিয়ে যায়।
এদিকে শহরের রাস্তায় ঘাস গজিয়ে
যায়। ফলে কালো ভেড়ার খাবারের অভাব হয় না। কালো ভেড়াটাকে শহরের মানুষ তাদের আত্মীয়ই
ভাবে। কারণ পথে ঘাটে চলতে ফিরতে এটার সঙ্গে দেখা হয়। আর শহরের মানুষ নিজেরাও ধীরে ধীরে
কালো ভেড়ায় পরিণত হতে থাকে। বিভিন্ন মহল্লার মানুষ তখন এই কালো ভেড়াটাকে বর্তমান খাদ্যাভাব
আর মহামারি রোগের জন্য দায়ি করা শুরু করে। কিন্তু কালো ভেড়ার তাতে কী আসে যায়? সে আপন
মনে এ-মহল্লা ও-মহল্লা ঘুরে বেড়ায়।
মানুষ তখনও কেবল ভাবতে থাকে—হয়তো এই কালো ভেড়াটাই তাদের জন্য অশনি সঙ্কেত বয়ে নিয়ে এসেছে।
মানুষ তখনও কেবল ভাবতে থাকে—হয়তো এই কালো ভেড়াটাই তাদের জন্য অশনি সঙ্কেত বয়ে নিয়ে এসেছে।
এদিকে গবেষণাগারগুলোতে এ-নিয়ে বেশ
তোলপাড় হয়। সেখানে কালো ভেড়ার বীর্য সংগ্রহ করে পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়। তারা ভাবে
কালো ভেড়াটার জিন থেকেই হয়তো এই মহামারি রোগের উৎপত্তি। মানুষের কালো মুখগুলো মাস্ক
দিয়ে ঢেকে যায়। অতিরিক্ত গরমে সেই মাস্কের ভেতরটা স্যাঁতস্যাঁতে হয়। কিন্তু মুখ দেখা
না গেলেও তাদের পায়ের দিকে তাকালে লোমশ বেরিয়ে থাকা পাগুলো ঠিক চোখে দেখা যায়।
হঠাৎ করেই একদিন শহরে বিজ্ঞাপন ঝুলানো সাইনবোর্ডের মতো স্ক্রিনে শহরের মানুষের জন্য একটা ঘোষণা আসে। তারা শুনতে পায় ঐ কালো ভেড়ার বীর্য থেকে হাজার হাজার ভেড়া উৎপাদিত হবে। সেই ভেড়ার বীর্য দিয়ে আরো কয়েকলাখ ভেড়া খুব দ্রুত সময়ের মধ্যেই তৈরি করা হবে। ইতোমধ্যে শহরের বুদ্ধিজীবী মানুষ যারা ঘরে বন্দি হয়ে ছিল তারাও যেন প্রাণ ফিরে পায়। তারা টেলিভিশনে চোখ বন্দি না করে নিজেরাই টেলিভিশন আর কম্পিউটারের মধ্যে ঢুকে পড়ে। তখন শহরের মানুষ আর তাদেরকে দেখতে পায় না। তারা কেবল নিজেরাই নিজেদেরকে দেখে। আর বলতে থাকে—এ তো এক আশ্চর্য আয়না! প্রযুক্তির অতি উন্নতির ফলে এই আয়নাগুলো বাইরের দৃশ্য প্রতিফলিত করে না। কেবল যার যার প্রতিচ্ছবিটুকুই ঐ আয়নাগুলোয় দেখা যায়। আর তাতেই উল্লসিত হয়ে আরো কিছু বুদ্ধিমান মানুষ তাদের দল ভারি করতে থাকে। তাদেরকে দেখা না গেলে বরং তাদের জন্য মঙ্গল—এই তত্ত্ব কথাটা বেশ ফলাও করে সংবাদপত্রে ছাপা হয়। পরদিন দেখা যায় কয়েকটি কালো ভেড়া সেই সংবাদপত্রগুলো পড়ছে। তাদের চোখে হাজার পাওয়ারের নীল চশমা। সেই চশমা দিয়ে তারা ধর্ষণ ও অজাচারের দৃশ্য দেখতে পেয়ে তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে শূন্যে মিলিয়ে যায়।
কিন্তু আকাশে উঠে বুঝতে পারে তারা আসলে নীল মোটা চশমার ভেতর দিয়েই ঘটনাগুলো দেখছিলো।
এদিকে ব্যবসায়ীরা শহরের কারখানাগুলো ভাড়া নেয়। মহামারির কারণে কারখানাগুলো এতদিন বন্ধ হয়ে ছিল। সেগুলো আবার প্রাণ ফিরে পায়। সবখানে তখন ভেড়া উৎপাদনের সাইনবোর্ড। শহরের বন্ধ দোকানগুলো খুলে যায়। বিশেষ করে সৌখিন দ্রব্যের দোকানগুলো পরিবর্তিত হয়ে যায় ভেড়ার কালো লোম আর সঞ্জীবনী পানীয় ভেড়ার বীর্য রাখার বোতলের দোকানে। অনেক মদ্যপায়ী মদ পান ছেড়ে দিয়ে ঐ কালো ভেড়া থেকে উৎপাদিত বোতলজাত বীর্য কেনার জন্য ভিড় করতে থাকে। এদিকে রাজনীতিবিদ ও নেতারা শহরে ঘুরে বেড়ানো শয়তানের দখলে থাকা ভেড়াগুলোর ছোট ছোট শিঙগুলোর সঙ্গে নিজেদের মাথা ঘষাঘষি করা শুরু করে। এই ভেড়াগুলো থেকে যদি সৌভাগ্যের ছোঁয়া তাদের মধ্যে সংক্রমিত হয় কেবল সেইজন্যই। কিন্তু ভেড়াগুলো তাদের মুখে লাল ছায়া লক্ষ করে দৌড়ানো শুরু করে। পাতি নেতারা তখন ভেড়াগুলোর সাথে বন্ধুত্ব তৈরি করার জন্য ভেড়ার দলেই মিশে যায়। ইয়াবাখোররা ভেড়ার গুটিমল সংগ্রহ করার উদ্দেশ্যে ভেড়ার পশ্চাদ্দেশের নিকটবর্তী হওয়ার চেষ্টায় লিপ্ত থাকে সবসময়।
অকস্মাৎ শয়তান এসে বিরাট মূর্তি
নিয়ে সবার সামনে হাজির হয়। পাহাড় সমান উচু পা নিয়ে সে শহরের এ-প্রান্ত ও-প্রান্ত পর্যন্ত
হেঁটে বেড়ায়। আর মানুষগুলো প্রথমে পড়িমরি করে ছুটতে থাকে কেয়ামত আসন্ন বলে। শহরের উপাসনালয়গুলো
আবার লোকজনে ভরে যায়। এতদিন যারা ঘরবন্দি ছিল তারা উপসনাগৃহে বন্দি হয়। কিন্তু ঈশ্বরের
কাছে মাথা ঠেকানোর সঙ্গে সঙ্গেই ভেড়ার দল হুড়মুড় করে ঢুকে তাদের মাথায় প্রশ্রাব করে
দেয়। তারা মলত্যাগ করে উপাসনালয় ভাসিয়ে দেয়। অপবিত্র উপাসনাগৃহে প্রার্থনা করা ঠিক
নয়।
এদিকে শয়তান তখন চারিদিক থেকেই তার হাজারো রেপ্লিকা তৈরি করতে থাকে। কালো ভেড়ার মতো সেও লাখো-হাজার শয়তানে পরিণত হতে থাকে। তবে ঠ্যাঙ দুটো তাদের বিশাল বড় বড়।
এদিকে শয়তান তখন চারিদিক থেকেই তার হাজারো রেপ্লিকা তৈরি করতে থাকে। কালো ভেড়ার মতো সেও লাখো-হাজার শয়তানে পরিণত হতে থাকে। তবে ঠ্যাঙ দুটো তাদের বিশাল বড় বড়।
শয়তানগুলো তাদের বৃহৎ ঠ্যাঙ নিয়ে
দাঁপিয়ে বেড়ানো শুরু করে। তাদের কপালের মাঝখান দিয়ে একটা বড় চোখ নির্গত হয়। এটা দেখে
মানুষ দজ্জালের ছায়া লক্ষ করে। অন্যদিকে ইলুমিনাতির নামে শুরু হয় শয়তানের মনোতুষ্টির
প্রার্থনা। শয়তানের বড় বড় ঠ্যাঙের আঘাতে শহর থেকে গ্রামে রেল-ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যায়।
শুধু তাই নয়, রাস্তার যত্রতত্র শয়তানের ঠ্যাঙ দিয়ে ভর্তি হয়ে যায়। কেরামতের মতো যারা
গ্রাম থেকে এসেছিল তাদের যাওয়া-আসার পথও বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু কেউ শহরে যাওয়ার কথা
আর ভাবে না। এদিকে যানবাহনের অভাবে গ্রামের খাদ্য শহরে আসা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়।
মানুষ তখন কালো ভেড়ার মাংস খাবার
জন্যই উদ্যত হয়। কিন্তু ততদিনে শয়তান সেই ভেড়ার অধিকার সম্পূর্ণই করায়ত্ব করে নিয়েছে।
কবরে শুইয়ে থাকা মৃত মানুষটি তখন দেখে তার হাড়গোড় ফেলে দিয়ে নতুন কবর রচনা হচ্ছে। চারিদিকে একটা শোরগোল সে স্পষ্টই শুনতে পায়। আর তা হল পৃথিবীতে কবরের স্থান সংকুলানের অভাব।
পৃথিবীটা নাকি শয়তানের পূর্ণ অধিকারেই
তখন চলে গেছে। বাঁচার পথ না পেয়ে তারা শয়তানের ছত্রছায়াতেই জীবনের শেষ কয়টা দিন পার
করতে চায়। ফলে শয়তান তার ইচ্ছেমতো কালো ভেড়া উৎপাদন করে চলে। মানুষের আর খাবারের অভাব
হয় না। কিন্তু কবরের জায়গা শয়তান সঙ্কুচিত করে রাখে। সেখানে শয়তানের শাগরেদ ছাড়া কারো
পক্ষে শান্তির ঘুম নামক মৃত্যু তখন অসম্ভব।
ফলে আমিও মুত্যু থেকে সচকিত হয়ে
পুনরায় বেঁচে উঠি। দেখি তখন ঈশ্বরের বিচার সভার সামনে আমি দণ্ডায়মান। কেরামতকে ঈশ্বরের
নিযুক্ত দূতরা টেনে হিঁচরে নিয়ে যাচ্ছে। আর আমাকে ঈশ্বর বলে চলেছেন...“কালো ভেড়াটা আমিই তোমার দায়িত্বে দিয়েছিলাম।
তুমি তার কোনো মূল্যই রাখোনি। কেরামতকে কেন দিয়েছিলে?”
আমি এর কিছুই ঠিক বুঝতে পারি না। সর্বক্ষমতার অধীশ্বরকে বলতেও পারি না যে, ব্যাপারটা কার্যকারণহীন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই পাপ আর পুণ্যের
দূতের কাছ থেকে খাতা দুটো চেয়ে নিলেন ঈশ্বর। তারপর খচখচ করে সেখানে লিখলেন, ‘অনন্ত নরকবাস’।
অথচ যে-কারো পাপের চেয়ে আমার পাপের পরিমাণ কিন্তু কমই ছিল।
অথচ যে-কারো পাপের চেয়ে আমার পাপের পরিমাণ কিন্তু কমই ছিল।
🔺🔻🔺
খোরশেদ আলম, গল্প ও গদ্যলেখক
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলা বিভাগের শিক্ষক
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন