শনিবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

বিরলগোত্রের অমিয়ভূষণ মজুমদার

 অমর মিত্র

শতবর্ষ পার হয়ে গেছে তাঁর। অমিয়ভূষণ মজুমদার থাকতেন কোচবিহার শহরে। সাহিত্যের জন্য কলকাতায় এসেছেন অনেক লেখক। অমিয়ভূষণ সেই দ্বারবঙ্গের ( দ্বারভাঙা ) বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় বা পূরণিয়ার সতীনাথ ভাদুড়ীর মতো কলকাতার বাইরে নিভৃতে থেকে গিয়েছিলেন। আজ থেকে ৩৫-৪০ বছর আগে কলেজস্ট্রিটের ফুটপাথ থেকে অমিয়ভূষণের গল্পের বই ‘দীপিতার ঘরে রাত্রি’ কিনে প্রথম পড়েছিলাম তাঁকে। এরপর পড়েছি ‘মহিষকুড়ার উপকথা’, ‘নয়নতারা’, ‘রাজনগর’—উপন্যাস। পড়েছি চাঁদবেনে, মধু সাধুখাঁ। অমিয়ভূষণ এক বিরলগোত্রের লেখক ছিলেন। অমিয়ভূষণকে আমি পড়েছি তার অসামান্য জীবনবোধের কারণে। চিত্রময়তার কারণে। আবার তাঁকে পড়িওনি তাঁর কোনো উপন্যাসের গদ্যের জটিলতার কারণে।



‘রাজ নগর’, ‘মহিষকুড়ার উপকথা’, ‘মধু সাধুখাঁ’ আমার প্রিয় উপন্যাস। ‘দুলহারিনদের উপকথা’ আমার প্রিয় গল্প। হ্যাঁ, অমিয়ভূষণের গল্প-উপন্যাস ছিল দূর অচেনা মফস্বলের মানুষজন, লৌকিক জীবন নিয়ে। উত্তরবঙ্গ, সংলগ্ন উত্তর বিহার অঞ্চলের নিরুপায় কৃষিজীবী মানুষের গল্প বলেছেন অমিয়ভূষণ। সেইসব গল্পের মানুষজনের জীবন হয়ে উঠেছে উপকথার মতো। দুলহারিন আর ভুখন যে অঞ্চলের মানুষ, সেই অঞ্চলে কাছের রেলপথ পঁচিশ ক্রোশ দূরে। বহু বহু ক্রোশ চললেও কৃষকের দেশ শেষ হয় না। মকাই আর জোয়ারের মাটি। চারদিকে পাহাড় এবং শাল মহুয়ার বন। ভুখন খেতমজুর। মহিষ চড়ায়। তার সঙ্গে থাকে দুলহারিন। তারা সহোদর না হয়েও নিজেদের ভাই বোন ভাবতে শিখেছিল একসঙ্গে বড় হতে হতে। দুলহারিন ভুখনের চেয়ে বছর দুই –চার বড়ই হবে। দুলহারিন হয়তো ভুখনের সৎমায়ের ও পক্ষের মেয়ে কিংবা বেটার বউ। ভুখনের বাবাকে সে বাবা বলত, সৎমাকে মা। তারপর এক এক করে মা বাবা মরে গেলে ভুখন আর দুলহারিন এই সংসারে দুজন মাত্র। পরস্পরের আপনার।


অমিয়ভূষণ ভুখন ও দুলহারিনের চেহারা বর্ণনা করেছেন। তাঁর বর্ণনায় ক্লাসিক লেখকের ঘরানা। দুলহারিনের বসন্ত হয়েছিল, এই জীবনে এই একটি মাত্র ঘটনা। বসন্ত তার মুখে দাগ রেখে গেছে। ফুটকিতে আচ্ছন্ন তার মুখ বেলে পাথরের বহু পুরাতন প্রতিমূর্তির মতো। ভুখনের তামা ও ছাই রঙে মিশানো রঙের ত্বক, মস্ত বড় মুখে ছোট একটা নাক। সে বিয়ে করতে পারছে না, অন্তত তিন কুড়ি টাকা লাগবে বিয়েয়। কী বিচিত্র এই জীবন। মা বাপ মারা গেলে কতদিন ভুখন তার বহিন দুলহারিনের বক্ষলগ্ন হয়ে ঘুমিয়েছে। এখন একই কুঁড়ের ভিতরে আলাদা দুটো চাটাই পেতে শোয়া। কিন্তু বর্ষায় যখন ফুটো চাল দিয়ে জল পড়ে মাটির মেঝের একটা দিক কর্দমাক্ত হয়ে যায়, তখন লাগে গোলমাল। দুলহারিন নিজের জায়গা ছেড়ে দিল ভুখনকে, কিছুতেই সে ভুখনকে নিয়ে শোবে না। ঘরের বাইরে গিয়ে থাকবে। নেহি, ঘাড় বেঁকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে দুলহারিন। সে চব্বিশ পঁচিশ, ভুখন একুশ বাইশ। দুলহারিনের না শুনে ভুখন রাগে লাফিয়ে গিয়ে তার দুকাঁধ থাবা দিয়ে ধরে। ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে দুলহারিন, ছোড়দে, বহিনকো ছোড়দে। কিন্তু বহিন কেন ভুখনের কথা শুনবে না? বেটাছেলে বাড়ির মালিক। পরেরদিন কাঁচা বাঁশ কেটে এনে ভুখন ঘর ছাইল অনেক রাত অবধি অস্পষ্ট চাঁদের আলোয়।তখন বহিন বলল, এবার শাদি কর, ঘর তো হলো। ভুখন এড়িয়ে যায় কথাটা। কিন্তু দুলহারিন জানে, পৃথিবীতে চাঁদ আর সূর্য ছাড়া কে আছে তাদের ? তাদের একজনের মৃত্যুর পর আর একজনের কী উপায় হবে, ভুখন যদি এই বেলায় বিয়ে করে কম দামে মেয়ে পাবে...।


এই গল্প এক আশ্চয জীবন বোধের। ভালোবাসার। ভুখন কী বুঝল, কাঠের পুতুল গড়ে তা বিক্রি করে টাকা জমাতে শুরু করে। পুতুল বিক্রির খুচরো পয়সাগুলো রোজ সন্ধ্যায় গুনতে বসে দুজনে। হা হা হাসে দুজনে। বিয়ে নিয়ে কত হাসি-ঠাট্টা গল্প হয়। টাকা প্রায় এককুড়ি যখন, দুলহারিন বেহুঁশ হয় জ্বরে। ডাক্তার ডেকে সেই জ্বর ছাড়ায় ভুখন। জমানো টাকা গেল, উপরন্তু ধার হয়ে গেল। ডাক্তার এক মহাজন। মাঝে মধ্যেই তাগাদা দিতে আসে। দুচার পয়সা নিয়ে যায়। না হলে পুলিশ কিংবা অভিশাপের ভয় দেখায়। ভুখন আর দুলহারিনে ঝগড়া হয়। কেন ভুখন তার জন্য নিজের টাকা বরবাদ করল? সে কি তার নিজের বহিন? কিন্তু পুরুষালী প্রীতির চোখ রাঙানির কাছে দুলহারিনের হার হয়। দুলহারিন আর কখনো বলবে না সে ভুখনের নিজের কেউ নয়। এই গল্পে অস্পষ্ট এক ছায়া আছে দুলহারিনের অন্যরকম ভালোবাসার। কিন্তু তা আন্দাজ করার ক্ষমতা ভুখনের নেই।


ভুখনের পয়সা জমানোর ইচ্ছে চলে যায় সব টাকা খরচ হয়ে দেনাদার হয়ে পড়ায়। কিন্তু দুলহারিনের সাধ হয় পয়সা জমানোর। ভুখন শুধু খরচ করতে চায় আয় করা টাকা। দুলহারিনের পায়ে একদিন পরিয়ে দেয় কাঁসার মল। এর প্রতিদান দিতে মেয়ে বেরিয়ে পড়ে নিরুদ্দেশে প্রায়। নিজে বিয়ে করে ভাইকে পণের টাকা দেবে। কিন্তু বর পায় কই ? একটি লোকের ফাঁদে পড়ে ধর্ষিতা হয়। এই গল্প ক্রমশ এক উপকথার দিকেই যেন এগোয়। দুলহারিন আর ভুখন, অচেনা যৌনতার কাছাকাছি এসে ফিরে যায়। অমিয়ভূষণ কী রহস্যময়তার দিকে নিয়ে যান এই গল্প। দুলহারিন যখন তার প্রেমের চিহ্ন প্রস্ফূটিত করে তোলে ভুখনের কাছে, ভুখনের প্রবল প্রত্যাখ্যান, প্রহার দুলহারিনকে কী যন্ত্রণায় না ফেলে, মেরে লাল, মেরে ভুখনোয়া, ভাইয়া! ভুখন কাঁদে, দুলহারিন, বহিন, আর মারব না। কিন্তু দুলহারিন পরের দিন উধাও। না উধাও হয়ে সে পারে কী করে? ভুখন তাকে খুঁজে পায় না বছর গড়িয়ে আর এক বছর গড়ালেও। এক মুরুব্বির কথায়, দুলহারিন যে বছর হারালো, সেই বছর দু-তিন হাজার নারী পুরুষ চলে গেছে মরিশাস দ্বীপে কাজ করতে। মানুষের জীবন বিচিত্র। দুলহারিন হয়েছে চার বাচ্চার মা, এক সংসারে জুটে গেছে। ইচ্ছে হলেও সে ভুখনকে খুঁজতে যেতে পারে না। কিন্তু শূন্যতা তো অনুভব করে।


ভুখন খুঁজে খুঁজে না পেয়ে দুলহারিনকে আর খোঁজে না। তবু কী একটা খোঁজেও। দুলহারিনকে খুঁজতে খুঁজতে দেশে দেশে ঘুরে বেড়ান তার নেশা হয়েছে। সারা দিন মাটি কাটার কাজ করে সন্ধ্যায় আকাশের দিকে চেয়ে শুয়ে থাকে। তারপর শুধু গল্পটাই থাকে। আর কিছু না। জীবন, জীবন, জীবন, জীবন—এমনভাবেই দেখেছিলেন অমিয়ভূষণ।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন