মু হ ম্ম দ স বু র
আমরা হেঁটেছি যারা পৌষের সন্ধ্যায়' তাদের একজন ছিলেন আমাদের শহীদুল হক কিংবা শহীদুল জহির। হিম হিম সন্ধ্যায় খড়ের গাঁদার পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে সোঁদা গন্ধের আমেজ তাকে কাবু করতো কিনা কখনো স্পষ্ট হতো না। বহুদিন, বহুরাত একই ছাদের নীচে কিংবা খোলা আকাশের নীচে মুখোমুখি বসে নির্বাক কাটিয়ে দিয়েছি যে যার ভাবনার জগতে। এ বাড়ি-ওবাড়ি গিয়ে নানা ভোজে অংশ নেয়া দু'জনের মাঝে কথা হতো যেন কার্টুনের ভাষায়। সংক্ষিপ্ত শব্দ, বাক্য ব্যবহারের অনুশীলন চলতো। সেই সত্তর সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত নানা সময়ে নানা আয়োজনে দেখেছি তাকে।
সেই কবে দেখেছি তাকে, বয়ঃসন্ধিকালে। কনিষ্ঠ এই আমি পেয়েছি ঠাঁই তার কাছে অনায়াসে দূরত্ব-দূর ব্যবধান সত্ত্বেও। গণঅভ্যূত্থানের সেই ঊনসত্তর সালে চট্টগ্রাম থেকে এসে ঢাকা কলেজে ভর্তি হওয়া শহীদুল হককে পেয়েছিলাম পরবর্তী বছর সত্তর সালে। যখন আমি প্রথম বর্ষে, তখন তিনি দ্বিতীয়বর্ষের ছাত্র। কী সপ্রতিভ, মিষ্টিহাসি আর লাবণ্যমাখা শহীদুলের মধ্যে তখন থেকেই গুরুগম্ভীরভাব মাঝে মাঝেই ফুটে উঠতো।
দক্ষিণ চট্টগ্রামের স্কুল জীবন শহীদুলের কেমন কেটেছিল জানি না। কাছাকাছি স্কুলের ছাত্র হিসেবে জানা ছিল সে সময়কাল, অস্থিরতার দিন-রাত। দেশজুড়ে রাজনৈতিক আন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়েছিল তখন দক্ষিণ চট্টগ্রামের সাতকানিয়া, চন্দনাইশে। সেই সময় স্কুলের গন্ডি ছাড়িয়ে ঢাকা কলেজে পড়ার সময়টি ছিল উত্তাল আন্দোলনের দিনরাত। সত্তর সালের আগস্ট মাসেই সম্ভবত ঃ শহীদুলের সঙ্গে পরিচয়পর্ব কলেজ ক্যান্টিনে। সহপাঠী কামাল চৌধুরীর সঙ্গে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলছিলাম। একই টেবিলের একপাশে বসে সিঙ্গারা চিবুচ্ছিল শহীদুল। কথার ঢেউ তার কর্ণকুহরে অবলীলায় ঢুকে পড়ে এবং তাগাদা দেয় তাকেই পরিচয় হতে। শহীদুলই প্রশ্ন তোলেন,- অ'নেরা কি পইট্টাত্তন আইস্সনদে।
এরপর কিছু বাক্যালাপ, স্কুল জীবন কোথায় কেটেছে ইত্যাদি। এসএসসিতে প্রথম বিভাগ পেয়ে কলেজে ভর্তি হন তিনি। মাঝে মাঝে ক্যান্টিনে দেখা হতো, 'কেন্ আছন কিংবা উত্তর হতো গম ন'লা'র। পুরনো ঢাকায় তখন শহীদুল থাকতেন। একবার আমাদের বাসায় এসেছিলেন, সম্ভবত সত্তরের অক্টোবরে। ভাগ্নের জন্মদিনে সতীর্থের মধ্যে তাকেও বলেছিলাম। যথারীতি এসেছিলেন; ফ্রাঙ্কলিন পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত বিশ্বের সেরা রূপকথা বই হাতে। যাবার সময় আমার সংগ্রহ থেকে নিয়েছিলেন দস্তয়ভয়স্কির ইডিয়ট উপন্যাসের ইংরেজি সংস্করণ আর নরেন্দ্রনাথ মিত্রর উপন্যাস কাঠগোলাপের গন্ধ। ততোদিনে অসহযোগ আন্দালন শুরু। কলেজ বন্ধ। তারপর মুক্তিযুদ্ধ। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে আগরতলায় চলে গেলে শহীদুল হক বিস্মৃত হতে থাকেন আরো অনেক কিছুর মতো।
যুদ্ধপরবর্তী কলেজে ফিরে এসে শহীদুল হককে আর পাইনি। তিনি ততোদিনে কলেজ ছেড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়ে গেছেন। ৭৩ সালে আবার দেখা, আমিও তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে। নিউমার্কেটে মনিকো রেস্তোরায় হঠাৎ দেখি শহীদুলকে। সম্পর্কটা আপনি থেকে তুমিতে নেমে আসা সম্ভব হয়নি উভয়ের স্বভাবগত কারণেই। 'বদ্দা ক্যান আছন জানতেই গম আছি বলে সহাস্যে করমর্দন করেছিলেন। হাতে কোলকাতার মাসিক চতুরঙ্গ ছাড়াও দেখেছিলাম একটি বই। সম্ভবতঃ অমিয় ভূষণ মজুমদারের কোনো উপন্যাস। এখন মনে পড়ছে না। আলাপচারিতার প্রসঙ্গ ছিল কারা কারা যুদ্ধে গেছেন, সেসবও। তারপর মাঝে মাঝে শরীফ মিয়ার ক্যান্টিন কিংবা মধুর ক্যান্টিনে দেখা হয়েছে। কুশলাদি ছাড়া আলোচনা তেমন আর এগুতো না।
এইচএসসি, বিএ সম্মান এবং এমএতে ভাল রেজাল্ট ছিল। সম্ভবতঃ ৭৭ সালে ক্যাম্পাস ছেড়েছিলেন শহীদুল, তারপর যোগাযোগহীন। '৮১ সালে আবার দুজনে দেখা। অগ্রজ সহপাঠী এবার সতীর্থের সারিতে পড়ে গেলেন।
বিসিএস '৮১ ব্যাচের সতীর্থ শহীদুল ২২০০ নম্বরের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে প্রশাসন ক্যাডার পান। ৮১ সালে ৬ মাসের বুনিয়াদি প্রশিক্ষণে দেখা তার সাথে। শাহবাগের কোটায় আবাসিক প্রশিক্ষণ কালে একসঙ্গে ক্লাশ করেছি কতো সকাল-বিকেল-দুপুর, সন্ধ্যায় একসঙ্গে হেঁটেছি, রাত জেগেছি। কোর্সের বিষয়, প্রশিক্ষকদের জ্ঞানদান পদ্ধতি, চাকরি জীবনের পোস্টিং ইত্যাকার বিষয়াদি আলোচনায় এলেও সাহিত্য সচরাচর আসেনি। প্রশাসন ক্যাডারের শহীদুল আর ট্রেড ক্যাডারের এই আমি স্বল্পবাক হবার কারণে আড্ডাবাজ হবার সুযোগ কম ছিল। শাহবাগের আকাশের নক্ষত্র চিনিয়েছিল শহীদুল অনেক রাত জেগেও। গ্রহ-নক্ষত্র নিয়ে তার আগ্রহ অপরিসীম, মার্কসের দ্বাঞ্জিক বস্তুবাদ প্রসঙ্গ মাঝে মাঝে তিনিই তুলতেন। বিশ্বজুড়ে তখন সমাজতান্ত্রিক জাগরণ তুঙ্গে। শহীদুল যে বামঁেঘষা তা ষ্পষ্টতঃই বুঝতে পারতাম। তবে সেটা যে সক্রিয় কোন সাংগঠনিক আবরণের নয়, তা-ও বোঝা যেতো।
'৮১ সালের ৩০ জানুয়ারি শহীদুল সহকারি সচিব হিসেবে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সড়ক ও সড়ক পরিবহন বিভাগে যোগ দেন। ৮৪ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সেখানে কর্মরত ছিলেন। এসময়ে আর দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি, '৮৪ সালের মার্চে বাণিজ্যমন্ত্রণালয়ে যোগ দেন সহকারী সচিব পদে। ছিলেন ৮৭ সালের ১ জানুয়ারি পর্যন্ত। ৮৭ সালের ২০ জানুয়ারি থেকে ৯১ সালের ৩১ জুলাই পর্যন্ত ছিলেন অর্থনৈতিক সম্পর্কবিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব। '৯১ সালের ১ আগস্ট থেকে ৯২ সালের ১৬ জুলাই পর্যন্ত ওএসডি থাকার পর পল্লী উন্নয়ন সমবায় বিভাগে (১৮/৭/৯২-২৯/৯/৯৪), সিনিয়র সহকারী সচিব, ৩০/১২/৯৫ পর্যন্ত সাভার বিপিএটিসিতে অপারেটিভ বিভাগের ডেপুটি ডাইরেক্টর ছিলেন। এরপর যোগ দেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে (২৫/৩/৯৯-১৪/৪/৯৯)। ৯৯ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত ওএসডি থাকার পর অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের উপসচিব পদে যোগ দেন (১৫/৪/৯৯-৭/১১/০১)। ২০০১ সালের ৮ নভেম্বর যোগ দেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক পদে। ছিলেন ২০০৩ সালের ২৬ আগস্ট পর্যন্ত।
যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতি পেয়ে ২০০৩ সালের ৩০ আগস্ট অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে যোগ দেন, ছিলেন ২০০৫ সালের ২৭ নভেম্বর পর্যন্ত। মাস খানেক ওএসডি থাকার পর অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি পেয়ে ২০০৫ সালের ২৬ ডিসেম্বর যোগ দেন টিসিবি'র চেয়ারম্যান পদে। ৬ মাস এই পদে থাকার পর ২০০৬ সালের ৩ মার্চ বীমা অধিদপ্তরের প্রধান বীমা নিয়ন্ত্রক পদে যোগ দেন। প্রায় ৪০ দিন এই পদে ছিলেন। এরকম একটি পদ যে আছে, তা জানা ছিল না। এই দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিয়ে তিনি ঐ বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর যোগ দেন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব পদে। ছিলেন ২০০৮ মাসের ৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। গত ১০ ফেব্রুয়ারি ভারপ্রাপ্ত সচিব হিসেবে যোগ দেন পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে।
১৯৫৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ঢাকায় জন্ম নেয়া শহীদুল হকের চাকুরীতে যোগদান ১৯৮১ সালের ৩০ জানুয়ারি। বাবা নুরুল হক এবং মা জাহানারা বেগমের জ্যেষ্ঠ সন্তানটি ৯১ ও ২০০১ সাল আমেরিকা ও ব্রিটেনে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়েছেন পরিকল্পনা ও সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে। ফরাসি ভাষা শিখেছেন ৯০ সালে। ফরাসি সাহিত্য পাঠের জন্য সম্ভবত। সে সময় নিয়মিত অলিয়ঁ ফ্রঁসেজে যেতেন এবং ফরাসি চলচ্চিত্রও দেখতেন। এ তথ্য তিনি নিজেই জানিয়েছিলেন।
৯০ সালে শহীদুলের সঙ্গে আকস্মিকভাবে দেখা গোড়ানে শ্বশুরালয়ে। ঐ দিন জানা গেল, তিনি আমার স্ত্রীর বড় বোনের বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী শুধু নন, শ্বশুরের এলাকায় বাড়ি। সেই সুবাদে তার বাবা-মায়ের সঙ্গে পূর্ব পরিচয় তাদের। ঢাকা কলেজের শহীদুল সেই থেকে আমার কাছে হয়ে গেলেন শ্বশুরবাড়ীর লোক। মাঝে মাঝে আমাকে ঠাট্টা করে 'জামাই বাবাজী' সম্বোধনও করেছেন। পারিবারিক অনেক অনুষ্ঠানে তার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হতো। শ্বশুর বাড়ীতেই শহীদুল জহিরের লেখা 'জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা' উপন্যাসটি প্রথম দেখেছিলাম। কিন্তু সেটি যে তারই লেখা, জেনেছিলাম অনেক পরে। যখন তিনি তার পারাপার গ্রন্থটি আমাকে উপহার দিয়েছিলেন। শহীদুলের বাসায় আমাদের কখনো যাওয়া হয়নি, তিনিই এসেছেন বিভিন্ন আমন্ত্রণে। এসে চুপচাপ থাকতেন। তবে সবার কুশলাদি জানতে চাইতেন। বেশির ভাগ সময় বইপত্র নাড়াচাড়া করেই কাটাতেন।
কর্মজীবনে ৬ বছর কানাডায় বাংলাদেশ হাইকমিশনে কর্মরত থাকা অবস্থায় কয়েকবার ফোনে তাঁর সঙ্গে কথা হয়েছিল; হয়তো সে সময়টায় তিনি আমার শ্বশুর বাড়ীতে কোন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বলেই। আমার শ্বশুর ৪ খানা বই লিখেছিলেন। ব্যাংকার জীবনের অবসরে সমাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। শ্বশুরের সাথে শহীদুল জহিরের সখ্যতা ছিল বলা যায়। শহীদুল হক তার লেখালেখি নিয়ে আলাপ করতে চাইতেন না। বরং অনেক সময় নতুন কিছু লিখছেন কিনা জানতে চাইলে মৃদু হেসে বলতেন, এই আর কি। আমার সঙ্গে চাটগাঁর ভাষায় কথা বলাটা ছিল তার সহজাত।
হয়তো শহীদুল হক কিংবা শহীদুল জহির নেই। হয়তো আছেন, হয়তো ঘুমিয়ে আছেন, হয়তো আছেন সতীর্থ, সহকর্মী, সহমর্মী, সহযোদ্ধাদের মনে এবং দীর্ঘদিন জুড়ে থাকবেন পাঠকের মনে অন্য আলোড়নে। সতীর্থের পুরাণ কাহিনী শেষ হবার নয়। মানুষের হৃদয়ে-মননে, চিন্তায় নবজাগরণে আরো বেশি আলোড়িত হবেন শহীদুল জহির। ছিলেন যিনি আমাদের সতীর্থ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন