বুধবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০১৪

'পেদ্রো পারামো' এবং 'জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা'- পুনর্পাঠ

সালমা বাণী


সাধারণত আমরা উপন্যাস বলতেই ভাবি, কোনো একজন ঔপন্যাসিক বা লেখক শুধু তার কল্কপ্পনা থেকে তুড়ি মেরে বের করে আনেন ঘটনা পরিবেশ চরিত্র আর সেসবের পশ্চাৎপট। 'জীবন ও রাজনৈতিক বাস্টস্নবতার' কোথাও যেন উপন্যাসের সেই ব্যাপারটি নেই। নামের ভেতরই যেন এই ছোট্ট উপন্যাস বা নোভেলার বাস্টস্নবতা, যা নোভেলার পুরোটা জুড়ে ম্যাজিকের মতো রুদব্দশ্বাসে আবর্তিত হয়েছে। ইতিহাসের পাতা থেকে তুলে আনা- বাংলাদেশের স্ট্বাধীনতা যুদেব্দর আগে ও পরের কাহিনী।
সময়ের ত্রক্রম, বিভিল্পম্ন স্টÿান এমনকি ঘটনাগুলো পর্যন্স্ন বাস্টস্নবের সমান্স্নরাল আরেক বাস্টস্নবের নির্মিতি। পাকিস্টস্নান আর্মি, গোলাম আযম তার গং, স্ট্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের মাটিতে রাজাকারদের পুনর্বাসনে দেশের অভ্যন্স্নরের চত্রক্রান্স্ন, এই চত্রেক্রর শক্তিসঞ্চারে বাধাদানে সমষ্দ্বিগত মিলনের অভাব; এসবই এই নোভেলার। ভিতরগত মহৃল সুর। এ নোভেল যেন ঐতিহ্য পুনর্নির্মাণের নতুন ধাপ। পিছিয়ে পড়ার ভাবনায় আমরা যারা সারা পৃথিবীর লেখার খোঁজ করে বেড়াই, বেশিরভাগ তারাই কিন্তু নিজের বাড়ির খোঁজ রাখি না। তারাই সবসময় নিজেদের নন্দনচিন্স্নাকে পরখ করে দেখতে চাই পাশ্চাত্যের চোখ দিয়ে, এটাই পহৃর্বকাল থেকে শিখে এসেছি, কারণ আমাদের উপন্যাসের সচল ধারাটি বগ্ধিকম বাবুর হাত দিয়ে এসেছে, নকশার যে নিজস্ট্ব ধারা তার আদল আখ্যানে ব্যবহৃত হয়নি তেমন, পশ্চিমি আদলে স্ট্বদেশি মাটিতে চেরি ফলের আবাদ দোষের তেমন নয় যদি খাদ্যগুণসল্পম্ন হয়। একে অস্ট্বীকার করার র্ঙ্ধা এত দিনে আমরা হারিয়ে ফেলেছি। তবে অস্ট্বীকারের কথা বলছি না, বলছি নিজেদের চেনার কথা, আত্মôপ্রত্যয়ের কথা।এই লেখায় আমিও পশ্চিমি কোনো উপন্যাস না নিয়ে লাতিন আমেরিকার একটি ছোট উপন্যাসের তুলনা টেনেছি, পাঠক প্রধানত ধরতে পারেন, আত্মôপ্রত্যয়ের অভাব, ঔপনিবেশিক মানসিকতা, পঠন-পাঠন দেখানোর ভান অথবা এই উপন্যাস আলোচনায় পহৃর্ববর্তী বাংলা উপন্যাসের কোনো প্রতিতুলনা বা সাদৃশ্য ও স্ট্বাতন্প্য চিহিক্রত করার মতো কিছু পাইনি বলে। যাই ভাবুন, 'জীবন ও রাজনৈতিক বাস্টস্নবতা' নিয়ে 'কালের খেয়া'র সাদক কবি মাসুদ হাসান যখন লিখতে বললেন, তখন প্রথম 'পেদ্রো পারামো'র কথাটিই মনে পড়ল; শহীদুল জহিরের জাদুবাস্টস্নবতা আর হুয়ান রুলফোর জাদুবাস্টস্নবতা একেবারেই এক নয় যেমন, তেমনি সাদৃশ্যও কিছুটা পরিলক্ষিত হয়। লাতিনিকরণ করে যারা শহীদকে হেয় করতে চান, তাদের পাঠ-অভিজ্ঞতার প্রতি শ্রদব্দা হারাই তখনই, যখন দেখি শহীদুল যে আপন ভুবন তৈরি করেন তার লেখায় তা একান্স্নই আমার স্ট্বদেশি যার অস্টিস্নত্ম্ব আমার মাটির শিকড়ে প্রোথিত। তাই শহীদুলকে পড়তে গিয়ে পেদ্রো পারামোর মতো অমন ছোট্ট উপন্যাস আবার পড়তে শুরু করি, যে উপন্যাসের চরিত্রেরা সব মৃত, তাদের স্ট্বদেশ ভাবনা চরিত্রদের কথোপকথন ও ভূ-মানচিত্র বাংলাদেশের স্ট্বাধীনতাকালীন সময়কেই মনে করিয়ে দেয়, মেক্সিকো ও বাংলাদেশ আমার কাছে একাকার হয়ে যায়, সময়হীন সময়ের মধ্যে চেনা-অচেনা এক রূপ-বাস্টস্নবতায়। তখনই 'উপন্যাসের নন্দন' প্রবল্পেব্দর কথা মনে আসে, যেখানে দেবেশ রায় ষ্দ্বই যে চিন্স্নার সহৃত্রের কথা বলেন, 'নন্দনচিন্স্নার নতুন সহৃত্র কখনোই তৈরি হয়ে উঠতে পারে না। নিজের ভাষার সৃষ্দ্বি বৈচিত্র্যের নতুন নতুন গভীর স্টস্নরের ভিতর ঢুকে যেতে না পারলে··· যখনই কোনো দেশে নন্দন আলোচনার নতুন সহৃত্র তৈরি হয়, তখনই সেই দেশের বা ভাষার শিল্কপ্পসাহিত্যের এক নতুন পাঠ আমরা পাই। শিল্কপ্প সাহিত্যকে অনিবার্যতই স্টÿানিক ও সাময়িক হতে হয়- দেশকালের দ্রাঘিমা-অক্ষাংশে সে এমনই বাঁধা। সেই স্টÿানিকতা ও সাময়িকতাকে বিশ্বজনীনে নিয়ে আসাটাই নন্দনসহৃত্রের প্রধান বা হয়তো একমাত্র কাজ। গ্রিস দেশ ছাড়া গ্রিক নাটক হতো না, গ্রিক নাটক ছাড়া অ্যারিস্দ্বটল হতেন না···'। এই যে 'অনিবার্যতাই স্টÿানিক ও সাময়িক'- কথাগুলো শহীদুল জহিরের সাতচল্ক্নিশ পাতার এই নোভেলা 'জীবন ও রাজনৈতিক বাস্টস্নবতা'য় গভীরভাবে পরিম্ফুট। যা কি-না সঠিক অনুবাদ হলে স্টÿানিকতা ও সাময়িকতাকে ছাড়িয়ে বিশ্বজনীন হয়ে উঠবে, কারণ মহান মুক্তিযুদব্দ নিয়ে এমন ছোট্ট পরিসরে আর কোনো মহৎ কর্ম বাংলা সাহিত্যে খুঁজে পাওয়া দুষ্ফড়্গর, এখানে কোথাও লাতিনিকরণের দোহাই দিয়ে পার পাওয়া যাবে না। কিংবা ছোট করা যাবে না এমন মহৎ কর্মকে। আমি মনে করি, জীবন ও রাজনৈতিক বাস্টস্নবতা আমাদের স্ট্বাধীনতার ইতিহাসের সবাক দলিল। স্ট্বাধীন বাংলার মাটিতে সাধারণ ক্ষমা ঘোষিত হয়েছিল এদেশের স্ট্বাধীনতার স্টÿপতির মুখ দিয়ে। সেই স্ট্বাধীন দেশে বার বার হয়েছে ক্ষমতার পট পরিবর্তন। ঘটনাত্রক্রম এবং কালপঞ্জি- নিয়ে যেমন নিপুন ভাবে খেলা করেন হুয়ান রূলফো, আলোহো কার্পেন্স্নিয়ের, গার্সিয়া মার্কেজের তেমনি নিপুন খেলা খেলতে চেষ্দ্বা করেছেন, শহীদুল জহির। অনেকাংশেই সার্থক হয়েছেন, স্ট্বদেশের মাটিতে পারস্যের গোলাপের চাষ যেমন আপনার হয়েছিল এদেশে, তেমনি তিনি যোগ্যতার সাথে ম্যাজিক ও বাস্টস্নবতাকে প্রথম রোপন করেন বাংলায়। সদ্য স্ট্বাধীন শেকড়-বাকড় উপড়ানো একটা দেশ যেখানে প্রতিদিন ক্ষমতালোভীদের লড়াই, আচল্ফ্বিতে খেয়াল খুশি ইচ্ছামত হঠাৎ অভ্যুত্থান এ সবকিছুই লাতিন আমেরিকার চাইতে কোনো অংশে কম নয়, চিত্র আর বাস্টস্নবতার রূপটি হয়ত কিছুটা ভিল্পম্ন। হাত ধরে ক্ষমতালোভীরা পুনরায় সঙ্গী করে স্ট্বাধীনতা বিরোধীদের আর বিকলাঙ্গ করেছে স্ট্বাধীনতা ফসল- সেটা ছিল একাত্তর সনের ডিসেল্ফ্বর মাসের একত্রিশ তারিখ। কিন্তু দু'বছর পর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হলে বদু মওলানা যখন লক্ষ্মীবাজারে ফিরে আসে মহলল্‌গার লোকেরা তার গায়ে পুনরায় পপলিনের ধহৃসর সেই আলখালল্‌গা দেখতে পায়। পুনরায় ফিরে আসার পর প্রথম দিনে সে মহলল্‌গার সকলের সঙ্গে বিনীতভাবে কুশল বিনিময় করে, সে একাত্তর সনে মহলল্‌গায় নিহত আট ব্যক্তির পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে যায়। মহলল্‌গার লোকেরা পরে তাদের এই বিশ্বাসের কথা বলেছিল যে, এই দুঃসাহসিক কাজের দ্বারা আসলে সে সাতটি ক্ষতচিহক্র পরীক্ষা করতে চেয়েছিল মাত্র। তখন সেই মঙ্গলবারের অপরাহেক্র আবদুল মজিদ তাদের প্রাঙ্গণের ফটকের কাছে কামিনী গাছতলায় বদু মওলানাকে বিনীত ভাবে দাড়িয়ে থাকতে দেখে। কেমন আছো তোমরা? এই প্রশ্নের ভেতরকার পরিহাস এমন নিদারুণ ছিল যে, নিজের বাড়ির প্রাঙ্গণের ভেতর তা শুনে এবং বদু মওলাকে দেখে আবদুল মজিদ বাক-রহিত হয়ে থাকে। এই আবদুল মজিদ যদি হয় আমাদের এই স্ট্বাধীন ভূখণ্ড তাহলে এই ভূখণ্ড তার সাত বীরপ্রতীকের রক্তের দাগ শুকানোর আগেই প্রত্যক্ষ করেছিল স্ট্বাধীনতাবিরোধীদের সদর্প আগমন। সামাজিক আর রাজনৈতিক টানাপড়েনের তীব্রতাকে জীবন্স্ন করে তোলার জন্য বাস্টস্নব রূপায়ণের মধ্যেই ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে কী অদ্‌ভুত সব কিল্ফ্‌ভূত কাল্কপ্পনিক সব উপাদান, যা আমার পাঠক হৃদয়ে লেখকের মতোই স্ট্বতোৎসারিত, স্ট্বতঃস্টম্ফূর্তভাবে আবর্তিত হয়েছে। লাতিন আমেরিকার জনপ্রিয় উপন্যাসের ধারায় লিখিত আপাত মনে হলেও শহীদুল জহির বাস্টস্নবে কল্কপ্পনার মিশেল দিয়ে রচনা করেছেন এক নতুন ভূখÐের নতুন শিল্কপ্পধারার ইতিহাস। যা তার পহৃর্বসহৃরি ওয়ালীউল্ক্নাহর রচনাতেও আবাস মেলে, বিশেষ করে 'কাঁদো নদী কাঁদো' উপন্যাসের প্রথম কয়েক পৃষ্ঠায়। হুয়ান রুলফোর 'পেদ্রো পারামো'র কোমালা, গার্সিয়া মার্কেজের 'এক শ' বছরের নিঃসঙ্গতায়' যে জনপদের পত্তন হলো, তা ওই সকল লেখকদের মায়া-কল্কপ্পনারই সৃষ্দ্বি, নতুন ইতিহাস বা ঐতিহ্য। কেননা লাতিন আমেরিকার কোথাও কোমালা বা মাকোন্দো নামে কোনো গ্রাম বা শহর নেই। আমাদের যেমন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ট্বপেম্নর দ্বীপ ময়নাদ্বীপও নেই বাংলাদেশের কোথাও। কিন্তু শহীদুল জহিরের নবাবপুর, লক্ষ্মীবাজার সব তো আমাদের অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যত ইতিহাসের কেন্দ্রে বিদ্যমান। তবে গার্সিয়া মার্কেজের মতো শহীদুল জহিরও শেষ পর্যন্স্ন এসে পৌঁছেছেন ইতিহাসেরই এক সজীব সংজ্ঞার্থে। মহল্ক্নার প্রতিটি বালক এবং বালিকার কাছে, পুরুষ এবং রমণীর কাছে যেন এই প্রথম উঞ্ছঘাটিত হয়েছিল যে, জগৎ সংসারে একটি ব্যাপার আছে যাকে বলে বলাৎকার। তারা আজীবন যে দৃশ্য দেখে কিছু বোঝে নাই, যেখানে একটি মোরগ তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় মুরগিকে; মহল্ক্নায় মিলিটারি আসার পর তাদের মনে হয়েছিল যে, প্রাঙ্গণের মুরগির মতো তার মা এবং কিশোরী কন্যাটি, পরিচিত ভালোবাসার স্টপী, তাদের চোখের সামনে প্রাণভয়ে এবং অনভিপ্রেত সহবাস এড়ানোর জন্য ছুটে বেড়াচ্ছে··· পাকিস্টস্নানি মিলিটারি এক ঘণ্টায় বিশ লক্ষ বছর ধরে মানুষের বুনে তোলা সভ্যতার চাদর ছিঁড়ে ফেলে এবং লক্ষ্মীবাজারের লোকেরা তাদের মহল্ক্নায় মানুষের গুহাচারিতা হাজার এবং লক্ষ বছর পর এক মর্মান্স্নিক অক্ষতম পুনরায় অবলোকন করে। শহীদুল জহিরের এই উপন্যাস পড়লে বোঝা যায় কতটা ক্ষোভ, কত ঘৃণা লালিত হয়েছে ঔপন্যাসিকের গভীর মননে। এই উপন্যাসের পটভূমি হলো স্ট্বাধীনতা যুদেব্দর পটভূমি এবং যুদেব্দাত্তর দেশে রাজাকারদের সদল্ফে্‌ভ পুনর্বাসন এবং ক্ষমতায়ন। এটা সল্ফঙ্হৃর্ণভাবে একটি খোলামেলা রাজনৈতিক উপন্যাস, পোস্দ্বমর্ডানিজমকে পাত্তা না দিয়ে এটা নিঃসংকোচ বাস্টস্নবের আখ্যান। কিন্তু আশ্চর্য তা আবার রাজনৈতিক ইশতেহারও হয়ে ওঠেনি। পরতে পরতে মিশে আছে স্ট্বপম্ন এবং প্রেম, সা্রদায়িকতা এবং মানবজীবনের হতাশা। এ তো জাদুবাস্টস্নবতা নয়, বাস্টস্নবের জাদুস্টিè্নয়া। ইতিহাস, বাস্টস্নব আর স্ট্বপম্ন সময় সব মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়ে উপন্যাসটি পরিণত হয়েছে বাস্টস্নবের পরপারে কোনো অধিকতর বাস্টস্নবে, সময়ে। স্ট্বল্কপ্প পরিসরে মাত্র কয়েকটি লাইনে একেকটি চরিত্রকে দৃঢ়ভাবে দাঁড় করিয়ে দেওয়ার বাহাদুরি ও জাদুকরি খেলা খেলেছেন শহীদুল জহির। কোন চরিত্রটি প্রধান হয়ে উঠবে, সেটা বোঝার আগেই আরেকটি চরিত্রকে প্রধান করে তোলেন অর্থাৎ সেই চরিত্রের ক্ষণিক উপস্টিÿতি কতটা গুরুত্ম্বপহৃর্ণ অথবা সেই চরিত্রের মুখ দিয়ে বের হয়ে আসা বাক্যাবলি বহন করে উপন্যাসের বিশদ তাৎপর্য- উপন্যাসটিতে ঘটনার বাস্টস্নবতার সঙ্গে বর্ণনার জাদুবাস্টস্নবতা এক নতুন মাত্রা এনে দেয়- যা ট্র্যাডিশনাল ইউরোপীয় উপন্যাসের ধারাকে ভেঙে চুরমার করে দেয়, যার ফলে বগ্ধিকমচন্দ্রের হাতে তৈরি হওয়া বাংলা উপন্যাসে অভ্যস্টস্ন লেখকরা কিছুটা বেকায়দায় পড়তে পারেন।পেরুর লেখক মারিও ভার্গাস য়োসা, ১৯৬৭ সালে ভেনেজুয়েলার কারাকাসে লাতিন আমেরিকার সবচেয়ে কাগ্ধিক্ষত ও সল্ফôানিত সাহিত্য পুরস্টড়্গার 'রোমুলো গাইয়োগাস' গ্রহণের সময় তার ছোট্ট ভাষণটিতে স্টষ্দ্ব করে বলেছিলেন, সাহিত্য হলো 'আগুন'। কেননা সাহিত্যের আছে দুটি অঙ্গীকারঃ এক তার শিল্কেপ্পর কাছে, শিল্কপ্পী তার কাছে; আর দুই মানুষের কাছে, সমাজের কাছে, দেশের কাছে। এ আগুন সারাক্ষণ স্ট্বয়ং সাহিত্যিককেই পোড়ায়; কিন্তু অন্য আগুন পোড়ায় সমাজ ও রাজনীতির যত অন্যায়, যত জঞ্জাল। শিল্কেপ্পর আর জীবন দর্শনের জ্বলন্স্ন শিখা- শহীদুল জহিরের রচনায় দপদপ করে জ্বলে উঠেছে- 'থুক দেই থুক দেই থুক দেই মুখে।' বদু মওলানা জানে আবদুল মজিদরা একাত্তরের নয় মাসের কথা ভোলে নাই। হুয়ান রুলফোর পেদ্রো পারামোকে যেমন বলা হয় মেক্সিকোর আত্মôা থেকে বেরিয়ে আসা অনন্য উপন্যাস, তেমনি জীবন ও রাজনৈতিক বাস্টস্নবতা হলো বাংলাদেশের অভ্যুদয় থেকে বেরিয়ে আসা অনন্য নোভেলা। পেদ্রো পারামোর চেয়েও ছোট্ট নোভেলা জীবন ও রাজনৈতিক বাস্টস্নবতা- মাত্র আটচল্ক্নিশ পাতার এই নোভেলার প্রতি বাক্যের শরীরজুড়ে জ্বলজ্বল করছে চাপা বিদ্বেষ। হুয়ান রুলফো আশ্চর্য দক্ষতায় থামিয়ে দেন চরাচরকে, আর শহীদুল জহির সেই দক্ষতার উত্তরসহৃরি হয়ে জাগিয়ে তোলেন রায়েরবাজারের বধ্যভূমিকে। মোমেনাকে আবদুল মজিদ চার দিন পর খুঁজে পায় রায়েরবাজারের পশ্চিম প্রান্স্নে, বুড়িগঙ্গা নদীর কিনারায়, বালুচরের মতো দেখতে এক মাঠের ওপর। আবদুল মজিদ এখন বুঝতে পারে না এই চার দিন তার আদৌ সংজ্ঞা ছিল কি-না। তার এখন শুধু মনে পড়ে খুঁজে খুঁজে সে যখন মোমেনাকে পায় সেই সময়টিকে। সে তখন তার বোনকে দেখে- তার একটি কেটে ফেলা, পেট থেকে ঊরু পর্যন্স্ন ক্ষতবিক্ষত, ডান ঊরু কোমর থেকে হাঁটু পর্যন্স্ন চিরে তরমুজের মতো হাঁ করে রাখা।নির্যাতনের এই চিত্র প্রত্যক্ষ করতে করতে পাঠকের দম বল্পব্দ হয়ে আসবে অপরদিকে যুদব্দবন্দি মানুষদের মতো আরেক মোমেনা এদিকে প্রতিনিধিত্ম্ব করে লক্ষাধিক নির্যাতিত নারীর। লক্ষ্মীবাজারের লোকদের মনে পড়ে একাত্তর সনে বদু মওলানা নরম করে হাসত আর বিকেলে কাক ওড়াত মহলল্‌গার আকাশে। এক থালা মাংস নিয়ে ছাদে উঠে যেত বদু মওলানা আর তার ছেলেরা। ··· একটি অদেখা মেয়ের জন্য লক্ষ্মীবাজারের এক বিষণ্ন বৃদেব্দর হৃদয় সেদিন ভেঙে পড়ে। এখন তার বাড়ির আঙিনায় তার নিজের আর তার বড় ছেলের জোড়া কবর। অন্য আরেকটি টুকরো পড়েছিল জমির ব্যাপারীর বাড়ির কুয়োতলায়, বিকেলে ভাতের চাল ধোয়ার সময়, হাঁড়ির ভেতর। এটা ছিল একটি কাটা পুরুষাঙ্গ। হাঁড়ির ভেতর এসে পড়তেই জমির ব্যাপারীর কিশোরী কন্যাটি চমকে উঠেছিল, কিন্তু হাঁড়ির ভেতর থেকে বের করে এনে সে বস্টçটি চিনতে পারে নাই।ছোট্ট একটি উপন্যাসের পুরোটা জুড়েই হত্যা-খুন, অত্যাচার-নিপীড়ণের চিত্র দু'পাড় ভাঙা খরস্রোতা নদীর মতো বয়ে যাচ্ছে। রাজাকার আর পাকিস্টস্নানি আর্মিদের এই নির্যাতন থেকে যেমন রেহাই পাইনি নারী, পুরুষ, উভয়লিঙ্গ; রেহাই পায়নি তেমন বাড়ির পোষা প্রাণী কুকুর পর্যন্স্ন। নবাবপুর এবং লক্ষ্মীবাজারের বিধ্বস্টস্নরূপ হয়ে ওঠে সারাবাংলা। আমাদের সমস্টস্ন ইন্দ্রিয়ের মধ্য দিয়ে তা ত্রক্রমাগত জীবন্স্ন হয় যে, এর সব পরিবেশ আষ্দ্বেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে পাঠককে। আমরা যেমন শিউরে উঠি, তেমনি আমরা দেখতে পাই আমাদের নড়বড়ে অস্টিস্নত্ম্ব। যুগপৎভাবে ভয়গ্ধকর নয়, মারাত্মôক হিংস্র অনুপুগ্ধখ গল্কপ্প সৃষ্দ্বি করেছে শহীদুল জহির আশ্চর্য দক্ষতায় গল্ফ্‌ভীর প্রখর অথচ সহজ, অনায়াস, স্ট্বতঃস্টম্ফূর্ত ভঙ্গিমায়; মনেই হয় না যে কোথাও একটা প্রখর শিল্কপ্প বোধ কাজ করে যাচ্ছে। কাটা কাটা, চাঁছাছোলা, নিরাসক্ত, নির্বিকার ভাষা, বাস্টস্নব রূপদানে বাস্টস্নবতার জাদুকরি মিশেল অথচ এই মায়া আখ্যানেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। কোথাও বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া বয়ান তিনি দেননি বরং বোঝাতে চেষ্দ্বা করেছেন এবং পেরেছেন কিসের ব্যঞ্জনা তৈরি করতে চাচ্ছেন। আর নয়তো কুয়াশার পর্দার মতো হয়ে ওঠে আখ্যানেরই কেন্দ্রীয় চিত্রাভাস। বোঝাই যায় না কী কঠোর শ্রমে ঘষে ঘষে অতিরিক্ত বোঝা ফেলে দিতে দিতে এই ঊনকথনের ভাষা তিনি আয়ত্ত করেছেন। কোনো অলগ্ধকার যেন নেই কোথাও; কিন্তু পার্ট পার্ট নিভাঁজ সজ্জিত, ভয়ানক বাস্টস্নব হয়ে উঠতে তার গা কাঁপে না। তার চিত্রকল্কপ্প স্টÿানিক বৈশিষ্দ্ব্যে ভরপুর- ত্রক্রমাগত নবাবপুর, লক্ষ্মীবাজার একটি যুদব্দবন্দি মহল্ক্না- মহল্ক্নার ভেতরের দুঃসহ অসহায় বন্দি মানুষ, পরিবেশ, তুলসীগাছ, কাক, উইপোকা, হাজামের ক্ষুর, কর্তিত পুরুষাঙ্গ- ব্যাপ্টস্ন হতে হতে পরিব্যাপ্টস্ন হয় একটি ভূখÐে, একটি মানচিত্রে। কিন্তু কল্কপ্পচিত্র কখনো গায়ের জোরে আখ্যানের ভেতর ঢুকে পড়ে না- সে হয়ে ওঠে ইঙ্গিত বা ব্যঞ্জনার অংশ অথবা একান্স্ন সঙ্গী। আমরা আমাদের সমস্টস্ন ইন্দ্রিয়ের মধ্য দিয়ে তাই অনুভব করি- দীর্ঘ একটি যুদেব্দর তাবৈ। ঠাwৈ মাপা মাপা নিরাভরণ গদ্য- বাস্টস্নবতার জাদুতে মোড়ানো এই ঐতিহাসিক উপন্যাস একদিন হয়ে উঠবে আমাদের আত্মôানুসল্পব্দানের ইতিহাস, যার শেকড় প্রোথিত কঠিন বাস্টস্নবের ভেতর। এ কারণেই এটা জীবন ও রাজনৈতিক বাস্টস্নবতা। আমরা জানি যে কোনো ভালো লেখাতেই সে লেখা কীভাবে পড়তে হবে, তার চাবিটাও লুকিয়ে থাকে। শহীদুল জহির চেয়েছেন, তার পাঠকরা তার উপন্যাসের চরিত্র হয়ে অংশগ্রহণ করুক। বাক্যের পর বাক্য ভেঙে বিশেল্‌গষণ করে পাঠকরা বের করে নেবেন এর মহৃল শাঁস, যেহেতু নোভেলার কোনো প্রচলিত গড়নও মানা হয়নি এই নোভেলা বা ছোট্ট উপন্যাসে। এ এমন এক নোভেলা, যেখানে লেখক নিজে অনুপস্টিÿত থেকে বলে যাচ্ছেন পাঠককে কী করতে হবে আর তা না হলে তাকে আপাতত বদলাতে হবে তার ঠিকানা। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন