বৃহস্পতিবার, ১৩ নভেম্বর, ২০১৪

অনিকেত

খোরশেদ আলম
একটা ট্যাকা কল্লে পরে দান,
দয়াল পয়গম্বর উম্মতেরে কইরা নেবেন পার।
ও ভাই একটা ট্যাকা কল্লে পরে দান,
দয়ার রহমান
নবীজীর উম্মতেরে কইরা দেবেন পার।
বেশ সুরেলা কণ্ঠে গান গেয়ে ‘ওভাইও, কি বোনও’ বলে বলে ভিখ মাগছে ছইফুদ্দিনের বউ। একটি সন্তান ডানহাতের বাহুতে আংটার মত আটকানো। জীর্ণ শীর্ণ হলে কি হবে তবু একটা ওজন তো আছেই। শিশুটির মাথা মায়ের ঘাড়ের ওপরে শোয়ানো। চোখ পিটপিট করে তাকাচ্ছে মেলায় আসা দর্শনার্থীদের দিকে। সদ্য ঘুম থেকে উঠেছে, চোখ কচলানোর ভাবটা এখনো যায়নি।

প্রায় একদুপুর বেলা মায়ের ঘাড়ের ওপরেই শুয়ে কাটায় মইরুদ্দি। মইরুদ্দির পেছন দিকটায় হাত রাখতে গিয়েও ঝুলে ঝুলে পড়ে কখনো। এখনো হাঁটতে শেখেনি তাই এ বিপত্তি। নইলে ছকুলুদ্দি আর কছুরুদ্দির মত ঢ্যাংঢ্যাং করে কানা বাপের সামনে দিয়ে দিয়ে সেও চলত। আর কদিন পরে তারও ছেড়া প্যান্টের ফাঁক দিয়ে নুনু বেরিয়ে পড়তো। তখন হাতে একটা কদমা থাকত। আর কয়েক সেকেন্ড পরপর কদমাটা চেটেচেটে খেত।

তিন তিনটে ভুখা নাঙ্গা হাড্ডিসার পিঁপড়ার মত সারি দিয়ে চলবে কয়েকদিন পরেছমিরন দেখতে পায়। ভিক্ষার মুখগুলো সম্প্রসারিত হলে আয়ও বাড়বে। বড়টা অর্থাৎ কছুরুদ্দি ওর কানা বাপের হাত ধরে থাকে। কখনো এর অন্য খেয়ালও জাগে। ছকুলুদ্দির হাতটা কখন বাপের হাতের মুঠোয় দিয়ে ফস করে সরে যায়। একা একা ভিক্ষা করার মজাটা সে এর মধ্যেই রপ্ত করে ফেলেছে। বেশ সুর দিয়ে চিকন মিহি গলায় আওয়াজ তোলে,
দানোকারীর পিতামাতা আল্লা সুখে রাখো কবরে।
নূরের টুপি মাথায় দিয়া আল্লা উঠাইবেন কাল হাশরে।।
ময়লা সাদা কাপড়ে ঢাকা একটা টেবিল। একটা মাইক বাজছে খনখন করে। রাস্তার যাত্রীদের দান পাবার ওসিলা। চেয়ারে বসা শুলকা দাড়িঅলা লোকের মুখে এই দানশ্লোকটি মনোযোগ দিয়ে শোনে কছুরুদ্দি। এবার নকল করে নিজে দুই একদিন প্র্যাকটিস করে নিজের গলার ক্ষমতা টের পায় সে। তখন থেকেই বাপের হাত ফাঁকি দিয়ে আশেপাশে ঘুরে এসে নিজের পেটে দানাপানিটা পড়লে বীরত্বের ভাবটা খিঁচিয়ে ওঠে তার মধ্যে। তখন বাপ-মা কাউকে তোয়াক্কা করে না সে। না দিলু ভাত মুই গেনু দারিয়াপুরের হাটত।একথা মুখ দিয়ে বের করে ভাঙা থালা ঝনাৎ করে ফেলে দেয় সে।

ছমিরনের গলাটা কয়েকদিন ভাঙা। তাই জুত মতো সুর তুলতে পারে না। ওদিকে কছুরুদ্দিকেও পাওয়া গেল না। ওকে পেলেও মায়ের ভাঙাগলাটার একটা সুরাহা হয়। কিন্তু মেলার ভিড়ভাট্টার মধ্যে মার্বেল খেলার একটা বাকসো তাকে আটকে রাখে।

কয়েকদিন থেকে ওকড়াবাড়ির মেলা হচ্ছে। স্থানে স্থানে সামিয়ানা টাঙিয়ে টুঙ্গিঘরের মত একেকটা জায়গায় বিশেষ বিশেষ ধরনের খেলা। কোনোটায় লোহা দিয়ে বানানো গোলাকৃতি রিং খেলা। একেকটা সাবান, আলতা,স্নো, পাউডার, সাবান, বিড়ির প্যাকেট দখল করতে হবে রিং ফিকিয়ে ফিকিয়ে। লাগ ভেলকি লাগ চোখে মুখে লাগ। আমার মুখে না লাগিয়া উয়ার মুখে লাগ। সাপুড়ে সাপ বের করছে তার ঝাঁপি থেকে। লুডুর মত বিশাল বিশাল বড় বড় ছক্কাগুটি দিয়ে ফড় খেলা। একমুখ খোলা লুডুর ছোট গোল কৌটার বৃহৎ সংস্করণ বিরাট কৌটাও আছে সঙ্গে। গুটির গায়ে রং করা নোকতার হিসেবে বাজি জেতা।

কিন্তু এসবকে ছাড়িয়ে কছুরুদ্দির দৃষ্টি মার্বেলের মেশিনটার দিকে। যন্ত্রের মধ্যে একেকটা রাস্তা আঁকাবাঁকা। সেই পথ বেয়ে একটা মার্বেল গড়িয়ে পড়বে নিচের দিকে। যদি বাকসের ভেতরে পড়ে যায় তাহলে দুই টাকার দান হার। আর যদি সম্পূর্ণ বাইরে পড়ে তাহলে দুই টাকার দানের জিত। কছুরুদ্দির সামনেই বেশ কজন দুই টাকার করে দান জিতে নিল। সে প্রথমে কিছুক্ষণ ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করল। নিজের মনে মনেই দুই চার ছয় আট করে করে একখানা ষাটগম্বুজ মার্কামারা দশ টাকার নোট ফড়ফড় করে তার পকেটে নড়ে উঠল। 

কছুরুদ্দির তাড়া সইল না। পুরা দুনিয়াটা তার হাতের মুঠোয় পাওয়া নির্ভর করছে ওই একখান দশটাকার নোটের ওপর। তারপর হাতের কোচর ভরে সাজ, বাতাসা, চিনির হাতি, গুড়ের ঘোড়া বাড়ির পথে চালান হলে মন্দ হয় না। কদমাটায় আর কয়েক সেকেন্ড পরপর চাটা দেয়া নয়। একবারেই দুইপাটি দাঁতের ভেতর সেধিয়ে কড়মড় করে চিবিয়ে খাওয়া। যাওয়ার সময় একটা ব্যাগ ভরে মইরুদ্দিসহ সবার জন্য গুড় মাখানো খোরমা, জোয়ারের খই আর ছয় আঙুল লম্বা ইয়া মোটামোটা পাক দেওয়া ‘কানমুচরি’ সঙ্গে নেওয়া। জিভে পানি এলে সুরুৎ করে পেছন দিকে একটা টান মেরে গলায় ঢুকিয়ে দেয় সে।

এবার মার্বেল একটা হাতে তুলে নেয় কছুরুদ্দি। মার্বেলটা ছাড়তে যায়। তাগ বসিয়ে চোখ দুটো সরু করে ভ্রুটা যতটা কুচকানো দরকার তারও চেয়ে বেশি কুচকে মার্বেলটা ছেড়ে দেয়। মার্বেলের গতিপথে শকুন চোখের মত নিশানা রাখে সে। কিন্তু বিধিবাম হয়ে মার্বেলটা পড়ে যায় বাকসের ভেতরে। কছুরুদ্দির ভিক্ষায় পাওয়া ছয় টাকার মধ্যে দু টাকা উধাও হল নিমিষেই। 

বাইরে থেকে সে খেলাটাকে যতটা ছেলেখেলা মনে করেছিল, আসলে তা নয় বুঝতে পারে। মাথার ভেতর তার চিনচিন করে ওঠে। সেই সকাল থেকে চেয়ে-চিন্তে টাকা ছয়টা যোগাড় করা। জেদ চেপে বসে তার। আবার মার্বেল নিয়ে ছু মন্তর ছু বলে ছেড়ে দেবার ভান করে। আবার সামলে নিয়ে তাগ লাগাতে যায়।
ঐ চ্যাঙরা বেশি ক্যারামতি দ্যাখাস নে। খেলবার আচ্ছিস তাড়াতাড়ি মার্বেল মার। মার্বেল খেলার যন্ত্রের মালিক রাগত স্বরে বলতে থাকে।

ভিড়ের মধ্যে ঝুঁকে পড়ে যেই মার্বেলটির গতিপথ ঘুরতে থাকে অমনি তার ভেতরে আশার আলো ঝলক দিয়ে ওঠে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আবার বাকসের ভেতরেই পতন।
দে চ্যাংরা তাড়াতাড়ি, দুই ট্যাকা বাইর কর, বাইর কর তাড়াতাড়ি।

কছুরুদ্দি পকেটে হাত দেয়। কিন্তু কি সর্বনাশ পকেটে তার যে একটা কানা পয়সাও নেই। প্রচণ্ড ভীড়ের মধ্যে সে যখন খেলার নেশায় উন্মাতাল তখনি কেউ একজন পকেটে হাত চালিয়েছে। কছুরুদ্দি হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। এদিকে মার্বেলঅলা চিৎকার করছেঢঙ করিস্ ন্যা কয়া দিল্যাম, ট্যাকা ফ্যালা, ট্যাকা ফ্যালা। জিতিয়্যা.. মোরে ট্যাকা নিবার মতলোব কচ্চিলু। এটি বসি থাক্। ইঞ্জিলখ্যান ধরি থাক বিকাল ব্যালা পজ্জন্ত।

কছুরুদ্দির পুরো দিনটাই মাঠে মারা যায়। পেটের খিদেটাও চাগিয়ে ওঠে। শালা মার্বেলঅলা সমানে দুই টাকার নোটগুলা তবিলে ভরাচ্ছে। কোমরে জাল পেচিয়ে তৈরি করা তবিল। টান মারলে হিড়হিড় করে সেই আগে দৌঁড়াবে টাকার আগে। ফলে ওর কাছে পকেটমার কেন ভেলকিঅলাও পাত্তা পাবে না।

বিকেল বেলা ছাড়ার কথা থাকলেও কছুরুদ্দিকে দুই টাকার মামলা চুকাতে গিয়ে সন্ধ্যা পার করতে হয়। এতক্ষণে আরো পাঁচটাকা রোজগার করে তার তহবিল দাঁড়াত এগার টাকায়। চুৎমারানির মার্বেলঅলা মোক এনা খাবারও দিলু ন্যা ! গালাগালি সাপসাপান্ত করে কছুরুদ্দি মাঠের পাশে চলে যায়। আজ আর সে ভিক্ষে করবে না। সারাদিন ইঞ্জিল খ্যান ধরি থাকতে থাকতে মোর গোয়ার বিশ উটি গেচে। রবিন হালাইয়ের দোকানের পাশ দিয়ে যাবার সময় কারো কাছে একটা ময়দার লাড্ডু গুড়ের সিরাসমেত দ্রুত হাত বাড়িয়ে নেয় সে। তা খেয়ে ক্ষুধাটা আরো তাগড়া হয়ে ওঠে। যেন বাছুর ছোটাছুটি করে পেটের ভেতরে।

কছুরুদ্দির আড়াই মাইল পথ হেঁটে নজিবরের কলার থোপের পাশে চট দিয়ে ঘেরা বাড়িটাতে গিয়ে পৌঁছায়। পায়খানার উপচে পড়া রসগুলো একটা সরু নালার মত জায়গা দিয়ে কলার থোপের থকথকে কাদায় গিয়ে মিশছে। ওখানেই থাকে কছুরুদ্দির বাপ কানাফকিরের পাঁচজনের একটি পরিবার। কছুরুদ্দির বাড়িতে পৌঁছানোর আগেই ছমিরন, কানাফকির, তার হাতে ধরা বুকের হাড়-পাঁজরে খোদার কালাম আঁকা মেজটা আর কোলে চড়া মইরুদ্দিটা ফিরে এসেছে।

মাঝখানের ছকুলুদ্দিটা হ্যাবলা গোছের। তবে হাত বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বিশেষ একটা মাথা নাড়ানোর ভঙ্গি ও মুখের ভাবে বুঝিয়ে দিতে সক্ষম হয়তার পেটে এখন খোরমাদানার ঝুরঝুরিটা পড়লেও পাকস্থলীর পোকাগুলো রিনঝিন করে উঠবে। ছকুলুদ্দি ওর মা ছমিরনের কাছে গল্প শোনেপেটের ভেতরে অনেকগুলো পোকা থাকে। পেটে খাবার পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো জেগে ওঠে। কোনো কারণে পেটে কুলকুল আওয়াজ হলে ছকুলুদ্দি সেসব পোকার কারসাজি বলেই মনে করে। তখন, ওই থাম থাম নড়িস না চড়িস না বলে পেটে থাবড়া মারতে থাকে।

ছমিরন কছুরুদ্দিকে জিজ্ঞেস করে, কোটে হারেয়া গেলু। ভরদিন খুঁজিখাঁজি মরি। হারামজাদা তুই এ্যাখনে এইদ্যান হলু ক্যা? বুড়া বাপটা সারাদিন কোকালো। মোর গালাটা ভাঙা। কেটা এ্যালা জোর করি প’সে হাতত দ্যায়?

কছুরুদ্দি তার সারাদিনের কাজের খেসারত যে কি দিয়েছে সে কথা প্রকাশ করে না। শুধু অস্ফূট আওয়াজ শোনা যায়, মার্বেলটা যদি খালি মুই এ্যাকনা বাম পাকে সই করি মারনু হয় তালে পকেটত দুই ট্যাকা। হ, এবার ডানদিকি এ্যাকনা সোজা করি, আরো দুই ট্যাকা। পকেটত ছয়ট্যাকা। দশ ট্যাকা হইল।

তুই কি কইস রে কছুরুদ্দি গুঞ্জরি-গুঞ্জরি। কিসির ট্যাকা। দশ ট্যাকা ভিক্ষে করি পাছিস? কোনটে?

কছুরুদ্দির মুখ দিয়ে কথা সরে না। এই বুঝি ধরা পড়ল। ধরা পড়লে পিঠের উপর কয়টা দুমদুম কিল পড়বে সে জানে। তারপর শোনা যাবে বুকশিনা নাগি গেল গো ছোইলট্যার এখন কি হইবে গো? ও কইছ্রের বাপ! কি করবেন গো করেন! 

কছুরুদ্দি ঘোরের মধ্যে ক্ষীণ কণ্ঠে মায়ের বিলাপ শুনতে পায়। না সে আর কখনো ওইসব মার্বেল, রিং খেলা, কি ফড় খেলাই হোক খেলবে না।

কানাফকির অসুখে পড়ে ভুগতে ভুগতে একদিন মারা গেল। মইরুদ্দি মায়ের কোল ছেড়ে কবেই কছুরুদ্দির মত নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখেছে ছমিরন টেরই পায়নি। 

দিনে দশ এগার কি বারো টাকার রোজগার নিজের পায়ে দাঁড়ানোই বৈকি ! চাইকি একস্যার চাউলও মিলব্যার পারে। মাঝখানেরটা পলিও হয়ে নুলো হয়েছে। ওর আয় রোজগার একটু বেশি। রাস্তার মোড়ে বসে থাকলেও ঝনাৎঝনাৎ পয়সাগুলো পড়ার শব্দে চমকিত হয় না সে। ছমিরন বাড়ি থেকে এলেই কেবল সেগুলোর কুড়িয়ে রাখে। নইলে চলার ক্ষমতা তার কই? পলিও বাঁকা ঠ্যাঙ দুটো নাড়াচাড়া করে নিজের মনেই ডুব দেয় ছকুলুদ্দি। বাপ থাকতে বাপের হাতের মুঠোয় তার মুঠ পাকানো থাকত। হিড়হিড় করে বাপকে টানতে টানতে যে সুরটা গলায় চড়ত তাতে বেহেস্তি হাওয়া ছিল।

কছুরুদ্দি নিজের রোজগারটা মায়ের হাতে তুলে দেয় না কখনো। বাপের হাত ফসকে বেরিয়ে যাবার স্বভাবটা তাকে এখনো আলাদা করে রাখে। কিন্তু হঠাৎ অসুখে পড়ে টাইফয়েড জ্বরে মরিমরি করেও সে বেঁচে যায়। জ্বরটা মাঝখান থেকে চোখ দুটো খুঁতো করে দেয়। 

কছুরুদ্দিনের দুনিয়াটা এখন ভয়াবহ আন্ধার। সে চোখ দিয়ে পানি গড়াতে চাইলেও সহসা কারো চোখে পড়ে না। নিশ্ছিদ্র অন্ধকার চোখের দিকে কে আর কতক্ষণ তাকিয়ে থাকে?

নুলো ছকুলুদ্দির দিনগুলো তবু ভাল। পা নাই তো কি! জ্বলজ্যান্ত দুটো চোখের মহিমা যে কী? তার কী বুঝবে ঐ হাবাটা ! 

মইরুদ্দি তাগড়া শরীর নিয়ে কানার ভান করে পয়সা কামাই করে। তাও ভাল। ভিড়ের মধ্যে ঠিকানা হারালেও ঐ বটগাছ তলায় বসলে দেওয়ানির ভিটা থেকে সদ্য মাড়াই করা ধান আর আধাশুকনো খড়ের গন্ধ নাকে এলে কলিজাটা জুড়িয়ে যায়। বাড়িতে গিয়ে পেটে ছাতুর গুড়াটা পড়লেও শব্দ করে মিহি চিকন ঢেকুর তোলা যায়।

কছুরুদ্দি এর মধ্যেই তার বাপের সাগরেদ কয়েকজন কানাফকিরের সন্ধান পায়। যদিও তাদের সঙ্গে খুব একটা দহরম মহরম সম্পর্ক তার বাপের ছিল না। কানারা জাতভাই বলে একটা সহানুভূতি তবু মাথাচাড়া দেয়। সারাজীবন ছমিরনই চিকন গলায় আল্লা-নবীজির নামে ভিক্ষে চেয়েছে। সে মা ছমিরনও এখন আর নেই। কানাদের সঙ্গে কছুরুদ্দির বিশেষ ভাব হয়। কানাফকির কয়েকজন বাজারের নির্দিষ্ট স্থানে বসে। কছুরুদ্দি তাদের সঙ্গে কয়েকদিন ভিক্ষায় বসে।

গায়ে ছেড়া শাড়ি কাপড় প্যাঁচানো কানি মেয়ে। কছুরুদ্দি যেখানে বসে তার অদূরেই ভিক্ষায় বসা। সে যখন ভিক্ষা মাগে তখনই কেবল কছুরুদ্দি তার উপস্থিতি টের পায়। অনেকক্ষণ লোকজনের যাওয়া আসা বন্ধ থাকলে নিজে থেকেইঅ এখন দুফুর ব্যালা নোকজন খুব একটা নাই। যাই দেখি উদিক। 

কানিটাও আস্তে সারা দেয়, হ এইখানে আর বসা যাবা নয়। উই রাস্তার ধারত গিয়া বসি। 

অন্য ফকিরদের কাছে কথাটা বিশেষ গুরুত্বের মনে হয় না। তবে এখানকার আয় রোজগার কম। ফকিরের সংখ্যা বেশি। তাই তারা খুশিই হয়। কানা কছুরুদ্দি আর কানিটা একসঙ্গে পাশাপাশি বসে। অন্যরা ভাবে তারা স্বামী-স্ত্রী। দুজনের ভেতরেও একটা ঐক্য হয়। একসঙ্গে আয় করে পয়সা গোনাগানতি করে একটা কৌটায় মুখবন্ধ করে রাখে। 

একেকদিন বেশি আয় হলে কানি বুঝে ওঠার আগেই আট আনার জিলাপি কিনে কানির হাতে তুলে দেয়। তাদের অন্তরঙ্গ আলাপটা আরো বেশি জমে। একদিন বলেঅ ময়ভান, শুনব্যার পাস? আয় আমরা একসাথে ঘর বান্দি। ছোইলপইলও হইবে। অরা সাহায্যও করব্যার পারে। 

ময়ভান বাচ্চাকাচ্ছা হবার কথা শুনে লজ্জা পায়।
কি যে কও না কানা। ধূর তোমার এ্যাকনা শরমও নাই। 

কথাটা বলেই কছুরুদ্দির আগের দিনগুলো মনে পড়ে। নিজের ভেতরে একটা ভিন্ন প্রতিচ্ছবি দেখতে পায়। তার সন্তান তার হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছে আর কছুরুদ্দি বলছে, একনা জোরে পা চলা বাপ। কিন্তু হঠাৎ কী ভেবে বসে। হাত ফসকে যদি আবার বাচ্চাটা পালায় তাহলে একটা দুর্ঘটনাও ঘটতে পারে। যেমন করে সে একদিন তার বাপের মুঠো থেকে ছাড়াতেই একটা গরুর গাড়ির চাকার নিচে পড়ে কাতরায় বুড়া কানা।

কছিরুদ্দির সম্বিত ফিরে এলে দেখে কানিটার নিশ্বাস এসে পড়ছে ওর প্রায় ঘাড়ের কাছে।
অ ময়ভান, কিছু কবার চাইস।
হ, বিয়া করবি, থাকপি কোটে?
থাকার চিন্তা করিস ক্যানে। এখন কি থাকপ্যার পাচ্ছিন্যা।

খোলা দুনিয়ায় থাকার জায়গার অভাব নেই। একথা তারা দুজনেই জানে। তবু বিয়ে করলে একসঙ্গে রাত্রে থাকতে হয় এটা তাদের অজানা নয়। কয়খান চট জোগাড় করে সামনে শীতটা না হয় জবুথবু করে কাটিয়ে দেবে। তাই সিদ্ধান্ত হয় তিন রাস্তার মোড়ে বটগাছটার ঝুরির তলায় খোদলের ভেতরে চটমুড়ি দিয়ে থাকবে। 

অনাগত দিনের সুখস্বপ্নে ভাসতে কারো দোষ নেই। কানাফকির আর কানিরও তাই প্রকৃতির অজস্র দানের মধ্যে মাথা গোঁজার অভাব হয় না।

মীরের বাগানে বৈশাখের মেলা হলে পীরের মানতের খিচুড়ি দিয়ে মাস বরাদ্দে ভাল খানা জোটে তাদের। দু বেলা খাবার তখন অনায়াসেই জুটে যায়। গলাটা চড়ালে দু চারটা টাকাও ঝনঝন করে থালায় ওঠে। কিন্তু মীরের বাগানের মেলা শেষ হলেই কানাদের মধ্যে বাজারে বসা নিয়ে একটা প্রতিযোগিতা পড়ে যায়। দারিয়াপুরের ছোট্ট বাজারটাতে তাদের স্থান যেন অকুলান হয়। 

প্রতিনিয়ত নতুন নতুন কিসিমের ফকিরের আমদানী ঘটে। ওকড়াবাড়ির অষ্টুমির মেলাটা কিংবা স্কুলের মাঠে সার্কাস এলে তারা হালে পানি পায়। কিন্তু ঐ কদিনই তো তারপরে আবার আগের মতই। পরিচিত লোকজনরা প্রতিদিন বাজারে এলেও একই লোককে ভিক্ষে দিতে চায় না। সাত দিনে একটা ফুটো পয়সা দিলেও মনে করে প্রতিদিনই দিচ্ছে এরকম।

মহাসড়কের ধারেও কানা-কানিদের আর বসা হয় না। বড় বড় গাড়ি চলে এখন তার ওপর দিয়ে। যে বটগাছটার ঝুরির নিচে আশ্রয় নিয়েছিল মহাসড়ক নির্মাণের সময়, সেটি কাটা পড়ে। তাদের আশ্রয় স্থলটিও নষ্ট হয়ে যায় যেমন নষ্ট হয় ঢিল ছুড়লে পাখির বাসা। 

কছুরুদ্দি বলতে থাকে : আগেই ভাল আছিল। এখন আর বসপ্যার পারি ন্যা। তাও হাটাহাটি করি এ্যাকনা-ওকনা পাই, তাতে কি আর পেট চলে বাবা। এদিক থাকার জাগাও নাই। স্কুলের ভাঙা ঘরত নিন পারি। 

তারা সিদ্ধান্ত নেয় বড় ব্রিজটার ফুটপাতের ওপর একটা জায়গা হতে পারে। কছুরুদ্দি হাত পাতে আর ভিক্ষা চায়। ও ভাই হামাক একটা ট্যাকা দিয়্যা যান। কছুরুদ্দি ফাটা গলায় সুর তোলে। ময়ভানও চিকন সুর মেলায়।
কতট্যাকা কত পয়সা অকারণে চলে যায়।
আল্লার আস্তায় দান করিলে আখেরাতে পাওয়া যায়।
কদিন ভাল রোজগার হবার পর তাদের মনে চেকনাই আসে। দু মাইল হেঁটে প্রতিদিন স্কুলের ভাঙা ঘরটায় কিংবা খোলা বারান্দায় এসে ঘুমায়। পরদিন সক্কাল বেলাতেই হাঁটতে হাঁটতে এর ওর কাছে থেকে একটা-দুটা রুটি কি হোটেলের বাসি খাবার চেয়ে-খুঁজে যাত্রা শুরু করে। একদিন দেখা যায় হাত ধরে হাঁটছে আধান্যাংটা শিশু, কানার ছেলে। ওর হাতটা বাপের হাতের ভেতরে। কানিটাও চলছে পাশাপাশি।

ও ভাই গো একটা ট্যাকা দিয়্যা যান। ও দয়াল শরীল ভাইসাব একটা ট্যাকা দিয়্যা যান। কত্ত ট্যাকা নষ্ট হয় গো ভাইজান। কানাক একটা ট্যাকা দিলে ফুরাবান্নয় গো ভাই। হামাক দিলে আল্লায় দিবে গো ভাই। কোলের ছইল না খায়া আছে গো। একটা ট্যাকা ও ভাই আল্লায় দিবে

গতদিনের ধর্মসভায় তারাও অন্যান্যদের সঙ্গে বসে মিলাদ-শরীফ পড়ে। হুজুরের কণ্ঠ তাদের মর্মে গিয়ে পৌঁছায়। ওয়াজে হুজুরের কণ্ঠে সুরেলা পাখির আওয়াজ ফোটেও আল্লার পিয়ারা বান্দারা, তোমরা বেশি বেশি কইরে দান কর। দান হইল আল্লার তরফ থেইকা গরীবের জন্য ফয়সালা। তোমরা এমন ভাবে দান কর, যাতে ডান হাতে দিলেও বাম হাতও বুঝতে না পারে। বলেন, সোবহানাল্লাহ।’... দানকারীর পিতামাতা আল্লা সুখে রাখেন কবরে  

কানা, ময়ভান ও তাদের ছেলে দানের কথায় সচকিত হয়। গজলটা তাদের ভেতরে আলাদা একটা কম্পন তোলে। দানটা যে তাদের প্রাপ্য এ খেয়ালও মনে আসে। হুজুরের বক্তৃতার ফাঁকে ফাঁকে তারা এদিক ওদিক হাত পেতে রোজগার করার চেষ্টা চালাতে থাকে। ওদিক থেকে কয়েকজন চিৎকার করে, ওই কানা, পরে ট্যাকা তুলিস। এখন ওয়াজের মদ্যে ডিসট্যাপ করিস ন্যা। 

অপরাধ করেছে এরকম একটা ভাব নিয়ে কানা কাচুমাচু হয়ে আবার এক জায়গায় বসে পড়ে। ওয়াজ শেষ হলে হইচই হট্টগোলের মধ্যে কানাদের কণ্ঠস্বর হারিয়ে যায়। হুজুরের পকেটে হাজারো মুসল্লি ছওয়াবের আশায় পয়সা তুলে দেয়। হুজুরের পকেট অতিরিক্ত ভারি হলে একখানা বড় কাবা শরীফের নকশাঅলা পাগড়ি পেতে দেয়। ঝরের মধ্যে গাছের পাতা পড়ে রাস্তা সয়লাব হয়ে যাবার মত সে পাগড়িটা টাকায় ভরে যায়। তা দেখে অনেকের চোখ ছানাবড়া হয়কী ফজিলত দানের মধ্যে দেখো! যারা বেশি দান করতে পারে না তাদের হৃদয়টা দুঃখে হুহু করে ওঠে।

পরদিন কানা-পরিবার আবার ভিক্ষেয় বসে। তিনজনে মিলে গতরাতের হুজুরের গাওয়া গজলের সুর আরো তীক্ষ্ণ করে তোলা যায়।
দীনের নবী মুস্তফায় আস্তা দিয়া হাইট্যে যায়।
হরিণ একটা বান্দা ছিল গাছেরি তলায় গো,
হরিণ একটা বান্দা ছিল গাছেরই তলায়।।
ব্রিজের ওপর দিয়ে গমনকারী পথিকরা গজলের চিকন সুরে মোহিত হয়ে পয়সা ছোড়ে ভাঙা টিনের থালায়। গজলটা তাদের হৃদয়কে টানে বলেই হয়ত কয়েকটা বেশি পয়সা পড়ে। পথচারীদের দরদ তখন দিগন্ত পাড়ি দিয়ে অতীত জমানার গাছের সঙ্গে বাঁধা হরিণের প্রতি। কানা সেখানে দৃশ্যমান সত্যের মধ্যে এক অদৃশ্য অবয়ব মাত্র। দূর মরুভূমির হরিণের কষ্ট তাদের কোমল হৃদয়ে হাহাকার তোলে। কিন্তু কানার ভাঙা থালায় দিন দিন ঝনঝন শব্দ কমে যায়। আগের মতই কানার পয়সায় টান পড়ে কয়েকদিন না যেতেই। ভরদুপুর বেলা কছুরুদ্দি কেউ রাস্তায় না থাকলে গালিগালাজও করে। 
চ্যুতমারানির‌্যা খায়া খায়া গাওখান মইষের নাকান বানাইছেন। হামার গাওত এ্যাকনাও গোশত নাই। শালার ছাওয়াগুল্যাও নাউয়ের নাকান ধলা ফকফকা, ঢোলের নাকান ফুলি উটচে মনে কয়। হামার ছইলের অসুখ যায় না। কন্টেকটার ফকা মিয়া এই ব্রিজখ্যান বানে দিচিল, কত্ত ট্যাকা মারি দিচে আল্লায় জানে! জারুয়্যার বাচ্চা তোমার বাড়িত তিনতালা হয় ক্যামন করি?
দূর থেকে যানবাহনের শব্দ টের পেলেই কানা চুপ করে। আগের গালির ভাষা তার পরিমার্জিত হয়। যদিও কণ্ঠে অনুযোগের সুরটি মিইয়ে যায় না। 

এত্তএত্ত মানুষ কেউ গাড়িত চড়ি, কেউ মটর সাইকেলত ভো ভো করি যান, কত্ত জন ট্যাকা খরচ করি গাইবান্দাত টকি দেকব্যার যান বাহে, হামার অন্দ মানষোক একটা ট্যাকা দিয়্যা যান। দুইদিন থাকি ঠিকমতন খাবার পাইন্যা বাহেবলে হাত বাড়িয়ে দেয় কছুরুদ্দি। 

তবুও দিনের শেষে আধাকেজি চাল কেনার পয়সা হলেও তরকারি কিনতে পারে না সে। বাজারের ভেতরে সন্ধ্যার পর প্রবেশ করে কারো কাছে দুটা আলু, একটা বেগুন, গোটাকয় বোঁটা-পচা কাঁচামরিচ জোটায়। কিন্তু প্রতিদিন কেউ দিতে চায় না। এ ধরনের ফকিরের সংখ্যা নেহায়েত কমও নয়। কেউ কেউ তার ওপর চড়াও হয়ে বলে, 
ওই কানা, শোক্করবারে-মোঙ্গলবারে হাটবারত আসপু। অন্যদিন আসপ্যার পাবু ন্যা। কানা একটু দূরে গিয়ে বিরবির করে, শোক্করবারে-মঙ্গলবারে হাটবারত আসিস; আউ, আ’দরে দিন কি হামরা নোচা খায়া থাকমো ? তোমরা তো পত্তায় সোনামুগ খায়া আচেন।
এদিকে কানার বউকে ব্রিজের ওপর কদিন থেকে দেখা যায় না, বাচ্চাটাও নাই। কানা একাই গজলে সুর তোলে। দু একদিন যেতে না যেতেই কানার পাশে আরেকজন এসে বসে। কানার রাগ হয়। শালা নিজি ভিক্কে পাইন্যা। আরেকজন আসি জুটিল। ওই, তোর বাড়ি কোনটে? 

এককথায় দুকথায় কানার সঙ্গে ভীষণ চটাচটি হয় নতুন আসা কানিটার। কালক্যার মদ্যে তুই এট্যা থাকি চলি যাবু। নাহলে তোক কি করি দেকপু কাল। কানিটা কিন্তু ভয় পায় না। উল্টো তাকে শাসায়, তুই যাবু, মুই ক্যান? আস্তা কি তোর বাপে করি দিসে? গোয়ারমেন্টের আস্তা। তুই অন্য জাগাত যাবু। 

তাদের এই ঝগড়াঝাটি পথচারিরা শোনে। তারা হাসাহাসি করে, কেউ গড়াগড়ি খায়। কেউ কেউ বলেনাগচে দুই জোনে। তামশাটা দেখো এলায়। 

স্কুলগামী দুষ্ট ছেলের দল তাদের ক্ষ্যাপায়, কানা খোড়া ভেংরে, তিন হারামি নেংরে। কেউ বলে, দেকলু কানার ঝাইট। নিজিরা ভাগাভাগি করি বসপু, তা নোয়ায়, ফির মজরা করে।

পরদিন আবার তারা ব্রিজের ওপর বসে। সূর্য উদয় হবার পরপরই আজ কানা চলে আসে ব্রিজের ওপর। দখলটা তার নেওয়া চাই-ই। কানি যেমন করে চিল্লাচিল্লি করল গতকাল, তাতে ভীষণ ক্রোধে উদ্দীপ্ত হয় তার মন।

কানি এসে সন্তর্পণে বসে। বামপাশের যেদিকটায় কানা বসে তার ঠিক উল্টোদিকে। কানা তার ক্রোধ সংবরণ করে। হয়ত মনে মনে ভাবে কি আর হবে কানির সাথে বৃথা ঝগড়াঝাটি করে! তার চেয়ে ওর সাথে দুটা ভাল করে কথা কই। একসাথে গলা মিলিয়ে গজলটা গাইলেও লোকজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়। কানা পাশ ফিরে পাশের জনকে জিজ্ঞেস করে,
ওই কানি।
কানি হরিণের মতো কানখাড়া করে সচকিত হয়। আজকে যদি কানা শালা তাকে কিছু বলতে চায় তাহলে কানির ব্যাগের মধ্যে যে ড্যাগারখান আছে সেটা দিয়ে সন্ধ্যাবেলায় কানার গায়ে একটা চোট লাগাবেই লাগাবে।
কি কবার চাস? ক
গজল জানিস নাকি? এমনি... পুছ কল্লাম।

কানি দেখে নরম সুর। কিন্তু গতকালের বিষয়টি সে ভোলে নাই। তাই সময় নেয়। তারপর সাতপাঁচ চিন্তা করে আরো কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে, গজল জানিন্যা, গীত কবার পাই।

কানা বলল, সব্বোনাশ। এটি যদি গীত কইস কানি, মানুষ এলাও ফিরি দেকপ্যার নয়। ঠেংনি খায়া ভিক্কে তোর শিক্যাত উটপে। হায় আল্লারে কোন বিপদ আসি জুটিল্। মনে মনে প্রমাদ গণে কানা।

তাই বলে কানি গীত গায় না। কানার চেয়েও তার জ্ঞান পরিষ্কার। কেবল কানাকে ভড়কাতে চায়।

অবশেষে কানা একদিন প্রস্তাব দেয়, ওই কানি। আয় একসাথে বসি ভিক্কে করি গজল কয়া কয়া। তোক শিক্যামো হামি।
হ, মুগ্যাস্ত করি ফ্যালাচি।
কানার মুখে তৃপ্তির হাসির রেখা। অ, তুই তো খুব চালাক আছিস দ্যাখা যায়। তা তোর বাড়ি যেন্ কোন্টে?
বাড়ি থাকলে কি এট্টি আসি?
তোর সোয়ামী নাই?
একটু কড়া গলায় কানি জবাব দেয়আছিল না !

কানা ও-ব্যাপারে আপাতত আর কিছু বলার সাহস পায় না। ইতোমধ্যে সে বুঝে গেছে কানির মনের ধার। এদিকে কানি যে তার কৌটার ভেতরে চকচকে ড্যাগারটা রেখেছে তা জানার সাধ্য কানার কোথায়? কানির সঙ্গে সে অন্য বিষয়ে আলাপ শুরু করে।
তা তোর বাচ্চা-কোচ্চা আছে না?
নাই ! বাপের নাকানে চোগলখোর সগ কয়টা। মোক একলায় থুয়া পলাইছে।

কানা তার নিজের সন্তানের কথা ভাবে। ওটা না জানি কোনদিন বাপ-মাও থুয়া কোনদিন পলায়া যায়? কানিকে সে প্রস্তাব দেয়ওই কানি চল্ হামার সাথে, থানের পাশত্ জাগাটাত হামরা থাকি। ( জায়গাটা চট দিয়া ঘেরা)। যাবু সেটি?

কানি ভাবে কানা তাকে কুপ্রস্তাব দিচ্ছে। কিন্তু তার কৌটার ছুড়িটা একটা সাহস জোগায়। আর যাই হোক কানা যদি উল্টা-সিদা কিছু করে তাহলে থানের নির্জনতায় কেউ তাকে সহসা ধরতে পারবে না। কিন্তু কানি দেখে সেখানে রোগে কোকাচ্ছে কানার বউ। কানার বউ প্রথমে টের না পেলেও ভিন্ন একটি নারী কণ্ঠের উপস্থিতিতে সতর্ক হয়ে ওঠে।
কেটা আসচে গো তোমার সাতে?
বউ, তুই নাই। অর সাথে ভিক্কে করি। এ কয়দিন কয়ট্যাকা বেশি আনল্যাম তো অরি জন্যে। তোর ওষুদের ট্যাকাটাও জোগাড় হইল।

কানি ময়ভানের কিন্তু রাগ চড়ে যায় মাথায়। অ, অর সাতে বইত্যালিগিরি করব্যার আইচে মাগী। অর ট্যাকার ওষুদ খাইন্যা। তোর স্বভাব মুই জানম না? গাছের খোদলত থাকার সোম তুই হারামি মাগীট্যার সাতে ফুসুর-ফাসুর করিস নাই?

কানা কছুরুদ্দি কী করে বোঝায়এই কানি আর সেই কানি এক নয়। অবিশ্বাস যার অন্তরে ঢুকেছে তার বিষ নামানো সহজ নয়। বিশেষ করে চোখ থাকলে প্রমাণ করা যায়। কিন্তু কানার রাজ্যে প্রমাণ কী? আর যারা কানা নয় তারাও কি ধোকা দেয় না গোপনে গোপনে? চোখ থাকা আর না থাকায় তফাৎ কেবল দিনের আলো আর রাতের আন্ধার। মনের মদ্যে সগল কিছুর ছবি দেখা যায়। তার আলো-আন্ধার নাই। এদিকে অন্ধকার আরো গাঢ় হয়। কানিটা কিন্তু যাবার কোন মতলব করে না। কানি ময়ভান জিজ্ঞেস করেগেইচে বইত্যালিট্যা?

রাত যতই বাড়ে কানা ততই চিন্তিত হয়ে ওঠে। এই বুঝি টের পায় ময়ভান। ময়ভান ঘুমায়। পাশ ফিরে শোয়। অন্য কানিটা তার প্রায় কাছাকাছি ঘুমায়। কানা তার প্রাকৃতিক কর্ম সারার জন্য একটু দূরের বাঁশ ঝারে গিয়ে বসে। শিশুটা অঘোরে ঘুমায়। সচকিত হয়ে উঠলেও সে বোঝে না কি ঘটে। 

ঘুমের ঘোরে কখন যেন ময়ভান কানিটার কাছাকাছি এসে যায়। ময়ভানের একটা হাত কানিটার গায়ে পড়ে। ময়ভান তার স্বামীর পরিচিত দেহটা খুঁজতে যায়। কিন্তু একি নরম শরীরের কোন দেও-দানব শুয়ে আছে তার পাশে? সহসাই ময়ভান টের পায় যে গতরাতে কানিটা এ তল্লাটেই রয়ে গেছে। চিৎকার করে ঘুমন্ত কানিটার বাহুমূলে ভীষণ একটি কামড় বসায় সে। কানিটাও চিৎকার করে ককিয়ে ওঠে। তার স্মরণ হয় পায়ের কাছে রাখা কৌটার কথা। দ্রুত হাত বাড়িয়ে সে ড্যাগারটা বসিয়ে দেয় তার সোজা বুকের দুদিকের পাঁজর সামনের দিকটায় যেখানে শেষ হয়েছে তার মাঝখানে। ফিনকি দিয়ে রক্ত ওঠে। সে রক্তের ছলকে ওঠা বুঝে ওঠার আগেই কানি পগার পার হয়। শিশুটা ভয়ে চিৎকার করে আর হাঁপাতে থাকে হাপানি রোগীর মত। কানি ময়ভানের শরীরের সব রক্ত শুষে নেয় খড়ের বিছানা। 

কানা কছুরুদ্দি কোথায় গিয়ে ধরবে ড্যাগারঅলা কানি শয়তানকে? মধ্যরাত্রির অন্ধকার পেরিয়ে যার পাখির মত পালাবার পথ চিনতে যার ভুল হয় না, সে আর যাই হোক অন্ধ নয়, একথাও তার কাছে নিশ্চিত সত্য হয়ে ওঠে।

 একা ছেলের হাত ধরে হেঁটে চলছে কানা কছুরুদ্দি। জন্মাষ্টুমির ওকড়াবাড়ির মেলা বসেছে আবার। মেলায় পৌঁছে নানারকমের জিনিসপত্র, ঘোড়দৌড়, খেলাধূলা, ভেলকিবাজি প্রভৃতির মধ্যে মার্বেল খেলা নজরে পড়ে কানার ছেলেটার।
অ আব্বা, মার্বল খেলমো।

কানা কছুরুদ্দি জন্মান্ধ নয়। ছোটবেলাকার সেই মেলার কথা মনে পড়ায় ছেলেকে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যায়। যেন প্রত্যেকটা মার্বেল পটপট করে তার ব্রহ্ম তালুর ওপর গিয়ে পড়ে। পটপট শব্দে সেগুলো তার মগজের ভেতরে ঢুকে ঝিঝি পোকার ডাক শুরু করে। ক্ষুধায় কোঁকড়ানো মা-বাপ-ভাইদের কথা মনে ভাসে। হাতের লাঠিটা ঠকঠক করে কেঁপে ওঠে তার।

“এই বুঝি তার ছাওয়ালটাও হাত ফস্কায়া হারায়ে যাবার চায়।” ঠিক সেদিনকার, দৃষ্টিসম্পন্ন কছুরুদ্দি আর তার কানাবাপ ছইফুদ্দিনের মতন।
---------------------------------------------------------------------------------------------------
(গল্পটি আনন্দধ্বনি পত্রিকায় প্রকাশিত হয় কানা কছুরুদ্দি নামে। লেখকের অনুমতিক্রমে গল্পটি পুনর্মুদ্রণ করা হল।উত্তরমেঘে শিলাবৃষ্টি গল্পগ্রন্থ অনুযায়ী গল্পটি পরিবর্তিত ‘অনিকেত’ নামে ছাপা হল।)

আনন্দধ্বনি, সম্পাদক : শঙ্কর কুমার মল্লিক, প্রকাশ : ১লা বৈশাখ ১৪২০( ১৫ এপ্রিল ২০১৩), আরণ্যক ট্রাস্ট, খুলনা।
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------
খোরশেদ আলম,গল্পকার ও প্রাবন্ধিক 
শিক্ষক, বাংলা বিভাগ 
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

1 টি মন্তব্য: