শনিবার, ৮ জুন, ২০১৯

লুনা রুশদীর উপন্যাস ‘আর জনমে’

মাসরুর আরেফিন

প্রায় দশ দিন হয় পড়ে শেষ করেছি প্রথম আলো ঈদসংখ্যায় লুনা রুশদীর উপন্যাস ‘আর জনমে।’ দশ দিন ধরেই ভাবছি এটা নিয়ে লিখব। ঈদের ছুটিতে লেখাটা দ্বিতীয়বার পড়লাম সে কারণেই। কিন্তু মাঝখানে মধুসূদন-বুদ্ধদেব- অমিয়, সুমন রহমান-এর গল্পগ্রন্থ ‘নিরপরাধ ঘুম’ (আমাকে সাহিত্যজগতের একজন ‘স্ট্রংলি রেকমেন্ড’ করেছেন সুমনের বইটা পড়ার জন্য), লুই আলথুসারের একটা বড় বই, মাহবুব আজীজের উপন্যাস ‘এইসব কলহাস্য‘, ‘শব্দঘর‘ ঈদসংখ্যায় নাজিব তারেকের দীর্ঘ প্রবন্ধ এবং আরও প্রায় আট-দশটা স্বল্পায়তন জিনিস পড়া হয়ে গেল, যেমন অনলাইনে ব্রাত্য রাইসুর দুটো অণুগল্পও, এবং সেভাবেই ‘আর জনমে’ নিয়ে লেখা আর হয়ে উঠলো না।
আমি আসলে ধরেই উঠতে পারছিলাম না ‘আর জনমে’-র ওপরে লেখাটা কোথায় শুরু করবো এবং কোথায় শেষ। ধাঁধার মতো লাগছে সবকিছু। উপন্যাসটা কি ভালো লেগেছে আমার? যে-কোনো লেখার বেলায় সাধারণত এর উত্তর হয় দুটো: হ্যাঁ বা না। এখন যদি এই চিরাচরিত মোটা দাগের মধ্যে ফেলতে পারা যাচ্ছে না এমন হয় কোনো লেখা, তখন কী করব? আবার ভালোই যদি না লাগে তো দ্বিতীয়বার পড়লাম কেন?
লুনার সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয় নেই আমার সেভাবে, বছর তিনেক আগে ফোনে অসংখ্যবার কথা হয়েছিল যদিও। জিয়া হায়দার রহমান-এর বিখ্যাত উপন্যাস ‘ইন দি লাইট অব হোয়াট উই নো’-র বাংলা অনুবাদের বেলায় কথা ছিল লুনা হবেন এর অনুবাদক, আর আমি সম্পাদক। পরে আমি সম্পাদক থেকেই যাই, কিন্তু বিশেষ কিছু কারণে, লুনা বেশ খানিকটা এগোনোর পরেও, অনুবাদকের বদল ঘটে। এ-বই বাংলায় পরে বের হয় পাঠক সমাবেশ থেকে—অনুবাদ শিবব্রত বর্মনের, সম্পাদনা আমার। লুনার সঙ্গে একসাথে প্রজেক্টটা করা না হলেও আমাদের বন্ধুত্ব অক্ষত থেকে যায়, ফেসবুকে। সেখানে লুনা নিয়মিত পোস্ট দেন, আর তখনকার দিনে আমি দিই অনেক অনিয়মিত। আমার স্ত্রী লুনার পোস্ট পড়ে বলেন, ‘লুনা রুশদী ভালো লেখে।’ আর আমিও পোস্টগুলির মধ্যে প্রায়ই ভালো লেখার চিহ্ন খুঁজে পাই, তবে বেশি পাই গেরস্থালী আবেগ, বাবা-মা-সংসার ইত্যাদি নিয়ে ‘অনুভূতিময়‘ আত্মকথন, যা আমার অত পছন্দের না। এরই মধ্যে লুনার একটা কবিতা ছাপা হয় ‘প্রথম আলো‘য়, এই মার্চের শুরুতে এক শুক্রবারে। কবিতার নাম ‘নেথানের উঠানে’। সেখানে লুনা একটা লাইন লেখেন, "ভাসমান দেখায় যেমন ডানারা কী তেমনই নির্ভার?" যদিও ‘কি’ সেখানে ‘কী’ হয়ে গেছে, এবং এ-লাইনের পরে লুনা প্রশ্নটার উত্তরও দিয়ে দিয়েছেন যে: ‘যেদিন বাতাস নাই, / অথবা ঝড়ে সব নড়বড় করে / উড়াল অসম্ভব সেই সব দিনে ঝাপটানো ডানাদের / অবিরাম অবিরাম ভার’, তবু আমি ভালোই লক্ষ্য করি কী এক ভয়ংকর এই এপিসটেমোলজিকাল প্রশ্ন আর কী এক ডানাওয়ালা প্রাণীদের ক্রাইসিস মুহূর্তকে চিত্রায়িত করা অপ্রত্যাশিত ও চমকে দেওয়া তার উত্তর। আমি ‘নেথানের উঠানে’ থেকেই লুনা রুশদীকে সিরিয়াসলি নেওয়া শুরু করি। এটা ছিল আমার দীর্ঘদিনের মধ্যে বাংলায় পড়া এক আশ্চর্য-সুন্দর কবিতা (যদিও শেষ লাইনে জীবনানন্দের ‘লাশকাটা ঘরের’ উল্লেখ আমার ভালো লাগেনি এবং সেটা আমি বলেছিলাম তাকে ফেসবুকেই)।
এই-ই লুনা রুশদী। সবচেয়ে ভালোলাগার অনুভূতিতে আপনি আচ্ছন্ন হবেন, এবং তারপরই পাবেন একটা বা দুটো লাইন যা আপনার হয় ভালো লাগবে না, না হয় কেমন যেন লাগবে। এ-কারণেই, লুনা রুশদী নামের মানুষটাকে ভালোভাবে বোঝার জন্যই, আমার ‘আর জনমে’ এই ঈদের ছুটির ফাঁকে দ্বিতীয়বার পড়া।
মেলবোর্ন শহরে ঘটে এ উপন্যাসের ঘটনা, যদিও যে ‘আমি’ কথা বলছে এখানে, নাম তাবাসসুম, তার প্রাইভেট শিক্ষকের সঙ্গে সেই দূর অতীতের একপক্ষীয় প্রেমটা ঘটেছিল ঢাকায়। আমি নিজেও মেলবোর্নে ছিলাম দীর্ঘদিন, আমার চাকরি জীবনের শুরুর দিকে, আজ থেকে বাইশ বছর আগে। সে হিসেবে উপন্যাসে লুনা যে রাস্তার যেখানে গিয়ে মেলার কথা বলেছেন, যে ট্রাম রাইডের কথা বলেছেন, যে নদী বা বিল্ডিংগুলির কথা বলেছেন, সবই পড়তে গিয়ে আমার ব্যক্তিগত স্মৃতিতে ভেসে উঠছিল দারুণভাবে। লুনার বর্ণনাভঙ্গী ডায়েরি লেখার মতন (নিজের দুটো উপন্যাসে আমার নিজের বর্ণনাভঙ্গিও তা-ই), তার টোন মূলত নিরাসক্ত, তার ভিশন মূলত হেলিকপ্টার থেকে দেখার, আর তার ‘পয়েন্ট অব ভিউ‘ তার নিজের মনোজগত, তিনি নিজে। এই প্রকরণটা বাইরে যথেষ্ট চলতি হলেও বাংলা সাহিত্যে এটা তেমন চালু নয়। আমার নিজের ব্যক্তিগত পছন্দের এই একই প্রকরণ—এই প্রথম পুরুষে কথা বলা এবং পৃথিবীকে একজন লেখক নিজে যেভাবে দেখেন সেভাবেই পাতার পরে পাতায় দেখতে থাকা। এখানে লেখকের মাথার সঙ্গে লেখকের লেখার পাতার সম্পর্ক ডাইরেক্ট, লেখক যা ভাবেন বা লিখতে লিখতে যা ভাবছেন, তা এখানে অন্যের ভাবনার মধ্য দিয়ে ফিল্টারড্ হয়ে আসার কোনো ব্যাপার নেই। অতএব ‘অথেনটিসিটি‘ এই প্রকরণের, যদি মোটামুটি এটা হ্যান্ডেল করা যায় তো, সবচেয়ে বড় পাওয়া। লেখক যতোই কাল্পনিক চরিত্র নির্মাণ করুন না কেন, এ ধরনের বলায় যেহেতু একটু পর পর ‘আমি’ ফিরে আসে তার নিজের অবজারভেশনগুলি নিয়ে, তাই কনফেশনাল একটা ব্যাপার এতে খুব ভালোভাবে থেকে যায়, এবং সে-কারণেই টেরি ঈগলটনের সাহিত্যতত্ত্ব বলে যে, রিয়ালেবল ফার্স্ট পারসন ন্যারেটরের বলার মধ্যে আত্মজীবনী লেখার যে সুর চলে আসে তাতে সবচেয়ে ভালো হয় "ইতিহাসের বয়ান, যেহেতু আইডেনটিটির মামলা এখানে শুরুতেই নিষ্পাদিত"।
আবার ঝুঁকিও আছে এই প্রকরণের—‘আমি’ দিয়ে বলতে বলতে সবকিছুর অতি-ব্যক্তিগতকরণ, এবং সেভাবে অতিরিক্ত আত্মমুখীনতার কবলে পড়ার ঝুঁকি। যেমন, লিখতে গিয়ে কিছুর ব্যাপারে আপনি প্যাশনেট হয়ে পড়লেন তো, সেই প্যাশনকে আর মেলাতেই পারলেন না উপন্যাসের ওই ক্ষণ, ওই পরিস্থিতির সঙ্গে, আবার টেরও পেলেন না যে ঘোরের মধ্যে হয়ে ওঠা নার্সিসিসটিক আত্মনিষ্ঠতা কিভাবে আপনার পৃথিবীকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলল পৃথিবীরই ইতিহাস থেকে, আর শেষে স্রেফ হয়ে রইল লেখকের ব্যক্তিগত ভালো-খারাপের, রাগ-বিরাগের এক দলিল। আত্মকথনমূলক, ডায়েরিধর্মী লেখায় অতএব লেখককে হতে হয় দ্বিগুণ দূরত্বে বসে নিজের বোধকে দেখতে ও মাপতে পারার মতো নিরাসক্ত; তার শক্তি থাকতে হয় যেখানে থামার সেখানেই থেমে যাবার, আর যেখানে মনে হচ্ছে শুরুটা হলে জমতো, সেখানে শুরু না করার।
লুনা দেখলাম এই উপন্যাসে সেই শক্তির, নির্বেদ ও নিরাসক্তির সেই শক্তির, সিচুয়েশনকে উসকে দিয়ে টগবগে করে তোলার পরে মুখ ফিরিয়ে নেবার বা অতি সামান্য এক দু লাইনের পরেই ওখান থেকে হুট করে প্রস্থানের সেই শক্তির বিরাট স্বাক্ষর রেখেছেন। এই জিনিসকে সাহিত্যের তাত্ত্বিক বিচার বলে ‘এসথেটিক ডিসট্যান্স’, ‘নন্দনতাত্ত্বিক দূরত্ব।‘ পাঠক হিসেবে আপনি অনুভব করবেন কী সব ঘটছে, ভয়ংকর বা ভয়ংকরসুন্দর অনেক কিছু ঘটছে, কিন্তু আপনি আবার তা বেশি অনুভব করবেন না। ‘ইউ উইল ফিল, বাট নট টু মাচ’, বলেছিলেন ইমানুয়েল কান্ট তার ‘ ক্রিটিক অব জাজমেন্ট‘-এ, একই বিষয় নিয়ে বলতে গিয়ে। লুনা খুব ভালো পারেন দেখলাম এই ‘নন্দনতাত্ত্বিক দূরত্ব‘ সৃষ্টির ও বজায় রাখার কাজটা। উপন্যাসের নায়িকা তাবাসসুম সন্তান নেবার জন্য কাতর, বারবার তার গর্ভপাত হয়ে যাচ্ছে, সে এক বিশ্রী অধ্যায় তার জীবনের, তুহিন নামের একজনের সঙ্গে তার সংসারের, আর এখন তুহিনের কথা মনে পড়ছে তার ক্ষণে ক্ষণে, বাসার বাচ্চা একটা ছেলের সঙ্গে সে তুহিনের গল্প করছে, বলছে যে, ‘আমার প্রিন্স চার্মিং ছিল না? আ লং লং টাইম অ্যাগো’, আবার তার অফিসেরই এক সহকর্মীকে বলছে যে সে, ‘এখন আর ম্যারিড নাই‘, কিন্তু তারপরও সেই ম্যারিড থাকার সময়টুকুই ঘুরে ফিরে আসছে তার স্মৃতিচারণে। পাঠক হিসেবে আপনি আটকা পড়ে যাচ্ছেন লেখকের ‘আমি‘র পাতা জালে, দূর বা নিরপেক্ষ বা নিরাবেগ বিচ্ছিন্নতা নিয়ে আপনি পড়ছেন এক মেয়ের মা হয়ে উঠতে না পারার কষ্টের কথা, এক সংসার ভেঙে যাওয়ার ধাপের পর ধাপের কথা, কিন্তু আপনি ভালোই বুঝছেন যে লুনা রুশদী আপনাকে খুব বেশি একটা ঢুকতে দিচ্ছেন না তার সেই ‘আমি’-র আত্মকথনের মাঝখানে। অনেকটা এমন যে লেখক যেন বলছেন: ‘এটুকুই জানো, এটুকু জেনেই খুশি থাকো; এই আমার লেখার দেয়াল, ওর ওপাশটায় থাকো,‘—যেমনভাবে বলেন ফকনার তার উপন্যাস থেকে উপন্যাসে, গল্প থেকে গল্পে। আমি দেখলাম লুনার বয়ানের মধ্যে আছে স্পষ্ট ফকনারের ছায়া, মনে হলো তিনি ‘অ্যাজ আই লে ডায়িং’-এর বিরাট ভক্ত পাঠক। তিন বছর আগে জেনেছিলাম Mark Strand-এর কবিতা লুনার খুব প্রিয়, আর যারা Mark Strand পছন্দ করেন তারা ফকনার পছন্দ করবেন সেটাই স্বাভাবিক—সাহিত্যে এই বিষয়গুলো বাঁধাধরা, যেমন জীবনানন্দ যার পছন্দ তার অমিয় চক্রবর্তীকেও ভালো লাগবে বেশ, কিম্বা বিনয় মজুমদার যার পছন্দ, উৎপলকুমার বসুও থাকবেন তার ভালো লাগার দীর্ঘ তালিকায়, এরকম। তো, এই পনের বছর আগের হারিয়ে যাওয়া বিয়ে, সংসার, সন্তান ধারণের আকাঙ্ক্ষা, সব কিছুর শেষ হলো গিয়ে ফকনারিয়ান এক ঢঙে—লুনা ‘দূরত্ব’ (এসথেটিক দূরত্ব) অর্জন করলেন বিষয়কে ব্যবহারিক প্রয়োজনাদি থেকে বিচ্ছিন্ন করে, না বলে যে কী পার্থিব কারণে (বা পার্থিব কারণকে তুচ্ছ করে) উপন্যাসের নায়িকা তাবাসসুম তুহিনকে ফেলে চলে গিয়েছিল অকল্যান্ডে। অতএব আমাদের হাতে থাকলো একটা সংসার ভেঙে যাওয়ার দৈনন্দিন কাজ-বাজ, হিসাব-নিকাশের ব্যাল্যান্সশিট নয়, একটা সংসার শেষ হয়ে যাওয়া নিয়ে লেখিকার (এবং আমাদের নিজেদেরও) ধেয়ানটুকু, গভীর ভাবনাটুকু। উপন্যাসের এক দুর্দান্ত মুহূর্তে লুনার সেই ফকনারিয়ান হ্যাট পরা অংশটুকু: ‘সব সময় অস্থির। মনে হতো কোথাও শান্তিমতন একটু দম ফেলতে পারব না। সিডনি শহরটাই পচে গিয়েছিল, যেখানেই যেতাম নষ্ট রক্তের গন্ধে থাকতে পারতাম না।...আমার অকল্যান্ড যাওয়াটা ছিল সবকিছু ছেড়ে পালানো। হঠাৎ সিদ্ধান্ত।...হোটেল বুক করে ফ্লাইটের আগের রাতে তুহিনকে বলেছি।...আমি এমন একটা জায়গা চাইছিলাম, যেখানে আমার কোনো অতীত নাই। যেখানে আমি ভিড়ের একজন।...প্রতিটা গর্ভপাতের সঙ্গে সঙ্গে [আমি] একটু একটু করে ফুরিয়ে গিয়েছি। যারা কখনো ছিল না, কখনো আসে নাই, তাদের না থাকায় আমার পৃথিবী খালি হয়ে গিয়েছিল।...মানুষ কী অদ্ভুত জীব, সেই সর্বগ্রাসী শূন্যতা থেকেও সে ফিরে আসে। আবার স্বাভাবিক দেখায় পারিপার্শ্বিক।’
লুনা এসথেটিক ডিসট্যান্সটুকু এভাবে ধরে রাখেন, সেই ডিসট্যান্সটাকে ভায়োলেট করেন না, পোস্টমর্ডানিস্টদের মতো পাঠককে মনে করিয়ে দেন না যে পাঠক স্রেফ একটা বই পড়ছেন, ফিকশন; বলেন না যে পাঠকের ভাবার কোনো কারণ নেই যে এটা লুনা রুশদী বা অন্য কোনো নামের কোনো বাস্তব মানুষের বাস্তব জীবনের গল্প।
আমার সেটাই পছন্দের। ফিকশন আমাকে নায়ক-নায়িকাদের রোজকার জীবনের মধ্যে নিয়ে যাবে, অনেকখানি নিয়ে যাবে, কিন্তু বেশি নেবে না, আর যেই বেশি নেওয়া শুরু করবে তখনই লেখক বদলে ফেলবেন তার পথ, প্র্যাকটিক্যাল লাইফের প্র্যাকটিক্যাল বিষয়গুলো অমনি ছুড়ে ফেলে ঢুকে যাবেন অনুধ্যানে, গভীর চিন্তায়। পুরো উপন্যাস জুড়ে এই ‘অ্যালিয়েনেশন ইফেক্টের’ অনবরত সৃষ্টিতে আমি দেখি লুনা খুব পাকা। আর তার এ জিনিসটাই আমাকে সব থেকে বেশি টেনেছে ‘আর জনমে’ পড়তে গিয়ে।
পাঠক হিসাবে আমার চরিত্রদের জন্য সরাসরি মায়ার দরকার নেই, ওই মায়া করার বা দেখানোর মতো মানুষ যেহেতু বাস্তব পৃথিবীতে আমার অনেক আছে। আমার দরকার চরিত্রগুলোর সঙ্গে একটা ইন্টেলেকচুয়াল লেভেলের বোঝাপড়া, যাকে বলা যেতে পারে চরিত্রগুলোর জন্য ইন্টেলেকচুয়াল সহমর্মিতা; দরকার বোঝা যে তারা যা করছে তা কোন পরিস্থিতিতে, কোন পারিপার্শ্বিক টানাপড়েন থেকে করছে, এবং ইতিহাসের কোন সময়ের কোন মোচড়ের সঙ্গে তাদের সেই করাটা বা না-করাটা সংযুক্ত। পাঠক হিসাবে ব্যক্তির অভ্যন্তরীণ টানাপড়েন আমি নিতে পারি, তবে কেবল একটা দাগ পর্যন্তই, তার বেশি না। তাই হুমায়ূন আহমেদের লেখা আমার পছন্দের উপন্যাস মাত্র দু-তিনটা, তার বেশি না, অর্থাৎ শুধু সেগুলিই ভালো লাগে যেগুলিতে ব্যক্তির কাজকর্মের একটা সংসারবহির্ভূত সামাজিক বা ঐতিহাসিক ব্যাখ্যাও খাড়া করিয়েছেন হুমায়ূন। লুনা, হুমায়ূনের মতোই, কাজ করেন ব্যক্তির অভ্যন্তরীণ টানাপড়েন নিয়ে; সাংসারিক জীবনের নানান গল্প, বাবা-মা, বাচ্চাকাচ্চাদের নানান অভিব্যক্তি, নানান দৈনন্দিন কথাবার্তা, হালকা কথা, ভারী কথা এসব তিনি তুলে ধরেন হুমায়ূনের মতো করেই। পড়তে গিয়ে বেশ কয়েকবার আমি নিজেকে জিজ্ঞেসও করেছি: হুমায়ুন আহমেদ পড়ছি নাকি? কিন্তু না, তারপরেই লুনা চলে যান মনোজগতের নিবিড় সব বিশ্লেষণে, যা আবার (পাঠক বুঝতে পারেন) গড়ে উঠেছে চরিত্রগুলির বহির্জগতের নানা সংঘর্ষ, নানা ঘটনা-দুর্ঘটনার রাসায়নিক সংশ্লেষণ থেকে। যেমন, দেশ ছেড়ে বাইরে থাকাটাই তো একটা দুর্ঘটনা—কেমন এক ডলস হাউজের মধ্যে থাকা, কোথাও না-থাকা-মতো এক থাকা। বাংলাদেশী অভিবাসনের এবং বিদেশে ভালো থাকার ঠাঁটবাটের ভেতরমহলটাতে এক মর্মান্তিকতা আছে, এক কেন্দ্রাতিগ শক্তির সব ছিড়েছিটে নেবার ব্যাপার আছে। লুনা সেই বিষয়টার আঁচল ছুয়ে ছুয়ে যান উপন্যাসের প্রথম মুহূর্ত থেকে শেষ পর্যন্ত— শেষে যখন নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চ মসজিদে হত্যাকাণ্ডের প্রার্থনা সভায় অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে জড়ো হয় নানা দেশের নানা মানুষ, আর সেই ভিড়ের মধ্যে দিয়ে চকিতে এগিয়ে এসে নায়িকার হাত ধরে তার তুমুল প্রেমে পড়া মফিজ নামের সেই ঢাকার প্রাইভেট শিক্ষকের এখনকার মেয়ে, যার নাম তার বাবা রেখেছেন তার নিজের গোপন প্রেমিকার নামেই — তাবাসসুম। ব্যক্তিজীবনের গল্প এভাবেই মোড়া হয়ে যায় সমাজজীবনের কথা দিয়ে, বাস্তবেও যেমন।
উপন্যাসটা শুরুতেই আমাকে ধোঁকায় ফেলে দেয় যখন মাত্র দুপাতা পরেই লেখক একটা পুরো প্যারাগ্রাফ ব্যয় করেন বেহরুজ বুচানি নামের ইরানি-কুর্দি এক সাংবাদিকের লেখা বই ‘নো ফ্রেন্ড বাট দ্যা মাউন্টেনস’ নিয়ে বলতে গিয়ে। বেহরুজকে অস্ট্রেলিয়ার মূল ভূখণ্ডে ঢোকার অনুমতি দেয়নি লেখকের এই নতুন দেশের সরকার। লেখক বাংলাদেশ ছেড়ে গিয়ে সেখানে ঢুকতে পেরেছিলেন বহু বছর আগে, কিন্তু এখনকার বেহরুজ তা পারেননি। বেহেরুজরা কেনো তা ইদানীংকালে পারছেন না, সে গল্প আমাদের জানা। বৈশ্বিক খবরগুলোর মধ্যে অনেক বড় এক খবর এটা যে, কিভাবে অস্ট্রেলিয়া সিরিয়া সংকটের সময় তার দরজা আটকে থাকল। আমি শুরুতেই ওই প্রসঙ্গ পড়ে ভাবলাম, উপন্যাস নিশ্চিত এগুবে সেই সংকটের গল্প নিয়ে। কিন্তু না, ওই প্রসঙ্গ সরাসরি আসেনি আর কখনো। তেমন ক্রাইস্টচার্চ হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে যখন মাঝামাঝি সময়ে হঠাৎ আগুন ধরে গেল এ-উপন্যাসে, আমি ভাবলাম এর পরেরটুকু পরিব্যাপ্ত থাকবে সেই হত্যাকাণ্ডের ছোয়া ও ছায়া দিয়ে। কিন্তু না, আবারও উপন্যাস এগিয়ে যেতে থাকলো তাবাসসুমের দৃশ্য থেকে দৃশ্যে নিজের ভাবনার ডানা মেলে ফরমাল অনুধ্যান-উড্ডয়নে। এর টোন বিষণ্ণতার, এর গদ্য সান্দ্র, এর বর্ণনাভঙ্গী ইমপ্রেশনিস্টিক, এর রং গাঢ়। পুরো উপন্যাসেই। যেমন, নায়িকা তাবাসসুম তুহিনের কথা ভাবছে: "সিডনির বহু স্টেশনে স্টেশনে, ক্যাফেতে, ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরিতে, বাসস্টপে অথবা রাস্তায় এরকমই ঘুরে বেড়াতাম তুহিন আর আমি। পৃথিবীর শুরু থেকে যা কিছু ঘটে গেছে, যেসব কথা বলা হয়েছে, হাসির, কান্নার, ভালোবাসার এবং ঘৃণার শব্দ —সবকিছু নাকি একইরকমভাবে রয়ে গেছে, এদের ক্ষয় নাই। সেভাবে কান পাতলে হয়তো এখনও সেখানকার আকাশে-বাতাসে আমাদের মিলিত হাসির শব্দ শুনতে পাওয়া যাবে।" দারুণ।
তবে আমার খটকা লেগেছে ভূ-রাজনীতির অংশগুলোয় দৈনন্দিন টেবিলটকের অতিরিক্ত লুনার কোনো কিছু বলার নেই দেখে—ক্রাইস্টচার্চ হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে, জেসিন্ডা আরডার্নের ভাষণ নিয়ে, অস্ট্রেলিয়ার সরকারের ডানপন্থী অভিবাসনবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীলতা নিয়ে। কিংবা লুনা যখন তসলিমা নাসরিনের সদ্য দেশত্যাগের পরপর অস্ট্রেলিয়ার টিভিতে সিগারেট খেতে খেতে সাক্ষাৎকার দেওয়ার বর্ণনা দিচ্ছেন, তখন আমার এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো নারীবাদের রাজনীতি নিয়ে আমি বোধহয় গূঢ় কিছু শুনব এবার। শুনিনি। ওখানেও লুনা নির্বাক, কিংবা বেশি হলে তিনি মধ্যবিত্ত মানুষের সকালের চায়ের কাপ হাতে নিয়ে নিরাপদ টুকটাক ভাবনার কাছটুকু ঘুরে আসামতো।
খেয়াল করলাম, রাজনৈতিক প্রসঙ্গগুলিতেই লুনার এই মধ্যবিত্ত মনোভঙ্গি, আর ব্যক্তির ভেতরকার ও মূলতঃ সাংসারিক নানা ভাঙচুরের প্রসঙ্গ এলেই লুনা কনটেমপ্লেটিভ, চিন্তাশীল, চিন্তায় সক্রিয়। উপন্যাসের সবচেয়ে শক্তিশালী দিক লেখকের এই কনটেমপ্লেশন, এই অনুধ্যানগুলি। ওরকম মোট আছে, গাঢ়-ঘন-নিবিড়-নির্ভুল গদ্য নিয়ে ওরকম আছে, আমার গণনা মতে, ৩৭ বার —৩৭ টা ইন্টেরিয়র মনোলোগ। এটুকু সাইজের এক উপন্যাসে মোট ৩৭ বার অতএব আমি পাঠক যেতে পারলাম ভাষার ওপারে, যেখানে মনের বাস্তবতাগুলো খেলা করে পার্থিব বাস্তবতাকে নিয়ে ক্রিটিক করতে করতে। এটাই যথেষ্ট এ-উপন্যাসকে ভালো উপন্যাস, শক্তিশালী এক উপন্যাস বলবার জন্য।
পড়তে গিয়ে বুঝলাম উপন্যাসের অনেক জায়গায় ‘প্রথম আলো‘ তাদের এডিটিং বাজেভাবে করেছে। লেখকের অনুপস্থিতির হেতু তাড়াহুড়োয় তারা এমন কিছু করেছে যাতে নির্বিষ হয়ে গেছে অনেক বাক্য, অনেক বিষাক্ত-রক্তাক্ত বয়ান। আমি নিজে ‘প্রথম আলো‘-তে যেহেতু লিখি এবং আমার লেখাও তারা আগে যেহেতু একইরকম জায়গায় জায়গায় নির্বিষকরণের মধ্যে ফেলে দিতেন (আমার ভাগ্যক্রমে এখন আর ফেলেন না), তাই আমি আন্দাজ করতে পারলাম কোথায় কোথায় লুনা সেই বাজে এডিটিংয়ের শিকার হয়েছেন। এটা যখন বই হিসেবে তিনি বের করবেন, তখন এগুলি তাকে নিশ্চিত ঘষেমেজে নিতে হবে, আর আরও মেঘথমথম করে নিতে হবে প্রাইভেট শিক্ষকের সঙ্গে তাবাসসুমের একতরফা প্রেমের দারুণ শক্তিশালী অংশটুকু (তুহিনের অংশগুলির থেকে অনেক বেশি প্রাণচঞ্চল ও স্নিগ্ধ, কিন্তু অকরুণ এক অংশ সেটা)। আর সেইসঙ্গে ঈদসংখ্যায় লেখার শব্দসংখ্যা-মেপে-দেওয়া অর্গলের বাইরে গিয়ে অভিবাসনের পৃথিবী ও বর্তমানে দ্রুত-ডান-দিকে-যেতে-থাকা জাতীয়তাবাদী বংশগৌরবের পৃথিবীকে (তার অস্ট্রেলিয়া, যার উপরে উপন্যাসে ছায়া ফেলেছে ক্রাইস্টচার্চ মসজিদের লাশগুলি) চিত্রায়নের বা সেই পৃথিবী সম্বন্ধে মন্তব্য করার বিষয়ে তাকে যেতে হবে সারফেসের আরও নিচে, যেহেতু সারফেসগুলির কথা তিনি বলে ফেলেছেন।
অবশ্য তা লেখকের স্বাধীনতা। আমি সমালোচনার জায়গা থেকেই বললাম যে, এমন হলে আরও ভালো হয়, কারণ যেটুকু পড়েছি তাতে অমনটা হলে, আর একটু অমনটা হলে, গাছের কাণ্ড যেহেতু নির্দিষ্ট করাই আছে তো ডালপালা এমন আরেকটু ছড়ালে, আমার মনে হয় ‘আর জনমে’ বাংলা সাহিত্যেরই এক অনন্য সৃষ্টি হয়ে থাকবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন