আগেও হয়েছে। বিয়ের পনেরো বছরে বেশ কয়েকবার সাজিয়া টেনশনে অস্হির হয়ে
পাবলিক প্লেসে চেঁচামেচি করে অস্বস্তিকর পরিস্হিতির সৃষ্টি করেছে। ইমতিয়াজ
ঘড়ি দেখলো। পৌণে বারোটা। আখাউড়া জংশনে ট্রেন প্রায় চল্লিশ মিনিট ধরে বসে
আছে। বাইরে ভাদ্র মাসের ঝকঝকে রোদ। ইমতিয়াজের পাশের জানালায় জনাকীর্ণ
প্ল্যাটফর্মের দৃশ্য। লাল পিলারের চারপাশে বাঁধানো বেদীতে, প্ল্যাটফর্মের
নীল চেয়ারগুলোতে, মেঝেতে বসা, প্লাটফর্মে দাঁড়ানো বেচাকেনায় ব্যস্ত, বা
ক্লান্ত ও অলস কোনো অপেক্ষায় থাকা অনেক মানুষ।
সাজিয়া বিরক্ত না করলে এই দৃশ্য দেখতে মন্দ লাগতো না। কিন্তু এই মুহূর্তে সাজিয়া একটার পর একটা প্রশ্ন করে যাচ্ছে। ট্রেন এখানে আটকে আছে কেন? আমরা কখন ঢাকায় পৌঁছাতে পারবো? যদি আরও লেট হয় তাহলে আমরা কি করবো? কমলাপুর স্টেশন থেকে এফডিসি যেতে কতোক্ষণ লাগবে? ট্রেনে বসে থেকে আনন্দির গলা কি বসে যাবে? ও কিভাবে অডিশনে সাকসেসফুল হবে? যদি সাকসেসফুল না হয় তাহলে আমার মেয়েটা কি অনেক কান্না করবে? ও অনেক কান্না করলে আমরা কি করবো?
এসব বেশীরভাগ প্রশ্নের উত্তর ইমতিয়াজের জানার কোনো কারণ নেই। আনন্দির কান্নার ব্যাপারটা বাদ দিলে বাকি প্রশ্নগুলো নিয়ে ইমতিয়াজও ভাবছে। কিন্তু এই মুহূর্তে ঐ প্রশ্নগুলোর উত্তর কেউই জানে না। আজকে আনন্দির ‘ক্ষুদে গাইয়ে’ প্রতিযোগিতার টিভি রাউন্ড অডিশন। চিটাগাং-এর আঞ্চলিক রাউন্ডে সে সিলেক্টেড। টিভি রাউন্ডের জন্য তাকে অনেক যত্ন করে তৈরী করা হয়েছে। দুজন প্রফেশনাল গায়িকা আনন্দিকে গত দুই সপ্তাহ ধরে ট্রেনিং দিয়েছে। এর মধ্যে একজন একটা রিয়ালেটি শো-তে সেকেন্ড রানার আপ। এদের পেছনে বিস্তর টাকা খরচ হয়েছে। ওদের টানাটানির সংসারে এসব খরচ রীতিমতো বিলাসিতা। কিন্তু সাজিয়ার এসব নিয়ে কোনো চিন্তা বা আপোষ নেই। ধারকর্জ করে টাকার জোগাড় করেছে ইমতিয়াজ।
আজকের রাউন্ডে সিলেক্ট হলে আনন্দি টপ পনেরোতে চলে যাবে। টপ পনেরোর টিভি কম্পিটিশন ঢাকায়। সেই কম্পিটিশনে গেলে আনন্দির জন্য ঢাকায় থাকা-খাওয়ার টাকা দেয়া হবে। ঢাকায় আসার খরচাও দেয়া হবে। আনন্দি আজকে সিলেক্ট হয়ে গেলে ওকে নিয়ে সাজিয়া ঢাকায় তার বোনের বাসায় থাকবে। এসব ব্যবস্হা সাজিয়া আগেই করে রেখেছে। কিন্তু আজকের রাউন্ডে সিলেক্ট না হলে কি হবে সেই চিন্তা সাজিয়ার নেই। ট্রেন সংক্রান্ত অনিশ্চয়তার সাথে ইমতিয়াজের মাথায় সেই চিন্তাও আছে। আজকের রাউন্ডে আনন্দি সিলেক্ট না হলে ধারকর্জগুলো বিশাল বোঝা হয়ে যাবে।
আনন্দি বাসে চড়লে অসুস্হ হয়ে পড়ে। ঢাকায় যাওয়ার একমাত্র উপায় তাই
ট্রেন। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও গতকালকের জন্য কোনো ট্রেন টিকেট পাওয়া
যায়নি। এটা নিয়ে সাজিয়ার প্রচন্ড রাগ। সাজিয়ার ধারণা ইমতিয়াজের আলস্যের
কারণেই ট্রেনের টিকেট মিস হয়েছে। আরও আগে টিকেট করলে পাওয়া যেতো … তখন এতো
রিস্ক নিয়ে আজকেই রওনা হতে হতো না। সাজিয়ার যুক্তিটা সঠিক, কিন্তু
ইমতিয়াজের সমস্যা টাকা। ট্রেনের টিকেটের জন্য টাকা জোগাড় করতে অনেক সময়
লেগেছে। সীমিত টাকায় স্নিগ্ধা ক্লাসের টিকেট করা গেছে। এসি প্রথম শ্রেণীর
টিকেট না করায়ও সাজিয়া ক্ষেপে গেছে। টিকেট দেখেই বলেছে, এসিতে না গেলে আমার
মেয়েটা গরমে অসুস্হ হয়ে যাবে … ও গান গাইবে কিভাবে? তুমি এসব একবারও ভাবলে
না? কেমন বাপ তুমি?
ইমতিয়াজকে জানালা দিয়ে বাইরে তাকানো অবস্হায় দেখে সাজিয়া শীতল কণ্ঠে বললো, এমন ভাবুক হয়ে কি দেখো?
– কিছু না। প্ল্যাটফর্মের মানুষজন দেখি।
– প্লাটফর্মের মানুষ দেখে কি হবে ? এসব না দেখে বাইরে গিয়ে খবরাখবর করো।
ট্রেন এখানে এতো লেট হলে কিভাবে হবে? আমার মেয়েটার অডিশনে লেট হয়ে যাবে
না?
ইমতিয়াজ ঢোক গিললো। সাজিয়া বেশ উঁচু স্বরে কথা বলছে। কথা বলার সময় ও আশেপাশে তাকাচ্ছে। ওদের কাছাকাছি একটা মাঝবয়সী দম্পতি বসেছে। তারা উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তাদের সেই দৃষ্টি সাজিয়াকে আরও উৎসাহ দিচ্ছে। আনন্দির অডিশনের ব্যাপারে ও এখন এমনভাবে কথা বলবে যেন সেই দম্পতি আগ্রহ নিয়ে এসব ব্যাপারে জানতে চায়। মানুষকে এসব বলার ব্যাপারে সাজিয়ার কোনো ক্লান্তি নেই। ইমতিয়াজ মনে মনে চাচ্ছে সেরকম কিছুই হোক। এসব নিয়ে অপরিচিত কারও সাথে কথা বললে সাজিয়ার টেনশনটাও কমবে।
ইমতিয়াজকে চুপ দেখে সাজিয়া স্পষ্ট স্বরে বললো, আমার এতো ট্যালেন্টেড একটা মেয়ে … জাস্ট এই দেশের এসব অনিয়মের কারণে ঠিকমতো তার ট্যালেন্ট দেখাতে পারবে না। আমরা কালকে রওনা হলে আমার মেয়ে নিশ্চিত অডিশনে টপ করতো। পরশু থেকে ওকে টিভিতে দেখতো সবাই।
পাশে বসা ভদ্রলোক নড়েচড়ে বসলেন। তার চোখেমুখে আগ্রহ দেখা যাচ্ছে।
ইমতিয়াজের ধারণা তিনি এখনই সাজিয়ার সাথে কথা বলবেন। অপরিচিত কোনো
ভদ্রমহিলার সাথে আলাপ শুরু করার এমন সুযোগ কারও ছাড়ার কথা না। ইমতিয়াজের
ধারণাকে সঠিক প্রমাণ করে তিনি বললেন, এক্সকিউজ মি … আপনার মেয়ে কি কোনো
টিভি শো-তে যাচ্ছে?
সাজিয়ার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে গেলো। ওকে দেখে মনে হলো ওর টেনশন এক নিমিষে অনেকটাই কেটে গেছে। ইমতিয়াজ মনে মনে হাসলো। গুড। এখন আরাম করে প্লাটফর্মের দৃশ্য দেখা যাবে। প্লাটফর্মের দিকে তাকাতেই ইমতিয়াজ শুনলো সাজিয়া খুব গুছিয়ে কথা বলা শুরু করেছে। ওর বলার ভঙ্গিতে মনে হচ্ছে ও এসব বলার জন্য অনেকক্ষণ ধরেই তৈরী হয়ে ছিলো।
– হ্যাঁ ভাই, আর বলবেন না … মেয়েটা আমার মাশাআল্লাহ খুব ট্যালেন্টেড বুঝলেন। আল্লাহর দেয়া গলা নিয়ে জন্মেছে। প্রফেশনাল লেভেলের গলা … ওর গান একবার যে শুনেছে সে-ই বলেছে সিডি বের করতে। কিন্তু এসব খরচ তো সম্ভব না। তবে ক্ষুদে গাইয়ে মিউজিক্যাল শো হচ্ছে না … ওখানে চিটাগাং রাউন্ডে গান গেয়ে আমার মেয়েটা সবাইকে স্পেলবাউন্ড করে দিয়েছে। ওখানে জাজরা ওর গান শুনে স্তব্ধ …. আর ঐ যে ইয়াং করে একজন মহিলা জাজ আছে না, কনি হক … টিভিতে এ্যারন নামের ছেলেটার সাথে গান টান গায় … চিটাগাং রাউন্ডে আমার মেয়েটার গান শুনে সে রীতিমতো জেলাস … চোখমুখ লাল হয়ে গেছে ….
– বলেন কি! কনি হক জেলাস হয়ে গেলো! আরে এদের তো এমন ইয়াং ট্যালেন্টকে মোটিভেট করার কথা ….
ইমতিয়াজ মনে মনে হাসলো। ব্যাটা ভালোই আলুবাজ। নিজের জন্য আরও কনভারসেশনের ফিল্ড তৈরী করছে। আনন্দি ভালো গায়, সন্দেহ নেই। কিন্তু সাজিয়া যেভাবে বলছে সেরকম কিছুই হয়নি। আনন্দির গান শুনে জাজরা সবাই খুব সুন্দর সুন্দর কথা বলেছিলেন। ওকে আরও রেওয়াজ করতে, আরও আবেগ দিয়ে গাইতে বলেছিলেন। ইমতিয়াজের ধারণা সাজিয়ার এখনকার কথাবার্তা শুনে আনন্দি খুব অস্বস্তিবোধ করছে। আনন্দি খুব লক্ষী মেয়ে, ও নিজের অবস্হান খুব ভালোই বোঝে। সাজিয়ার এসব আচরণ ওকে খুব বিব্রত করে। তবুও ও কিছু বলে না।
সাজিয়া হাত নেড়ে নেড়ে বেশ জোর গলায় বলছে, কি যে আপনি বলেন ভাই … আপনি
এই সেলিব্রিটি লাইনের কিছুই জানেন না। এরা সব কূটনা … এরা কেউই চায় না এমন
ইয়াং ট্যালেন্টরা উঠে আসুক। কিন্তু সত্যিকারের ট্যালেন্টকে কে আটকাবে বলেন …
আমার মেয়েটা সবাইকে মাত করে সিলেক্ট হয়ে গেলো। এখন ঢাকা যাচ্ছি অডিশনের
জন্য … এটা জাস্ট একটা ফরমালিটি আর কি। চিটাগাং রাউন্ডের অন্য দুজন জাজ তো
বললো যদি ফরমালিটির ব্যাপার না থাকতো আমার মেয়েকে তারা ডাইরেক্ট ফাইনালেই
নিয়ে যেতো।
– বলেন কি! এমন বললো? ডাইরেক্ট ফাইনাল !!
– হ্যাঁ ভাই, আপনাদের দোয়া বুঝলেন। একজন সুরকার জাজ ছিলো যে … সে তো সিনেমায় গান গাওয়ার অফারও দিয়ে রেখেছে …
বারোটার উপরে বাজছে। এখনও ট্রেন ছাড়ার কোনো লক্ষণ নেই। ইমতিয়াজের জানালার কুড়ি গজের মতো দূরত্বে প্লাটফর্মে একজন বৃদ্ধ ভিক্ষুক শ্রেণীর লোকের সাথে একটা দশ এগারো বছরের ছেলেকে হাঁটতে দেখা যাচ্ছে। বৃদ্ধ লোকটা বাঁশী বাজাচ্ছে আর ছেলেটা গান গাইছে। ছেলেটার হাতে একটা সিলভারের বাটি। গানের সাথে ছেলেটা সিলভারের বাটিতে হাত দিয়ে ঠুকে তাল বাজাচ্ছে। আবদুল আলীমের বিখ্যাত গান। আর কতোকাল ভাসবো আমি দুখের সারি গাইয়া, আমার জনম গেলো ঘাটে ঘাটে ভাঙা তরী বাইয়া।
ইমতিয়াজের কানে এখন আর কিছুই আসছে না। অপূর্ব বাঁশীর সুরের সাথে ছেলেটার সুরেলা কণ্ঠে ভেসে আসা গান ওকে সম্মোহিত করে ফেলেছে। ছেলেটার গান শুনে মনে হচ্ছে সে কণ্ঠ বা হৃদয় থেকে না, আত্মা থেকে গাইছে। এমন গান ইমতিয়াজ বহুদিন শোনেনি। গানের এমন আবেদন ইমতিয়াজ বহুদিন অনুভব করেনি।
তারা দুজন ট্রেনের দিকেই আসছে। গানের অন্তরা হচ্ছে। আমি রইলাম শুধু দয়াল আল্লাহ তোমার পানে চাইয়া …. ইমতিয়াজ অনুভব করলো ওর শরীরের পশম খাড়া হয়ে যাচ্ছে। প্লাটফর্মের কিছুই ও আর দেখতে পাচ্ছে না … ওর মনে হচ্ছে ও ভরা নদীর বুকে একটা নৌকায় বসে আছে। সেই নদীর সর্বাঙ্গে ঢেউ। নদীর বাতাসে এই গান হচ্ছে। কে এই গান গাইছে ইমতিয়াজ সেটা জানে না।
ছেলেটা আর তার সাথের বংশীবাদক বৃদ্ধ এখন ইমতিয়াজের জানালার খুব কাছে।
তাদেরকে ঘিরে অল্প কিছু লোক জড়ো হয়েছে। ছেলেটা গান শেষ করে সিলভারের বাটি
এগিয়ে টাকা চাচ্ছে। কেউ তেমন কিছু দিচ্ছে না। ইমতিয়াজ কাঁপা কণ্ঠে বললো, এই
শোনো, এখানে আসো।
ছেলেটা কিছু বলার আগেই সাজিয়া বললো, কি হলো, কাকে ডাকো তুমি?
– ঐ ছেলেটাকে … খুব সুন্দর গাইছে … আরেকটা গান শুনি ওর।
সাজিয়া ধাতব কণ্ঠে বললো, তুমি আর কাজ পাও না, না! তোমার নিজের মেয়ে এতো ভালো গান গায়, আর এখন এখানে বসে আমরা ভিখিরিদের গান শুনবো!…. খবরদার …
আনন্দি মৃদু স্বরে বললো, আম্মু ছেলেটা অনেক সুন্দর গান গায় …
– চুপ করো। তোমাকে মাঝখানে কথা বলতে হবে না। এসব ছেলেরা নেশা টেশা করে
গান গেয়ে আরও নেশার পয়সা কামাচ্ছে … এসব আবার গান নাকি …. তুমি নিজে এতো
ট্যালেন্টেড, টিভিতে যাচ্ছো … তুমি এখন এদের এসব হাউকাউ শুনবে!
ইমতিয়াজ কিছু না বলে আবার বাইরে তাকালো। আনন্দি ওর পাশে এসে বসেছে। ইমতিয়াজের কাঁধে হাত রেখে আনন্দি বললো, ওকে আরেকটা গান করতে বলো বাবা, প্লিজ।
জানালার পাশেই ছেলেটা দাঁড়ানো। রোদে পোড়া তামাটে মুখমন্ডল, চোখ কোটরে
বসে গেছে। কিন্তু সজাগ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। কাপড়-চোপড়ে অভাবের স্পষ্ট ছাপ।
ইমতিয়াজ কোমল স্বরে বললো, আরেকটা গান করো, প্লিজ।
– কোন গান শুনবেন?
– আবদুল আলীমের যে কোনো গান।
– গান প্রতি কুড়ি ট্যাকা। আগে ট্যাকা দেন।
ইমতিয়াজ পকেট থেকে একশ টাকার নোট বের করে দিলো। ছেলেটা স্পষ্ট স্বরে বললো, ভাঙতি নাই। আইজকা কোনো কামাই হয় নাই।
– লাগবে না। তুমি গান করো।
ছেলেটা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, একশ ট্যাকায় পাঁচ গান হইবো। আগেরটা একটা হইয়া গেছে, এখন দ্বিতীয় গান হইবো।
– করো, তুমি পাঁচটা গানই করো।
ছেলেটা সাথে সাথে গান শুরু করলো। আল্লাহু আল্লাহু তুমি জাল্লে জালালু, শেষ করা তো যায় না গেয়ে তোমার গুণগান। তুমি মাটির আদমকে প্রথম সৃষ্টি করিয়া, ঘোষণা করিয়া দিলে শ্রেষ্ঠ বলিয়া।
চোখ কখন ভিজে গেছে ইমতিয়াজ খেয়াল করেনি। ওর কাঁধে আনন্দির হাত। সেই হাত
অল্প কাঁপছে। ইমতিয়াজ ছেলেটার গানে ডুবে থেকেই টের পেলো আনন্দিও মনে মনে
কাঁদছে। একজন শিশুশিল্পী আরেকজন শিশুশিল্পীর গান শুনে অদৃশ্য অশ্রুতে শুদ্ধ
শ্রদ্ধা জানাচ্ছে। ছেলেটার গান শোনার জন্য এখন প্লাটফর্মের ঐ অংশটায় তাকে
ঘিরে ভিড় জমছে। ট্রেনের কামরার কয়েকজন যাত্রীও ইমতিয়াজের জানালার কাছে এসে
দাঁড়িয়েছে। চোখেমুখে মুগ্ধতা নিয়ে তারাও গান শুনছে।
সাজিয়া আসেনি। ও স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। গানের শুরুতে সাজিয়া কি কি সব বলার চেষ্টা করছিলো। কিন্তু ট্রেনের সেই মাঝবয়সী ভদ্রলোক যখন ‘এক্সকিউজ মি’ বলে উঠে জানালার কাছে এসে দাঁড়ালো, সাজিয়া কথা বলার জন্য আর কাউকে খুঁজে পেলো না।
ছেলেটা গান শেষ করার পরপরই ঐ ভদ্রলোক বললেন, প্রেমের মরা জলে ডুবে না, এই গানটা পারো?
বৃদ্ধ লোকটা বললো, আবদুল আলীমের সব গানই সে পারে। বিশেষ অনুরোধের গান গাইলে তিরিশ ট্যাকা।
– ও কি আপনার ছেলে?
– জ্বি জনাব। তয় সে অনেক বড় গাতক … আমার সঙ্গীত এতো বড় না। সে সঙ্গীতে আমারে ছাড়ায়ে গেছে। সঙ্গীতে সে আমার পিতার সমান।
আনন্দি কাঁপা কণ্ঠে বললো, তোমার নাম কি?
ছেলেটা নাম বললো না। এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ আনন্দির দিকে তাকিয়ে হঠাতই
গান শুরু করলো। শোনো গো রূপসী কন্যা, কার লাগিয়া গাথো ফুলের মালা।
ট্রেন হুইসেল দিচ্ছে। রূপসী কন্যার গান এখনও শেষ হয়নি। অন্তরাতে ছেলেটার
কণ্ঠে সুরের অপূর্ব কাজ হচ্ছে। গানের সাথে অপরূপ মাধুরীতে মিশেছে বাঁশীর
সুর। ওদেরকে ঘিরে মুগ্ধ শ্রোতারা নির্বাক হয়ে গান শুনছে। এদের কারও অন্য
কোনোকিছুর খেয়াল নেই।
ইমতিয়াজের চোখ থেকে পানি পড়ছে। মুগ্ধতার সেই কান্নায় ও কোনো লজ্জাই পাচ্ছে না। ওর পাশে বসা আনন্দিও নিঃশব্দে কাঁদছে। ইমতিয়াজ মনে মনে বললো, বাবা, তুমি অনেক বড় শিল্পী … অনেক অনেক বড় শিল্পী। স্রষ্টা নিজে তোমার কণ্ঠে সুধা ঢেলেছেন। মাশাআল্লাহ।
চারপাশের পৃথিবীর মুগ্ধতার কোনোকিছুই ছেলেটাকে স্পর্শ করছে না। ওখানে দাঁড়িয়েই সে আপন সুরে মগ্ন হয়ে গান গাইছে। কে শুনছে বা আর কোথায় কি হচ্ছে এসব কিছুই তার ধ্যানে নেই। ট্রেনের হুইসেলে আর প্লাটফর্মের ব্যস্ততায় সেই গান গাওয়ার কোনো হেরফের হচ্ছে না। ইমতিয়াজের মনে হচ্ছে ছেলেটার গান বাস্তব কোনো ঘটনা না, মায়াবী কোনো স্বপ্ন। ট্রেনের হুইসেলের শব্দকে এখন অপার্থিব আর পার্থিবের পালাবদলের ডাক মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে এটা আখাউড়া জংশন না, এটা পার্থিব-অপার্থিবের সন্ধিস্হল।
ট্রেনের সেই ভদ্রলোক তার অনুরোধের গান শুনতে পারেননি। তবুও তিনি পকেট থেকে পঞ্চাশ টাকার নোট বের করে ছেলেটার দিকে এগিয়ে দিলেন। ট্রেন নড়তে শুরু করেছে। প্লাটফর্মের সঙ্গীতময় দৃশ্য দূরে যেতে শুরু করেছে। কিন্তু ট্রেনের শব্দ ছাপিয়ে ছেলেটার গান তার গুণমুগ্ধ শ্রোতাদের হৃদয়ে ভেসে আসছে।
ট্রেনের কামরার সবার মধ্যে এখন একটা অস্বাভাবিক নীরবতা। প্রায় সবার চোখেমুখে ঘোর লাগা মুগ্ধতা। কেউ কারও সাথে কোনো কথা বলছে না। শুধু সাজিয়া কথা বলার চেষ্টা করছে। থমথমে কণ্ঠে নিজেকেই নিজে বলছে, এই দেশে সত্যিকারের ট্যালেন্টের কথাও কেউ শুনতে চায় না। আমি আমার মেয়েটার ট্যালেন্টের কথা বলছিলাম, আপনারা সবাই কোন এক ভিখিরির গাঁজা খাওয়া গান শুনতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন … এটা হচ্ছে হাবিজাবির দেশ … স্টান্টবাজির দেশ ….
ইমতিয়াজ সাজিয়ার কথা শুনতে পেলো। সাজিয়া ইমতিয়াজের ভালোবাসার মানুষ। ওর
কথা ইমতিয়াজ শুনতে পাবেই। তবে ওর ধারণা ট্রেনের কামরার আর কেউই এসব শুনছে
না। আনন্দিও না।
কেতন শেখ
সাহিত্য,
কাব্য, সঙ্গীত আর শিল্প নিয়ে কেতন শেখ-এর স্বপ্নময় জীবন। ২০১৩ থেকে জাগৃতি
প্রকাশনীর সাথে নিয়মিত লিখছেন। কাজল, নীল গাড়ি ও সাদা স্বপ্ন,
এক-দুই-আড়াই, অধরা অনুরাগ ও অভিসরণ আলোচিত উপন্যাস। এ ছাড়াও লিখেছেন
অন্তঃস্রোত (গল্পগ্রন্হ) ও চতুষ্পথ (কাব্যগ্রন্হ)। বাংলা কবিতা, বাঙালিয়ানা
ম্যাগাজিন, প্রিয়.কম সাহিত্য পত্রিকা, আলফি পত্রিকা, নক্ষত্র ও অন্যান্য
ব্লগে ও পত্রিকায় নিয়মিত লেখেন।
জন্ম ঢাকায়। ভ্রমণ শৌখিন। পৃথিবীকে দেখার স্বপ্ন নিয়ে ভ্রমণ করেছেন ভারত, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, স্পেন, সুইজারল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, চীন, কোরিয়া ও অন্যান্য দেশে। পেশায় অর্থনীতিবিদ। যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অফ সাউদাম্পটন থেকে অর্থনীতিতে পি এইচ ডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন। বর্তমানে লন্ডনের ইউনিভার্সিটি অফ ওয়েস্টমিন্স্টারে অর্থনীতির সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। লেখালেখির মতো সঙ্গীতও তাঁর অন্যতম প্রিয় শখ। তাই মাঝে মাঝে অবসরে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত রেকর্ডিং স্টুডিও এপসিলনে নীল বাতি জ্বালিয়ে সুর সৃষ্টি করেন।
ব্যক্তিজীবনে আড্ডাপ্রিয় ও বন্ধুপরায়ণ। স্ত্রী ও দুই পুত্রকে নিয়ে থাকেন ইংল্যান্ডের এইল্সবারীতে।
জন্ম ঢাকায়। ভ্রমণ শৌখিন। পৃথিবীকে দেখার স্বপ্ন নিয়ে ভ্রমণ করেছেন ভারত, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, স্পেন, সুইজারল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, চীন, কোরিয়া ও অন্যান্য দেশে। পেশায় অর্থনীতিবিদ। যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অফ সাউদাম্পটন থেকে অর্থনীতিতে পি এইচ ডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন। বর্তমানে লন্ডনের ইউনিভার্সিটি অফ ওয়েস্টমিন্স্টারে অর্থনীতির সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। লেখালেখির মতো সঙ্গীতও তাঁর অন্যতম প্রিয় শখ। তাই মাঝে মাঝে অবসরে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত রেকর্ডিং স্টুডিও এপসিলনে নীল বাতি জ্বালিয়ে সুর সৃষ্টি করেন।
ব্যক্তিজীবনে আড্ডাপ্রিয় ও বন্ধুপরায়ণ। স্ত্রী ও দুই পুত্রকে নিয়ে থাকেন ইংল্যান্ডের এইল্সবারীতে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন