বুধবার, ৫ নভেম্বর, ২০১৪

দ্য আর্ট অব নভেল: মিলান কুন্ডেরার উপন্যাস ভাবনা


মোজাফ্ফর হোসেন 

বর্তমান সময়ের সফল কথাসাহিত্যিকদের একজন মিলান কুন্ডেরা (১৯২৯)। জন্ম চেকোস্লোভাকিয়ায়। আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন এই লেখক উপন্যাস ও ছোটগল্পের পাশাপাশি প্রবন্ধ লিখেও বোদ্ধা পাঠকদের দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হয়েছেন। বিশেষ করে তাঁর ‘দি আর্ট অব নভেলা’(১৯৮৫) বিশ্ব সাহিত্যে ইতোমধ্যেই উল্লেখযোগ্য স্থান করে নিয়েছে। বইটিতে প্রবন্ধ, নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার ও ভাষণ-এই চার ফর্মে উপন্যাস সম্পর্কে কুন্ডেরার ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গির সাক্ষাৎ মেলে। পরস্পর সম্পর্কযুক্ত সাতটি স্বতন্ত্র অধ্যায়ের সন্নিবেশ ঘটেছে এখানে। উপন্যাস আধুনিক সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় ফর্ম। কাজেই এটি নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে।

তবে কুন্ডেরা তথাকথিত পথে হাঁটেন নি। তিনি কোনো তত্ত্বীয় আলোচনার ভেতরেও প্রবেশ করেন নি। খালি আধুনিক ইউরোপীয় উপন্যাসের বিষয়বস্ত্ত নিয়ে কথা বলেছেন। আঙ্গিক নিয়ে কিঞ্চিৎ আলোচনা হয়েছে তবে সেটাও করা হয়েছে একাডেমিক আলোচনার বাইরে থেকে। একজন উপন্যাস বোদ্ধা হিসেবে তিনি তাঁর পাঠ থেকে আধুনিক উপন্যাসকে ব্যাখ্যা করছেন। তিনি বলছেন- ‘প্রত্যেক উপন্যাস আসলে সত্তাময়। আপনি যে মুহূর্তে একটি কাল্পনিক চরিত্র সৃষ্টি করবেন, তখনই আপনাকে মুখোমুখি হতে হবে এই প্রশ্নের-সত্তা কি? এটাকে কিভাবে বোঝা যাবে?’ [তর্জমা: বর্তমান আলোচক] অর্থাৎ উপন্যাস সৃষ্টি মানে একটা সত্ত্বা সৃষ্টি করা। সেই সত্তাটি হবে স্বতন্ত্র। নতুন এক জীবনের আজ্ঞাবহ। কেননা জীবনকে তিনি দেখছেন এই ভাবে-‘আমরা একবারই জন্মাই। আমরা কখনো পূর্বজন্মের অভিজ্ঞতা দিয়ে জীবন শুরু করতে পারি না। আমরা যৌবন কেমন না জেনেই শিশুকাল ত্যাগ করি। বিবাহিত জীবন কেমন না জেনেই বিয়ে করি। ... কাজেই মানুষের জগৎটাই হল অনভিজ্ঞতাময়।’ [তর্জমা: ঐ] কুন্ডেরা মনে করছেন একজন মানুষের অস্তিত্ব তার ভেতরেই লীন। মানুষের সমষ্টির অভিজ্ঞতার সাথে ব্যক্তির ব্যষ্টিক অভিজ্ঞতার বিস্তর ফারাক। উপন্যাসের চরিত্রগুলো সমষ্টির অংশ হয়েও সম্পূর্ণ আলাদা। আত্মচেতনার মগ্নতায় ভর করে নিজস্ব সত্তান্বেষণ করাই তাদের মূল লক্ষ্য। যে কারণে তিনি উপন্যাসকে মানব অস্তিত্ব সন্ধানের অন্যতম বলিষ্ঠ মাধ্যম বলে মনে করছেন। উপন্যাসের কাজই হল কল্পিত চরিত্রগুলোর মধ্য দিয়ে বিচ্ছুরিত অস্তিত্ববাদের ওপর ধ্যাণারোপ করা। মানুষ যেহেতু তার অতীতকে বদলাতে পারে না, সেহেতু সে সবসময় চায় তা পুনঃসৃষ্টি করতে। এই পুনঃসৃষ্টি আসে নতুন নতুন সম্ভাবনা নিয়ে। এই চাওয়াটাই তাকে উপন্যাস লেখার দিকে চালনা করে থাকে। জ্ঞানই হল উপন্যাসের একমাত্র নৈতিকতা। এ জ্ঞান মর্ত্যের জ্ঞান নয় মোটেও, এ জ্ঞান হল মানুষের মননের জ্ঞান। অনাবিষ্কৃত কিছুকে আবিষ্কার করাও উপন্যাসের নৈতিকতার মধ্যে পড়ে। বিস্তারিত অর্থে, উপন্যাস হল এক মহৎ গদ্য সৃষ্টি করা যার ভেতর দিয়ে একজন ঔপন্যাসিক অস্তিত্বের আদি থেকে অন্ত অনুসন্ধান করে চলেন। যে সকল উপন্যাসের ভেতর এই অনুসন্ধানের সন্ধান মেলে না কুন্ডেরা তাকে বলছেন ‘অনৈতিক’ উপন্যাস।
মানুষ ভাবে আর ঈশ্বর হাসেন। হাসেন কারণ মানুষ যত ভাবে সত্য ততই দূরে সরে যায়। কুন্ডেরা বলছেন, ঈশ্বরের এই হাসি থেকেই জন্ম নেই ইউরোপের উপন্যাস। আধুনিক যুগের বস্ত্তবাদী চিন্তাকে নিন্দাবাদের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে বইটির দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনা। এখানে তিনি উল্লেখ করেন যে, আধুনিক যুগের প্রতিষ্ঠাতা শুধু দেকার্তে নন, সার্ভান্তেসও। কেননা ঔপন্যাসিক হিসেবে তাঁরা ইউরোপের একই সমস্যার সাক্ষী। কুন্ডেরা মতে- ‘যদি শিল্পের কাজই হয় বিস্মৃত অতীতকে ঘেঁটে দেখা তাহলে সার্ভান্তসের হাত দিয়েই ইউরোপীয় শিল্পের অবয়ব দাঁড়িয়েছে।’ [তর্জমা: দুলাল আল মনসুর, দি আর্ট অব নভেল, কাগজ প্রকাশন, ২০০৭] ইউরোপীয় আধুনিক উপন্যাস নিজস্ব ধারায় অস্তিত্বের নানান দিক উন্মোচন করেছে। কুন্ডেরা এ-পর্যায়ে ইউরোপীয় উপন্যাসের ঐতিহ্যের ওপর বিশদভাবে আলোকপাত করেছেন-বালজাক মানুষের ঐতিহাসিক অস্তিত্বকে আবিষ্কার করেছেন, ফ্লবেয়ার মানুষের দৃষ্টির সামনের অদেখা জগতকে উঠিয়ে এনেছেন। তলস্তয় মানুষের আচরণগত দিক ফুটিয়ে তুলেছেন, প্রুস্তের মাধ্যমে খয়ে যাওয়া অতীত আর জয়েসের মাধ্যমে অন্তর্মুখী বর্তমানে প্রবেশ করেছে উপন্যাস। টমাস মানের মাধ্যমে উপন্যাস অতীত-পুরাণকে বর্তমানের চালিকাশক্তি হিসেবে গণ্য করেছে। রিচার্ডসন মানুষের অন্তর্জালের ঘটনা উন্মোচনের দিকে মনোনিবেশ করেছেন। এইভাবে কুন্ডেরা সামগ্রিক ইউরোপের উপন্যাসের ঐতিহ্যের ওপর আলোকপাত করেছেন।
উপন্যাসের ইতিহাস নিয়ে কথা বলতে গিয়ে কুন্ডেরা বলছেন যে, উপন্যাসের শুরু ইউরোপে। চূড়ান্ত ভাঙ্গা-গড়াটাও সেখানে। বিশ্বাস যেদিন হালকা হয়ে গেল সেদিনই ডন কিহোতে নিজের চেনা জানা জগত ছেড়ে অচেনায় পা বাড়ালো-এভাবেই জন্ম নিতে থাকলো চূড়ান্ত সত্য ভেঙ্গে অনেকগুলো আপেক্ষিক সত্যের। জন্ম হল আধুনিক যুগের, জন্ম নিলো উপন্যাস। উপন্যাস অনেকগুলো আপেক্ষিক সত্যের মাঝে যে অস্পষ্টতার প্রজ্ঞা তা থেকেই নিজের প্রজ্ঞাকে বের করে আনে। তাই তো সার্ভান্তাসের কাছে কাজটি বীরত্বখোঁচিত বলে মনে হয়। কিন্তু কুন্ডেরা বলছেন- ‘পাঠক যেহেতু সর্বোচ্ছ স্বর্গীয় বিচারের রায় ছাড়া নিজের চোখে কিছুই দেখতে পায় না। এই অক্ষমতার কারণে উপন্যাসের অনিশ্চয়তার প্রজ্ঞা তাদের কাছে অধরাই থেকে যায়।’ [তর্জমায়: ঐ]  
উপন্যাসের মনোজাগতিক পরিচয় দিতে গিয়ে কুন্ডেরা বলছেন যে, উপন্যাস ব্যক্তির আত্মপরিচয়ের সাথে জড়িত। মানুষ যেহেতু জগতের ঘটনার মধ্যে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে পায় না, তাই তাকে ফিরে আসতে হয় অন্তর্জগতে। আধুনিক উপন্যাস সেই কাজটিই করতে লাগলো। কুন্ডেরা তাঁর উপন্যাসের চরিত্রগুলোর আত্মপরিচয়, আত্মসত্তাকে বুঝতে পারা না পারা এসব নিয়ে খোলাখুলি কথা বলেছেন। বেশিরভাগ আলোচনা জুড়ে আছে কুন্ডেরার বিখ্যাত উপন্যাস ‘দ্য আন্বিয়ারেবল লাইট্নেস অব বিং’-এর কথা; কথাপ্রসঙ্গে এসেছে ‘লাইফ ইজ এলস্হোয়ার’, ‘দ্য জোক’, ‘দ্য বুক অব লাফটার এন্ড ফরগেটিং’, ‘লাফেবল লাফ’ উপন্যাসের কথা। কুন্ডেরা তাঁর উপন্যাসের ভিত্তি হিসেবে দাড় করিয়েছেন ‘চিন্তাপ্রবণ প্রশ্ন’কে। যে সকল দার্শনিক শিল্পকে দার্শনিক এবং তাত্ত্বিক ধারার পরবর্তী রূপ বলে মনে করেন তাদের সাথে দ্বিমত কুন্ডেরার। কেননা তিনি বলছেন- ‘উপন্যাস ফ্রয়েডের পূর্বেই অচেতনতা নিয়ে কথা বলেছে, মার্ক্সের পূর্বে শ্রেণিসংগ্রামের কথা বলেছে, ইন্দ্রিয়তাত্ত্বিকদের পূর্বে ইন্দ্রিয়তাত্ত্বিক বিষয়ে কথা বলেছে।’ [তর্জমা: ঐ]
চরিত্রের অতি বর্ণনা কমিয়ে কুন্ডেরা জোর দিয়েছেন পরিস্থিতি বর্ণনাতে। কাজেই চরিত্রগুলো দেখতে কেমন, তাদের অতীত কি এগুলো খুব কমই জানা যায় তাঁর উপন্যাসে। একই কাজ করেছেন কাফকা ও মুসিল। তাঁদের তৈরি চরিত্ররা তলস্তয় কিংবা দস্তয়ভস্কির চরিত্রদের মতো বিন্যস্ত না। এক্ষেত্রে অনেকের ধারনা, বর্ণনার ঘাটতি থাকলে চরিত্রের জীবন ঘনিষ্ঠতা কমে। উপন্যাসের ক্ষেত্রে কুন্ডেরা সেটা অপরিহার্য বলে মনে করছেন না। তিনি বলছেন- ‘উপন্যাসের চরিত্র বাস্তবের মানুষের ছদ্মরূপ হতে পারে না। চরিত্র কাল্পনিক এবং পর্যবেক্ষণমূলক আত্মপ্রতিমা।’ [তর্জমা: ঐ] সব বলে না দিলে পাঠকদের সুবিধা থাকে নিজের মতো করে চরিত্রের অবয়ব নির্মাণ করার। চরিত্র হয়ে ওঠে আংশিক লেখক ও আংশিক পাঠকের কল্পনার যৌথ ফসল।
অস্তিত্ব নির্ভর উপন্যাসের সামাজিক-ঐতিহাসিক গুরুত্ব নিয়ে কথা বলতে গিয়ে কুন্ডেরা বলছেন যে তিনিও হেইদেগারের মতো বিশ্বাস করেন মানুষের সাথে পৃথিবীর যে সম্পর্ক সেটা অভিনেতার সাথে মঞ্চের যেমন সম্পর্ক তেমন নয়। সম্পর্কটা কাছিমের সাথে তার খোলসের মতো। মানে বিশ্ব হলো মানুষেরই অংশ বিশেষ। এজন্যে বিশ্ব বদলালে মানুষের অস্তিত্ব বদলাবে। তবে ঐতিহাসিক দিক পর্যবেক্ষণ করা আর ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতের বিশদ বয়ান এক কথা নয়। কুন্ডেরা ইতিহাসের যতটা সম্ভব কম উপাদান নিয়ে উপন্যাস নির্মাণের পক্ষপাতী। ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখাটাকে তিনি খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ বলে মনে করছেন না। কারণটা তিনি ব্যাখ্যা করছেন এই বলে- ‘ঐতিহাসিক পরিস্থিতি চরিত্রের জন্যে শুধু নতুন অস্তিত্ব তৈরি করে না। বরং অস্তিত্বের প্রেক্ষাপটে ইতিহাসকে বুঝতে হয়, বিশ্লেষণ করতে হয়।’[তর্জমা: ঐ] যা ঘটে গেছে তা ইতিহাস। সেখান থেকে যে সম্ভাবনার আলো বিচ্ছুরিত হয় সেটাই অস্তিত্ব। উপন্যাসের কাজ সেই বিচ্ছুরিত সম্ভাবনাকেই পর্যবেক্ষণ করে দেখা।
উপন্যাসের শিল্প নিয়ে কথা বলতে গিয়ে কুন্ডেরা বলছেন- ‘উপন্যাসকেও কৌশল দ্বারা ওজন করে নিতে হবে। যে সব রীতি-প্রথা উপন্যাসিকের কাজে লাগবে সেগুলো মেনে চলা যেতে পারে।’ [তর্জমা: ঐ] তবে তিনি উপন্যাসকে কলাকৌশলের হাত থেকে মুক্তি দিয়ে বাচনিক উপাদান কমিয়ে দেওয়ার পক্ষপাতী। তাতে উপন্যাসের ঘনত্ব বাড়বে। এরপর কুন্ডেরা যুক্তি দিয়ে তাঁর উপন্যাসের নানান দিক প্রতিষ্ঠা করছেন। সঙ্গীতের সাথে কুন্ডেরার উপন্যাসের গভীর একটা সম্পর্ক আছে। কুন্ডেরা সেটা জেনে বুঝেই করেছেন। তিনি বলছেনে- ‘একেকটা অধ্যায় একেকটা গতিতরঙ্গ এবং একেকটা পরিচ্ছেদ একেকটা লয় তাল। এই তালগুলো দীর্ঘ হতে পারে, সংক্ষিপ্ত হতে পারে। এতে লয় আসার পথ সুগম হয়।’ সঙ্গীতের মতো উপন্যাসেও স্বরের সমতা বজায় রাখা জরুরী। এই অর্থে প্রতিটা ভাল উপন্যাসের সাথে সঙ্গীতের অপরিহার্য এই দিকটা মিলে যায়। কুন্ডেরার মতে- ‘উপন্যাসে সঠিক মাত্রায় ভিন্নস্বরের মিশ্রণের শর্ত হলো প্রথমত বিভিন্ন ধারার সমতা এবং দ্বিতীয়ত সামগ্রিকতার অখন্ডতা।’[তর্জমা: ঐ] সঙ্গীতের সাথে উপন্যাসের তুলনাটা ঐক্যের, ছন্দের এবং সেটা সম্পূর্ণই প্রাসঙ্গিক। কুন্ডেরা সঙ্গীত আবহে বড় হয়েছেন। পড়াশুনাও করেছেন সঙ্গীত বিষয়ে। তাই তো তার এই পর্যবেক্ষণের আলাদা একটা গুরুত্ব আছে। প্রসঙ্গক্রমে সালমান রুশদির কথা না বলে পারছি না। রুশদি একই অনুপ্রেরণা অর্জন করেছেন চলচ্চিত্র থেকে। তাঁর ভাষ্যে- The classic form of film montage is long shot, medium shot, close-up, medium shot, long shot, medium shot, close-up, medium shot, long shot—like a kind of dance.That great period of film making has a lot to teach novelists. I always thought I got my education in the cinema. [Interview: Paris Review]
বইটির একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ জুড়ে আলোচনা করা হয়েছে কাফকার উপন্যাস নিয়ে। কাফকা যে উপন্যাসের ঐতিহ্য নির্মাণ করেছেন কুন্ডেরা সেই ঐতিহ্যেরই ধারক। কাফকার সাহিত্যকে তিনি আধুনিক আমলাতান্ত্রিক জীবনযাত্রার প্রতীকী উপস্থাপন বলে মনে করছেন। কাফকা দেখিয়ে দিয়েছেন যে একজন ব্যক্তির ফাইল বা নথিপত্র ঐ ব্যক্তির জায়গা জুড়ে নিয়েছে-ফাইলটাই হল আসল, ব্যক্তি তার ছায়া বিশেষ। কাফকার সাহিত্যের অন্য একটা অপরিহার্য দিক হল- অপরাধীর অপরাধ খুঁজে নেওয়া। আপনাকে জেলে বন্দি রেখে অত্যাচার করা হচ্ছে কাজেই আপনাকে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে আপনি অপরাধী। কাফকার সাহিত্য এমনটিই বলছে। সমস্যাটা শুধুমাত্র সামাজিক বা রাজনৈতিক না, মনস্তাত্বিকও বটে। অভিযুক্ত একসময় সত্যি সত্যি মেনে নেয় যে সে অপরাধী। সে নিজেই তার শাস্তির যথার্থতা আবিষ্কার করে। কাফকায় এই সমস্ত পরিস্থিতিটা মনে হবে যেন উপহাস, শুধুমাত্র উপহাসের ঐ চরিত্রগুলোর কাছে মনে হবে এটা একটা দুঃস্বপ্নের মতো। (এই উপহাসকে কুন্ডেরা দেখছেন এইভাবে- ‘আমাদেরকে মানুষের মহত্ত্বের সুন্দর ইল্যুশন দেখিয়ে দুঃখবোধ সান্ত্বনা জানায়। কমিক বড়ই নিষ্ঠুর, এটা নির্মমভাবে আমাদের বেঁচে থাকার অর্থহীনতার ওপরই অর্থারোপ করে।’) কাফকা যে জগতটা চিহ্নিত করছেন সেই জগতটা অফিস আদালত ও আমলা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কুন্ডেরা বলছেন যে, কাফকা ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ভেবে লেখেন নি। তাঁর কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও ছিল না। প্রকৃতির নিয়মেই যেন কাফকার গল্পগুলো আজ সত্য হয়ে দেখা দিয়েছে। পুঁজিবাদ থেকে সমাজতন্ত্র-সবখানেই আজ তা তেমনই প্রাসঙ্গিক। অন্যত্র বলছেন- ‘কাফকা আমলাতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাকে উঠিয়ে এনেছেন তাঁর উপন্যাসের কাব্যে। তিনি খুব সাধারণ একজন মানুষের অতি সাধারণ একটা গল্পকে মিথে, এপিকে রূপান্তরিত করেন তা পূর্বে দেখা যায়নি।’ [তর্জমা: বর্তমান আলোচক]
উঁচু মানের উপন্যাস ঔপন্যাসিকের চেয়ে বেশি বুদ্ধিদীপ্ততার সাক্ষর বহন করে। এজন্যেই ঔপন্যাসিক দার্শনিক নন। ঔপন্যাসিক সবসময় তার উপন্যাসের আড়ালে থাকবেন। জনগণের প্রতিনিধিত্ব করা তার কাজ না। ঔপন্যাসিক সুসান সোনটাগ তাঁর একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন- ‘একজন সিরিয়াস লেখক নিজের ছাড়া অন্য কারো মুখপাত্র নন। এখানেই সাহিত্যের মহত্ব’। [অনুবাদ: বর্তমান আলোচক, প্যারিস রিভিউ] কুন্ডেরা এখানে বলছেন- ‘উপন্যাসিক কারই মুখপাত্র নন। এমনকি নিজের ভাবনারও মুখপাত্র নন।’ [তর্জমা: দুলাল আল মনসুর, ঐ] কাজেই এখানে বিরোধ আসতে পারে। যেমন, আচেবে তাঁর একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন- ‘আমি বুঝতে পারলাম আমাকে লেখক হতে হবে। আমাকে ইতিহাসবিদ হতে হবে।’ [তর্জমা: বিদ্যুৎ খোশনবীশ, দৈনিক অর্থনীতি প্রতিদিন] তার মানে তিনি নিজেকে তাঁর জাতির মুখপাত্র হিসেবে গণ্য করছেন। তিনি লিখেছেন তাঁর জনগোষ্ঠীর প্রকৃত ইতিহাস লিখতে। আচেবে এমন এক জনগোষ্ঠীর লেখক যাদের ইতিহাস লেখা হয়েছে ইউরোপীয়দের দৃষ্টি দিয়ে। অর্থাৎ শোষকশ্রেণির হাত দিয়ে তা রচিত। কাজেই ইগবু জাতির প্রকৃত ইতিহাস সেখানে নেই। থাকবার কথাও না, সেই কথায় বলছেন চিপিউয়া এলডাল - ‘যখনই অন্যরা তোমার গল্প বলতে যাবে দেখা যাবে যে সেটা বেঁকে গেছে’। [তর্জমা: বর্তমান আলোচক] এখানে ইতিহাস মানে শুধু রাজনৈতিক ব্যাপার না, সাথে শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি জড়িত। আচেবে সাবল্টার্ন-এর পক্ষ থেকে সাহিত্য রচনার কথা বলছেন। তিনি সেই কাজটিই করেছেন ‘থিংস ফল আপার্ট’ এ। এই উপন্যাসটি পড়ে ইগবু জাতিকে যেভাবে জানা যাবে অনেক ইতিহাসের আকর গ্রন্থ পড়েও হয়ত সেইভাবে জানা যাবে না। এখানে ইতিহাস ও রাজনীতি যেভাবে এসেছে, সেটা এসেছে গল্পের প্রয়োজনেই। একই কথা বলা যায় ‘আঙ্কেল টমস কেবিন’ এর বেলায়। এই উপন্যাসটি বিশ্বে এন্টি স্লেভারিকে যেভাবে নিরুৎসাহিত করেছে তা ইতিহাসের অনেক গ্রন্থও পারেনি। কাজেই কুন্ডেরার ‘উপন্যাসিক কারই মুখপাত্র নন’ কথাটা সবক্ষেত্রে সত্য বলে খাটে না। রুশদি যেমন বলছেন- ‘পৃথিবীর একটা ব্যাপক অংশ আমার গল্পে চলে আসে। এর কারণ এই না যে আমি রাজনীতি নিয়ে লিখতে চায়। এর কারণ হল আমি জনগণ নিয়ে লিখতে চাই। (তর্জমা: বর্তমান আলোচক, প্যারিস রিভিউ) আবার সবসময় যে উপন্যাস জনগণের প্রতিনিধিত্ব করবে তাও না। অনেক সময় উপন্যাসকে একজন লেখকেরও প্রতিনিধিত্ব করতে দেখা যায়; সেই কথায় বলছেন আচেবে তাঁর ‘দি ট্রুথ অব ফিকশন’ এ-‘প্রত্যেকে গল্প বোনে তার নিজের জন্যে-নিজের বেঁচে থাকাকে উপভোগ্য করে তুলতে। গল্পগুলো সত্য হোক মিথ্যা হোক, ভাল হোক মন্দ হোক-তার চোখ দিয়ে জগতকে দেখবার অসম্ভব এক শক্তি নিয়ে হাজির হয়।’ [অনুবাদ: বর্তমান আলোচক] কাজেই এইদিক থেকে ঔপন্যাসিককে কুন্ডেরা যতটা নৈবর্ত্তিক থাকতে বলছেন সেটা নিয়ে ভিন্ন কথা বলার অবকাশ থেকেই যাচ্ছে। এমনি করে আলোচ্যগ্রন্থে অনেক বিষয় নিয়ে পাঠকদের সাথে কুন্ডেরার দ্বিমত ঘটার নানান ক্ষেত্র হয়ত আছে-কিন্তু বইটির বিশেষ এখানে যে কুন্ডেরা জোর করে পাঠকদের ঘাড়ে তার ভাবনাকে চাপিয়ে দিচ্ছেন না। তিনি শুধু ভাবনার জগৎটা উসকে দিচ্ছেন। উপন্যাসের গঠনপ্রণালী নিয়ে কুন্ডেরার বিশ্লেষণাত্মক আলোচনার কারণে পৃথিবীর যে কোনো ভাষার লেখকদের জন্যে বইটি অবশ্য পাঠ্য। অনেকটা লেখালেখির ওপর লেখালেখির মতো। এখানে কোনো সাহিত্য তত্ত্ব নেই, কোনও নির্দিষ্ট সাহিত্য দর্শনও নেই, আছে শুধু একজন পন্ডিত লেখকের সচেতন ভাবনা- explication of the authors principle. অনেক পাঠক ইন্টারনেটে জানিয়েছেন যে, কুন্ডেরার এই বইটি তাদেরকে নতুন করে কাফকা, প্রুস্ত, বালজাক, ফ্লবেয়ার, ভলতেয়ার, মান, মুসিল প্রভৃতি লেখকদের পুনঃপাঠে অনুপ্রাণিত করেছে। এবং তাদের সামগ্রিক পাঠকেও ভাবিয়ে তুলেছে। কাজেই দেখা যাচ্ছে, যারা উপন্যাস পড়তে পছন্দ করেন, তাদের কাছেও বইটির গুরুত্ব তেমনি অপরিসীম।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন