মঙ্গলবার, ৬ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪

অমিয়ভূষণ মজুমদার : সত্তার বিস্তার

 রীতা মোদক

“আমার জীবন সমতলের হাঁটুজলের নদী। পার আছে, পারে ঘরবাড়ি, ধানের আর তিলের ক্ষেত, মেয়েরা জল নিতে আসে, রাতে গুলবাঘাও হয়তো, সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত আছে, কিন্তু নিতান্ত সাধারণ, ভুলে যাওয়ার মতো ঢেউ ওঠে না, মধুকর ডোবে না, জলদস্যুদের বছর চলে না।”(১)


শুধু তাই নয়, নিজের সম্পর্কে বলতে গিয়ে অন্যত্র জানিয়েছেন, — “আমি জানিনা কি করে মন তৈরী হয়, কিন্তু আমার এই জীবনে আজ পর্যন্ত কিছু extra-ordinary ঘটেনি।” (২) নিজের সম্পর্কে একথা বললেও তাঁর সৃষ্ট সাহিত্যপাঠ আমাদের জীবনের বিভিন্নতলে সঞ্চরণ করায়। নিত্য-নতুন ঘটনা ও বিষয়ের দ্বার উন্মোচন করে। ঐতিহ্যপূর্ণ পারিবারিক উত্তরাধিকার যেন অজান্তেই তাঁর রচনায় স্থান করে নেয়।


অমিয়ভূষণ মজুমদার। জন্ম — ২২ মার্চ, ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে (৮ চৈত্র, ১৩২৪ বঙ্গাব্দ) মাতুলালয় কোচবিহার শহরে। পিতার নাম অনন্তভূষণ মজুমদার, মাতা জ্যোতিরিন্দু দেবী। আত্মপরিচয় দিতে গিয়ে জানাচ্ছেন, “বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ। পৈতৃক নিবাস পাবনা জেলায়, সারা থানা ( চলতি কথায় সব চাইতে অপরাধপ্রবণ থানা), পাকুরিয়া গ্রাম। হার্ডিঞ্জ ব্রীজ থেকে তিন মাইল দূরে। হার্ডিঞ্জ ব্রীজ যেখানে শেষ সেখানে পাকশি স্টেশন (আসলে নাম তো পাকশে); যেখানে নেমে পায়ে হেঁটে, গোরুর গাড়িতে কিম্বা পাল্কিতে যেতে হত।”(৩) বাড়ির কথা তাঁর লেখাতেই পাই, “… তো এই বাড়িটার কথা আর-একটু বলতে হবে। আমি জানতাম না। কিন্তু দেখছি নীল ভুঁইয়া, রাজনগর, গড় শ্রীখণ্ড ওই বাড়িটার সঙ্গে কোনো-না-কোনোভাবে যুক্ত। যেমন বাবা একবার মাকে বলেছিলেন, — ‘না-দেখে, না-শুনে আমি কী করে-বা বাবার ঠাকুরদাদাকে তাঁর পোশাক, চালচলন, কথা বলা, মনের ভঙ্গি, নীল ভুঁইয়ার দেয়ালে এঁকে ফেলেছি’।”(৪) তাঁর সাহিত্যচর্চা শুরু হয়েছিলো মা-দিদিমার কাছে রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণের গল্প শুনে। আর জানাচ্ছেন ‘বাবা লেখাপড়ার ব্যাপারে সেকেলে ছিলেন’। চার ঘন্টার মধ্যে তিন ঘন্টাই ইংরেজি পড়তে হোতো। কলকাতায় ভর্তি হয়েও অসুস্থতার কারণে ফিরে আসতে হয়। ইংরেজি অনার্স নিয়ে ভর্তি হন কোচবিহারের ভিক্টোরিয়া কলেজে।


অল্প বয়সেই চাকরিতে যোগ দেন। একবছর পর বাইশ বছর বয়সে বিবাহ করেন গৌরীদেবীকে। স্ত্রীর ভূমিকা তাঁর জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। অমিয়ভূষণের সাহিত্য রচনার প্রধান উৎসাহদাতা তিনিই এবং সমস্ত লেখার প্রথম পাঠিকাও তিনি। নিজের সাহিত্য সৃষ্টি সম্পর্কে অমিয়ভূষণ জানাচ্ছেন, “ আমি যে উপন্যাস লিখতে চাই তা এখনও লেখা হয়নি। অর্থাৎ আমি যাকে উপন্যাস বলে স্বীকার করতে কুণ্ঠিত হব না তেমন উপন্যাস লেখার চেষ্টা করে থাকি। হয়তো তা কোনদিনই লেখা হবে না, লেখা হলেও ছাপা হবে না, কিন্তু সেগুলি আমার জাগ্রত ও নিদ্রার আনন্দ। এই আনন্দ ছাড়া আমার চলে না, এমন নেশা ধরেছে। যখন লিখি না তখন ছবি আঁকি। আমার ছবি কোন exhibition-এ পাঠাবো কিনা ভাবি না। কিন্তু তুলির টানে ফলকে রঙ ধরলে মনে হয় মস্তিষ্কে সহস্রদল পদ্ম থেকে মধুস্রাব হচ্ছে। আমার যে উপন্যাস ছাপা হবে না তা লিখতেও এমন হয়।”(৫) বহুধা বিস্তৃত সাহিত্যই যেন তাঁর অস্তিত্বের আনন্দ উৎসার।


সঞ্জয় ভট্টাচার্যের “পূর্বাশা” পত্রিকায় প্রথম অমিয়ভূষণ মজুমদারের গল্প প্রকাশিত হয়। এছাড়া “চতুরঙ্গ”, “গণবার্তা”, “ক্রান্তি” পত্রিকায় তিনি লেখা পাঠান। ‘গড় শ্রীখণ্ড’ (১৯৫৭) তাঁর প্রথম উপন্যাস। এই উপন্যাসটি “পূর্বাশা” পত্রিকায় জ্যৈষ্ঠ ১৩৬০ থেকে ফাল্গুন-চৈত্র ১৩৬১ কালপর্বে প্রকাশিত হয়। এটি ধারাবাহিক প্রকাশকালে লেখক পরিচিতি হিসেবে সঞ্জয় ভট্টাচার্য সম্পাদকীয় মন্তব্য করেন, “ তরুণ কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে শ্রীযুক্ত অমিয়ভূষণ মজুমদারই এমন একজন লেখক যিনি বহুবিধ কোণ থেকে জীবনকে দেখতে জানেন। তাঁর রচিত গল্প ইতিপূর্বে সাহিত্য পিপাসুদের তৃপ্তি দান করেছে। ‘গড় শ্রীখণ্ড’ তাঁর প্রথম উপন্যাস আমাদের আশা আছে — এ রচনাটি তাঁকে বাংলা উপন্যাসের আসরে একটি সম্মানের আসন দান করবে।” (৬) এই ভবিষ্যৎবাণী যে কত সত্য তা আজ আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তাঁর রচিত বিখ্যাত উপন্যাসগুলি হলো —“গড় শ্রীখন্ড”, “নয়নতারা”, “দুখিয়ার কুঠি”, “নির্বাস”, “মধু সাধুখাঁ”, “রাজনগর”, “ফ্রাইডে আইল্যান্ড অথবা নরমাংস ভক্ষণ ও তাহার পর”, “মহিষকুড়ার উপকথা”, “বিশ্বমিত্তিরের পৃথিবী”, “সোঁদাল”, “মাকচক হরিণ”, “হলং মানসাই উপকথা”, “চাঁদবেনে” প্রভৃতি। লিখেছেন অসংখ্য ছোটোগল্প যার মধ্যে থেকে নির্দিষ্ট কিছু বাছা মুশকিল হয়ে পড়ে। “প্রমীলার বিয়ে”, “তাঁতি বউ”, “সুনীতি”, “দীপিতার ঘরে রাত্রি”,” দুলারহিনদের উপকথা”, “সাদা মাকড়সা”, “অধ্যাপক মোহিত স্যানের উপাখ্যান”, “শ্রীলতার দ্বীপ”, “সাইমিয়া ক্যাসিয়া” প্রভৃতি গল্পের বিষয় যেমন আলাদা, তেমনি ভিন্ন ভিন্ন তাদের পরিবেশন।


অমিয়ভূষণ মজুমদারের “গড় শ্রীখন্ড” উপন্যাসটি যেমন বিস্তৃত তেমনি এর বহু চরিত্র ও তাদের বিচিত্র ডাইমেনশন। ‘অস্থির দেশকালের পটে’ রচিত উপন্যাসটিতে ব্যক্তি জীবনের ভাঙ্গাগড়ার সঙ্গে সঙ্গে আঁকা হয়েছে দেশ-কাল-সমাজ জীবনের নানা উত্থান-পতন। ‘রচনা প্রসঙ্গ’ অংশে লেখক যা জানাচ্ছেন তা থেকে আমরা আন্দাজ করে নিতে পারবো সময়ের পদচিহ্ন, “রামচন্দ্রের দলটা কলকাতার কাছে এই সহরের উপান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। … … … সহরের প্রান্ত থেকে এই বাড়িটার কাছাকাছি এসে পৌঁছতে তাদের একদিন লেগেছিল, সকাল থেকে রাত দশটা প্রায়।… কিছুক্ষণ তারা দাঁড়ালো, তারপর তারা বসে পড়লো ফুটপাতের উপর ; তারায় ভরা আকাশের নিচে গোল হয়ে আর-একটি রাত্রি যাপনের জন্য …”। উপন্যাসে সান্যালমশাই অনসুয়ার শঙ্কাকে উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই— ‘বরং সদানন্দকে একটু সমঝে দিও, চাষীদের কয়েকটা ছেলে কী গান করলো, সেটার সাথে নীল বিদ্রোহের তুলনা রূপুর মাথায় যেন না ঢুকিয়ে দেয়। এরকম চেষ্টা হচ্ছে।’ কিন্তু অনিবার্য পরিণতি এড়ানো যায় নি। জীবনবোধ প্রসঙ্গে আলোচ্য উপন্যাস সম্পর্কে লেখক জানিয়েছেন যে সুরতন ত প্রেমে পড়ার মুখেই ছিল, তার অবচেতনে একটা ভয় ছিল পুরুষের প্রতি—সেইজন্য যাকে ভালোবাসতো সেই মাধাই বায়েনকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করতে পারলো না। জীবনে যারা সব চেয়ে বঞ্চিত, সেই শ্রেণি জীবনে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে, “ছোটখাট জিনিস দিয়ে আমরা জীবনের আয়োজন করছি— এটা কিন্তু চিরস্থায়ী, কালকে সারপাস করে যাচ্ছে”। তপোধীর ভট্টাচার্য উপন্যাসটি সম্পর্কে জানিয়েছেন, “সময় সেখানে প্রকৃত কুশীলব আর সময়ই আখ্যানের কেন্দ্রীয় আকল্প। স্তরে-স্তরে ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে যে ইতিহাস-নিবন্ধ সময়, কত অন্তঃস্রোত তার, কত না চোরাটান। সব মিলিয়ে, বহুমাত্রিক জীবনের সন্দর্ভ পেশ করতে চেয়েছেন লেখক ; জাতীয় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ এক সন্ধিলগ্ন যেহেতু তাঁর উপজীব্য, রাজনৈতিক অবচেতনার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম সঞ্চরণশীল ছায়া আখ্যানকে একই সঙ্গে দিয়েছে লাবণ্য এবং দার্ঢ্য।”(৭)


অমিয়ভূষণের লেখায় উত্তরবঙ্গ-ডুয়ার্সের জীবন ও প্রকৃতি বারে বারে ঘুরে এসেছে। “উত্তরবঙ্গের ভাষা ও সাহিত্য সম্বন্ধে” (৮) প্রবন্ধে তিনি একদিকে সেখানকার ইতিহাস-প্রকৃতি, অন্যদিকে ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি-নৃতত্ত্ব সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। বলেছেন চিলাপাতা বনের কথা, নল রাজার গড়ের কথাও। “মধু সাধুখাঁ” উপন্যাসে গল্প ও ঘটনা সুনিপুণ বুননে এই স্থান ও সময়ের ইতিহাসই তুলে ধরেছেন।


“ফ্রাইডে আইল্যান্ড অথবা নরমাংস ভক্ষণ ও তাহার পর” উপন্যাসে তিনি মানুষের মধ্যেকার বন্যতা ও পাশবিকতাকে তুলে ধরেছেন। প্রবলের ক্ষমতা এবং স্বার্থসিধির জন্য দুর্বলের প্রতি অত্যাচার মানুষকে পশু করে তোলে। বন্য থেকে ধাপে ধাপে আধুনিকতার আলোয় এসেও মানুষের অন্তর্গতসত্তায় পাশবিকতাই কার্যত বহমান। লেখক অসাধারণ প্লট ও আঙ্গিকে তা উপস্থাপন করেছেন। উপন্যাসের শেষ বাক্যটি তাই অত্যন্ত জরুরী হয়ে পড়ে— “হে প্রভু ঈশ্বর তুমি যে আলোক হও বল এবং আলোক হয় এবং তুমি শয়তান সকলও সৃষ্টি কর এবং বধ হও বলিলে বধ হয় পরন্তু তাহা বল না কেন তুমি শয়তানকে অনুতপ্ত দেখিতে চাও।” “মহিষকুড়ার উপকথা” উপন্যাসের পটভূমি ‘কোচবিহার-আলিপুরদুয়ার অঞ্চল’ হলেও লেখকের মনোভুমিই এর আসল পটভূমি। মহিষকুড়া নামের খুব সাধারণ এক গ্রামের গল্প এটি। উঠে আসে নানা বিদ্রোহ-যন্ত্রণার ছবি। সাধারণের অসাধারণ কাহিনি। “গল্পটা এক অকিঞ্চনের একমাত্র রত্ন সেই রমনী ও তার গর্ভজাত আত্মজকে হারিয়ে ফেলা। যে শব্দ জানে না, প্রেম শব্দটাকেই শোনে নি, সুতরাং ভাষা-উলঙ্গ এক নিছক মানুষের most fundamental দাঁড়ানোর জায়গা ( Adam এর যদি Eve হারিয়ে যেতো?) হারিয়ে ফেলা। তার তুলনায় জমি, জিরাত, জমির রাজনীতিএ সবই অকিঞ্চিতকর নয়?”(৯) সমস্ত কিছুর ঊর্ধ্বে অনুভূতির সূক্ষ্মতায় চরিত্রকে দেখতে চেয়েছেন, ভিন্নার্থে দেখাতেও চেয়েছেন অমিয়ভূষণ। এখানেই তাঁর স্বাতন্ত্র্য। দেখিয়েছেন সম্পর্কের নানা বিন্যাস-জটিলতা।


প্রাকৃতিক পরিবেশের বিপন্নতাও উঠে এসেছে নানাভাবে। জোর করে প্রকৃতিকে বশ করতে গিয়ে পাল্টে যাচ্ছে স্বাভাবিকতা। “সোঁদাল” উপন্যাসে তার চিত্র এভাবে ফুটে উঠেছে, “ এটা বনই নয়। নদীতে ভেঙে যাওয়া গ্রাম, যা নদী সরে যাওয়াতে বন হয়ে গিয়েছে। … মরুচমতী নদী এখন এপার থেকে একেবারে ওপারে চলে গেছে, যেন মানুষের বাঁধ দেওয়ার ঘৃণাতে।” মানুষের লোভের আগ্রাসনে বেড়ে গেছে জমির সীমা, “ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগে এদিকে কোথায় বন , কোথায় তার সীমা, কোথায় কার কতটুকু জমি, কেউ জানতো না। একবার বন এগোতো, একবার চাষের খেত” ( মহিষকুড়ার উপকথা)।


সমালোচকেরা যাই বলুক নিজের লেখা নিয়ে স্পষ্টবাক্‌ অমিয়ভূষণ, “… তবে আমার লেখা গল্প বা উপন্যাস যে ডেলিপ্যাসেঞ্জারের রেলভ্রমণে সঙ্গী হয় না অথবা গৃহবধূর অবসর বিনোদনের সঙ্গী হতে চায় না তা আমি নিজেই অনুভব করি।”(১০) উপন্যাসের ভাষা নিয়ে বলেছেন, “ আমার মনের যে ভিশনটা আছে, সেটাই আমার গল্প। আমার ভিশনে কি ওই ডায়ালেক্টগুলো আসে? আমার ভিশনে তা স্বপ্নের মতো আসে। আমি যখন ওই সাঁওতালী ডায়ালেক্টটাকে ব্যাকরণসর্বস্ব ও খাঁটি করে ফোটাতে চেষ্টা করি তখনই আমি কিন্তু I am being false to myself—তখনই চেষ্টা করছি কিছু দিতে, চেষ্টা করে খারাপ করে দিচ্ছি বা চেষ্টা করে অন্য কিছু করছি। সুতরাং আমি কমিউনিকেশনের স্বার্থে সহজ করছি, আমার কমিউনিকেশনটাকে লিপিবদ্ধ করার জন্যে লিখি”।(১১)


“গল্প ভাবনায় বিষয়বস্তু নির্বাচনে তাঁর তথাকথিত চমক সৃষ্টির প্রবণতা লক্ষ করা যায় না। পাঠককে কাছে টানার জন্য কোন রোমান্টিক সেন্টিমেন্টাল মোহ সৃষ্টি নয়, এক নির্মোহ জীবন সম্পৃক্ত আবেগ অমিয়ভূষণের লেখার উপজীব্য হয়েছিল।”(১২) শুধু তাই নয়, তাঁর নিজস্ব ‘নৈর্ব্যক্তিক কথকতা ঢঙ’ তিনি গল্পের ভেতরে নিজস্ব আঙ্গিক-শৈলীতে পরিবেশন করেন। পাঠকরুচি বা জনপ্রিয়তার পরোয়া তাঁর কোনোদিনই ছিলো না। উচুঁ তারে বাঁধা তাঁর গল্পে তাই একদিকে যেমন আছে মানবিক সম্পর্কের নানা জটিলতা-মনস্তত্ত্বের গহীন অরণ্যে বিচরণ, তেমনি আছে প্রচলিত সামাজিক নানা ভাবনা থেকে বেড়িয়ে এসে নিজস্ব চিন্তার ভুবন। প্রথম গল্প ‘প্রমীলার বিয়ে’। প্রকাশিত হয় ‘পূর্বাশা’ পত্রিকায়, কার্তিক ১৩৫৩-এ। পর পর প্রকাশিত হয় ‘মধুছন্দার কয়েকদিন’, ‘নন্দরানী’, ‘তাঁতি বউ’, ‘ইতিহাস’, ‘গারদ’, ‘সুনীতি’, ‘দীপিতা ঘরে রাত্রি’ প্রভৃতি গল্প। তাঁর গল্পগ্রন্থগুলি হল —‘পঞ্চকন্যা’(১৯৬২), ‘দীপিতার ঘরে রাত্রি’(১৯৬৫), ‘শ্রেষ্ঠ গল্প’(১৯৮৬, বাণীশিল্প), ‘এই অরণ্য এই নদী দেশ’(১৩৯৫), ‘শ্রেষ্ঠ গল্প’(১৯৯৪, দে’জ), ‘ম্যাকডাফ সাহেব ও অন্যান্য গল্প’ (২০০০), ‘গল্পসমগ্র’ (প্রথম খণ্ড, ১৪০১)।


অমিয়ভূষণ ‘গল্প ও উপন্যাসে এক স্বতন্ত্র নিঃসঙ্গ ধারায় স্বরান্তের সন্ধানে ছিলেন’ এবং ‘তাঁর বিষয় ভাবনাও সম্পূর্ণ অর্জিত মনন নির্ভর’।(১৩) তাঁর গল্প নানা বিষয়ের— মানুষের রাজনৈতিক সংকট, নারীদের জীবনের নানাবিধ জটিলতা-সংকট,নারীর মূল্যবোধ,পারিবারিক বিপর্যয়, ভ্রমণ কাহিনি,শিকার কাহিনি ইত্যাদি। ‘প্রমীলার বিয়ে’ গল্পে শিক্ষিত আত্মসচেতন নারীর আত্মসংকটের কথা ফুটে উঠেছে। ‘আহার বিষয়টিতে তার মতো মেয়ের রুচির উপরে কারোর ছায়া পড়তে পারে’এটা তার কল্পনার অতীত ছিলো। প্রমীলা ভালোবেসেই সব মানিয়ে নিতে চায়। কিন্তু বড়দার কাছে তার স্বামীর মিথ্যাচারণে পৃথিবীর সবচেয়ে মধুরতম কথা প্রমীলার কাছে গ্লানিময় হয়ে উঠলো। অন্যদিকে লেখকের সাবলীল বর্ণনায় উঠে এসেছে যুদ্ধকালীন সময়, অভিজাত মানসিকতার প্রতিচ্ছবি। যেমন প্রমীলার বাবার প্রসঙ্গে পাই, “সব কনট্রাক্টরদের মতোই তিনি যুদ্ধের বাজারে কিছু-কিছু ভেজাল চালিয়েছেন বৈকি, কিন্তু ব্যবসায় ওতো আছেই”— ঠকানো কিভাবে সহজ জীবনাচারণ হয়ে উঠেছে তাও যেন লেখক দেখালেন। অন্যদিকে মাখনদের আভিজাত্য সম্পর্কে জানিয়েছেন যে, সাধারণকে অসম্মান কখনো নয় কিন্তু কোনো ব্যবসাদার এদের স্ববর্ণ হতে পারে না। তাই ‘প্রমীলার যেন অসবর্ণ বিয়ে হয়েছে’। “তাঁতি বউ” গল্প এক নারীর আত্মোৎসর্গের কাহিনি। “সুনীতি” গল্পে সামাজিক বৃত্তকে পার হয়ে গিয়েও শেষ পর্যন্ত নিজেকে সে অতিক্রম করতে পারে নি। আসলে নিজেকে জানা যে বড়ো কঠিন! লেখক তো আসলে পঙ্কে পদ্মেরই সন্ধানী। তাই শুরুতেই বলেন, “.. কিছুর প্রমাণ নয়, কোনো প্রস্তাবও নয়, শুধু বর্ণনা। এর বেশি আমার দাবি নেই।” আর গল্পের শেষে ভাবেন, “অদ্ভুতভাবে জড়িয়ে পড়েছে সুনীতি সারা জীবন।” প্রত্যেকটি চরিত্রের প্রতি গভীর মমতা লেখককে আমাদের চিনতে শেখায়। লেখা তাঁর ভালোবাসা। নিজের তাগিদেই লিখেছেন সারাজীবন, “লিখি নিজের সুখের তাগিদে সে কী intensive delight কি করে বোঝাবো? কোথায় ছাপা হবে, ছাপা হবে কিনা তা ভাবার যুক্তি কোথায়?”(১৪) গভীর মনস্তত্ত্বের ছবি “দীপিতা ঘরে রাত্রি” গল্পে। ক্রমাগত জটিল চিন্তা ও সবকিছুর বিশ্লেষণ তাকে জীবনের সুকমল অনুভূতি থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। শেষে তার মনে হয়, “বিশ্বাস ত্যাগ করাটা উচিত হয় নি। বিশ্বাস জিনিসটা অবিভাজ্য, প্রাচীনের প্রতি সব বিশ্বাস ত্যাগ করতে গিয়ে বর্তমানে বিশ্বাস রাখা আর সম্ভব নয়। মনে হল আশ্রয় চাই কিছু…।” “দুলারহিনদের উপকথা” গল্পের বিষয় নর-নারীর পারস্পরিক সম্পর্কের আকর্ষণ-বিকর্ষণ। “গল্প”-এ রয়েছে এক যোদ্ধৃনারীর কথা। “সাদা মাকড়সা” গল্পটিতে কথকের মনে হয়েছে নানা রূপে ‘জীবনটাই একটা স্ত্রী-মাকড়সা’। তাই শুরুতেই দেখি তার সহজ স্বীকারোক্তি— “কে কখন কি কাজ করে, কেন করে এ যদি বলা গেল তবে পৃথিবী সম্বন্ধে সব বলা হল, সীমাবদ্ধ করা হল। মানুষের মনকে কখনও পরিসীমায় বর্ণনা করা যায়?” জীবনের বিচিত্র রূপ অমিয়ভূষণ মজুমদার পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন তাঁর রচনা সম্ভারে।


অনেক নাটক লিখেছেন অমিয়ভূষণ মজুমদার। জানাচ্ছেন, “ আমার লেখক জীবনের একেবারে প্রথমদিকে আমার দু-তিনটি একাঙ্ক নাটক প্রমথ বিশী মশায়ের কাছে আমার এক আত্মীয় নিয়ে গিয়েছিলেন। আত্মীয়মুখে শুনেছি নাটকগুলি নাকি বিশী মশায়ের ‘মন্দ লাগে নি’।”(১৫) প্রথম নাটক “দা গড অন মাউন্ট সিনাই”। অন্যান্য নাটকগুলি হল “মহাসত্ব”, “রাঙাদি”, “বিয়োগ”, “মধুরার ফ্ল্যাট ও মিউজিয়াম” প্রভৃতি। এছাড়াও অমিয়ভূষণ মজুমদারের বিশেষ কৃতিত্ব তাঁর প্রবন্ধ রচনা। “রবীন্দ্রোৎসব”, “সাহিত্যের ধারণা”, “সাহিত্য ও স্বাধীন চিন্তার দায়িত্ব”, “অনুমান করি”, “শরৎচন্দ্রের উপন্যাস”, “উপন্যাস সম্বন্ধে”, “প্রাচীন কোচবিহারের ভাষা এবং সংস্কৃতি”, “সঞ্জয় ভট্টাচার্য”, “উদ্বেল সেই দয়ার সাগরকে”, “জনৈক ইমমরালিস্টের চিঠি—১”, “জনৈক ইমমরালিস্টের চিঠি—২”, “জনৈক ইমমরালিস্টের চিঠি—৩”, “স্বপ্নভঙ্গ”, “দৃশ্যকাব্য”, “লিখনে কী ঘটে”, “ঔপন্যাসিক ও জীবন দর্শন”, “সংস্কৃতি বিষয়ক প্রস্তাব”, “সাহিত্যিক জীবন মহাশয়”, “উপন্যাসের ভাষা”, “সংবিত্তি”, “উত্তরবঙ্গের ভাষা ও সাহিত্য সম্বন্ধে”, “কবিতার আধুনিকতা ও দুরূহতার বিষয়” প্রভৃতি। খেয়াল করলেই বুঝতে পারবো তাঁর বিষয়ের প্রতি বিস্তারের দিক। লেখকের মনন সবচেয়ে ভালো বোঝা যায় তাঁর সৃষ্ট প্রবন্ধ দিয়ে। আলোচ্য লেখকের ক্ষেত্রে তা আরো গভীরতর সত্য। “বুদ্ধি যে সত্তাসারের সমগ্রতা ধরতে পারে না দর্শন অনেকবার এ স্বীকারোক্তি করেছে। সেজন্যই আত্ম-আবিষ্কার আপাতদৃষ্টিতে দর্শনের ‘দায়’ বলে ভ্রান্তি জন্মালেও মানুষ সাহিত্যের দিকে না ঝুঁকে পারে না। সেজন্যই লেখা।”


উল্লেখপঞ্জি :


১. “নিজের কথা”। অমিয়ভূষণ রচনা সমগ্র-১। প্রথম প্রকাশ- এপ্রিল ২০০২। দে’জ পাবলিশিং।


২. “আমার সম্বন্ধে”। অমিয়ভূষণ রচনা সমগ্র-৪। প্রথম প্রকাশ- জুন ২০০৭। দে’জ পাবলিশিং।


৩. তদেব।


৪. “নিজের কথা”। অমিয়ভূষণ রচনা সমগ্র-১। প্রথম প্রকাশ- এপ্রিল ২০০২। দে’জ পাবলিশিং।


৫. “আমার সম্বন্ধে”। অমিয়ভূষণ রচনা সমগ্র-৪। প্রথম প্রকাশ- জুন ২০০৭। দে’জ পাবলিশিং।


৬. “রচনা প্রসঙ্গ”। অমিয়ভূষণ রচনা সমগ্র-১। প্রথম প্রকাশ- এপ্রিল ২০০২। দে’জ পাবলিশিং।


৭. “উপন্যাসের বিনির্মাণ”। তপোধীর ভট্টাচার্য। প্রথম প্রকাশ- দীপাবলী, ২০১০। বঙ্গীয় সাহিত্য সংসদ।


৮. “উত্তরবঙ্গের ভাষা ও সাহিত্য সম্বন্ধে”। অমিয়ভূষণ রচনা সমগ্র-৮। প্রথম প্রকাশ- জানুয়ারি ২০১০। দে’জ পাবলিশিং।


৯. “রচনাপ্রসঙ্গ”। অমিয়ভূষণ রচনা সমগ্র-৬। প্রথম প্রকাশ- জুন ২০০৮। দে’জ পাবলিশিং।


১০. সাক্ষাৎকার-৪। বিজ্ঞাপন পর্ব ভল্যুম- দশ, ১৯৮২।


১১. সাক্ষাৎকার-২। বিজ্ঞাপন পর্ব ভল্যুম- দশ, ১৯৮২।


১২. “প্রসঙ্গ অমিয়ভূষণের গল্প”। সুব্রত রাহা। উত্তরাধিকার, ৫ম বর্ষ ১ম সংখ্যা, অক্টোবর-ডিসেম্বর ১৯৯৫।


১৩. তদেব।


১৪. “আমার সম্বন্ধে”। অমিয়ভূষণ রচনা সমগ্র-৪। প্রথম প্রকাশ- জুন ২০০৭। দে’জ পাবলিশিং।


১৫. “রচনা প্রসঙ্গ”। অমিয়ভূষণ রচনা সমগ্র-১। প্রথম প্রকাশ- এপ্রিল ২০০২। দে’জ পাবলিশিং।


সহায়ক গ্রন্থ :


১. অমিয়ভূষণ রচনাসমগ্র, প্রথম খণ্ড — একাদশ খণ্ড


২.তপোধীর ভট্টাচার্য। ‘উপন্যাসের ভিন্ন পাঠ’। বৈশাখ, ১৪১২। বঙ্গীয় সাহিত্য সংসদ। কলকাতা।


৩. তপোধীর ভট্টাচার্য। ‘উপন্যাসের বিনির্মাণ’। দীপাবলী, ২০১০। বঙ্গীয় সাহিত্য সংসদ। কলকাতা।


৪. রমাপ্রসাদ নাগ। ‘স্বতন্ত্র নির্মিত অমিয়ভূষণ সাহিত্য’। জানুয়ারি, ২০১০। পুস্তক বিপণি। কলকাতা।


সহায়ক পত্রিকা :


১. উত্তরাধিকার।


২. বিজ্ঞাপন পর্ব।


লেখিকা বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপিকা


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন