শুক্রবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

চেতনাপ্রবাহরীতির উপন্যাস

চেতনাপ্রবাহ বা Stream of consciousness কথাটি প্রথম ব‍্যবহার করেন উইলিয়াম জেমস তাঁর principles of psychology(1890)বইটিতে। জাগ্রত বা সজাগ মনের অবিচ্ছিন্ন চিন্তার প্রবাহ বা সচেতনতাই চেতনা প্রবাহ। একটু ব‍্যাপক অর্থে চরিত্রের মানসিক অবস্থা ও চেতনাধারার বিচিত্র অবস্থাকে ধরবার নানা কৌশলকেও ধরে নেওয়া যেতে পারে। এখানে চরিত্রের অন্তর্মুখী আত্মকথনের চরম অবস্থায় মানসিক যথাযথ প্রতিফলনই লেখকের মূল লক্ষ্য থাকে। এই রীতির প্রথম উপন‍্যাস জেমস জয়েসের 'ইউলিসিস' উপন‍্যাসটি 1922। এছাড়াও বাংলায় অন্তঃশীলা, জাগরী, একদা, বিবর, অপরাহ্ন ইত্যাদি।

চেতনা প্রবাহমূলক উপন্যাসের সংজ্ঞা নির্ণয় করতে গিয়ে পাশ্চাত্য সমালোচক রবার্ট হামফ্রি বলেছেন- “We way define stream of consciousness fiction as a type of fiction in which the basic emphasis is placed on explanation of the pre-speech levels of consciousness for the purpose, primarily, of revealing the psychic being of the characters.” অর্থাৎ চেতনা প্রবাহ রীতির উপন্যাসে চিন্তাভাবনাগুলি প্রাক-বাচনিক স্তরের যুক্তি পারম্পর্য, বাক্যগত অন্বয়, শব্দের ব্যাকরণসম্মত ও প্রথাগত বিন্যাস ইত্যাদি গতানুগতিকতা থেকে মুক্ত।

‘চেতনাপ্রবাহ’ বা ‘Stream of consciousness' শব্দবন্ধটি মনস্তত্ত্ব থেকে আহৃত। প্রখ্যাত দার্শনিক উইনিয়াম জেমস্ তার 'Principles of Psychology' তে অর্ধচেতন স্তরের নানা ভাবনা-স্মৃতি অনুভব সহ মানব মনের নিরন্তর প্রবাহকে নদীর প্রবাহমান জলধারার সঙ্গে তুলনা করেছেন- “Consciousness flow-let our call it stream of thought of consciousness, or of subjective life.” ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত এই ভাবনারই সমান্তরালে দেখা গেল আর এক দার্শনিক বেগসঁর elanvital-এ, উভয় দার্শনিক মানবমনের অন্তর্নিহিত চেতনার রহস্যটিকে ধরতে চেয়েছিলেন।

বৈশিষ্ট্য


চেতনাপ্রবাহমূলক উপন্যাসের লক্ষণগুলি নিম্নে সূত্রাকারে সাজানো হল।


  • বহির্জগৎ নয়, অন্তর্জগতের টানা পোড়েনেই এ জাতীয় উপন্যাসের মনোনিবেশ ও প্রকাশের বিষয়।

  • এ জাতীয় উপন্যাসে কোনও আকর্ষণীয় গল্প / কাহিনী, একটি সুসংবদ্ধ প্লট থাকে না। কি ঘটছে তা দেখানো নয়, কেন এবং কিজন্য ঘটছে বা চরিত্রের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া দেখানোই এর মূল উদ্দেশ্য। কেবল সময়ানুক্রমিকভাবে একটি সুষম কাহিনী বিন্যাসে বিভিন্ন চরিত্রের অন্তর্লীন আবেগ অনুভূতি এখানে ব্যক্ত করা হয় না।

  • মানব মনের বহুবিচিত্র ও অসংখ্য চিন্তা ও অনুভব, চরিত্রের যে অন্তলোক লোকচক্ষুর অন্তরালে তাকে গোচরীভূত করতে লেখক গ্রহণ করেন—অন্তরস্থ স্বগতোক্তি বা Interior monolague'-এর কৌশল।

  • মূলতঃ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অন্তর্ভাষণ, সর্বজ্ঞ বা সর্বদর্শী বিবরণ, এবং স্বগতোক্তির মাধ্যমে ঔপন্যাসিক চেতনার প্রবাহটিকে দেখাবার চেষ্টা করেন।

  • চেতনাপ্রবাহ মূলক উপন্যাসে সময়ানুক্রমিক বিন্যাস (Chronological order) থাকেনা। এক স্তর থেকে অন্যস্তরে চেতনা যেমন ছুটে চলে, তেমনি অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ সব এলোমেলোভাবে মিলে মিশে যায় চেতনা প্রবাহমূলক উপন্যাসে।

  • এই শ্রেণীর উপন্যাসে, ঔপন্যাসিক চরিত্রের অন্তর্মুখী বিশ্লেষণ দেখাতে পারেন,‌ অতিক্রম করতে পারেন স্থান ও কালের সীমাবদ্ধতার অন্তরালে। কখনো এগিয়ে, কখনো পেছিয়ে চেতনাপ্রবাহকে দিতে পারেন অনায়াস গতি।

  • চেতনা প্রবাহরীতির উপন্যাসে পাওয়া যায় এক অসম্ভব কল্পনামণ্ডিত, ছন্দোময় গদ্য, তাতে থাকে এক স্বয়ংক্রিয়তা ও আপাত অসংলগ্নতা; অনেক সময়ই ছেদ বা যতি চিহ্ন বর্জন করে লেখক অনর্গল চেতনাপ্রবাহকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ধরার চেষ্টা করে থাকেন।


আসলে চৈতন্যপ্রবাহ রীতির পূর্বাভাস ছিল অষ্টাদশ শতকের ইংরেজ উপন্যাসকার লরেন্স স্টার্নের ‘Tristram shandy (1760-67) তে উপন্যাসের প্রচলিত কাঠামো ভেঙে আঙ্গিক ও ভাষার স্বীকৃত রাজপথ পরিত্যাগ করে স্টার্ন মানব মনের গূঢ় জটিলতাকে ধরতে চেয়েছিলেন এক আপাত অসংলগ্ন দুরধিগম্য কৌশলে। Tritram Shandy-র কোথাও কোথাও তাই সাদা কিংবা কালো কিংবা তারকা চিহ্নিত পাতা মানবমনের অপার রহস্যভেদের বিচিত্র ফলশ্রুতি রূপে পরিগণিত।


দৃষ্টান্ত : ইংরেজিতে চেতনাপ্রবাহ রীতির প্রথম সচেতন শিল্পী হেনরি জেম্স তাঁর উপন্যাসে চরিত্রের অন্তর্লোককে উন্মোচন করেন, বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে দেখা গেল অতীত স্মৃতি চারণা মূলক উপন্যাস রচনার প্রবণতা। ১৯১৩তে প্রকাশ পেল মার্সেল প্রস্ত এর 'Remembrance of Things past (৬য় খণ্ড), ১৯১৫য় বের হল ডরোথি রিচার্ডসনের ‘pilgrimage' উপন্যাসের প্রথম খণ্ড ‘পয়েন্টেড রুফস'। এই উপন্যাস আলোচনা সূত্রে সিনক্লেয়ার ‘চেতনাপ্রবাহ পদ্ধতি' কথাটা প্রথম উল্লেখ করেন। ১৯২৬তে প্রকাশিত হল জেমস্ জয়েসের ‘এ পোর্ট্রেট অব দ্য আর্টিস্ট অ্যাজ দ্য ইয়ং ম্যান’ মূলতঃ ভার্জিনিয়া উল্ফ ও জেমস জয়েস উপন্যাসে চেতনা প্রবাহ রীতির মধ্য দিয়ে চরিত্রগুলিকে নিজেদের মুখোমুখি উপস্থাপন করেছেন।


বাংলাতে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘রজনী’, ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’, রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’, ‘চতুরঙ্গ’, ‘ঘরে বাইরে’, বুদ্ধদেব বসুর ‘তিথিডোর’, ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের অন্তঃশীলা’, গোপাল হালদারের ‘একদা’, সঞ্জয় ভট্টাচার্যের ‘সৃষ্টি’, সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘জাগরী’, ‘সংকট’, 'অচিনবাগিনী', সমরেশ বসুর 'বিবর', বিমল করের ‘অপরাহ্ন’, ‘অসময়' ইত্যাদি এই চেতনা প্রবাহধর্মী উপন্যাসের তাৎপর্যপূর্ণ উদাহরণ। মনে রাখতে হবে, চেতনাপ্রবাহমূলক উপন্যাস মনস্তত্ত্বমূলক উপন্যাসের উন্নততর রূপ।


একটি বাংলা চেতনাপ্রবাহ উপন্যাস সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘জাগরী’ উপন্যাস খানি চেতনাপ্রবাহমূলক রীতিতে পরিপূর্ণভাবে অভিষিক্ত। এ গ্রন্থ সম্পর্কে সমালোচক শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন “কারাগারে বন্দী একজন স্বাধীনতা সংগ্রামের যোদ্ধার মৃত্যুমুহূর্ত প্রতীক্ষায় দুর্বিসহ স্মৃতি ভাবাকুল ও কল্পনা জাল বয়নে রুদ্ধশ্বাস, অন্তিম জীবনের দুঃস্বপ্ন বিভীষিকার এক অদ্ভুত ব্যঞ্জনাপূর্ণ ও আবেগ তপ্ত চিত্র অঙ্কিত হইয়াছে। আগত মৃত্যু সম্ভাবনা তাহার সমস্ত অনুভূতিকে এমন একাগ্র ও এক লক্ষ্যাভিমুখী করিয়াছে যে, ইহার টানে তাহার পূর্বজীবনের ইতঃস্তত নিক্ষিপ্ত স্মৃতি সূত্রগুলি অনিবার্যভাবে এই সর্বগ্রাসী ভাব কেন্দ্ৰে সংহত হইয়াছে।” মূলতঃ ১৯৪২-এর আগষ্ট আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে একটি পরিবারভূক্ত চারটি চরিত্রের চেতনার স্তরে চিন্তাভাবনার আবেগ অনুভূতি অভিজ্ঞতার যে প্রবাহ ধাবিত হচ্ছিল, তাকে অর্থাৎ বিশু, বাবা, মা ও নীলু এই চারটি চরিত্রের অন্তর সত্য উদ্ভাষিত করেছিলেন সতীনাথ কালান্তরালের জীবন নিয়ে লেখা 'জাগরী' উপন্যাসে।


চেতনার প্রাক্ বাচনিক স্তরে যে অভিজ্ঞতা অনুভূতি, স্মৃতির অনুষঙ্গে যে চিন্তার প্রবাহ বিশুর ফাসিকে কেন্দ্র করে তার নিজের মনে এবং তার বাবা, মা ও ছোট ভাই নীলুর মনের গভীরে আসছিল তাকে নিপুণ শিল্প দক্ষতায় সাজিয়ে লেখক নির্মাণ করেছেন একটি সুসংহত কাহিনীবৃত্ত। জেলখানায় বসে আসন্ন মরনের অঙ্গুলি স্পর্শে জীবনের সমস্ত অভিজ্ঞতা, আশা, কল্পনা, বাসনা, স্বপ্ন স্মৃতি বিশুর সমগ্র মন জুড়ে বীণার তারের মতো অনুরণন হয়ে চলেছে। বৈপ্লবিক প্রচেষ্টার বহুমুখী কর্মোদ্যম তরুণ মনের বিচিত্র স্বপ্নবিলাস, অসম্ভব আদর্শকে রূপ দেবার জন্য নানা অসম্পূর্ণ প্রয়াস, উত্তেজনার তরঙ্গে তরঙ্গে ছুটে চলা শক্তির অভিমান ও তাকে বহুদূরে নিক্ষেপ করে এগিয়ে যাওয়া কল্পনার অভিসার জীবনের এই বিরাট প্রবাহ বিলোপের সংকীর্ণ গিরিসংকটে প্রবেশে উদ্যত হয়ে এক দুর্গম, সঙ্গীতের সুরের মতো ছন্দায়িত হয়ে উঠেছে। বিপ্লবের বস্তু, রূপটি মানবতার অশ্রান্ত আর্তির স্পর্শে একটি সুক্ষ্ম ভাবধারা অর্জন করেছে।


নির্জন 'ফাসির সেলে' মৃত্যুর প্রতীক্ষায় ‘বিশু’, ‘আপার ডিভিসনে’ তার গান্ধীবাদী বাবা, ‘আত্তবাৎকিতায়’ তার মা এবং জেল গেটে ছোট ভাই নীলু—চারটি চরিত্রই একটি ভয়ঙ্কর পরিণতিকে সামনে রেখে চিন্তার তরঙ্গে ভাসতে ভাসতে চেতনার গভীর থেকে গভীরতর প্রবাহে ডুবে গেছে। স্মৃতির আঁকা বাঁকা পথ ধরে নানা ঘটনা, কথা, স্পষ্ট ও অস্পষ্ট নানা অনুভূতি এলোমেলো ভাবে ভিড় করেছে যার মধ্য দিয়ে প্রত্যেকেই অনুভব করতে চেয়েছে আপনার অন্তর সত্যকে যা কেবল অনুভবের যোগ্য। কিন্তু যাকে জানতে বাচনি রূপে প্রকাশ করা দুষ্কর। প্রসঙ্গক্রমে সাময়িক বিশুর অন্তর্জগত সম্পর্কে উদাহরণের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে— "ওগুলি বোধ হয় কাক—এত দূর হইতে ঠিক চেনা যায় না....পাখীরা কিন্তু রাত্রে ডানা ঝটপট করে-


সেই একবার বকড়ী কোলে মিটিং করিয়া ফিরিবার সময় কামাখ্যাথানের বিরাট বটগাছটির নীচে আমাদের সারারাত থাকিতে হইয়াছিল। এখানকার মাটিতে শুইয়া থাকিলে নাকি কুন্ঠরোগ সারিয়া যায়।....অনেকগুলি কুষ্ঠ রোগী আশপাশের গাছগুলির নীচে শুইয়া রহিয়াছে, ছিলাম আমি আর নীলু; আর সঙ্গে ছিল বোধ হয় সহদেও। সারারাত পাখীর ডানা নাড়ার সে কী শব্দ! মনে হইতেছে মা দাওয়ায় বসিয়া আছেন। মাথা নাড়িতে নাড়িতে নীলুর দিকে তাকাইয়া, দণ্ডমূলে জিহ্বা ঠেকাইয়া একটু শব্দ করিলেন—‘চিক’। তারপর ছড়া কাটলেন—‘স্বভাব না যায় মলে’। নীলু আমার দিকে চোখ দিয়া ইশারা করিল–ভাবটা এই যে ‘দাদা এইবার’। দুজনে যাহা ভাবিয়াছিলাম—ঠিক যাহা ভাবিয়াছিলাম—মা সংস্কৃত শ্লোক আওড়ালেন।"

—এইভাবেই বিশুর চেতনায় একটা অভিজ্ঞতা, ঘটনার স্মৃতি ভাসতে ভাসতে আসে, আবার মিলিয়ে যায়, তৈরি হয় চলচ্চিত্রের ‘মন্তাজ’।


চেতনা প্রবাহের নিরবচ্ছিন্ন গতি পরিস্ফুট করতে সাধারণভাবে ‘অন্তভাষণ’ ব্যবহার করাই রীতি। ‘জাগরীতে’ ব্যবহৃত হয়েছে ‘প্রত্যক্ষ অন্তৰ্ভাষণ’ (direct interior mono logue.)–বিশু, বাবা, মা, নীলু, চারটি চরিত্রই উত্তম পুরুষে নিজ নিজ চেতনালোকে উন্মোচিত করেছে, এর ফাঁকে ফাঁকে প্রহরী, ওয়ার্ডার, জেলের সঙ্গীসাথী কেউ কেউ সর্বদর্শী লেখক বা পর্যবেক্ষকের মতো তাদের টুকরো মন্তব্য জুড়ে দিয়েছে। চেতনাপ্রবাহমূলক উপন্যাসের চরিত্র বা চরিত্রগুলির মানস-উপাদান অনেক সময়ই প্রকাশ করা হয় স্বগতোক্তির মাধ্যমে। লেখক সতীনাথ তাঁর চরিত্রগুলির অন্তর্ভাবনা ব্যক্ত করেছেন স্বগতোক্তির কৌশলে। চেতনা প্রবাহরীতিতে নিরবচ্ছিন্ন গতি বজায় রাখতে ‘free association.' বা 'মুক্ত অনুসঙ্গ’ কে কৌশল হিসাবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ‘জাগরী' উপন্যাসের চারটি মুখ্য চরিত্র স্মৃতির মুক্ত অনুসঙ্গের মাধ্যমে নিজ নিজ জীবনের চলটি রচনা করেছে। অতএব চেতনাপ্রবাহ মূলক উপন্যাস হিসাবে ‘জাগরী’র বিশিষ্টতাকে অস্বীকার করার নেই।



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন