বুধবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০১৪

শাহাদুজ্জামানের গল্প : মিথ্যা তুমি দশ পিঁপড়া


যুবকের তিনটি চিঠি আমদের হাতে। প্রথম চিঠিটি তার মায়ের কাছে। সম্ভবত তখন প্রশিক্ষনের সবেমাত্র শুরু। যুবকের বিহ্বলতা।
মা/
তোমাকে সশস্ত্র সালাম। এখানে এসে এই নতুন রকমে সালাম দেওয়া বেশ কায়দা করে শিখছি। সকাল বিকাল মাথা উচু ,শিরদাড়া সোজা আর সিনা টান করে কুচকাওয়াজ করে চলেছি। একবার ডান পা তুলছি আর একবার বাম পা। মাটির উপর বুটের গোড়ালি সেইটুকু জোরে লাগাবার চেষ্টা করছি যাতে মাথার ব্রহ্মতালু কেপে উঠে। এতদিন জানতাম মানুষের মগজটাই আসল,  এখন তো দেখছি আসল হলো হাঁটু। দুটো সুস্থ সবল হাঁটু থাকলেই জীবনে সাফল্য নিশ্চিত।
সময় কাঁটে বেল্টের পিতল চকচক করছে কিনা, বুটের পালিশে আমার মুখ দেখা যাচ্ছে কিনা এইসব উদ্বিগ্নতা নিয়ে। প্রতিনিয়তই আমাদের স্মরণ করিয়ে দেওয়া হচ্ছে আমরা দেশরক্ষার মহান দায়িত্বে নিয়োজিত সম্মানিত নাগরিক,দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান । অতএব আমদের চলা, কথা, ভাবনা সবই হবে অন্যরকম ,বিশিষ্ট। তাই অভিনব সব পরিক্ষা নিরীক্ষা চলছে আমাদের মন আর শরীরের উপর। ডিগবাজি দিতে দিতে বমি করে ফেলছি। ঘন্টার পর ঘন্টা মাথা নিচে পা ওপরে দিয়ে থাকতে থাকতে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছি। জ্ঞান ফিরলে আবার টলতে টলতে গিয়ে বসছি অস্ত্র-বিদ্যার ক্লাসে। মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে হ্যাভার স্যাক কাঁধে নিয়ে পাশের জংগলে মাইল তিনেক দৌড়ে এসে আবার শুয়ে পড়ছি বিছানায়। পাখিপড়ার মতো পালন করে যাচ্ছি সব আদেশ। যুদ্ধ যার পেশা,আদেশ পালনের ক্ষেত্রে তার কোন দ্বিধা থাকতে নেই,প্রশ্ন থাকতে নেই,আবেগ থাকতে নেই।

কিন্তু মা এই ঘোরটোপের জীবন কি চেয়েছিলাম আমি? বৃহত্তর মানুষের স্বপ্ন নিয়ে মিছিল করতাম। চেয়েছিলাম এমন কিছু করতে যা শুধু আমার ব্যক্তিগত জীবন ঘিরে আবর্তিত হবে না, ছড়িয়ে যাবে আরও অনেক মানুষের মধ্যে। কিন্তু তোমরা সেই জীবন কে ভয় পেলে। আমাদের পারিবারিক এই ছোট মিছিলকেই তোমরা বড় করে তুললে আমার কাছে। উৎসাহ দিয়ে বললে ,সংক্ষিপ্ত সময়ে একটা নিরাপদ ,সম্মানজনক উপার্জনের এটিই সবচেয়ে ভাল উপায়। তা ঠিক ,একটা সুঠাম শরীর ,কলেজ পর্যন্ত বিদ্যা আর বছর দুয়েকের এই বিচিত্র প্রশিক্ষণ শেষে আমার অর্থকরী আর সামাজিক মুল্য বেশ ভালই হবে। কিন্তু মা,কি করে মেলাবো এইসব প্রশ্ন? যখন আমরা একদিকে ভ্রূণ হত্যাকে বলছি অপরাধ আবার এইদিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শিখছি মানুষ হত্যারই কৌশল। যখন একজনকে হত্যা করলে তাকে বলছি খুনী,আর হাজার হাজার মানুষ কে হত্যা করতে পারলে তাকে বলছি বীর। যে অস্ত্র আমার হাতে উঠেছে ,কে জানে হয়তো একদিন সেই মিছিলের দিকেই তাক করতে হবে আমার রাইফেল। ভেবেছিলাম শুধু অর্থ উপার্জনের জন্য যে কোন একটা জীবিকার কাছে নতজানু হওয়ার এই মধ্যবিত্ত পরিণতি কে ভাঙতে পারবো। মেলাতে পারবো জীবন আর জীবিকার সমীকরন। সেটা আর হলনা। তোমাদের অবাধ্য হওয়াই কি উচিত ছিল আমার? মনের ভেতর ক্ষোভ আর দ্বিধা নিয়ে শরীরটাকে ইউনিফরমের ভেতর ঢুকিয়ে এভাবেই দিন কাটাচ্ছে তোমার হবু লেফটেন্যান্ট ছেলে। তোমার মনে আছে মা,ছোটবেলায় বাবা আমকে কঠিন সব ইংরেজী বানান শিখাতে গিয়ে এই “লেফটেন্যান্ট” শব্দটিও শিখিয়েছিলেন একদিন। বলেছিলেন “মিথ্যা তুমি দশ পিপড়া ” এই অদ্ভুত বাক্যটিকে কৌশলে অনুবাদ করলেই বানানটা পাওয়া যাবে। কী কাণ্ড দেখো, এতদিন পরে ঐ বাক্যটিই যেন ভর করেছে আমার ওপর। ঐ অর্থহীন বাক্যটিই অনেক অর্থবহ মনে হচ্ছে এখন। কেন যেন ঐ উদ্ভট কথাগুলো উচ্চারণ করলেই মনের ভেতর বেশ একটা আরাম পাচ্ছি। মার্চপাস্টের সময় মনে মনে তাই বাক্যটা আওড়াই। ডান পা ফেলি,বলি মিথ্যা,বাঁ পা ফেলি, বলি তুমি ,আবার ডান পা ফেলি ,বলি দশ, তারপর বাঁ পা ফেলি, বলি পিপড়া। একসময় বাকি শব্দ গুলো বাদ দিয়ে ব্যান্ডের তালে তালে পা ফেলি আর মনে মনে শুধু বলি মিথ্যা ,মিথ্যা ,মিথ্যা,……
ইতি
দ্বিতীয় চিঠিটি প্রেমিকার কাছে। অনুমান হয় প্রশিক্ষণ তখন শেষ পর্যায়ে। যুবকের অভিযোজন।
সু/
কাল মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে ,বাতি জ্বালাতেই দেখি আমার বুটের উপর আশ্চর্য সুন্দর একটা প্রজাপতি। আর কি অবাক কাণ্ড দেখো, আজ সকালেই তোমার একটা চিঠি পেলাম। যেদিন তোমার চিঠি পাই, সেদিন আমার সবকিছুই ভুল হয়ে যেতে থাকে। প্যারেডে ভুল করি,পিটি-তে ভুল করি, নড়তে চড়তে পারিনা। এডজুটেন্ট ধমক দিয়ে বলেন, pregnant duck. এখন কিন্তু এখানকার সব কিছুতেই মজা পাচ্ছি। এখান থেকে বেরিয়ে যাবার জন্য আগের মত ছটফট করি না।বেরিয়ে কোথায় যাব বলো?পৃথিবীটাকে বদলে দেবার স্বপ্ন নিয়ে মিছিল করবো,যেমন করতাম? না , আমাদের মত মধ্যবিত্তদের পেটে অত স্বপ্ন হজম হয়না। তাছাড়া আমার এই মাঝারি academic মেধা নিয়ে কতোটুকই বা আগাতে পারতাম? আর ব্যবসা? সেতো আমার বিষয় নয়। একটু নিরাপত্তা, একটু ভালভাবে বেঁচে থাকার জন্য বাবা-মা ,ভাই-বোন মিলে আমাদের প্রাণান্ত চেষ্টা চলছে সেই কবে থেকে। আমার দিকে তাকিয়ে তার আশায় বুক বেঁধেছেন। ভেবেছেন একদিন আমি তাদের কষ্ট লাঘব করবো। তাদের সবাই কে কাঁদিয়ে কোন অনিশ্চয়তার পথে যাত্রা শুরু করেছিলাম আমি?  তার চেয়ে এই নিশ্চিত regimented জীবনই ভালো।  এইতো কদিন পরেই passing out parade, তারপর বাঘের নকশার জামা উঠবে গায়ে ,কাঁধে চকচক করবে পেতলের তারা ,বুটে বুটে খটখট শব্দ তুলে উঠবো জলপাই রঙের গাড়িতে, চারদিকে থাকবে মুহুর্মুহু স্যালুট। থাকা,খাওয়া, পোশাক নিয়ে ভাবতে হবে না কোনদিন। আর যদি যুদ্ধ লেগেই যায়,আমরা আর কতদূর কি করবো বলো? যুদ্ধতো করবে সাধারণ মানুষ,যেমন করেছিল মুক্তিযুদ্ধে। সুতরাং জীবনটা মোটামুটি সুখেই কাটবে। কাঁধে যখন ‘তারা’ থাকবে তখন স্বপ্ন দেখবো ‘শাপলার’, যখন ‘শাপলা’ থাকবে তখন দেখবো ‘তলোয়ার’-এর স্বপ্ন। আর হ্যাঁ ,এখন ভাবছি এরপর একটা ট্যাংককেই ফুল দিয়ে সাজিয়ে হাজির হবো তোমাদের বাড়িতে।এখন তোমার বাবা নিশ্চয়ই আমাকে prospect less  ছেলে বলে বাতিল করতে পারবেন না? অবশ্য এখন একটু tension -এ আছি চেহারাটা নিয়ে, এখানে ঢুকবার পর তুমি তো আর দেখো নি ,চুল বাটি ছাঁটে কেটে,দাড়িগোঁফ চেছে, চোয়াল ভেঙ্গে দেখতে হয়েছি ঠিক গলা-ছোলা মোরগগুলোর মত। চেহারা-ছবি দেখে শেষে তুমি আবার বাদ করে দেবে না তো?
ইতি
তৃতীয় চিঠিটি বন্ধুর কাছে। ততদিনে প্রশিক্ষণ সমাপ্ত। যুবকের রুপান্তর।
জনাব civilian/
পাহাড়ের ওপর অপূর্ব guest house। জিপ,স্পিডবোট সব এখন আমার control-এ। এ সময় এলে পুরো জায়গাটা চমৎকার ঘুরিয়ে দেখাতে পারতাম। একসময় এখানে আসবার জন্য কতো plan করেছিলাম। তখন ঢুকবার permission-এর জন্য অন্যের মুখাপেক্ষী হতে হতো। আর এখন আমি সবাই কে permission দেই। এতো করে বল্লাম,এলি না। আবার জ্ঞান ফলিয়ে চিঠি লিখেছিস। যতো গালাগালি দিস,জেনে রাখিস defense-এর strength-এর ওপরই একটা দেশের dignity নির্ভর করে। তোরা ভাবতে পারবি না,দেশের ভেতর থেকে আর বাইরে থেকে কতরকম চাপ থাকেসবসময়। সেগুলো face করার জন্য আমাদের প্রতি মুহুর্তেই প্রস্তুত থাকতে হয়। খুব একটা সুখে আছি ভাবিস না। constant একটা ঝুকিঁ মাথায় নিয়ে থাকতে হয়। এই ঝুঁকির পুরস্কার হিসেবে আমরা যদি কিছু সুযোগ-সুবিধা ভোগ করি তাহলে সেটা কি unjustified? আর দেশসেবার কথা যদি বলিস,আমি তো বলবো আমরাই অনেক -organized, disciplined way-তে সেটা করছি। তোদের মতো chaos সৃষ্টি করে নয়। সবসময় মঞ্চের বাইরে থেকে দেশের জন্য কাজ করে গেলেও কখনো কখনো দেশের স্বার্থেই বাধ্য হয়ে সরাসরি মঞ্চে উঠে আসতে হয় আমাদের। ভেতরের হিসেবটা তোর কি খুব কঠিন মনে হয়?ভেবে দেখ আমাদের দেশ ultimately চলে কাদের পয়সায়? Donor দেশগুলোর পয়সাতেই তো? এখন ওরা পয়সা দেবে আর সে পয়সার security চাইবে না, সেটা তো হয় না।তোরা কি সেই security দিতে পারবি? দীর্ঘদিন এমন বিশৃঙ্খলা অবস্থা চলতে থাকলে ওরা তো আস্থা হারিয়ে ফেলবেই। ওরা চাইবে strong কারো ওপর depend করতে। আর তখনই আসতে হবে আমাদের। কারণ আমদের আছেstrict chain of command ,আছে effective management system, সেই সাথে আমদের হাতে আছে বৈধ অস্ত্র। অতএব আমরাই ওদের পাঠানো পুঁজিকে দক্ষতার সাথে পাহারা দিতে পারি। So my friend ,বেশি চ্যাঁচামেচি না করে এখন থেকেই আমার সাথে যোগাযোগটা ঠিকমত রাখ। অচিরেই যে কাজে লেগে যাবে না কে বলতে পারে?
ইতি
চিঠি পাঠ শেষ। এবার আমরা ভাবতে পারি। আমরা মিথ্যা নিয়ে ভাবতে পারি অথবা সত্য নিয়ে ভাবতে পারি কিংবা হয়তো ‘পিঁপড়া’ নিয়েও।
আরো পড়ুন শাহাদুজ্জামানের গল্প নিয়ে আলোচনা :

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন