বৃহস্পতিবার, ১৪ মে, ২০২০

উপন্যাস নিয়ে উপক্রমণিকা / আনিসুল হক


কথাসাহিত্য নিয়ে তিনজন বাঙালি লেখকের ভাষ্য, আমাদের কালে, আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়। হাসান আজিজুল হক, দেবেশ রায় আর আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। এঁদের মধ্যে সবচেয়ে প্রাণবন্ত সবচেয়ে স্বাদু আবার হাসান আজিজুল হক। এবং আমার কাছে, শুধু লিখিত প্রবন্ধ বিবেচনায় নিলে, তুলনামূলকভাবে নিষ্প্রভ মনে হয়েছে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে (অবশ্য তাঁর মৌখিক সাক্ষাৎকারগুলি খুবই চিন্তা উদ্রেককারী)।
উপন্যাস নিয়ে পরিকল্পিতভাবে সবচেয়ে বেশি ও সবচেয়ে সুনির্দিষ্ট প্রবন্ধ লিখেছেন দেবেশ রায়। সে সবের মধ্যে চিন্তার মৌলিকত্ব আছে। গভীরতা আছে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের আর দেবেশ রায়ের উপন্যাস-ভাবনায় একটা স্পষ্ট মিল দেখতে পাই। এ ধরনের প্রশ্ন মনের মধ্যে উঁকি দেয়, কে আগে প্রবন্ধটা লিখেছিলেন, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস নাকি দেবেশ রায়? কিন্তু এ তথ্যটা খুব জরুরি নয়, যেহেতু আমরা জানি যে, দুজনের রাজনৈতিক মতাদর্শটাও একই রকম। আর উপন্যাস-ব্যাখ্যায় দুজনের পদ্ধতি যেহেতু একই রকম, ফলে তাদের মত প্রায় একই রকম হতে বাধ্য।

দেবেশ রায় উপন্যাস বলতে একটা নির্দিষ্ট ধারণা বা আদর্শকে বোঝেন। সেটা তিনি বুঝেছেন কতগুলো বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত উপন্যাস পাঠের ও বিশ্লেষণের অভিজ্ঞতা থেকে। তিনি বলছেন, উপন্যাস বলতে ডন কুইকসোট, টম জোনস, স্কারলেট অ্যান্ড ব্ল্যাক, হিউম্যান কমেডি, ওআর এন্ড পিস, আনা কারেনিনা, ব্রাদার্স কারামোজভ, এদের দ্বারা নির্দিষ্ট আদর্শ বোঝায়। এ উপন্যাসগুলোতে সমসাময়িক রাজনীতি আর ব্যক্তিমানুষের নিয়তি যেমন ওতপ্রোত, আমাদের ভাষায় তেমন উপন্যাসের অভাব (উপন্যাসচিন্তা, সময় ও সমকাল)
দেবেশ রায়ের উপন্যাস-ভাবনা থেকে যা বোঝা যায়, উপন্যাসের মুলে থাকবে ব্যক্তিমানুষ, কিন্তু সেই ব্যক্তিমানুষের জীবন কীভাবে রাষ্ট্র কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে, সেটা হবে উপন্যাসের একটা অপরিহার্য উপাদান। এবং এ জায়গাটায় দেবেশ রায় মনে করেন, আমাদের উপন্যাসে একটা দীনতা আছে: আমাদের উপন্যাসে সমাজ আছে, কিন্তু রাষ্ট্র অনুপস্থিত।

আমাদের বিখ্যাত উপন্যাসগুলি পড়লে বোঝা যায় না, ও সময় আমার ব্রিটিশ শাসনাধীন ছিলাম। এর কারণ, দেবেশ রায় মনে করেন, আমাদের উপন্যাসের জন্ম সাম্রাজ্যবাদের অধীনতাকালে, রাষ্ট্র-ব্যাপারে ব্যক্তি অংশ তখন কোনো সংকট সৃষ্টি করে নি। আর রাষ্ট্রশক্তির মোকাবেলায় মানুষ তখন সমাজকে আশ্রয় বা আধার বলে ভেবেছিল। সিপাহী বিদ্রোহের পর ইংরেজ শাসন নির্দিষ্ট আকার পেতে শুরু করল, ব্যক্তিমানুষের নিয়তি রাষ্ট্র কর্তৃক প্রত্যক্ষভাবে নিয়িন্ত্রিত হতে লাগল, তখনও কেন উপন্যাসে রাষ্ট্র অনুপস্থিত? কারণ ইংরেজি শিক্ষিত লেখক ওই রাষ্ট্রের মুৎসুদ্দির ভূমিকা পেয়ে গেছে। সে নিজেকে ট্রাজেডির হিরো বানালো, নিজেকে বাঁচিয়ে চলল। ফলে রাষ্ট্রের সঙ্গে তার কিংবা তার চারপাশের মানুষগুলোর দ্বান্দ্বিক সম্পর্ককে এড়িয়ে নিয়ে সে আশ্রয় নিলো বর্ণহিন্দু সমাজে। আর ব্রিটিশ উপনিবেশের অবসানের পর? এখনও উপন্যাসে রাষ্ট্র অনুপস্থিত, উপন্যাস রচিত হয় ব্যক্তিজীবনের সুখদুঃখ আশা নিরাশা নিয়ে। এটাকে দেবেশ রায় একটা বড় দীনতা বা ঊনতা মনে করেন।

দেবেশ রায়ের আরেকটা পর্যবেক্ষণ খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। সেটা হল, আজকালকার পাশ্চাত্য উপন্যাসগুলোয় রাষ্ট্র আর তেমন উপস্থিত নয়, সেখানে মানবজীবনের বিচ্ছিন্নতা, ব্যক্তিমানুষের ফাঁদে পড়া পরিণতি, অস্তিত্বের দার্শনিক সংকটই প্রধান উপজীব্য। কাফকা, কিংবা কাম্যুতে এই অস্তিত্ববাদী সংশয়ই তো মুখ্য। সেটা বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর পশ্চিমী উপন্যাসে দেখা দেবার আগেই জগদীশ গুপ্ত বা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে বাংলা উপন্যাসে দেখা গেছে। এদিক থেকে আমরা ইউরোপের পূর্বসূরী। এবং এটা কেন ঘটতে পেরেছিল, তার ব্যাখ্যাও আমরা পাই দেবেশ রায়ের কাছ থেকে। তার ভাষায়, ‘সাম্রাজ্যবাদের পেষণে, ক্ষয়গ্রস্ত বর্ণহিন্দু সমাজের কাঠামোয়, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের গ্রাম-আমাদের ‘অসাধু সিদ্ধার্থ’ বা শশী-কুবেরের মত আউটসাইডারের জন্ম দিয়েছে।’ আর মহাযুদ্ধোত্তর ইউরোপের সঙ্গে তার মিলটা কোথায়? ‘সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রকাঠামোর ধ্বংস, ক্ষয়গ্রস্ত খ্রিস্টীয় সমাজের কাঠামোয় ন্যাটো-মার্শাল প্ল্যান আর ইয়োরোপীয় কমন মার্কেটের ইউরোপ বর্তমান পশ্চিম ইয়োরোপের আউটসাইডার নায়কের জন্ম দিয়েছে।’

২.
উপরের আলোচনা থেকে আমার উপন্যাসের দুটো ধরন পাচ্ছি। বা পাচ্ছি উপন্যাসের দুটো সংজ্ঞা। এক: ব্যক্তি আর রাষ্ট্র এ দুয়ের সম্পর্কের দ্বন্দ্ব নিয়ে উপন্যাস। দুই: ব্যক্তির অস্তিত্বের দার্শনিক সংকট নিয়ে উপন্যাস। প্রথম ভাগে যে উপন্যাসগুলো পড়ে, তাদের কিছু নাম আমরা আগেই দেবেশ রায়ের মুখে শুনেছি, ডন কুইকসোট, ব্রাদার্স কারামোজভ, আনা কারেনিনা ইত্যাদি। আর দ্বিতীয় ভাগে পড়বে আউটসাইডার, ট্রায়াল--এগুলো। বাংলা সাহিত্য থেকে খুব বড় মুখ করে নাম নেওয়া যাবে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র কাঁদো নদী কাঁদো বা চাঁদের অমাবশ্যা-র।
দেবেশ রায় যে দীনতার কথা বলেন, বলেন যে-‘উপন্যাস নিয়ে আমাদেন দীনতার ভাব আছে। প্যারীচাঁদ, বঙ্কিমচন্দ্র, ত্রৈলোক্যনাথ, রমেশচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, তারাশঙ্কর, মানিক, বিভূতিভূষণ, সতীনাথ, জীবনানন্দ, কমলকুমার সত্ত্বেও সে দীনভাব কাটে না-’ সেটা কিন্তু তিনি বলছেন উপন্যাসের প্রথম ধরনটি সম্পর্কে, দ্বিতীয় ধরন, ফাঁদে পড়া ইঁদুরের মত ব্যক্তিমানুষের দার্শনিক সংকট নিয়ে যে অস্তিত্ববাদী ঘরানা, সেটি নিয়ে নয়।

৩.
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস খুব একটা তাৎপর্যপূর্ণ কথা বলেছেন, কথাসাহিত্যের সূত্রপাত মানুষ যখন ব্যক্তি হয়ে উঠছে, তখন থেকে।
অর্থাৎ কিনা সামন্ততন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে যখন পুঁজিবাদের সূচনা ঘটতে থাকল, তখন থেকে। সেটার প্রভাব কবিতাতেও পাই, মহাকাব্যের যুগের অবসান ঘটিয়ে এল ব্যক্তির নিজস্ব চাওয়া-পাওয়া-না পাওয়ার কবিতা, লিরিক।

৪.
উপন্যাসের কেন্দ্রবিন্দুতে যে ব্যক্তি মানুষ, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এবং উপন্যাস যে ধরনেরই হোক না কেন, রাষ্ট্রসম্পর্কিত, বা অস্তিত্ব সম্পর্কিত ব্যক্তিমানুষ উভয় ধরনেরই অনিবার্য উপাদান। উপন্যাস রচিত হয় ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্ক নিয়ে, ব্যক্তির সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক নিয়ে, আর ব্যক্তির নিজের সঙ্গে নিজের যে দ্বন্দ্ব, তা নিয়ে।

৫.
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস আর দেবেশ রায় দুজনেরই আফসোস, বাংলা কথাসাহিত্যের শুরুতে আলালের ঘরের দুলাল বা হুতোম প্যাঁচার নকশা জাতীয় লেখাগুলো যে ধারার প্রবর্তন করেছিল, তা মরুপথে হারিয়ে গেছে। তারা দুজনেই ডন কুইকসোট ও গালিভার’স ট্রাভেলের উদাহরণ স্মরণ করেন সপ্রশংস ভাষায়। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বলেন, ‘আলালের ঘরের দুলাল, হুতোম প্যাঁচার নক্শা, সধবার একাদশী কী বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রো হাঁটি পা পা করার পর উপন্যাস জোর কদমে চলতে শুরু করতে না করতেই ঐ পা দিয়ে সমাজকে সে প্রায় ঠেলে ফেলতে উদ্যত হয়েছে-’ (উপন্যাস ও সমাজ বাস্তবতা, সংস্কৃতির ভাঙা সেতু)। দেবেশ রায় বলেন, ‘বাংলা সাহিত্যের ছোট সীমায় নববাবু, নববিবি, আলাল-দুলাল, নিমচাঁদ, বুড়ো শালিখ ইত্যাদি অনেক দূর এসেছিল-প্রায় যেমন ইউরোপীয় পিকারস্কেরই নায়ক। কিন্তু এরা টিকতে পারল না। কমলাকান্তে এরা সবাই এক হয়ে গিয়ে বাংলা কাহিনী থেকে চলে গেল।’

৬.
এখন পর্যন্ত আলোচনায় দেখা যাচ্ছে, (১) বাংলা সাহিত্যে রাষ্ট্র আর ব্যক্তিজীবনের নিয়তির ওতপ্রোত পরিণতিসমৃদ্ধ উপন্যাসের অভাব আছে, (২) অন্যদিকে অস্তিত্ববাদী উপন্যাসের ক্ষেত্রে বাংলা সাহিত্য পশ্চিমের পূর্বসূরী, আর (৩) বাংলা কথাসাহিত্যের শুরুর দিকে হুতোম বা আলাল (ওদের যেমন ডন কুইকসোট বা গালিভার) যে ব্যঙ্গবিদ্রুপের ধারা সূচনা করেছিল, তার বিকাশ অব্যাহত না থাকা নিয়েও আমরা দুঃখ করতে পারি।
যে দুজন লেখকের মতের সূত্র ধরে আমরা এই সারমর্মে পৌঁছতে পারলাম, তারা দুজনেই সৃষ্টিশীল কথাসাহিত্যিক। উপরের দফা ৩টি তাদের নিজেদের সৃষ্টিকর্মের আলোচনার প্রয়োগ করে দেখি না কেন, কী দাঁড়ায়।
হ্যাঁ, এদের দুজনে ১নং দফায় বর্ণিত অভাব পূরণে বেশ এগিয়ে এসেছেন। হাসান আজিজুল হক মনে করেন, ইলিয়াসের খোয়াবনামা আর দেবেশ রায়ের তিস্তাপারের বৃত্তান্ত বিশ্বসাহিত্যের অবিস্মরণীয় উপন্যাসের তালিকায় গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ, নগীব মাহফুজ, সালমান রুশদী, গুন্টার গ্রাস প্রমুখের কীর্তির পাশাপাশি স্থান পাওয়ার উপযুক্ত।

হাসান আজিজুল হকের কথায় আমরা আস্থা রাখতে পারি। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের মৃত্যুর পর ভোরের কাগজ সাময়িকীতে প্রকাশিত প্রবন্ধে হাসান আজিজুল হক এ উক্তি করেছিলেন। যদিও বলে নিয়েছিলেন, শুধু মন্তব্য করলেই হবে না, তাঁর উক্তি ব্যাখ্যা ও প্রমাণ-সাপেক্ষ। ব্যাখ্যা বা প্রমাণ উপস্থাপন তিনি (বা অন্য কেউ) ভবিষ্যত নিশ্চয়ই করবেন। উপন্যাস দুটোর বড়ত্ব শুধু, শুধু আকারে নয়, অন্তর্গত রসায়নেই, আঁচ না করে পারা যায় না। আশা করা যায়, এ উপন্যাস দুটো অবিনশ্বর কীর্তি হিসাবে বাংলা সাহিত্যে টিকে থাকবে অনন্ত সময়। উপন্যাসদুটোর আরেক ইতিবাচক বৈশিষ্ট্য-তাদের মানুষেরা প্রান্তিক মানুষ, নিম্নবর্গের মানুষ। মহৎ উপন্যাস মাত্রেই নিম্নবর্গের মানুষ নিয়ে কারবার করবে, এটা সব সময় নাও হতে পারে। ডন কুইকসোট বা গালিভার বা আনা কারেনিনা বা মিড নাইট’স চিল্ডরেন-এর সালিম সিনাই বা ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অফ সলিচুডের কর্নেল অরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া কেউই, সেই অর্থে নিম্নবর্গের মানুষ নয়। কিন্তু আরো দুটো দফা রয়ে গেল। যে দার্শনিক সংকট নিয়ে উপন্যাস রচনায় আমরা পথিকৃৎ এবং ব্যঙ্গবিদ্রূপের যে ধারায় আরো কাজ না হওয়ায় আমরা ক্ষতিগ্রস্ত, সেই ব্যাপারগুলো খোয়াবনামায় কী তিস্তাপারের বৃত্তান্ত-তে কি উপেক্ষিত নয়? এ প্রশ্নের উত্তরে ‘না’ বলার চাইতে বরং পাল্টা প্রশ্ন ছোড়া যায়, একই উপন্যাসে বা একই ঔপন্যাসিককে সব কাজ করতে হবে কেন? না, করতে হবে না, ফলে খোয়াবনামায় বা তিস্তাপারের বৃত্তান্ত-তে যা পেয়েছি, তাই নিয়েই আমাদের গৌরব করতে হবে। অস্তিত্ব নিয়ে দার্শনিক অন্বেষা, বিচ্ছিন্নতাবোধ, আউটসাইডার মনোবৃত্তি ইত্যাদি পশ্চিমের নাগরিকদের নৈমিত্তিক অভিজ্ঞতা। কিন্তু আমাদের বর্তমান জীবনের তা কি বানানো ব্যাপার? এটা যদি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বা জগদীশের জন্যে স্বাভাবিক হয়, বর্তমানের মধ্যবিত্ত লেখকের জন্যে কি নয়? এ প্রশ্নের উত্তর এক কথায় দেওয়া কঠিন। বরিশালের জীবনানন্দ দাশের পক্ষে কলকাতায় গিয়ে এলিয়েনেটেড বোধ করাই হয়তো স্বাভাবিক। হয়তো স্বাভাবিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র পক্ষেও।
আবার যদি কেউ সচেতনভাবে মেহনতি জনতার কাতারে গিয়ে মুক্তি খোঁজে, মধ্যবিত্ত বৃত্তকে অতিক্রম করতে পারে, নিম্নবর্গের সাহিত্য ছাড়া অন্য কিছুকে বিলাসিতা বলে গণ্য করার অধিকার তার আছে। কিন্তু মুশকিল হল, সচেতনভাবে শ্রেণীচ্যুত হওয়ায় সাধনায় অসচেতন (জন্মগত নিয়তিতাড়িত?) বিচ্যুতি ঘটে যায়। যেমন: আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বলেন, বাংলা ভাষায় প্রথম সফল উপন্যাস লেখেন বঙ্কিমচন্দ্র শুধু কেচ্ছার প্রতিই আকৃষ্ট হয়েছিলেন, কাহিনীকে চলমান জীবনের দলিলে পরিণত করার আকাক্সক্ষা তার হয়নি।’ তাহলে বঙ্কিম সফল হলেন কী করে?

সংস্কৃতির ভাঙা সেতু বইয়ের ভূমিকাকার শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়ের দৃষ্টি এড়ায়নি, তিনি লিখছেন, ‘ইলিয়াসের আদর্শ ব্যক্তি আসলে দ্বিধাবিভক্ত, দ্বৈতসত্তার: বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের নায়ক আবার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পথিকৃৎও। গোলটা ঠিক এখানেই। .....ঐ বিধির বাঁধন কাটে কার সাধ্য! আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের মতন শক্তিমান লেখকও সবসময় পারেননি; ধারাবিবৃতির ধোঁয়াশা কোথাও কোথাও তাঁকেও আচ্ছন্ন করেছে।....এর ফলে অনেক ক্ষেত্রে ঊনিশ শতকের রথীমহারথীদের ভালোমন্দ বিচার নিছক বুর্জোয়া ভাব বা অ-ভাবের ভিত্তিতে সারা হয়েছে।’

৭.
ব্যক্তি হিসাবে লেখকের নিজেরও কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। একেবারেই বাস্তব সীমাবদ্ধতা। আমি যে শ্রেণীতে জন্মগ্রহণ করেছি এবং যে শ্রেণীর রুচি নিয়ে বড় হয়েছি, তারপর যে শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠেছি, শুধু প্রতিজ্ঞা আর অধ্যবসায় দিয়ে তার বাইরে কি পুরোপুরি আসা সম্ভব? বর্তমান বাংলাদেশের একজন মধ্যবিত্ত লেখকের উপলব্ধিতেও বিচ্ছিন্নতার বোধ, অস্তিত্ববাদী ক্লান্তি আসা খুবই সম্ভব।
ভালো হয়, যদি এই অস্তিত্ববাদী সংকটটা লেখক তার সময়, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রেক্ষাপটে মিলিয়ে নিয়ে করতে পারেন।
হাসান আজিজুল হক যাদের বড় ঔপন্যাসিক বলছেন, তাদের অনেকের ক্ষেত্রেই এ কথাটা সত্য। আমি উদাহরণ দিতে চাই। দস্তয়ভস্কির উপন্যাস যে অস্তিত্ববাদী গল্প, ফাঁদে পড়া মানুষের গল্প, সেটা আগে থেকেই প্রতিষ্ঠিত। কাফকা, কাম্যুর সাথে তার নাম একই নিঃশ্বাসে উচ্চারিত হয় অনেক সময়ই। (‘যে আত্মিকতা ও বিচ্ছিন্নতাবোধ অস্তিত্ববাদী চিন্তার জন্য আবশ্যক, তা যথার্থভাবেই দস্তয়েভস্কির সাহিত্যে লক্ষ্য করা যায়।’ অস্তিত্ববাদ: সাহিত্যে, অস্তিত্ববাদ, শরীফ হারুন।) এ সুযোগে অস্তিত্ববাদী উপন্যাসের লক্ষণগুলো শরীফ হারুনের বই থেকে কাম্যুর প্রসঙ্গ ধরে তুলে ধরা যাক: ‘তার (কাম্যুর) রচনার মাঝে লক্ষ্য করা যায় মানব অস্তিত্বের অপরিহার্য অঙ্গ-জীবন ও জগতের অসঙ্গতি, অস্থায়ীত্ব, অনিশ্চয়তা, বেদনা, নৈরাশ্য, অবসাদ, মনস্তাপ, শংকা, আত্মচ্যুতি বা বিচ্ছিন্নতা ও মৃত্যুচিন্তা। এ সব কারণে তাকে অবশ্যই অস্তিত্ববাদী সাহিত্যিক বলা চলে।’

নগীব মাহফুজের খোঁজ উপন্যাসটিও তাই। কেনযাবোরো ওয়ের শিকার ও পারসোনাল ম্যাটার। রুশদীর মিডনাইট’স চিল্ডরেন। যে শিশু ১৯৪৭-এর ১৫ আগস্ট প্রথম মুহূর্তে জন্মেছে, তার ভবিষ্যত জীবনের অস্তিত্ববাদী সংকটগুলো রাষ্ট্রের ভবিষ্যতের সঙ্গে মিলিয়ে নিয়েছেন লেখক।

আর আছেন গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ। তার লাভ ইন দ্য টাইম অফ কলেরা পাঠের স্মৃতি আমি কাম্যুর প্লেগ পড়ার স্মৃতি থেকে এখন এতদিন পরে আর আলাদা করতে পারি না। তার অফ লাভ এন্ড আদার ডেমন্স-এ কী ঘটে? প্রথম পাতাতেই ছোট মেয়েটিকে কুকুরে কামড় দেয়, অন্য যাদের কামড়েছিল কুকুরটি, তাদের সবাই মারা গেছে, বেঁচে আছে শুধু মেয়েটি, এবং ভালোবাসছে। আমরা জানি যাই ঘটুক, মেয়েটির নিয়তি স্থির হয়ে গেছে, তাকে মরতেই হবে। কী ঘটে ক্রনিকল অফ এ ডেথ ফোরটোল্ড-এ? হাসান আজিজুল হকের ভাষ্য শুনি: (এ বইটি) সব মিলিয়ে ফাঁদের গল্প। মানুষ এক ফাঁদ থেকে আর এক ফাঁদে পা দিচ্ছে, তারপর একসময় পুরোপুরি আটকে পড়ছে। ইতিহাসের ফাঁদ, অর্থনীতির ফাঁদ, স্বৈরতন্ত্রের ফাঁদ, সাম্রাজ্যবাদের ফাঁদ, ভাগ্যের চাকার ফাঁদ, সম্পূর্ণ নির্দোষের অজানা ফাঁদ-আর সেই বিশাল মহাদেশীয় ফাঁদ, যার থেকে নিস্তার নাই আজকের পৃথিবীর কারও। তারই গল্প লেখেন বটে মার্কেজ যিনি মানুষের অবসান অস্বীকার করেন আর বিশ্বাস করেন এখনও সময় আছে, সময় আছে দ্বিতীয় সুযোগের, সময়ের মধ্যে ঢোকার। (মহাদেশের কথক: গাবরিয়েল গর্সিয়া মার্কেজ, কথাসাহিত্যের কথকথা।)

হাসান আজিজুল হকের নিজের মধ্যেও এই দ্বন্দ্ব বিলকুল আছে। তিনি একই সঙ্গে বিশ্বাস করেন সেই বিশাল মহাদেশীয় ফাঁদ, যার থেকে নিস্তার সেই কারও। আবার তিনি ক্রমাগতভাবে লড়াই করে চলেছেন মানুষের মুক্তির। তার গল্পেও এটা ঘটে। তার ‘সাক্ষাৎকার’ গল্পটায় একটা লোককে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, কেন নিয়ে যাওয়া হয়েছে, সে জানে না, ব্যাপারটা পুরোপুরিই কাফকায়েস্ক। কিন্তু আমার সঙ্গে আলাপকালে হাসান আজিজুল হক এ গল্পের কাফকাধর্মী ব্যাখ্যা মেনে নিতে অস্বীকার করেন, এবং এটা রাষ্ট্র বনাম ব্যক্তিমানুষের দ্বন্দ্বের গল্প-এ ব্যাখ্যাটাকে পছন্দ করেন। হাসান আজিজুল হক তাঁর প্রথম উপন্যাস বৃত্তায়ন লিখে যে ফেলেছেন, এটা সত্য। খুবই অস্তিত্ববাদী ঘরানার গল্প, বৃত্তাবদ্ধ জীবনের গল্প, পলায়নবৃত্তির গল্প। এখন তিনি ওই উপন্যাসটিকে অস্বীকার করতে চান। এই হল স্বতঃস্ফুর্ত প্রবণতার সঙ্গে অর্জিত মূল্যবোধের দ্বন্দ্বের ব্যাপার।

ভালো হয় যদি মানুষের ফাঁদে পড়ার ব্যাপারটা সময়-সমাজের সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া যায়। এর একটা বিপদের কথা আমাদের জানা, কুন্ডেরা যেটা জানাচ্ছেন কাফকা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে, যে, কাফকাকে ব্যাখ্যা করতে যাওয়া মানেই তাকে অপব্যাখ্যা করা। কিন্তু ইউরোপের বেলায় একথা সত্য হলেও এশিয়া বা ল্যাটিন আমেরিকা বা আফ্রিকার বেলায় এটা সত্য নাও হতে পারে। একই সঙ্গে রাষ্ট্রের ফাঁদ আর নিয়তির ফাঁদকে মিলিয়ে কি অসাধারণ হয়ে ওঠেননি মার্কেজ, হয়ে ওঠেননি মহাদেশের কথাকার।

মার্কেজের একটা নতুন বইয়ের জন্যে শুধু কলাম্বিয়া নয়, সমস্ত ল্যাটিন আমেরিকার উš§ুখ হয়ে চেয়ে থাকে। ছোটগল্পের ক্ষুদ্র পরিসরে আমাদের হাসান আজিজুল হকও তাই করেন, নিয়তির ফাঁদের সঙ্গে মিলিয়ে নেন রাষ্ট্র-সময়-সমাজের ফাঁদকে। তার গল্পও নিষ্ঠুর নিয়তিরই গল্প। কিন্তু এর সঙ্গে তিনি মিলিয়ে নেন সময়-সমাজ-রাষ্ট্রের চাপকে। (হাসান আজিজুল হক-এর মা-মেয়ের গল্প-এর সঙ্গে আমি মার্কেজের সরলা এরেন্দিরা -র মিল পাই।)

৮.
আমার এ লেখায় অস্তিত্ব কথাটা ঘুরেফিরে আসছে। অস্তিত্বের সংজ্ঞা কী? এইবার আমরা আসব মিলান কুন্ডেরায়। কুন্ডেরা এ কথাটা খুব জোর দিয়ে বলেন যে, ‘উপন্যাস বাস্তবতাকে নিরীক্ষণ করে না, নিরীক্ষণ করে অস্তিত্বকে। আর যা ঘটেছে, তাই অস্তিত্ব নয়, অস্তিত্ব হচ্ছে মানব-সম্ভাবনার রাজত্ব, মানুষের পক্ষে যা কিছু হওয়া সম্ভব, যা কিছু করার জন্য সে যোগ্য তার সব। মানুষের এটা ওটা সব সম্ভাবনাকে আবিস্কার করে ঔপন্যাসিক রচনা করেন অস্তিত্বের মানচিত্র। এবং আবারও স্মরণ করি, অস্তিত্ব মানে বিয়িং-ইন-দ্য-ওয়ার্ল্ড। এভাবে চরিত্র আর তার জগত দুটোকেই দেখতে হবে সম্ভাবনা হিসেবে।’ (মিলান কুন্ডেরা, দ্য আর্ট অফ দ্য নভেল)
বিয়িং-ইন-দ্য-ওয়ার্ল্ড এই পরিভাষাটা হাইডেগারের দেওয়া। কুন্ডেরা ব্যাখ্যা করছেন, মানুষের সঙ্গে জগতের সম্পর্কটা সাবজেক্ট আর অবজেক্টের নয়, তেমন নয়, যেমন দর্শকের চোখে চিত্রকর্ম, অভিনেতা আর মঞ্চের মতোও নয়, মানুষ আর জগত ওতপ্রোতভাবে বাঁধা, যেমন একটা ঝিনুক আর তার খোল। জগতটা মানুষের অংশ, তার মাত্রা, জগত বদলালে অস্তিত্বও বদলায়।
কথাটা কিন্তু ঘুরেফিরে এক জায়গায় আসছে, মানুষ আর তার জগত। ব্যক্তিমানুষ আর তার পরিপার্শ্ব। এবং কুন্ডেরা খুব জোর দিয়ে জানাচ্ছেন, সে উপন্যাস অর্থহীন, যাতে মানুষের অস্তিত্বের কোনো নতুন সম্ভাবনা উৎঘাটিত না হচ্ছে।

৯.
এ কথা খুবই শোনা যায় যে, ইউরোপে উপন্যাসের মৃত্যু ঘটেছে বা ঘটতে যাচ্ছে। কথাটা এজন্যে বলা হয় যে, ইউরোপের ব্যক্তিজীবনে আর কীবা বৈচিত্র আছে, ওখানে একজন ঔপন্যাসিক অস্তিত্বের কোন্ নতুন সম্ভাবনাই বা আর আবিস্কার করবেন?

অন্যদিকে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের, মানুষের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্কের হাজার হাজার অকর্ষিত জমিন পড়ে রয়েছে এশিয়ায়, ল্যাটিন আমেরিকায়, আফ্রিকায়। আজ ইউরোপ আমেরিকায় নন্দিত হচ্ছে অভিবাসীদের উপন্যাস, যেহেতু তাদের পক্ষে সম্ভবপর মানুষের অস্তিত্বের নতুন দিগন্ত উন্মোচন।
ইউরোপে উপন্যাসের মৃত্যু হবে বা হয়ে গেছে কিনা, ব্যাপারটা ভাবিয়েছে কুন্ডেরাকেও। কুন্ডেরা অবশ্য উপন্যাস সৃষ্টির প্রথম মুহূর্তটিকে দেখেন আধুনিক যুগের শুরুর মুহূর্ত হিসেবে।

প্রসঙ্গের শুরুটা হয়েছিল এভাবে যে, গ্যালিলিও আর দেকার্তের মাধ্যমে যে আধুনিক যুগের শুরু, যাতে দুনিয়াটাকে বিবেচনা করা হচ্ছে কেবল কারিগরী আর গাণিতিক অনুসন্ধানের ক্ষেত্র হিসেবে, মানুষকে অপসারিত করে দেওয়া হয়েছে কংক্রীটের দেওয়ালের ওপারে, তাতে করে এডমুন্ড হুর্শাল প্রশ্ন তুলছেন, ইউরোপ কি বাঁচতে পারবে। কুন্ডেরা ব্যাপারটাকে দেখছেন অন্য দৃষ্টিতে, বলছেন, ইউরোপের আধুনিকতার শুরু কেবল গ্যালিলিও বা দেকার্তে (তার ঘোষণা, মানুষ হল প্রকৃতির প্রভু আর মালিক) থেকে নয়, বরং আরো একজনের থেকেও, তিনি হলেন সার্ভান্তেস, তার হাতে সূচিত হলো এমন এক শিল্পমাধ্যমের, যার কাজ আর কিছুই নয়, কেবল মানুষের অস্তিত্বকে অনুসন্ধান করা। হাইডেগার অভিযোগ করেছিলেন যে, এর আগে মানুষের অস্তিত্ববাদী ধারণাকে ইউরোপীয় দর্শন উপেক্ষা করেছে, তার বিপরীতে গত চার শতক ধরে উপন্যাস মানুষের অস্তিত্বকেই নানাভাবে আবিষ্কার করেছে, অনুসন্ধান করেছে, উন্মোচন করেছে। তবে হ্যাঁ, সার্ভান্তেসের দন কিহোতে একদিন বেরিয়ে গিয়েছিল তার সামনের বিশাল পৃথিবীতে, আর কাফকায় এসে এক ভূমিজরিপকারী কোর্ট বা ক্যাস্ল-এর চৌহদ্দীতে ঘুরপাক খাচ্ছে, কোথায় যাবে সে, তার সফর এখানেই বাঁধা পড়ে যাচ্ছে।

এখন যদি উপন্যাসেরই মৃত্যু ঘটে, এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে, ইউরোপের আধুনিক যুগেরই মৃত্যু। কুন্ডেরা অবশ্য বলছেন আরো চারটি সম্ভাবনার কথা, যা অবলম্বন করে উপন্যাস বেঁচে থাকতে পারে, সেগুলো হল--নাটুকেপনায় পরিপূর্ণ লঘুতার শীর্ষস্পর্শী হওয়া (অ্যাপিল অফ প্লে), স্বপ্ন আর কল্পনার তুঙ্গে ওঠা (অ্যাপিল অফ ড্রিম), চিন্তা বুদ্ধি আলোচনার জন্যে গল্পকে খুলে দেওয়া (অ্যাপিল অফ থট), আর সময়ের ব্যক্তিগত সীমাকে অতিক্রম করে একাধিক ইতিহাসপর্বকে একই সঙ্গে ধারণা করা।

১০.
ওই সমস্যা ইউরোপের। আমাদের নয়। রাষ্ট্র আর ব্যক্তির সম্পর্ক উপন্যাসে নানাভাবে এখানে উন্মোচন হওয়ার অপেক্ষায়।
এত এত সামরিক শাসন গেল, এত এত সৈন্য এদেশে, এত জেনারেল, এত অবসরপ্রাপ্ত, এত অভ্যুত্থান, এত মৃত্যু, এক রাতে ফাঁসীর রজ্জুতে ঝুলেছে শতশত সৈন্য, কই তাদের কাউকে উপন্যাসে দেখি না কেন? আমাদের ঔপন্যাসিক নিুবর্গের মানুষ নিয়ে লেখেন, আধাসের গম দেওয়ার নাম করে চেয়ারম্যান বলাৎকার করছে অভাবী নারীকে, এ দৃশ্য অনেক পাওয়া যাবে, কিন্তু অভাবের শুরুটা রাষ্ট্রের যে ওপরতলা থেকে, গমের অর্ধেকটা গোড়াতেই সরিয়ে নিয়েছেন প্রধান কর্ণধার, আর সাহায্যদাতা-গ্রহীতা পরামর্শক সবাই মিলে যে বলাৎকার করছে পুরো দেশটাকেই, সে কথা কে লিখবে, কোন ঔপন্যাসিক? একজন আমলা, যে চাকুরির প্রথম দিন থেকেই ঢুকে পড়ল এক ক্যাস্ল্-এ, যেখানে মূল্যবোধটাই অদ্ভুত, জীবন-সায়াহ্নে এসে কি একবারও পুরো জীবনটা তার চোখে ঝলকে ওঠে না অনুশোচনা আর সান্ত্বনাসহ। নাকি দেবেশ রায় যা বলেছিলেন পরাধীনদেশের নতুন ঔপন্যাসিকদের সম্পর্ক যে, এরা নিজেদের সম্পর্কে এমন কিছু লেখেনি, পাছে নিজেই হাস্যকর হয়ে ওঠে, সেই সতর্কতা কাজ করছে আমাদের এখনকার ঔপন্যাসিকদের মধ্যেও।

১১.
উপন্যাসে গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের আগ্রহ জন্মালো কীভাবে?
যখন আইনের ছাত্র হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমবর্ষে পড়ছি (বয়স নিশ্চয়ই উনিশ তখন), এবং ইতিমধ্যে ‘রূপান্তর’ গল্পটা পড়ে ফেলেছি। প্রথম বাক্যটা খুব মনে পড়ে, ‘একদিন সকালে অস্বস্তিকর স্বপ্ন থেকে জেগে উঠি গ্রেগরি সামসা দেখতে পায় যে নিজের বিছানায় সে একটা বিরাট আরশোলার রূপান্তরিত হয়েছে।’ (পেয়ারার সুবাস)
হ্যাঁ, মার্কেজের অস্তিত্ববাদী প্রবণতার পক্ষে একথা যখন স্মরণ করছি, তখন এ উদ্ধৃতিও অত্যাবশ্যক হয়ে ওঠে। মার্কেজ বলেন, ‘আমি চাই, বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে পরিণত হোক। এবং আজ হোক কাল হোক তা হবেই। কিন্তু অঙ্গীকারের সাহিত্য হিসেবে বা সামজিক প্রতিবাদের উপন্যাস হিসেবে ল্যাটিন আমেরিকায় যা এসেছে, সে সম্পর্কে আমার কিছু দ্বিমত আছে। এর অন্যতম কারণ, জীবন ও জগত সম্পর্কে এসব উপন্যাস যে সীমিত বক্তব্য পেশ করে, তা দ্বারা কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল হয় না। সচেতনতা দূরের কথা বরং তাকে তা আরো মন্থর করে দেয়। আমার চরমপন্থী বন্ধুদের অনেকে মনে করেন যে কী লিখতে হবে না হবে তা নির্দেশ দিয়ে শেখানো উচিত। কিন্তু এতে করে সম্ভবত অবচেতনভাবে তারা সৃজনশীল রচনার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করে নিজেরাই প্রতিক্রিয়াশীল ভূমিকা পালন করেন। আমার বিশ্বাস, প্রেম সম্পর্কিত উপন্যাসও যেকোনো উপন্যাসের সমমূল্য। তাই যদি হয় তো একজন লেখকের দায়িত্ব-বলতে পারেন বিপ্লবী দায়িত্ব হল-ভালো লেখা।’ (পেয়ারার সুবাস, ১৯৮৩, গার্সিয়া মার্কেজ)
পাশাপাশি স্মরণ করি দেবেশ রায়ের কথা। ‘সর্বত্রই লেখককে তত্ত্ব বাতলানোর অবিনয়, ঔচিত্যবিচারের ঔদ্ধত্য। যেন মানিকবাবু লিখতে পারেন-মাত্র এটুকুই তার জোর। তাই বলে কী লিখতে হবে ও কেন লিখতে হবে-সেটা তাঁর ওপর ছেড়ে দেওয়া যায় না। এ বিপদ সমালোচকরা যতটা বাড়ান, প্রায় ততটাই বাড়ান সমকালীন দুর্বল লেখকরা।’ ভয় হয়, দুর্বল লেখক হিসেবে আমি নিজেও একই বিপদ বাড়াচ্ছি না তো।
আবার এও দেখি, সংবাদপত্রে প্রায়ই লেখা আসে, কথাসাহিত্যের ওপরে আলোচনা, সেসবের পান্ডুলিপি প্রমাদে আকীর্ণ, বানান ভুল বাক্যের গঠন ভুল, কিন্তু তারা আলোচনা শুরু করেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বা হাসান আজিজুল হক বা এমন কোনো নমস্যাকে দিয়ে। হায়, বড় লেখকের আলোচক মাত্রই যদি বড় লেখক হত। সৈয়দ শামসুল হক একবার দুঃখ করে বলেছিলেন, বাংলাদেশে সাহিত্যের বিচার করা হয় রাজনৈতিক মানদণ্ড দিয়ে। কথাটায় সত্যতা আছে। এক্ষেত্রে কথাসাহিত্যে বোধ করি চৈনিক বামরা একটু বেশিই ভাগ্যবান।

১২.
বাংলাদেশে তিনজন কথাসাহিত্যিককে আমি খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। তিনজনই হক। সৈয়দ শামসুল হক, হাসান আজিজুল হক ও মাহমুদুল হক। এ মন্তব্যটাও প্রমাণ আর ব্যাখার দাবি রাখে, সেটা ভবিষ্যতে করা যাবে, আজ শুধু প্রস্তাবনাটা পেড়ে রাখা গেল।

১৩.
সাম্প্রতিক কোন্ উপন্যাস নিয়ে আমার ভালো লাগা তুঙ্গ স্পর্শ করেছে?

অরুন্ধতী রায়ের দি গভ অফ স্মল থিংস। ভালো, ভালো এবং ভালো। প্রধানত মুগ্ধ করেছে তার সৌন্দর্য সৃষ্টির ক্ষমতা, তার রসবোধ, ব্যঙ্গবিদ্রূপের শক্তি, আর কাহিনীর জ্যামিতিক আকার, গল্পটা রৈখিক নয়, বৃত্তাকার, যে কোনো এক জায়গা থেকে পড়া শুরু করে শেষ পর্যন্ত পড়ার পর বাকিটা যদি পড়ি প্রথম থেকে, কোনো ক্ষতি নেই। গল্পটা যে প্রত্যাবর্তনের গল্প। বৃত্তাবদ্ধ জীবনের গল্প। অরুন্ধতী রায়ের উপন্যাসটিতে কমুনিস্টদের খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করা হয়েছে। সে হিসেবে এটা প্রতিক্রিয়াশীলদের পক্ষে যায়। যেমন মিলান কুন্ডেরার কমুনিজিমবিরোধিতা মিশনারি উৎসাহ ও একাগ্রতার পর্যায়ে পড়ে। কিন্তু তা তাদের উপন্যাস-আস্বাদনে কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায় না।

১৪.
অনেক লেখক হয়তো চান, তার গল্পটা এমনভাবে বলা হোক, যেন সেটা সত্য বলে মনে হয় পাঠকের কাছে।
আমি এভাবে লিখতে চাই না। আমি চাই গল্পের তোড়ে যেন পাঠক ভেসে না যায়, গল্পটা যে আমার বানানো, সেটা পাঠককে বার বার মনে করিয়ে দিতে চাই। তারপর তাকে বলি, দেখো, এর চেয়ে আরো করুণ আরো ভয়াবহ আরো হাস্যকর আরো বড় অন্যায় আমাদের রোজকার জীবনেই ঘটছে এ গল্পের কাজের মেয়ের দুঃখে দুঃখী হয়ে চোখের জল ফেলা সহজ, কিন্তু নিজের বাড়ির কাজের মেয়েটিকে আমরা কী হালে রেখেছি, সেটা কি আমরা একবারও ভাবি।
আখ্যানের ধারাবাহিকতা ক্ষুণ্ণ করে এভাবে আঘাত করলে নান্দনিক রুচি আহত হয় হয়তো, আর বাংলার উপন্যাসের আদি পাঠক, প্রধানত পাঠিকা, যারা আখ্যানের মোহে মজে পড়ে যান পাতার পর পাতা, বইয়ের প্রধান ক্রেতা তারা, খুবই বিরক্ত হন, কিন্তু আমি নাচার। তবে কৌশলটা নতুন কিছু নয়, ব্রেশ্ট সেই কবেই এ-রীতি চালু করে গেছেন (থিওরি অব এলিয়েনেশন)। কাহিনীর প্রবাহ ধরে চলতে চলতে উটকো স্পিডব্রেকারের মতো যখন এসে পড়ে সংবাদপত্রের কাটিং, সাক্ষাৎকার, কলাম, পরিসংখ্যান, হোচট খাওয়া অসম্ভব নয়। পাঠককে দোষ দিচ্ছি না, যে-দেশে উপন্যাস লেখা হয়নি তেমন, সে দেশে আবার প্রতি-উপন্যাস!

১৫.
ইউরোপে উপন্যাস মারা গেছে কি যায় নি, কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয় লেখা হবে বলে মাতৃগর্ভে বর্ধিষ্ণু ভ্রুণের মতো অপেক্ষায় আছে দারুন সব উপন্যাস।
নোবেল পুরস্কার ভাষণে (১৯৮২) যা বলেছিলেন মার্কেজ, তার শেষাংশটা আবার স্মরণ করতে চাই। ‘সমস্ত দমনপীড়ন, নির্যাতন, লুঠতরাজ, আত্মবিক্রয় সত্ত্বেও, আমাদের উত্তর হচ্ছে: জীবন। না বন্যা, না মহামারী, না বুভুক্ষা, না প্রলয়-ঝড়, এমন কী শতাব্দীর পর শতাব্দী জুড়ে চিরকাল-চলা যুদ্ধবিগ্রহও মৃত্যুর ওপর জীবনের নাছোড় প্রাধান্যকে হ্রাস করতে পারেনি। এ এমনই সুযোগ বা অধিকার যে তা ক্রমবৃদ্ধি পায়, দ্রুতহারে বাড়ে: প্রতিবছর সেখানে মৃত্যুর চাইতেও, বেশি হয় নবজন্ম ৭৪,০০০,০০০-নবজীবনের এ এক পরিমাণ যা নিউইয়র্কের জনসংখ্যাকে প্রতিবছর সাতগুণ বাড়িয়ে দিতে পারে। তাদের বেশির ভাগই জন্মায় এমন সব দেশে যাদের বৃত্তসম্পদ খুবই কম, আর তাদের মধ্যে বলাই বাহুল্য, আছে লাতিন আমেরিকা। অন্যদিকে অধিকতর সমৃদ্ধ দেশগুলো যথেষ্ট শক্তি সঞ্চয় করার ব্যাপারে এমনই লাভ করেছে যে তার একশ গুণ লোককে তারা মুহূর্তে নির্মূল করে দিতে পারে, শুধু পে আজকের পৃথিবীর সব মানুষকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে তাই নয়, এ দুর্ভাগ্য গ্রহে এ-যাবৎ যত মানুষ জন্ম নিয়েছে সাকুল্যে তাদের সকলকেই ধ্বংস করে দিতে পারে।..... এই ভয়াল বাস্তবতার সামনে-সমস্ত মানুষীকালে যাকে মনে হয়েছিল নিছক কোনো কল্পলোক বলেই, আমরা যাঁরা কথা বানাই, কাহিনী গড়ি, আমরা তবু বিশ্বাস করি সবকিছু, বিশ্বাস করবার দাবি ও অনুভূতি রাখি যে এখনও এক বিকল্প/ বিরুদ্ধ রাজ্য গড়বার কাজে কল্পরাজ্য-জীবনেরই কল্পরাজ্য-যেখানে অন্যদের কাছে আর কেউ ঠিক করে দেবে না তার মৃত্যুর রূপ কী হবে, সেখানে সত্যিই ভালোবাসা হয়ে উঠবে নিশ্চয় আর সুখ হয়ে উঠবে সম্ভব, যেখানে যেসব দেশ একশ বছরের নিঃসঙ্গতার দণ্ড পেয়েছ, শেষটায়, চিরকালের জন্যে পারে পৃথিবীতে এক দ্বিতীয় সুযোগ।’
মুমুর্ষুর কানে জীবনের এ জয়গান পৌঁছে দেওয়ার কাজটা সত্যিই কঠিন, উপন্যাসকে সে কঠিন কাজই করতে হবে। সমস্ত মানবপ্রজাতিকে তার ইতিহাসসহ ধ্বংস করার ক্ষমতা রাখে যে মানুষ, তারা ঘন্টার পর ঘন্টা, দিনের পর দিন দেখল, রুশ সাবমেরিনে একটু একটু করে শ্বাসবন্ধ হয়ে আসছে ১১৮ জন নাবিকের, ওই ১১৮ জন এগিয়ে যাচ্ছে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে। এমনকি গ্রহান্তর থেকে আসা সম্ভাব্য হামলা মোকাবেলায় প্রস্তুত যে মানুষ, তারা দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার জন্য পৌঁছতে পর্যন্ত পারল না সাবমেরিনের আশেপাশে।

১১৮ জন মানে কি একটা সংখ্যা। নাকি ১১৮ জন ব্যক্তি। ১১৮টা অস্তিত্ব। তাদের প্রত্যেকের জন্ম আছে, আছে বেড়ে উঠবার আলাদা ইতিহাস, প্লেগের ইঁদুরের মত অসহায় তারা, মৃত্যুকে বরণ করে নিচ্ছে, এই পর্ব চোখের সামনে ঘটতে দেখল আর ঘটতে দিল সমস্ত পৃথিবী, এতবড় কাফ্কান ফাঁদ কি কল্পনা করতে পেরেছিলেন কাফকা নিজেও? দন কিহোতের পরিব্রাজন যদি ভূ-পরিমাপকের কোর্ট কিংবা প্রাচীরপ্রকারে বদ্ধ হয়ে উপন্যাস তথা ইউরোপের আধুনিকতাকেই আটকে দেয়, তাহলে ওই ১১৮ জনের সঙ্গে ইউরোপের উপন্যাসের সলিলসমাধি ঘটে নাকি? নাকি ফিনিক্স পাখির মতো ভস্ম তেকে জেগে উঠবে উপন্যাস। যে পাখি তার প্রাণটুকুন লাভ করবে তৃতীয় বিশ্ব থেকে।

ধূলিচিত্র, আগস্ট ২০০০


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন